আলোয় অন্ধকার পর্ব-৩৯

0
2212

#আলোয়_অন্ধকার🍁
#Roja_islam
#part 39

বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে আজ থালার মত মস্তবড় চাঁদটা দেখা মেলছেনা কেমন সাদা মেঘের আড়ালে বারবার লুকিয়ে যাচ্ছে গোল বৃত্তটা। তবে আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তাঁরার মেলা! রাত্রীর আঁধারে হাল্কা চাঁদের আলোয় টিলার উপর সব কিছু কেমন ঘোলাটে। তবুও সব চমৎকার লাগছে কিয়াশার। সাদা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে মস্তবড় চাঁদ অসংখ্য তাঁরা। সেইসাথে নিচে সবুজের সংমিশ্রণ আর আবছা আলোয় অস্পষ্ট সব কিছুই যেন আলাদা সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ করতেই ব্যাস্ত! কিচেন থেকে আস্ফির ভারী ভারী কন্ঠে টিয়াকে তদকারি করার শব্দ কিয়াশা নিজের রুমের বারান্দায় বসেও পাচ্ছে। ইদানীং অস্থির অস্থির কাটে কিয়াশার সময় গুলো। ওর বাটারের মত মনটা কেন যেন আস্ফির উপর ম্যাল্ট হয়ে যেতে চাচ্ছে। যেটা কিয়াশার মানতেই কষ্ট হচ্ছে। সেটা থেকেই এই অস্থিরতার উৎপাত্তি আসলে! এদিকে ও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। মাথাটাও ইদানীং মাঝেমধ্যেই ব্যাথার উপরেই থাকে তবুও ও সম্পূর্ণ সুস্থ থাকার স্ট্রং অভিনয় করে যাচ্ছে। এ ছাড়া কিছুই করার নেই। তা না হলে স্তব্ধ ওকে ইতালির দ্রুত পাঠাতেও রাজি হবেনা। আর সেটা ও চাচ্ছে না কিছুতেই না। ওকে দ্রুতই এই দেশ এই দেশের মায়াময় মানুষ গুলোকে ত্যাগ করতে হবে। অল্প সময়ে কিছু মানুষ কে বড্ড বেশি আপন মনে করা বিষয়টা খুব ভয়ংকর। অনেক সময় অল্প সময়ের জন্য পাওয়া ভালোবাসা গুলো কখনও ভুলা যায় না। সারাজীবন এই স্মৃতি তাড়া করেই বেরায়। ও নিজের জীবনে এমন কোনও স্মৃতি তৈরি করতে বিন্দু মাত্র রাজি নয়। এগুলো মানুষকে ইমোশনাল করে দেয়৷ আরও ভালোবাসা পাওয়া তীব্র আকাঙ্খা লোভ মনের গহীনে বসবাস করতে থাকে। একসময় সেই আকাঙ্খার বসবাস বড় আকার ধারণ করে। তখন মানুষ নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মারিয়া হয়ে যায়। একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সব কিছু করতে তৈরী হয়ে যায়। কিছু ভাগ্যবান হয়তো ভালোবাসা পেও যায়। কিন্তু ও সেই ভাগ্যবান হতে কখনওই পারবেনা! সেটা ওর ভালোই জানা তাই ও সব কিছু থেকে যত দ্রুত সম্ভব পালাতে চায়। এমনিতেই যেই প্রফেশনে ও কাজ করে থাকে সেখানে ফিলিংসের কোন দাম নেই। এগুলোতে জোরানো মানেই দূর্বল হয়ে পরা। যা ও হতে চায় না।

না হলে স্তব্ধের মতো ওকেও সারাজীবন প্রিয় কারো চিন্তায় দূর্বল হয়ে পরতে হবে। যদিও স্তব্ধ অনেক বেশি স্ট্রং ও জন্য এগুলা ব্যাপার না। কিন্তু কিয়াশা একজন মেয়ে ও নিশ্চয়ই এতো স্ট্রং থাকতে পারতোনা! কি ভাবছে কি ও এসব। আস্ফি অন্যকাউকে ভালোবাসে সেটা জানার পরেও এগুলো ভাবার মানেই হয়না! মাথাটা ফেঁটে যাচ্ছে ব্যাথায়! ও দ্রুত উঠে ব্যাথার ঔষধ নিয়ে নিচে যায়।

টিয়া আস্ফির কোথায় আজ স্তব্ধের জন্য রান্নায় মেতেছে। টিয়া যেহেতু কিছুই পারেনা সেহেতু আস্ফি ইউটিউব দেখে দেখে সব বলে বলে দিচ্ছে ওকে। আর টিয়া গেঞ্জির হাতায় কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে রান্না করছে! আর মনে মনে ভাবছে এত কঠিন রান্না গুলোই কেন ওর বরের পছন্দ হতে হলো! অবশেষে ১১ টায় ও রান্না করে রুমের দিকে এগুলো। সেই যে রুম থেকে বের হয়েছে ও আর রুমে উঁকিও দিতে পারেনি। কিভাবে দিবে কিয়াশা আস্ফি ওকে জ্বালিয়ে মারছিলো লজ্জাতেই আর রুমে আসার চেষ্টাও করেনি। রুমের কাছে এসেই আবার আরেক অনুভূতি ঘিরে ধরলো ওকে। কেমন ভয় অস্বস্তি আবার ভালোলাগার সংমিশ্রণ! উঁকিঝুঁকি দিয়ে রুমে ঢুকে দেখলো স্তব্ধ নেই বেডে হয়তো উঠে গেছে। উঠে থাকলে নিচে যায়নি কেন ছেলেটা? দিন রাত রোজা থাকার প্ল্যান করেছে নাকি? কিভাবে না খেয়ে এত সময় ঘুমায় মানুষ? যদিও স্তব্ধকে না খেয়ে ঘুমুতে দেখে টিয়া নিজেও চা ব্যাতিত কিছু খেতে পারেনি আজ!

রুমে খুজে না পেয়ে বারান্দায় তাকাতেই দেখতে পেলো তাকে! স্তব্ধ শুধু ট্রাউজার পরে খালি শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। কানে ফোন হয়তো জরুরি কাজে কেউ ফোন দিয়েছে! আবছা আলোর স্তব্ধের উদম শরীর সেটা বুঝতে পেরেই টিয়া আড়ষ্ট হয়ে গেলো। কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো! এখন স্তব্ধের সামনে পরতে চায় না! শাওয়ার নেওয়াটাও প্রয়োজন রান্না করে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে একদম!

স্তব্ধ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–” ও কিছু বলেছে?”

টনি বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
–” স্যার এই সাইকো মুখ খোলার মানুষ নয়। আমাদের এত কষ্ট না করে একে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া দরকার!”

স্তব্ধ শীতল কণ্ঠে বলল,
–” তাহলে আমরা কে? স্টুপিড! ”

টনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল! বলল,
–” না মানে আমি নতুন তো…!”

স্তব্ধ মুখে চরম তিক্ততা ফুটিয়ে বলল,
–” তোমাকে স্পেশালি এই কাজটা দিয়েছি আমি টনি! আমি চাই তুমি আমাকে ডিসিপয়েন্ট না করো! ওর সাথে যা খুশি করো কিন্তু নিজের মুখ যেন খুলতে বাধ্য হয় ও। তা না হলে টিয়ার কথা রাখতে পারবোনা আমি। কোনও জেল, পুলিশ, ফাসি নয়। সোজা আমার হাতে মৃত্যু হবে ওর এটাও ফাইনাল! ”

টনি মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
–” আমি আমার বেস্ট ট্রায় করছি স্যার! তবে ও মরে যাক সেটাই চাই আমি! ”

স্তব্ধ বাঁকা হাসলো উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বলল,
–” সেটা আমিও চাই! শুধু টিয়ার জন্য একটা সুযোগ ও পেয়েছে! এন্ড লিসেন যতই ওর ডানা কেটে দিনা কেন আমরা! ভুলে যেওনা শত্রুকে হাল্কার উপর নিতে নেই টনি। ও মরে গেলেও আমরা শান্তি পাবোনা। ওর বাবা আমাদের ছেড়ে দিবেনা। তাই আমি চাইছি জীবন বাজি লাগাতে হলে সবাইকে শিক্ষা দিয়েই জীবন বাজি লাগাবো। শুধু শুধু বোকার মতো ওকে মেরে ফেলতে চাইনা আমি! ওকে দিয়ে অনেক কাজ বাকি টনি! আর আমার মনেও হয়না। ডেনিয়াল ব্যাক আপ প্ল্যান না নিয়ে এখানে এসেছে! ও যখন তখন একটা ঝটকা দিতে পারে আমাদের সো ইউ শুড ভেরি ক্যায়ারফুল টনি!”

টনি চকিত কণ্ঠে বলল,
–” তার মানে টিয়ার কথা জাস্ট একটা কথা মাত্র! আপনার মাথায় বড় কোনও প্ল্যান চলছে? এত এত রিস্কের পরেও স্যার কি ভাবে সম্ভব ?”

স্তব্ধ ওর বিখ্যাত বাঁকা হাসি হাসলো অতঃপর ফোন ঠুক করে কেটে রুমে ঢুকে বুঝলো! ওয়াশরুমে কেউ আছে! কেউটা কে? অবশ্যই ওর টিয়া পাখি! কথাটা ভাবতেই ও দ্রুত নিজের দিকে তাকালো! ও আর এক সেকেন্ড লেট না করে একটা টি-শার্ট পরে নিলো! তারপর আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে বহুদিন পর তাকালো! তখনি টিয়া ওয়াশরুম থেকে রেরুলো স্তব্ধ আয়নার দিয়েই টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধতার সাথে। রাত করে শাওহয়ার নেওয়ার মুটামুটি ঠাণ্ডাই লাগছে টিয়ার। জরসর হয়ে হাটতে হাটতে স্তব্ধের কাছে এসে মাথানিচু করে বলল,
–” আপনার আগমনে আমার মনে হয় শীত চলে এসেছে স্তব্ধ এতো ঠাণ্ডা লাগছে! উফফ!”

স্তব্ধ ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো সত্যি টিয়া কাঁপা-কাঁপি করছে রীতিমতো। ও দ্রুত হাত উঠিয়ে টিয়ার কপালে রাখলো! না জ্বর নেই। চিন্তার ভাজ পরলো ওর মুখে স্তব্ধের চিন্তিত মুখের দিকে কাঁপতে কাঁপতে তাকিয়ে টিয়া বলল,
–” পেঁচার মতো মুখ করে…! ”

টিয়ার কথা শেষ না হতেই স্তব্ধ একটানে টিয়াকে নিজের বুকের উপর ফেলল! শক্ত করে জরিয়ে ধরলো নিজের বাহুতে! টিয়ার কাঁপুনি মূহুর্তের মধ্যে ঠিক হয়ে গেলো! উল্টো গাল দুটো মনে হলো গরম হয়ে গেলো এবার! স্তব্ধ আস্তে করে বলল,
–” কেন বলেছে এত রাতে শাওয়ার নিতে? রাতে জ্বর আসবে তোমার! ”

টিয়া সেভাবে থেকেই স্তব্ধের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” ভবিষ্যৎ দেখতে পান আপনি? রাতে জ্বর হবে জানলেন কি করে? ”

বলেই মুখটিপে হাসলো টিয়া। স্তব্ধ নিজেও বাঁকা হাসলো কিন্তু কিছু বলল না। মুখ বাড়িয়ে টিয়ার কপালে চুমু খাবে তখন দরজার টোকা পরলো। টিয়া এক লাফে দূরে সরে গেলো স্তব্ধের থেকে। স্তব্ধ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে গিয়ে দরজার খুলতেই কিয়াশাকে দেখতে পেলো। কিয়ারা ওকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
–” রোজা ১২ ঘণ্টা রাখে স্তব্ধ কিন্তু তোমার তো ২৪ ঘণ্টা হয়ে গেলো! দ্রুত নিচে এসো! ”

স্তব্ধ মাথা দুলালো! কিয়াশা রুমে উঁকি দিয়ে টিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। স্তব্ধ সেটা দেখেও দেখলো না ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। কিয়াশা চলে যেতে ধরলে স্তব্ধ শীতল কণ্ঠে বলল,
–” তোমাকে সুস্থ দেখে ভালো লাগলো কিয়াশা!”

কিয়াশা বিনিময়ি হাসলো কিছু বলল না! এদিকে টিয়া মনে মনে গালি দিচ্ছে কিয়াশাকে সারা সন্ধ্যে ওকে কিয়াশা আস্ফি খুঁচিয়েছে। এখন আবার চোখ টিপলো অসভ্যগুলো! টিয়ার চোখ স্তব্ধের দিকে পরতে সেও চোখ টিপ দিলো!৷ টিয়া হা করে তাকিয়ে রইলো। স্তব্ধ নিচে চলে গেলো! টিয়া নিজেও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে পিছু নিলো স্তব্ধের! ডাইনিং এ সবাই টিয়া আস্ফির প্রশংসা করলো রান্নার জন্য! শুধু স্তব্ধ বাদে ও নিজের প্রিয় তেহারি পেয়ে শুধু খাওয়াতেই মনোযোগ দিয়েছে! অবশ্য কেউ আশা রাখেনি স্তব্ধ নিজের মূল্যবান মুখ খুলে প্রশংসা করবেও। কারণ স্তব্ধ কম কথা বলতে পছন্দ করে সব কিছুতেই নিজের অনুভূতি প্রকাশে সে বরাবরই ব্যার্থ! তাই টিয়া মন খারাপ হয়নি টিয়া বুঝেনিয়েছে স্তব্ধ খুশি হয়েছে। যেটা ওর খাওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো!

খাওয়া দাওয়া শেষে দুই ভাই ছাদে এলো! স্তব্ধ সভাব সুলভ সিগারেট ধরালো! চেইনস্মোকার আস্ফি চোখ মুখ খিঁচে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুতেই স্তব্ধকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা ও এই জিনিস ছুয়েও দেখেছে৷ এমনেই বাবার কাছে ধরা খেয়ে বসে আছে! স্তব্ধ হুট করেই বলল,
–” ইতালি তুই গিয়েছিলি!”

আস্ফি ভীতি নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–” আঙ্কেল ফোন করেছিলো আমাকে না যেয়ে পারিনি!”

স্তব্ধ রেগে তাকায় ওর দিকে! চেঁচিয়ে বলল,
–” এসবের মাঝে আমি তোকে আর কখনও ঢুকতে দেখেছি! তো ইটস নট গুড ফর ইউ, গড ইট! ”

আস্ফি আস্তে করেই বলল,
–” ইয়েস ভাই!”

বলেই স্তব্ধ এক মিনিট দাঁড়ালোনা ছাদে! রেগে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো ছাদ থেকে। আস্ফি হাফ ছেড়ে বাঁচলো! জানে ও অপছন্দের কাজ করেছে স্তব্ধের তাও ভাইকে হেরে যেতে ও দেখতে পারতোনা! কিছুতেইনা। স্তব্ধ চলে গেছে কিনা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে নির্ভয়ে আস্ফি নিজেও একটা সিগারেট খাওয়া ধরলো! কিন্তু ওর স্বস্তি বেশি সময় রইলোনা হঠাৎ কিছুর শব্দে বিস্ফোরিত নয়নে ছাদের ছোট ঘরে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো স্তব্ধ তাকিয়ে আছে ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে! আস্ফি ভয়ে সিগারেট টা হাত থেকে ফেলতে ভুলে গেলো আজ!

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here