আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১০
সেদিনের পর থেকে আর বর্ণের সাথে দেখা হয়নি। একয়েক দিনে আমি ও বারান্দা দরজা কিংবা রুমের জানালা কোনোটাই খুলিনি। ছাঁদে ও যাইনি।
বারবার কেন যেন মনে হয় বর্ণকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আবার ভয় হয় এটা ভেবে যে, আমি যদি সেই একই ভূল করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনি? একটা বড় প্রশ্নের বুকে জোরালো ভাবে আঁটকে পড়েছি আমি। কে জানে এই প্রশ্নের উত্তর কী?
সেদিনকার পর থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে আমি বর্ণের অনুপস্থিতি আমাকে ভীষণ ভাবে কষ্ট দিচ্ছিল। কেন এমন হচ্ছে? আমি নিজেই তো বর্ণকে সরে যেতে বলেছি। তাহলে এমনটা হওয়ার কারণ কী? আমার তো বর্ণের প্রতি কিছুই নেই৷ না কোনো ভালোবাসা বা ভালোলাগা না অন্য কোনো আবেগ অনুভূতি। তবে কেনই বা আমার এত কষ্ট?
রাত তখন সাড়ে বারোটা। আজকে ঘরে বেশ গরম। আমি তাই জানালা, বারান্দার দরজা সব খুলে দিয়েছি। বর্ণ যেহেতু এখানে আর আসেন না। সেহেতু আমার আর সমস্যা হওয়ার কথা না।
জানালা দরজা খুলে দেওয়ার পরই ঘরটা বাতাসে বেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি তখন চুপচাপ বসে ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়াচ্ছি। বারান্দায় গিয়ে ঠান্ডা বাতাসে একটু বসলাম। আশেপাশের বাসার সব বাতি গুলোই বন্ধ বলতে গেলে। সবাই হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছে। আবার কেউ কেউ হয়ত ঘুমানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে। চারপাশ খুব নিরব। সেখানে শুধু আমি আর আমার কল্পনারাই ভেসে বেড়াচ্ছে।
আনমনে এ-সব ভাবতে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখি; বর্ণ অপাশের বারান্দা থেকে একমনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের হঠাৎ চোখাচোখি হতেই আমরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। বর্ণ ও আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে এদিক ওদিকে তাকাতে শুরু করলো৷ আমিও উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আমি জানি বর্ণের দৃষ্টি এখন আমার দিকেই। আমি আবছা ভাবে একটু একটু করে বর্ণের দিকে তাকাচ্ছি। বর্ণ যদি বুঝতে পারতো তাহলে কখনোই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো না। বর্ণ ভেবেছেন আমি তাঁকে দেখছি না। কিন্তু আমি আলতো চোখে একটু পরপর ওনার দিকেই তাকাচ্ছি।
আমি এবার যখন আসলেই চলে যাবো৷ তখন পেছন থেকে কে যেন হালকা করপ আমায় ডাকলো। মেহুলিকা!
আমি জানি এটা কে? তাই সে দ্বিতীয় বার আমাকে ডাকার আগেই আমি পেছন ফিরে তাকালাম। পেছন তাকিয়ে আমি বর্ণকেই দেখতে পেলাম। পেছন ফিরে তাকাতেই বর্ণ আমাকে খুব শান্ত গলায় বললেন,
— মেহুলিকা!
–জ্বী বলুন।
— আমি চলে যাচ্ছি কাল মেহুলিকা। তোমার সাথে আবার আমার ঠিক কবে দেখা হবে জানি না।
— ওহ, ভালো থাকবেন ;আল্লাহ হাফেজ।
— আর কিছু বলবে না মেহুলিকা?
— আর কী বলার থাকতে পারে আমার?
— একবারেই কিছু বলার নেই মেহুলিকা?
— নাহ।
— তবে বেশ। আমার কিছু কথা শুনবে? বেশি সময় নষ্ট করবো না তোমার। এটুকু ভরসা করতেই পারো।
— আচ্ছা বলুন।
— মায়া হয় না একটুও আমার প্রতি?
— আমার হাতে কিছুই নেই। শুধু আপনাকে মিথ্যে আশায় ফেলে রাখবো কেন বলুন?
— তুমি চাইলেই সব সম্ভব। আমার পড়াশোনা শেষ হতে খুব বেশি দেরি নেই। এরপর জব পেয়ে গেলেই কোনো সমস্যা হবে না। তুমি একটু অপেক্ষা করতে পারবে না আমার জন্য?
— আমার ফ্যামিলি কখনোই প্রেমের বিয়ে মানবে না। তাই অযথা এসব কথা বলেও কোনো লাভ নেই।
— আমাদের যে প্রেমের বিয়ে এটা তোমার ফ্যামিলিকে বলবে কে? তুমি চাইলেই আমি একটা না একটা উপায় বের করতে পারতাম। আচ্ছা, একটা কী সুযোগ দিতে পারো না আমাকে তুমি?
— সুযোগ দিলে কী হবে?
— কী হবে মানে? তুমি জানো না কী হবে?
— এতটাও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিও না। একটা জিনিস একটু বোঝার চেষ্টা করো। শোনো আমি এখানে থাকবো না। তোমার সাথে আমার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম এই ফোন। আমি তোমাকে অন্য প্রেমিকদের মতো সপ্তাহে সপ্তাহে দেখা ও করতে বলতে পারবো না। আমি নিজেই এখানে থাকবো না। একটা সুযোগ দাও প্লিজ। প্লিজ!
— আমার একটু সময় লাগবে। আমি পরে জানাচ্ছি।
— কিছু বলার থাকলে এখনই বলে দাও মেহুলিকা। আমি কালকেই আমার বড় আপুর বাসায় ব্যাক করবো। তখন চাইলেও কোনো লাভ হবে না। তোমার উত্তর কী? হ্যাঁ না কি না? যেকোনো একটা উত্তর দাও। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
— আমার উত্তর!
— উফ জলদি বলো মেহুলিকা। আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
— আমার উত্তর হ্যাঁ।
— আমার না মাথা ঘুরছে মেহুলিকা। কেমন কেমন যেন লাগছে আমার।
— মানে!
— তোমার মতো একটা মেয়ে এত জলদি হ্যাঁ বলে দিল? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এখন ও।
— তাহলে কী বলতাম? না বলবো? আচ্ছা আপনি যদি চান তাহলে না-ই বলি।
— এই না না।
— আপনাকে ভরসা করলাম। আশাকরি, আমার এই ভরসার যথাযথ মর্যাদা আপনি দেবেন।
— সেটা তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।
— হুম,
— কোথায় যাচ্ছো মেহুলিকা?
— আমার ঘুম পাচ্ছে। সকালে আবার ক্লাস আছে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে। বায়, শুভ রাত্রি।
— একটা মিনিট! লাস্ট একটা কথা শুনে যাও
— কী?
— তোমার ফোন নাম্বারটা দাও না আমাকে।
— আমার নতুন সিম, তাই নাম্বারটা ঠিক মনে নেই আমার।
— আচ্ছা, তাহলে আমার নাম্বারটা তুলে নাও। 01….
— হুম, আর কিছু বলবেন আপনি? আমার কিন্তু যেতে হবে।
— আচ্ছা যাও। সময় পেলে ফোন দিয়ো আমাকে। আমি তখন তোমার নাম্বারটা তুলে রাখবো।
আমি এরপর চলে এলাম রুমে। যেহেতু বর্ণ এখানে থাকবেন না। সেহেতু সেই হিসেবে ওনাকে একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। তবুও আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। পুরুষ মানুষ বলে কথা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে বারান্দা থেকে তোয়ালে আনতে গিয়ে দেখি; বর্ণ তখন ও ওখানে। দূর থেকে দেখে যা বুঝলাম উনি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন। চলে যাবেন তাই হয়ত।
— শুভ সকাল!
— মেহুলিকা! তুমি এত সকালে?
— কলেজে যাবো একটু পরে তাই উঠলাম।
— ওহ, আমিও এখন বের হয়ে যাবো। যেতে আবার একটু সময় লাগবে।
— হুম, বায় ভালো থাকবেন।
— তুমিও!
এরপর আমি আবার আমার মতো রুমে চলে এলাম। মনটা খুব খারাপ লাগছিল। বর্ণকে খুব বলতে ইচ্ছে করছিল আপনি থেকে যান না বর্ণ। কিন্তু সেটা সম্ভব না। যা হবার তা হবেই। মানুষের কাজ হলো সেইটাকে হওয়াটাকে মেনে নেওয়া।
কলেজে গিয়ে আমি মনিরাকে বর্ণের ব্যাপারে সব বললাম। মনিরা সব শুনে আমাকে বলল,
— বাহ্ তলে তলে এত!
— মোটেও তলে তলে কিছু করিনি আমি। তলে তলে কিছু হলে আমি সরাসরি কখনো তোকে বলতাম না।
— হুম বুঝেছি বুঝেছি। বর্ণ ভাইয়ার কোনো সুন্দর কাজিন-টাজিন নেই? না মানে আমিই বা আর কতদিন এভাবে সিঙ্গেল থাকবো?
— পাগলের মতো কথা বলিস না। ওনার কাজিন আছে কি না আমি কীভাবে জানবো?
— হুম, নিজের বেলায় ষোলো আনা। আর আমার বেলায় চার আনা।
— এত প্রেম করার শখ থাকলে ওই রাস্তার মোড়ের পাগলটার সাথে প্রেম কর যা।
— যাহ্ শয়তান!
— হাহাহা!
রাতে আমি বর্ণকে খুব মিস করছিলাম। চিন্তা করলাম বর্ণের নাম্বার যেহেতু আমার কাছে রয়েছে। সেহেতু বর্ণকে একটা কল দেওয়াই যায়। ভয়ে ভয়ে আমি বর্ণের নাম্বারে কল দিলাম। প্রথমে বর্ণ যখন ফোনটা ধরে হ্যালো বললেন। তখন আমি এক প্রকার চমকে উঠলাম প্রায়। ভয়ে আমি তাড়াতাড়ি করে কলটা কেটে দিলাম। পরক্ষণেই নিজের এমন বোকামির কাছে হার না মেনে আবারও বর্ণের নাম্বারে কল দিলাম। বর্ণ এবার আগেরবারের মতো কলটা ধরে আবার বললেন হ্যালো।
চলবে….