আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৮
আমি একপ্রকার অস্থির হয়ে ছিলাম এটা জানতে যে, আসলে কে হতে পারে ওই চিঠির মালিক।
বিকালে আম্মাকে অনেক বলার পর আম্মা ছাঁদে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ছাঁদে গিয়ে প্রায় পাঁচ মিনিট বসে থাকার পর পায়রাগুলো উড়ে আমাদের ছাঁদে এসে বসলো। আমি পায়রা গুলোর দিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম। আসলে, কোন পায়রার পায়ে আমার জন্য লিখা চিরকুটটা বাঁধা। একটু খোঁজাখোজি করার পর পেয়ে গেলাম সেই কাঙ্খিত চিরকুটটা।
চিরকুটটা পাওয়া মাত্রই আমি দৌড়ে নিচে নেমে আসলাম। রুমে ঢুকেই ওই চিরকুটটা পড়তে বসে গেলাম। চিরকুটে আজকে বেশি কিছু লিখা ছিল না অন্যদিনের মতো। তবে যা লিখা ছিল তাতে আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। চিরকুটে লিখা ছিল,
” তোমার কথা আমি ফেলতে পারি না৷ ইচ্ছে করে তোমাকে আর তোমার বলা কথা গুলোকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখি। তুমি যেহেতু বলেছো আমি আজকেই আমার পরিচয় দিবো। তবে এখন না। আজকে রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে। তখন তুমি বারান্দায় এসো। তারপর যা হওয়ার হবে। ”
আমি এবার অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাত হবে। অন্যদিন সন্ধ্যার সময়টা খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেলেও। আজকে কেন যেন সেটা হলো না। মনে হচ্ছিল যেন এক একটা মিনিট পনেরো মিনিটের সমান।
কিন্তু মাঝখান দিয়ে ঘটলো আরেকটা ঘটনা। তখন আমি আর আম্মা রাতে খাবার খাওয়ার জন্য সব কিছু গুছিয়ে রাখছিলাম।আমি টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে রাখছিলাম৷ আর আম্মা খাবার গরম করছিলেন। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই আমরা একটু চমকে উঠলাম। এত রাতে আবার কে এলো বাসায়?
আব্বা আমাদের কাউকে উঠতে নিষেধ করলেন। নিজে গিয়েই গেট খুললেন। গেট খুলে দেখেন ছোট চাচা এসেছেন। এত রাতে আসার কারন জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম। চাচী ওবার বাবার বাসায় গিয়েছেন। চাচা রাতে একা একা ঘুমাতে পারেন না। তাই আমাদের বাসায় চলে এসেছেন।
চাচা আমাদের সাথেই এক টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করলেন। বিপত্তিটা তখনই ঘটলো যখন আম্মা বললেন যে, আব্বা আর চাচা একসাথে পাশের ঘরে ঘুমাবেন। আমি যেন আম্মার সাথে আম্মার রুমে গিয়ে ঘুমাই।
আমার এই কথাটা শুনে এত রাগ হয়েছিল বলার বাইরে। এই রাতের অপেক্ষায় বসে ছিলাম আমি৷ আর এখন চাচা এসে সব ঘেটে ঘ করে দিলেন। ধুর! ভালো লাগে না আমার কিছু!
সেদিন রাতে এক প্রকার রাগ নিয়েই আম্মার সাথে ঘুমাতে গেলাম আমি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দার দরজা খুলে দেখি, সেখানে ছোট্ট একটা চিরকুট ফেলে রাখা। আমি চিরকুটটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তাতে লিখা ছিল,
” সারাটা-রাত তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তবুও একটা বার দেখা দিলে না! ”
আমার খুব খারাপ লাগলো লিখাটা পড়ে। আসলেও সেই ব্যাক্তিটি আমার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু আমিই আসতে পারিনি।
আমিও খাতা থেকে ছোট্ট একটা কাগজ ছিঁড়ে নিলাম। তাতে লিখলাম,
” আমি চেষ্টা করেছিলাম তবে পারিনি। আমার জন্য কালকে এতটা সময় অপেক্ষা করেছেন তাতে আমি সত্যিই দুঃখিত। মাফ করবেন আমাকে। আশা করি আজকে আর কোনো সমস্যা হবে না।”
চিরকুটটা লিখে জানালার সামনে রেখে দিলাম। এরপর আমি কলেজে চলে গেলাম।
কলেজ থেকে এসে, ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করার পর রুমে এসে দেখি; জানালার সামনে নতুন একটা চিরকুট রাখা। আমি দ্রুত চিরকুটটা খুললাম। তাতে লিখা ছিল,
” হুম, তোমার মাফ চাওয়ার দরকার নেই৷ যেখানে তোমার অপেক্ষায় কয়েকশ কোটি রাত এভাবে বসে থাকতে পারবো। সেখানে এটা তো কমই। যাই হোক আজকে তুমি এসো কিন্তু। আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
এরপর আবার আগের দিনকার মতো রাতের আশায় বসে রইলাম। সময় তো যাচ্ছেই না। এরপর অনেক অপেক্ষার পালা শেষে রাত হলো। আম্মা আব্বা খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লেন৷ আমি আমার ঘরেই শুতে গেলাম। আমি শুধু শুয়ে থাকলাম কিন্তু ঘুমালাম না। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাত সাড়ে বারোটা বাজবে। ওই সময়টা মোটামুটি একটু নিরব থাকে। তাই ওই সময়ে বারান্দায় গিয়ে কারো সাথে কথা বললেও কেউ শুনতে পাবে না।
আমার প্রথমে খুব ভয় লাগছিল। তবুও সাহস করে আল্লাহর নাম নিয়ে পা টিপে টিপে বারান্দার দরজা খুললাম। খুব আস্তে দরজাটা খুললাম। কারন শব্দ হলেই সর্বনাশ। বারান্দার দরজা খুলে বারান্দার লাইট অন করলাম। খুব সাবধানে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। গিয়ে দেখি কেউই নেই! কিছুই নেই। তবুও চিন্তা করলাম আরেকটু অপেক্ষা করি। প্রায় দশ মিনিট পর। হঠাৎ করে পাশের বারান্দা থেকে একটা শব্দ পেলাম। আমি চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাতেই ;সামনে থেকে শুনতে পেলাম,
— এই যে আমি!
আমি সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম। এটা আর কেউ না এটা বর্ণ! তাহলে বর্ণই এত কিছুর পেছনে যুক্ত ছিল? কেন করলো বর্ণ এমন? এত সব চিরকুট তাহলে বর্ণই লিখতো? না কি আমি ভুল দেখছি? আমি এবার বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি এখানে?
— আমি থাকবো না তো আর কে থাকবে?
— মানে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বলবেন বুঝিয়ে বলুন।
— মানে হলো, তুমি আমায় ডেকেছো।আমি তাই এসেছি।
— আমি আপনাকে কখন ডাকলাম? আপনার সাথে আমার দেখা ও হয়নি এবং কথাও হয়নি। তাহলে আমি আপনাকে কীভাবে ডাকবো?
— তুমিই আমায় ডেকেছো!
— আজেবাজে কথা কম বলুন। আমি মোটেও আপনাকে ডাকিনি।
আমি এটা বলে যখনই বারান্দা থেকে রুমে চলে আসতে যাচ্ছিলাম তখনই বর্ণ বলে উঠলেন,
— তুমি আমাকে ডেকেছো মেহুলিকা! সামনাসামনি না হলেও চিরকুটে তুমি আমাকে ডেকেছো।
আমি এবার বড়সড় একটা চমক পেলাম। যাকে আমার ভাষায় বলে আরকি টাশকি খাওয়া। মানে আমি এবার খুব ভালমত টাশকি খেলাম। এবং আমাকে টাশকি খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করেছেন বর্ণ। আমি এবার কৌতূহল নিয়ে আবার কয়েক পা সামনে গিয়ে বললাম,
— মানে?
— তুমিই তো আমাকে চিরকুটে বললে আমার পরিচয় দিতে। এই তো এটাই আমি।
— ওই চিরকুট গুলো আপনার দেওয়া!
— আমি ছাড়া আর কারোর সাহস আছে তোমার দিকে তাকানোর?
— কেন করেছেন এইসব?
— ইচ্ছে হয়েছে তাই!
— ইচ্ছে হয়েছে মানে! শুধু শুধু একটা মেয়েকে বিরক্ত করবেন আপনি?
— আমি মোটেও কাউকে বিরক্ত করিনি। আমি শুধু আমার মনের কথা গুলো তোমাকে বলেছি।
— যাই হোক, আসল কথায় আসুন এবার। কেন করেছেন এসব?
— কারন!
— কী কারন বলুন।
— কারন, আমার তোমাকে ভালো লাগে মেহুলিকা।
— হুম, একটা মানুষ হিসেবে আপনার আমাকে ভালো লাগতেই পারে তো? কিন্তু এটার জন্য আপনি আমাকে এভাবে বিরক্ত করতে পারেন না।
— এই ভালোলাগা আর সেই ভালোলাগা এক না। আমার তোমাকে ভালোলাগে কারন আমি তোমাকে ভালবাসি।
— মানে কী এইসবের!
— এটাই সত্যি! তোমার কথা আমার বড় আপু জানে। আমার দুলাভাই জানে। সবাই জানে!
— হায় আল্লাহ! আপনি কী পাগল? এইসব কে করে?
— তো? ভালবাসা কী লুকানোর মতো কিছু না কি? আমি একটা মানুষকে ভালবাসি এটা আমি বলবো না?
— ভালবাসা -টালোবাসা বলতে কিছু নেই। সব আবেগ। এসব বাদ দিন আর ভাল হয়ে যান। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না কখনো।
— আমার ভালবাসাকে তুমি আবেগ বলে অপমান করতে পারো না। আমি এখন প্রাপ্ত বয়স্ক। তাই আমার এখন আবেগ -টাবেগ কিছুই নেই। যা আছে সব ভালবাসা।
— সব আপনার মাথা! আপনি আর আমাকে বিরক্ত করলে আপনার খবর আছে বলে দিলাম। এইসব চিরকুট-ফিরকুট আমাকে আর লিখবেন না বলে দিলাম।
— আমি এত কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে ভালবাসো? হয় হ্যাঁ বলবে নাহলে না।
— আমার উত্তর অবশ্যই না। আমি আপনাকে চিনিও না ঠিকঠাক আপনাকে আমার ভাল-টালো কিছুই লাগে না। অতএব আপনাকে আমি ভালবাসিও না। বিদায় ভাল থাকবেন। টাটা…
আমি এটা বলেই বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলাম। ব্যাটা তো ভারী নিলজ্জ! এমন বেহায়ার মতো কেউ কথা বলতে পারে? পুরো সোজাসাপ্টা আমাকে ভালবাসি বলে দিল! হায় আমার কপাল! কথায় আছে না? পুরান পাগলের ভাত নাই নতুন পাগলের আমদানি। এখন আমার অবস্থা ও সেরকম। যা বুঝতে পারলাম এখন থেকে জানালা, বারান্দার দরজা আর খুলে রাখা যাবে না।
চলবে…