#আয়নামতী
#পর্ব_১২
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দুটো মাস পরের কথা।
ফজলু মিয়ার বাগান বাড়ির আঙিনা তখন রজনীগন্ধার সৌরভে সুবাসিত। চারপাশটা মৌ মৌ করছে সাদা শুভ্র রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধে। স্টিকগুলো কাটার উপযোগী হয়েছে। বাগানের একপাশের গাঁদাফুল গুলো ও তোলার উপযুক্ত হয়েছে। অন্যপাশের ফুলগুলো এখনো কচি। আয়না তার পাশের বাড়ির দুইটা মেয়েকে তার সাথে নিয়ে আসলো ফুল তোলার জন্য । রেণু সহ চারজন হলো। রহমত মিয়ার কাজ পড়লো গ্রেডিং ও প্যাকেজিং। শুক্রবার দিনটা। আয়ান দোকান বন্ধ রাখলো একদিন। নামিরা আবদার করেছিল আয়নার বাগান দেখতে যাবে, আয়ান তাই তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গেল না। আয়শা বেগম খুশি ও হলো। আয়ানকে বলল
‘ বিয়ার পর ঘুরতে যাইতে হয় বাবু। বউরে তো তুই বেড়াতে নিয়া যাসনাই। বউ ও যাইতে চায়নাই। এইবার চাইতেছে, নিয়া যাহ।
আয়ান সায় জানালো। আয়না আগেই চলে গিয়েছে। নামিরা আর আয়ান পরেই গেল। আজকে আয়নার ফুল ডেলিভারি দেওয়ার কথা। বাগানের মালিনী আজ ভারী ব্যস্ত।
বাগান বাড়িতে যাওয়ার পর আয়নাকে বাগানের একপাশে দেখতে পেল আয়ান আর নামিরা। আয়না মেয়েগুলোকে ফুল তুলতে তুলতে কি যেন বলছে। আয়ান ডাকতেই আয়না চোখ ফিরালো। আয়ান আর নামিরাকে দেখে খুশি হয়ে গেল। দৌড়ে এল। বলল
‘ দেখো, কি সুন্দর না আমার বাগান?
আয়ান নাক তুলে বলল
‘ উহু।
নামিরা হেসে ফেলল। আয়না মুখ বেকিয়ে বলল
‘ সুন্দর লাগেনাই?
আয়ান হেসে পিঠ চাপড়ালো তার। বলল
‘ টুনির বাগানবাড়ী বলে কথা। সুন্দর হতেই হবে।
আয়না দুহাতের আঙুল দিয়ে গাল টেনে দিল আয়ানের। আয়ান গালে হাত দিয়ে নামিরাকে বলল
‘ দেখেছ মিরা, আমাকে কপি করছে৷
নামিরা হেসে ফেলল। আয়না কোমরে হাত রেখে বলল
‘ তুমি আমার গাল টানো তখন আমার কেমন লাগে। এবার বুঝো ঠেলা।
আয়ান হেসে ফেলল৷
_________
কুহেলী বাপের বাড়ি ছিল অনেকদিন। প্রায় দু মাসের কাছাকাছি। আজ কাল করে করে আর আসেনি। শেষমেশ আনহিতা বলায় অনুরাগকে তাকে আনতে যেতে হলো। কুহেলী আসলো। আনহিতার সাথে ভালোভাবে কথা বললে ও অনিমার সাথে তার খাপে খাপ মিলেনা কোনোমতে। যেকোনো ইস্যু ধরেই ঝগড়া লেগেই থাকে। এইতো বাপের বাড়ি যাওয়ার আগের দিনই না কত কথা কাটাকাটি হলো। এই ঝগড়ার মূল ইস্যু ছিল কুহেলীর শাড়ি নিয়ে। দুইদিন পর পর শাড়ি কিনার জন্য জেরা করে এই মেয়ে। অনুরাগ ও না পারতে কিনে দেয়। না বলার স্বভাব কোনোকালেই তার ছিল না।
তবে সে জানে মেয়ে মানুষ একটু লাই পেলেই হয়, পুরো পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় এনে দেওয়ার জন্য আবদার করতে দুবার ভাবেনা। তাদের চাই আর চাই। যত পায় তত চায়। কুহেলীর ও একই অবস্থা। দিনদিন তার আবদার যত তত বিশাল আকার ধারণ করছে। অনুরাগ তাই মেজাজ দেখিয়ে বলেছিল, মাসে একটা শাড়িই পাবে তুমি, এর চাইতে বেশি না। এত শাড়ি আমি মা,আপা আর দাদীকে কখনো কিনতে দেখিনি।
কুহেলী অনুরাগকে তখন কিছু বললো না। তার সব ক্ষোভ গিয়ে পড়লো অনিমার উপর। অনিমা নিশ্চয়ই তার ভাইকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে। তাই অনুরাগের অনুপস্থিতিতে কি ঝগড়াটা না হলো অনিমার সাথে। অনিমা ও মুখের উপর বলেছে তুই এককাপড়ে বেরিয়ে যাহ আমার বাড়ি থেকে সামান্যতম মানসম্মান থাকলে। অনুরাগ এলে কুহেলী বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য আবদার করলো, অনুরাগ দিয়ে ও এল। কিন্তু আসল কারণটা তার অগোচরে থেকে গেল। এই যে মাসখানেক পরে এল আনহিতা ভেতরে ভেতরে ভারী চিন্তায় থাকলো। অনিমা গর্ভে সন্তান। সামনেই দিন তারিখ।
মেয়েটা একটু চিল্লাপাল্লা করলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্ষতি হয়। আর কুহেলী থাকলে খাবার টেবিল থেকে শুরু করে যেখানে সেখানে ঝগড়া লেগে যায়। শায়খ চৌধুরী এমনিতে ও ক্ষেপে আছেন। কিছুদিন পরেই ইউপি নির্বাচন। এইবার চেয়ারম্যান পদে তিনি থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। পারিবারিক সমস্যা ও দিনদিন জটিল হচ্ছে। মাথা কাজ করছেনা তার।
কুহেলী চৌধুরী বাড়িতে আসার পরপরই শায়লা বেগম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লো। গ্রামের হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। শায়লা বেগম উপরে যাইহোক, বেশ শ্বাশুড়ি ভক্তি করেন তিনি। দিন দুয়েক হাসপাতালে ছিল। কিন্তু আর পেরে উঠা যাচ্ছেনা তার অসুস্থতার জন্য। তিনি ও রাত জাগতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনুরাগ মাকে নিয়ে আসলো। স্ত্রীকে অনুরোধ করলো যাতে তার দাদীজানের সাথে কিছুদিন থাকে। সুস্থ হলেই নিয়ে আসবে। কুহেলী রাজী হলো। দাদীশ্বাশুড়ির মন জয় করতে হবে তাকে, তাহলে বাইরে যাওয়ার সম্মতি পাবে সে। তার উদ্দেশ্য সফল ও হলো। শায়লা বেগম খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। কুহেলী অনুরাগকে বলল ওনাকে যাতে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সে নিজেই সেবা করবে। অনুরাগ খুশি হলো কুহেলীর কথায়। রাগটা ও কমে এল। তবে কুহেলী যে সুযোগ সন্ধানী সেটা টেরও পেল অনুরাগ। কুহেলীর চালাকি ধরতে পেরে নিজেকে বেশ চালাক মনে হলো। যাইহোক উন্নতি হচ্ছে তার, অন্তত কাউকে বেকুব ডাকার চান্স সে আর দিতে চায় না।
শায়লা বেগমের দেখাশোনা,খাওয়াদাওয়া সব কিছু কুহেলীর নখদর্পনে। কাপড়চোপড় ও ধুয়ে দেয় কুহেলী। অবশ্য তার এসব করতে খারাপ লাগেনা। তার দাদীর সব কাজ সে নিজেই করত। দাদী মারা গিয়েছে গত ছয়বছর। দাদীকে সে খুব চোখে হারায়। কত ভালোবাসার এই দাদা দাদীগুলো।
শায়লা বেগমের চোখের মণি হয়ে উঠে কুহেলী। অনিমা দেখে আর মুখ ভাঙায়। এই কুহেলী মেয়েটার নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। অনিমার এই মেয়েকে একটু ও ভালো লাগেনা৷ এই মেয়েটা ভালো কথা বললে তার ভালো লাগেনা৷ কেন লাগেনা সে বলতে পারেনা। তার ভাইয়ের সাথে এই মেয়ের যায় না। রূপ দিয়ে কি হবে? ভালো না মেয়ে, কোনোদিক দিয়ে ভালো না। অবশ্য সে নিজে ভালো কিনা সেটা দেখতে অনিচ্ছুক সে।
দশ পনের দিন পরের কথা। শায়লা বেগম সুস্থ হয়ে কুহেলীকে কিছু চাইতে বলল তার কাছে। কুহেলী সৌজন্যতা রক্ষার্থে প্রথমে কিছু বলল না। কিন্তু পরে দেখা গেল শায়লা বেগম নিজেই একটা ছোটখাটো গয়না দিল কুহেলীকে। গলায় পড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আমি এইটা আমার নাতবউয়ের জন্য রেখেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে এইটা তোমাকে দেওয়ার সঠিক সময় এসেছে তাই দিলাম।
কুহেলীর চক্ষু চড়কগাছ! কি ভেবেছিল আর কি হলো? তবে গয়না পেয়ে ভারী খুশি হলো সে। শায়লা বেগম বললেন
‘ শোনো নাতবউ একটা কথা বলি। বাচ্চা নিয়ে একটু ভেবো। দাদুভাইয়ের সাথে কথা বলো।
কুহেলী লজ্জায় মিইয়ে গেল। মিহি গলায় বলল
‘ আমাকে একটু শহরে যেতে হবে দাদীজান। তারপর এসে,,
শায়লা বেগম মনঃক্ষুণ্ন হলেন। রাগ সমেত বললেন
‘ আবার শহরে কেন? তুমি আবার নাচগান করবা নাতবউ?
কুহেলী বলল
‘ নাহ নাহ, নাচগান করব না তো। একেবারে সব মিটিয়ে চলে আসব। পরে তো যেতে পারব না তাই।
শেষের কথাটাই লজ্জাজনক ভাব কুহেলীর। শায়লা বেগম বলল
‘ আচ্ছা। আমি বলব বউমাকে যাতে তোমাকে যাওয়ার পারমিশন দেয়।
কুহেলী উপরনিচ মাথা নাড়ালো।
তবে যাওয়ার আগে কুহেলীর সাথে আবার ভয়াবহ ঝগড়া হয়ে গেল অনিমার সাথে। ঝগড়ার বিষয়টা হচ্ছে, কুহেলীর বাইরে যাওয়া নিয়ে। তার মা অসুস্থ, আর ছেলের বউ আছে নাচগান লাফালাফি নিয়ে। আনহিতা শোয়া থেকে উঠে ঝগড়া থামাতে পারলেন না। কুহেলীর এক কথা সে যাবে মানে যাবেই। সে তার দাদীশ্বাশুড়ির অনুমতি নিয়েছে। আনহিতা শোয়া থেকে উঠে দোতলায় যেতে চাইলেন। শায়খ চৌধুরী সংবাদপত্র পড়ছিলেন। চেঁচামেচির আওয়াজ তার কানে আসছিল কিন্তু তিনি পাত্তা দিচ্ছিলেন না। আজ অনুরাগ এলে এই মেয়ের একটা বিহিত করতেই হবে। ঝগড়া থেমে গেল অনেক আগেই । আনহিতা ঘরে যাওয়ার আগমুহূর্তে কুহেলী ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসলো। আনহিতাকে বলল
‘ আমাকে ক্ষমা করবেন মা। আমাকে যেতে হচ্ছে কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, আমি চলে আসব শীঘ্রই। আপনার মেয়েকে আমি বুঝিয়ে কূল পাচ্ছিনা। ওনি সবসময় লেগে থাকে ঝগড়া করার জন্য। কিছুক্ষণ আগে ও কি ঝগড়াটানাই করলো।
শায়খ চৌধুরী গর্জে উঠে বললেন
‘ থামো। আর বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে। কে বলেছে তোমাকে ফিরতে। যাও। নাহলে ধাক্কা দিয়ে বের করব তোমায় বেয়াদব মেয়ে। ফকিরের মেয়ে। একটু লাই পেয়ে আকাশ ছুঁয়েছ ভাব দেখাচ্ছ?যাও। দূর হও।
অপমানে থমথমে হয়ে উঠলো কুহেলীর মুখ। সে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। অনুরাগকে সে সব বলে দেবে। তার অপমান? এত স্পর্ধা?
আনহিতা নিজের ঘরে যাওয়ার আগে শায়লা বেগমের আর্তনাদ শুনলেন। শায়খ চৌধুরী দৌড় দিলেন, সাথে আনহিতা ও। রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে দেখা গেল অনিমাকে। পেটে হাত দিয়ে মুচড়ামুচড়ি করতে করতে একপর্যায়ে মূর্ছা গেল অনিমা। তার ছেলে অমি চেঁচিয়ে কাঁদছে। অনিমার পড়নের শাড়ি পেটিকোট ভিজে উঠেছে রক্তে। সবাই দিশেহারা হয়ে পড়লো। আনহিতা ঢসে পড়লো। দারোয়ান আর শায়খ চৌধুরী দুজনের সাহায্য গাড়িতে তোলা হলো অনিমাকে। অনুরাগ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল শহর থেকে। রাতেই জানা গেল অনিমা মৃত বাচ্চা প্রসব করেছে। মেয়ে সন্তান৷ আঘাত পাওয়ায় সন্তান পেটেই মারা গেছে। ভাগ্যিস মা বেঁচে গিয়েছে। সবাই শুকরিয়া জানালো আল্লাহর দরবারে। মা বেঁচে এই যথেষ্ট। তবে জ্ঞান ফেরার পর অনিমা কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার যতটুকু মনে আছে সে ঔষধ খেয়ে একটা আপেল নিয়ে খাচ্ছিল। খেতে খেতে ঘর থেকে বের হয়ে কুহেলী আর দাদীজানের ঘরের বারান্দা দিয়ে আসছিল নিচে। আপেলে কামড় দিতেই আচমকা পা পিছলে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। আওয়াজ ও করতে পারলো না। ব্যাথায় বাকহীন হয়ে পড়লো সে। যত্নে বড় হয়ে উঠা গর্ভের বাচ্চার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার শব্দ যেন সে শুনতে পেয়েছিল। কি যন্ত্রণার মুহূর্ত! তার ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটা কেন দুনিয়ার আলো দেখেনি? পাগলের মতো প্রলাপ করতে লাগলো অনিমা। অনুরাগ সামলাতে পারলো না। মা গুলো বোধহয় এমনি হয়?
আশরাফ এমন খবর শুনে ক্ষুব্ধ হলেন শ্বশুরবাড়ির প্রতি। কেমন মানুষ তারা? আজ বাচ্চা মারা না গিয়ে অনিমার কিছু হয়ে যেতে পারতো। অমির কি হতো?
আনহিতা মেয়ের কান্না দেখে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সব এত খারাপ হচ্ছে কেন? কারো সাথে কি কোনো অন্যায় করেছে তারা ?
অনিমা স্বাভাবিক হলো অনেকদিন পর। কুহেলীর কথা তখন মনে নেই কারো। পরিবারের উপর এত ধকল গেল অথচ এই দেড়টা মাস কুহেলী একবার ও খোঁজ নিল না। অনুরাগ ব্যাপারটা মাথায় ও নিল না। সুযোগ আসবে তার। সে আপাতত ব্যস্ত বোনকে নিয়ে। অনিমাকে সব ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য আশরাফ তাকে তার সাথে ইন্ডিয়া নিয়ে গেল। ছেলে অমিকে ও নিয়ে গেল। দুমাস পর ফিরবে বলেছে। অনুরাগ হাঁফ ছাড়লো। তার বোনটা ভালো থাকুক।
দিনদুয়েক পরে শহরে পাড়ি জমালো সে। শহরে রাস্তায় লাল বাতি জ্বলার সাথে সাথে অনুরাগের চোখে একটি ব্যানার পড়লো। লাল রঙের ওড়না বিহীন একটি কামিজ পড়া কুহেলীর ছবি আছে সেখানে। টুথপেষ্টের বিজ্ঞাপন। অনুরাগ হাসলো ছবিটার দিকে তাকিয়ে। নিজের বউ তার, সে নিজেই এখনো ভালো করে দেখলো না, আর সারা বিশ্ববাসী অনায়াসে দেখছে। সে শুধু ভাবছে এই ব্যানারটা তার দাদীজান দেখলে কি হবে? অনুরাগ ভাবলো কুহেলীর সাথে আজ দেখা করতে যাবে সে। সাথে অন্য কাজ ও আছে। গেল ও সন্ধ্যার দিকে। গিয়ে জানা গেল একটা ছোটখাটো শর্ট ফিল্মের জন্য রূপগঞ্জে গিয়েছে কুহেলী। রাতেই ফিরবে। কুহেলীর স্বামী বলায় বেশ আদরযত্ন ও পেল অনুরাগ। কুহেলী সেই রাতে ফিরলো না। তারা জানালো রাত হয়ে যাওয়ায় ফিরতে পারেনি কুহেলী। অনুরাগ যেই কাজে গেল সেই কাজ করেই ফিরে এল শুধু কুহেলীর সাথে দেখা হলো না।
তার দুইদিন পর বিকেলে দেখা করতে গেল অনুরাগ। সে ভার্সিটির পাশেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। সে আবার এলে ওখানের দুইটা মেয়ে এসে জানালো
‘ কুহেলী সাজঘরে। ওর সাজের কাজ চলছে।
অনুরাগ অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণ পর খবর এল কুহেলী এখন কারো সাথে দেখা করতে চাইছে না। অনুরাগ বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল
‘ আমি এক্ষুণি দেখা করতে চাই। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি।
কেউ যেতে না দিলে অনুরাগ নিজেই ঢুকেই পড়লো। কুহেলী ছুটে এল। অনুরাগকে দেখে হেসে বলল
‘ আমি তো মজা করছিলাম। আপনি তো দেখছি ডেঞ্জারাস। ভেতরে চলে যাচ্ছেন বউ দেখতে?
অনুরাগ শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল
‘ চলো।
‘ কোথায়?
‘ বাড়ি।
‘ কিন্তু আমার তো অনেক কাজ। বুঝার চেষ্টা করুন।
‘ কোনো কাজ নেই। চলো৷
কুহেলী যেতে চাইলো না। তার প্রতিদ্বন্ধী মারিয়া অনুরাগকে দেখে হেসে বলল
‘ হাই স্যার।
অনুরাগ ঠোঁট এলালো। কুহেলী ভয়ার্ত চোখে বলল
‘ আপনারা একে অপরকে চেনেন?
মারিয়া হেসে বলল
‘ উনি আমার ভার্সিটির টিচার কুহেলী।
কুহেলী বলল
‘ ওহ। তারমানে আমি তোমার টিচারের ওয়াইফ, তোমার তো আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকার কথা।
হাসলো মারিয়া। বলল
‘ অবশ্যই ডাকতাম, কিন্তু।
অনুরাগ থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ ধন্যবাদ মারিয়া, আমাকে সাহায্য করার জন্য। তুমি যেতে পারো।
মারিয়া হেসে চলে গেল। কুহেলী তার হাসির রহস্য উদঘাটন করার আগেই শক্ত হাতের বাঁধনে বন্দী হলো তার হাত। সহায়ক পরিচালক মহিবুল হাসান এসে বললেন
‘ মিঃ চৌধুরী একটু ভেবে দেখুন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?
অনুরাগ ফেটে পড়লো রাগে। বলল
‘ জাহান্নামে।
কুহেলীকে টেনে নিয়ে গেল অনুরাগ। কুহেলী সারা রাস্তায় এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো কিচ্ছু বলল না অনুরাগ। তার বাসায় চলে আসলো কুহেলীকে নিয়ে। অনুরাগের শক্ত চোয়াল দেখে কুহেলীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তবে সে এবার সাহস করলো। অনুরাগ ঘরে আসতেই কুহেলী রাগ দেখিয়ে বলল
‘ আপনি অশিক্ষিতদের মতো করছেন কেন? আমাকে কাজ করতে দিচ্ছেন না কেন? কেন এমন করছেন?
অনুরাগ শান্ত হতে চাইলো। চোখের কোণায় লাল শিরার দেখা মিলছে। হাতের মুঠো আপনাআপনি নিশপিশ করছে শক্ত হতে। পুরুষালী শক্ত হাত দিয়ে সপাটে চড় বসালো সে কুহেলীর গালে। কুহেলী ঢলে পড়ে গেল। গালে হাত দিয়ে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইলো অনুরাগের দিকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল
‘ আমাকে মারলেন?
অনুরাগ পকেটে হাত গুজলো। মারিয়ার দেওয়া প্রত্যেকটা ছবি ছুঁড়ে মারলো কুহেলীর দিকে। কুহেলী চোখ মুছে কুড়িয়ে নিল সেগুলো। ছবিগুলোতে চোখ বুলাতে না বুলাতেই ছুটে গেল অনুরাগের দিকে। অনুরাগ দুপা পিছু হেঁটে গেল। হাত বাড়িয়ে বলল
‘ খবরদার নোংরা হাতে ছুঁবে না আমায়। বিশ্বাসঘাতক। দূর হও।
কুহেলী কান চাপা দিয়ে বলল
‘ এসব মিথ্যে। সব মিথ্যে। আপনি ভুল বুঝছেন আমায়। মারিয়া এগুলো মিথ্যে ছবি,
অনুরাগের ভয়ংকর রূপটা দ্বিতীয় বার দেখলো কুহেলী। অন্য গালে সপাটে চড় বসিয়ে, হাত দিয়ে গাল চেপে ধরলো অনুরাগ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ কোনটা মিথ্যে কুহেলী? দিনের পর দিন আমাকে মিথ্যে বলে, আমাকে ফাঁকি দিয়ে মহিবুল হাসানের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়া? কোনটা মিথ্যে? মহিবুল হাসানের সাথে তোমার নোংরা ছবি? কোনটা মিথ্যে? রূপগঞ্জ থেকে মারিয়া ফিরতে পারলো, সবাই ফিরতে পারলো, সিনেমার নায়ক ফিরতে পারলো কিন্তু তুমি আর মহিবুল হাসানের জন্য শুধু রাত হয়ে গেল? ফিরতে পারলে না? একা রাত কাটিয়েছ গ্রামে। সব খবর আমি পেয়েছি। কত টাকা দিয়েছে সে তোমায়? টাকার জন্য মানুষ এতটা নিচে কি করে নামতে পারে? তোমাকে ব্যবহার করছে, আর তুমি ও সুযোগ দিলে। বাহ, সাবাশ কুহেলী। সাবাশ। টাকা তোমাকে নোংরা বানিয়ে দিল। তুমি নোংরা কুহেলী। বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক।
অনুরাগ চলে গেল। কুহেলী বসে রইলো ঘরের এককোণে। মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
অনুরাগ আবার ফিরলো রাত এগারোটার দিকে। খাবারের প্যাকেট এনে ছুঁড়ে মারলো কুহেলীর দিকে তারপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। কুহেলী উঠে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে হেঁটে গেল অনুরাগের কাছে। তার পায়ের কাছে বসে হাতজোড় করে কাঁপা-কাঁপা ভাঙা গলায় চোখ মুছতে মুছতে বলল
‘ আমায় ক্ষমা,,,ক্ষমা করেন। আমার বাবাকে কিছু বলবেন না। সইতে পারবে না। মরে যাবে। আমাকে সুযোগ দিন, আমি আর কক্ষণো এমন করব না। আমাকে সুযোগ দিন। আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।
অনুরাগ পা সরিয়ে নিল। চোখের উপর হাতের কব্জি রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। যদি একটু সময়ের জন্য হলেও শান্তি পায়। কিন্তু না! কুহেলী শান্তি দিল না। পায়ের উপর শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। তার চোখের জলে অনুরাগের পা ভিজলো। অনুরাগ শেষমেশ পা সরাতেই ছিটকে পড়ে গেল কুহেলী। অনুরাগ বলল
‘ খবরদার আমাকে ছুঁবেনা। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আগে মনে হয়নি তোমার বাবা কষ্ট পাবে। বিবাহিত হওয়া সত্বেও অন্য পুরুষের সাথে ছিঃ। ছিঃ কুহেলী। মেয়ে মানুষকে আমি সবসময় সম্মানের চোখে দেখে এসেছি। নাহ তোমরা এত সুযোগ সন্ধানী? এতটা? আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দূর হও তুমি নইলে সব বলে দেব আমি সবাইকে। বের হও। আমার সামনে জীবনে ও আসবেনা। নইলে খুন করব আমি তোমায়।
কুহেলী দাঁড়িয়ে পড়লো। ছবিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে গেল। বাইরে এসে আগুন ধরিয়ে দিল সব ছবিতে। চোখমুখ মুছে মুঠোফোন দিয়ে কল দিল মহিবুল হাসানকে। রেগে গিয়ে বলল
‘ ইতরের বাচ্চা ইতর, আমি তোকে ছাড়ব না। ছাড়ব না। তুই সব শেষ করে দিলি।
মহিবুল হাসান ওপাশ থেকে বললেন
‘ বাকি টাকা গুলো তাহলে দিতে হবে না।
কুহেলী ফোন কেটে দিল। না টাকা তার লাগবে।
অনুরাগ ঘুমানোর চেষ্টা করলো। বুকের উপর ভার ভার অনুভব হতেই চোখ মেললো সে। কুহেলী আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে শুয়েছে তাকে। আঁকড়ে ধরে বলল
‘ আমাকে ক্ষমা করে দিন৷ আমি না বুঝে,,,
অনুরাগ চুপ করে রইলো। চোখে ভাসছে ওই ছবিগুলো। কি নোংরা নোংরা অঙ্গভঙ্গি করে কুহেলী কথা বলছে মহিবুল হাসানের সাথে, আর বাকিগুলো?
ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসলো অনুরাগের। তার উপর শুয়ে থাকা নোংরা মেয়েটি নারীজাতের কলঙ্ক। সুযোগ দেওয়া যাবেনা কোনোমতেই৷ কিছুতেই যাবে না।
চোয়াল শক্ত হয়ে আসতেই জোরে ধাক্কা দিল অনুরাগ। আচমকা বলে বসলো
‘ গত দুইমাসে তুমি তোমার বাবার বাড়িতে ছিলে নাহ? বাপের বাড়ির নাম করে মহিবুলের সাথে সময় কাটিয়েছ।
কুহেলী আবার কেঁদে দিয়ে বলল
‘ মিথ্যে। একদম না।
অনুরাগ পা দিয়ে ঠেলে দিল তার গায়ে লেগে থাকা কুহেলীর শাড়ি। মাথা চেপে বলল
‘ মারিয়া মিথ্যে বলবেনা আমায়। সে বলেছে আমায় গত দুই মাসে তোমাকে বেশিরভাগ সময় মহিবুল হাসানের বাসায় আসাযাওয়া করতে দেখেছে। তোমার বাসায় ও। উফফ তুমি দূর হও কুহেলী। তোমাকে দেখলেই একটা একটা মনে পড়ছে আমার। দূর হও।
কুহেলী বলল
‘ আমায় ক্ষমা করুন। আমি আর কখনো এমন করব না। ভুল তো হয়ে থাকে মানুষের।
অনুরাগ মাঝরাতেই ফিরে গেল গ্রামে। কুহেলীকে ঘুমন্ত রেখে। কুহেলীকে দেখলেই তার নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।
ভোররাতে ঘুম ভাঙার পর অনুরাগকে দেখলো না কুহেলী। নিজের চুল নিজে টেনে ছিঁড়তে চাইলো। চিৎকার করে কাঁদলো। ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে কাঁদতে কাঁদতে বমি করে ভাসিয়ে দিল বিছানা। তারপর জ্ঞান হারালো। বাড়িওয়ালা অনেক লোকজন ডেকে, দুটো মেয়ে মানুষের সাহায্য হাসপাতালে নিয়ে গেল কুহেলীকে। পুলিশ আসলো সুসাইড কেস ভেবে। ডাক্তার জানালো কুহেলী সন্তানসম্ভবা, অপরদিকে গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিল পুলিশ। অনুরাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কেন তার স্ত্রীকে মাঝরাতে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে গ্রামে চলে এসেছেন? তার উপর তারই সন্তানের মা হতে চলেছে কুহেলী৷
অনুরাগ কিছু বলল না। শায়খ চৌধুরী খুশি হয়ে ঘরে নিয়ে এলেন কুহেলীকে। তার বংশধর আসতে চলেছে। আনহিতা আর শায়লা চৌধুরীর চোখেমুখে আনন্দ।
কুহেলী পুলিশকে ভুলভাল বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিল। বলল,
‘ তার শ্বাশুড়ির অসুস্থতার খবর শুনে তার স্বামী গ্রামে ফিরে গিয়েছেন মাঝরাতে। আর সে হাত কেটেছে কাল স্বামীর সাথে তার খানিকটা মনোমালিন্য হয়েছে সে ভেবেছে স্বামী এজন্যই চলে গিয়েছে। ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। এগুলো তাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। পুলিশের নাক গলানোর দরকার নেই।
অনুরাগ হাসলো কুহেলীর যুক্তি আর বুদ্ধিতে। বাহ তার বাচ্চার মা কি বুদ্ধিমতী! বাহ।
চৌধুরী বাড়িতে উৎসব উৎসব আমেজ চলে এল। কুহেলী সবার মধ্যমণি হয়ে উঠলো।
__________
প্রায় অনেকটা সময় পার হওয়ার পর তৃতীয়বারের মতো ফুল এল আয়নার বাগানে। তখনই ঘটলো বিপত্তি। ফজলু মিয়ার বাগান বাড়ি আর বসতবাড়ি কেনার জন্য তৎপর হয়ে উঠলো শায়খ চৌধুরী। ফজলু মিয়া এমনিতেও কয়দিন বাঁচবেন? রেণু তো তার সব সম্পত্তির মালিক হবে। শায়খ চৌধুরী বললেন ফজলু মিয়াকে জমিজমা দেবে। টাকা ও দেবে। কিন্তু এই জায়গাটা তার চাই। আয়না সেখানে নাক গলানোর কে? সেসব তো তার জমি না। ফজলু মিয়া কিছু বলতেই পারলো না। শায়খ চৌধুরীর উকিল এসে সব কাগজপত্র বুঝিয়ে দিল ফজলু মিয়াকে। ফজলু মিয়া যখন বলল জমি ছাড়বে না, তার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছাড়বে না। তখন তার পরের দিন মাঝরাতে কে যেন পুরো বাগান আর চালাঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। কোনোমতে প্রাণে বেঁচেছিল ফজলু মিয়া আর রেণু। বাকিসব পুড়ে ছাই। আয়না চোখের সামনে দেখলো, নিজের স্বপ্নরাজ্য কেমন যেন মুহূর্তেই ঝলসে গেল। কোথায় বাগান? কোথায় তার ফুলবানু হওয়ার স্বপ্ন? সব তো ছাই!
শক্তপোক্ত আয়নার চোখের কোণায় হয়ত আগুনের দাউদাউ লেলিহান শিখা এসে পড়ায় একটুখানি জলের দেখা গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তা আগুন হয়ে উঠলো। সে প্রতিজ্ঞা করলো তার স্বপ্নগুলোকে যারা ছাই করে দিয়েছে তাদের সে ছাড়বে না। কখনোই না।
ফজলু মিয়ার কাগজপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় শায়খ চৌধুরীর সুবিধা হলো। তিনি নতুন কাগজপত্র বানালেন। ফজলু মিয়াকে অন্য জায়গায় জমি দিয়ে পুরোটা তিনি দখলে নিয়ে নিলেন।
চলবে,,