আয়নামতী পর্ব-৪১

0
1870

#আয়নামতী
#পর্ব_৪১
#পুষ্পিতা_প্রিমা

মাস দুয়েক পরের কথা।

বসার ঘরে সোফায় গুমোট চেহারায় বসে থাকা মানুষগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আয়না। অনেকটা ঘোমটা টানা। গায়ের উপর অনুরাগের দেওয়া চাদরটি। সোফায় বসা লোকদুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চাইলো আয়নাকে। অতঃপর বলল

‘ আপনিই রূপাকে দত্তক নিয়েছেন?

‘ হ্যা।

‘ আমরা কাগজপত্র চাই। আমরা ওর চাচা হই। ওকে আমরা নিয়ে যেতে চাচ্ছি।

‘ এতদিন পর ভাইঝির কথা মনে পড়লো?

‘ কাগজপত্র গুলি দেখান।

‘ এখন হাতে নেই। আপনারা মাসখানেক পরে আসুন।

‘ আমরা জানি আপনার কাছে কোনো কাগজপত্র নেই। রূপাকে আমরা নিয়ে যাব।

আয়না তেজী চোখে চেয়ে থাকলো। বলল

‘ এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা? আমার তো মনে হয় না রূপা আপনাদের চিনতে পারবে। ও অনেক সম্পত্তির মালিক এইজন্যই কি ওকে নিয়ে যেতে এসেছেন। যাতে লুট করে নিতে পারেন?

সোজাসাপটা জবাব। হা করে থাকলো আলমগীর আর জাহাঙ্গীর সাহেব৷ এটুকুনি একটা মেয়ে। কি ধারালো কথা?

‘ লুট তো মনে হয় করেই নিয়েছেন মিসেস চৌধুরী।

‘ রূপাকে নিয়ে যেতেই পারেন যদি ও চায়।

‘ কথা ঘুরাচ্ছেন?

‘ আপনাদের উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পেরেছি মিস্টার। আপনারা যা করার করতে পারেন।

আলমগীর আর জাহাঙ্গীর সাহেব বেশিকিছু বলতে পারলেন না। চলে গেলেন শেষমেশ। আনহিতা এসে বলল

‘ বৌমা অনুকে তো বলতে পারতে। ও সামলে নিত।

‘ ওনাকে জড়াতে চাচ্ছিনা মা। ওনাকে কিছু বলার দরকার নেই।

‘ আচ্ছা ঠিক আছে। যা ভালো মনে হয় করো।

____

প্রায় সপ্তাহখানেক পর কক্সবাজার থেকে ফিরলো অনুরাগ। সাতদিন তার মিটিং প্লাস অন্যান্য কাজ ছিল। ফেরার কথা দশদিন পর। কিন্তু সম্প্রতি খালেকুজ্জামান সন্ত্রাস হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, এমতাবস্থায় আনহিতা পাগলের মতো ছেলেকে জেরা করলেন ফিরে আসার জন্য। ফোনকলের উপর ফোনকল আর মায়ের কান্নার চোটে ফিরে আসতে হলো অনুরাগকে। অন্যদিকে আয়না চৌধুরী বাড়িতে নেই। সে গিয়েছে বাপের বাড়ি। রূপাকে নিয়ে তার চাচাদের সাথে ঝামেলা চলছে। কোর্টকাচারি পর্যন্ত এগিয়েছে সেই ঘটনা। অনুরাগ বাড়ি এসে সব শুনে প্রচন্ড ক্ষেপে গেল৷ আয়না কেন তাকে কিছু জানায়নি? ভেতরে রাগ পুষে রাখলো অনুরাগ। সন্ধ্যার দিকে আয়নাদের বাড়ি পৌঁছতেই দেখলো আয়না নাকি বাড়িতে নেই। উকিল বাড়ি গিয়েছে। অনুরাগ গাড়ি নিয়ে উকিল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যেতে না যেতেই দেখলো আয়না বেরিয়ে এসেছে। অনুরাগকে দেখে চমকালো সে। ঠোঁটে হাসির রেখা টানতেই অনুরাগের থমথমে চেহারা দেখে হাসি থামিয়ে দিল। পাশ থেকে রূপা বলল

‘ আমি কি আর বাবুর সাথে থাকতে পারব না আপা? আমি কোথাও যাব না। জেম্মা জেঠু, ভাই,ভাবি বাবুকে না দেখা ছাড়া আমি কেমনে থাকবো?

আয়না তার হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। বলল

‘ আমি আছি তো। চিন্তা নেই। প্রফেসর রেগে কেন আছে রে?

‘ জানিনা। কিছু বলোনি তাই বোধহয় রাগ করছে।

আয়না এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। বলল

‘ সালাম ছোটসাহেব!

অনুরাগ বলল

‘ মাঝরাস্তায় আমি কথা বলিনা। গাড়িতে উঠে বসতে পারে নয়ত আমি চলে যাচ্ছি।

‘ জ্বি সাহেব।

জোরে হর্ন বাজালো অনুরাগ। আয়না ঠোঁট চেপে হাসলো। রূপাকে নিয়ে বসলো গাড়িতে। তারপর বলল

‘ আপনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই এসব জানায়নি প্রফেসর। রেগে আছেন?

জবাব দিল না অনুরাগ। সোজা চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসলো আয়না আর রূপাকে। আয়না বলল

‘ আম্মা আমাদের অপেক্ষায় থাকবে। কি করলেন এটা?

‘ আমি বলে এসেছি। কাঁচা কাজ করিনা।

‘ পাকা কাজ ও তো করেন না।

‘ একদম চুপ।

হেসে ফেলল আয়না। রূপা তার সাথে বাড়িতে পা রাখলো। অমি এসে টেনে নিয়ে গেল তাকে। আয়না অনুরাগের পেছন পেছন পা বাড়ালো ঘরের দিকে। ঘরে পৌঁছে গেল অনুরাগ লম্বা লম্বা পা ফেলে। আয়না তার পেছন পেছন ছুটলো। ঘরে পৌঁছে দেখলো অনুরাগ হাতের ঘড়ি খুলছে। হাঁপিয়ে উঠলো আয়না। বুকে হাত দিয়ে দম নিয়ে এগিয়ে গেল। ডাকল

‘ প্রফেসর শুনুন না। একটা কথা ছিল।

‘ কারো কথা শোনার মুডে আমি নেই। কেউ আমার কথা শোনে, না ভাবে। আমি চোখের সামনে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ, একটু আড়াল হলেই যেন আমি মরে গেছি। বুঝি আমি কতটা মূল্যহীন আমি।

‘ প্রফেসর একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে কেন বাড়াবাড়ি করছেন?

ঘর থেকে বের হয়ে গেল অনুরাগ। আয়না পিছু যেতেই অনুরাগ থমকালো। বলল

‘ একদম পিছু আসবে না।

আয়না রাগে ফোঁসফোঁস করলো। বলল

‘ যাচ্ছি না। আপনার সাথে কথা বলার জন্য ও যাব না আমি।

‘ কি বললে? আমার রাগ ভাঙাবে তা না নিজে রাগ দেখাচ্ছ?

‘ একশবার দেখাব।

‘ আয়নামতী!

‘ আমি ভয় পাই না আপনাকে।

গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল অনুরাগ। আয়না টুইটুম্বুর জলভরা চোখে চেয়ে থাকলো। বলল

‘ আমি থাকব না আপনার ঘরে।

‘ বের হয়ে যাও। আটকাচ্ছে কে?

আয়না একদম কথামতো বালিশ আর কাঁথা নিয়ে বের হয়ে গেল। শায়লা বেগমের রুমে গিয়ে রেখে আসলো। শায়লা বেগম মিটমিটিয়ে হেসে বললেন

‘ আহারে সোহাগিনী। তোমার বউ সোহাগা জামাই রাখবেনি আমার ঘরে?

‘ আমি থাকবো।

খাবারদাবারের বিরাট আয়োজন টেবিলে। এতগুলো পদের রান্না দেখে কৌতূহল হলো অনুরাগের। এত রান্না কেন? কে খাবে? আনহিতা হেসে হেসে বলল

‘ আজকে বিশেষ দিন সোহাগ। আমি সব নিজ হাতে রেঁধেছি।

অনিমা খেতে খেতে বলল

‘ তোর জন্য মাঝেমধ্যে দুঃখ হয় ভাই।

‘ কি হয়েছে? কেউ আমায় বলবে তো।

আনহিতা আয়নাকে অনুরাগের সামনে এনে বসিয়ে দিল। ভাত মেখে খাইয়ে দিতে দিতে বলল

‘ বৌমাকে আমি পাঠিয়েছি বেড়ানোর জন্য। তুমি নিয়ে এসেছ কেন?

অনুরাগ জবাব দিল না। আয়না চিবিয়ে খেতে লাগলো। তাকালো না অনুরাগের দিকে।

‘ কে জানে কেন নিয়ে এসেছি।

আয়না খাওয়া বন্ধ করে দিল। অনুরাগ বিড়বিড় করে বলল

‘ আমাকে খাইয়ে দেয় না। কোথাকার একটা মেয়েকে খাইয়ে দেয়।

আয়না ঘনঘন মাথা নাড়ালো আর খাবে না বলে। আনহিতা জোরাজোরি করে খাইয়ে দিতে দিতে বলল

‘ এখন ওসব শোনা যাবে না। চুপচাপ খাও।

অনুরাগ তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। তারপর বাইরে চলে গেল। রাত এগারোটার দিকে ফিরলো বাড়িতে। ততক্ষণে সবাই ঘুম। বাড়িটা নির্জীব। ঘরে গিয়ে আয়নাকে দেখতে পারলো না। মাথা গরম হয়ে গেল অনুরাগের। এই মেয়ে তাকে এত জ্বালায় কেন? বউ ছেড়ে সে এক সপ্তাহ ছিল না? এখন আর থাকতে পারবে না। উফ আয়নামতী তাকে কবে বুঝবে? রাগ ও বুঝেনা। সে রাগলেও অনুরাগলো রাগ ভাঙাতে হবে, অনুরাগ রাগারাগি করলেও অনুরাগ কে-ই রাগ ভাঙাতে হবে।
শায়লা বেগমের ঘরে এখনো লাইট জ্বলছে। হামান দিস্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। অনুরাগ দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। পা টেনে ঘুমন্ত আয়নার পাশে বসে থাকা শায়লা বেগম হেসে ফেলল। বললেন

‘ আমি জানতাম তুমি আসবা। সেজন্যই তো দরজা খোলা। আহারে বউপাগলা সোনা মিয়া। বউ ছাড়া ঘুম আসেনা।

‘ আমার বউ তোমার ঘরে ঘুমাবে কেন? তুমি ওকে কি কি শিখিয়েছ আর?

‘ অনেককিছু শিখালাম গত এক সপ্তাহে। তোমাকে ও কিছু শিখায়। বউ এমন সময় বাপের বাড়ি থাকে। এনেছ কেন?

অনুরাগ ফটাফট জবাব দিল,

‘ দরকার নেই। আমার বউ আমার ঘরে থাকবে। দেখি সরো। যেতে দাও।

শায়লা বেগম সরে পড়লেন। অনুরাগ পাঁজা খোলা করে তুলে নিল আয়নাকে। শায়লা বেগমকে বলল

‘ মহাজ্বালায় আছি।

হেসে ফেলল শায়লা বেগম। অনুরাগের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল

‘ হায়রে বউসোহাগা!

আয়না নড়েচড়ে উঠতেই অনুরাগ ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল। লাল রঙের ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। তারপর মশারী টাঙিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো। ঘুমকাতুরে বউটা ঘুমাচ্ছে। রাগ লাগলো অনুরাগের। সে কেন এই মহিলাকে এখানে আনতে গেল। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়৷

আয়না ঘুম ছুটলো অনেক্ক্ষণ পর । নিজেকে নিজের ঘরটাতে আবিষ্কার করলো সে। অন্যদিকে পাশ ফিরে শোয়া তার পাশে একটি পুরুষ দেহদবয়ব। হাত দিয়ে ছুঁতেই দেখলো সত্যি মানব। বিড়বিড় করে বলল

‘ প্রফেসর আমাকে আবার দিয়ে আসুন। ভালো হবে না।

অনুরাগ তার গলার আওয়াজ শুনে চট করে ফিরলো। বলল

‘ পারব না। নিজেই চলে যাও।

আয়না উঠতেই অনুরাগ হাত চেপে ধরে টান দিল। কোমল শরীরটা এক হাত দিয়ে আগলে ধরে বুকের নিচে আনলো। বলল

‘ একদম মেরে ফেলব।

‘ মেরে ফেলুন। আপনার বাচ্চা কুহেলীকে মা ডাকবে।

‘ আয়নামতী!

হেসে ফেলল আয়না। হাত দিয়ে টেনে দিল অনুরাগের নাক। বলল

‘ আপনাকে রাগ করা একদম মানায় না সাহেব।

‘ মানায়। সুন্দর লাগে।

হাসলো আয়না।

‘ কি কথা বলবে বলছিলে। বলো।

গলায় মুখ গুঁজে কথাটা বলল অনুরাগ। আয়না বলল

‘ বলব না। ছাড়ুন তো।

অনুরাগ ছেড়ে দিল চট করে। পাশ ফিরে শুয়ে থাকলো। আয়না হেসে ফেলল। ডাকল

‘ প্রফেসর একটা কথা শুনুন না।

অনুরাগ ফিরলো না। আয়না এক হাত দিয়ে তার পিঠ আঁকড়ে ধরে মুখ ঠেকালো পিঠে। নরম ঠোঁট দিয়ে পিঠ স্পর্শ করে বলল

‘ খুব জরুরি কথা। এইবার সত্যি সত্যি বলব।

অনুরাগ ফিরলো। বলল

‘ কি?

আয়না বলল

‘ এদিকে আসুন।

অনুরাগ একটু কাছে ঘেঁষে বলল

‘ মজা করবে না আয়নামতী।

আয়না হেসে ফেলল। বলল

‘ করব।

অনুরাগ সরেই যাচ্ছিল। আয়না এক হাত ধরে ফেলল। তারপর হাতটা আলতো করে রাখলো নিজের উন্মুক্ত শীতল হয়ে থাকা উদরের নিচে। সাথেসাথে চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো প্রাণপুরুষের সেই স্থির উষ্ণ হাতের স্পর্শ। কম্পন ধরলো সারা গায়ে। হাতটা নড়তেই চোখ মেললো আয়না। তার দিকে ঝুঁকে থাকা মানুষটিকে বলল

‘ আর ও স্পষ্ট করে বলা চায়?

চুপচাপ, নির্বিকার চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইলো অনুরাগ। প্রশ্ন ঘুরলো মাথায়, জীবনের সবচাইতে খুশির মুহূর্তে মানুষের ঠিক কি করা দরকার?

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here