আয়নামতি পর্ব-১৪

0
1897

#আয়নামতী
#পর্ব_১৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

অনিমা ইন্ডিয়া থেকে ফিরলো সপ্তাহ খানেক হয়েছে। অনুরাগ না থাকায় তার ভালো লাগছেনা। অনেক জোরাজোরি করে অনুরাগকে আসার জন্য রাজী করালো সে। অনুরাগ এল। তবে ওই ঘরটাতে আর গেল না।
কুহেলীর ব্যাপারে সব ইতোমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে। কুহেলীর পরিবারের সবাই জেনে থম মেরে আছে। শায়খ চৌধুরীর সামনে আসার সাহস করেনি। এত চরিত্র খারাপ মেয়েকে রঙ চঙ মাখিয়ে বিয়ে দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল? শায়খ চৌধুরী তো ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকলেন। সুযোগ পেলে ওদের এমন শিক্ষা দেবে!
সমাজে এখন তার অবস্থান ধরে রাখাটা খুব কষ্টকর হয়ে গেছে । নাওয়াজ শেখ সুযোগ বুঝে পদ নিয়ে নেবে। ব্যাটা ভদ্রলোকের পক্ষে অনেকেই। কিন্তু শায়খ চৌধুরী পণ করলেন নিজের কাছে তিনি নাওয়াজ শেখকে কখনো চেয়ারম্যান পদ নিতে দেবেন না। কিছুতেই না। যা করতে হয় তার জন্য তিনি সব করবেন। তবু ও তিনি পদ ছাড়বেন না। কিন্তু চট্টগ্রামের এমপি সাহেবের সাথে নাওয়াজ সাহেবের বেশ ভালো সম্পর্ক। কি যেন আত্মীয় লাগে? বেশ চিন্তায় আছেন শায়খ চৌধুরী।

_______________

সকাল সকাল রহমত মিয়ার হাঁকডাক শোনা গেল। আয়না মাথায় কাপড় দিয়ে বের হয়ে এল ঘর থেকে। পেছন পেছন আয়শা বেগম ও বের হয়ে এলেন। রহমত মিয়া এসে দশ হাজার টাকা দিল আয়নাকে। বলল
‘ এগুলা বড় সাহেব পাঠাইছে আপা। জরিমানা বাগান পুড়ার।
আয়না বলল
‘ উনি কেমনে পাঠালেন? এগুলো নিশ্চয়ই উনার ছেলের কাজ। আমি এগুলো নেব না। নিয়ে যান।
রহমত মিয়া আয়শা বেগমকে বলল
‘ কিসব বলে দেখেন খালাম্মা? নিয়া গেলে তো আপনি ঠকে গেলেন। দেখেন ফুল বিক্রি হলে আপনার তো বিশ ত্রিশ হাজার লাভ হইতো। এখন দশ হাজার দিছে তো আরও কম দিছে।
আয়শা বেগমের দিকে তাকালো আয়না। আয়শা বেগম কিছু না বলে চলে গেলেন। আয়না টাকাগুলো নিয়ে নিল। যে ধারগুলো হয়েছে ওগুলো শোধ করে দিতে পারবে এই টাকাগুলো দিয়ে।
রহমত মিয়া এদিকওদিক তাকিয়ে একটা কাগজ বের করলো পকেট থেকে। আয়নার দিকে সযত্নে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আপা ছোডসাহেব লিখাটা মন দিয়া পড়তে কইছে। পড়বা। অনেক ভালা কথা লিখা আছে।
আয়না নিল। সাথে সাথেই খুললো। তারপর কাগজের লিখাটুকু পড়ে বলল
‘ রেণু কোথায়? আজকে তো এখানে আসার কথা ছিল। ওদের বাড়িটা কোথায় দিয়েছে?
রহমত মিয়া বলল
‘ চৌধুরী বাড়িদের পেছনের বাগানবাড়িটা ফজলু মিয়ারে দিছে। বড়সাহেব কিন্তু জায়গা দিছে, বাড়ি ও দিছে।
আয়না মাথা নাড়ালো। শুধু তারই ক্ষতি করলো। আয়না কাগজে আবার চোখ বুলালো। সেখানে লিখা
‘ আয়নমতী তোমার বাগান পুড়ে গেছে শুনে খারাপ লাগলো। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। এই যে দশ হাজার টাকা দিল সেগুলো বাবা দিয়েছে। আর কত টাকা তোমার লস গেছে তা রহমত মিয়াকে বলে দিও, চেষ্টা করব দিয়ে দেওয়ার। নতুন করে বাগানবাড়ি শুরু করো। ভেঙে পড়োনা।
আয়না কাগজটা মোচড়ে নিল। ঘরে গিয়ে লিখলো
‘ প্রথমবার ফুল বিক্রি করে পেয়েছি পনের হাজার টাকা। লাভ ছিল সাতহাজার টাকা। ২য় বার ফুল বিক্রি করলে আর ও লাভ পেতাম আমি অনেকগুলো ফুল ২য় বার তোলার জন্য তুলিনি। পর পর সাত আটবার ফুল তোলা যেত বাগান থেকে। তারমানে বুঝতে পারছেন কত টাকা লস গেছে। সব হিসেব করে পাঠিয়ে দেবেন। আমি আবার বাগান শুরু করব।

অনুরাগ কাগজটা পেল। কিন্তু সময় হয়নি বিধায় পড়া হলোনা। তবে যখনি সময় পেল পড়ে নিল। আয়নামতীর স্পষ্ট উত্তর দেখে ভালো লাগলো। ব্যবসাতে যেহেতু লস গেছে সেহেতু সব জরিমানা আয়নামতীর প্রাপ্য। অনুরাগ আবার লিখে পাঠালো।

‘ ঠিক আছে, নগদ টাকা দিচ্ছি না। ফজলু মিয়াকে যেখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে ওখানে বিশাল একটা সাজানো গোছানো বাগান বাড়ি আছে। ওখানে চাষ শুরু হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। ফুল চারা ও কিনে রাখা হবে তুমি শুধু চারা আর কন্দ রোপণ করে দিতে আসবে। বাকি কাজ তোমার। তারপর ও চারা রোপণের কাজটা ও আমার লোক করে দিতে পারবে যদি তুমি বলো। তারপরও কত টাকা বাকি থাকে তা হিসেব করে বলে দেবে।

চিরকুটটা আয়না সন্ধ্যায় পেল। মনের মাঝে থাকা সুপ্ত আশাগুলো জেগে উঠলো। ঔ যে কাল স্বপ্নে দেখলো সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট বাগানের মাঝখানে। তার চারপাশে ফুল আর ফুল। রঙ বেরঙের ফুল। সেই স্বপ্ন তাহলে এমনি এমনি দেখেনি? অনেকদিন পর মুখে হাসি ফুটলো তার। একদিন যখন তার অনেক অনেক বাগান হয়ে যাবে তখন সে একটা বাগান চৌধুরী সাহেবকে দিয়ে দেবে এই এতগুলো সাহায্য করার জন্য। সব ঋণ একসাথে শোধ হয়ে যাবে তখন। এখন তার অনেক কাজ। নামিরা কপাল কুঁচকে আয়নাকে দেখলো। আয়না ঘরে চলে গেল। কাগজ কলম নিয়ে লিখলো,

‘ ধন্যবাদ প্রফেসর সাহেব। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভালো থাকুন।

অনুরাগ ভেবেছিল আয়না খুব জরুরি কিছু লিখবে। কিন্তু কাগজ খুলে এই স্ত্রী সন্তান শব্দটা দেখে নিজের নামের শেষ দু অক্ষরের যথার্থতা দেখাতে দিয়ে আবার দেখালো না। তবে ক্ষেপে গেল ভীষণ। তবে এটুকু ভাবনায় এল, মেয়েমানুষ মানেই বিরক্তিকর। হায়রে, তার ও আয়নামতীকে ভালো লাগতো নাকি, ভাগ্যিস কুহেলীর সাথে বিয়েটা হলো নইলে তো আবার এই আয়নামতীর খপ্পরে পড়ত সে। বলা তো যায় না, এই আয়নামতী কত বড় দুর্দান্ত মহিলা। হতেই পারে। মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করা মানেই, জেনেশুনে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। কে জানে আয়নামতী আবার কাকে ঠকানোর জন্য জন্ম নিয়েছে।
সে যাইহোক অনুরাগ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে লিখলো
‘ দেখো আয়নামতী তোমার ভালো চাইছি আমি। তুমি ও আমার ভালো চাও। বেশি বাড়াবাড়ি করো না। যা বলছি তাই করো। আর কি কি পাবে তুমি আমার কাছে তা বলে দাও। কত টাকা পাবে?
আয়না চিরকুটটা পেয়ে হাসলো। লিখলো,
‘ পাবো বোধহয় লাখখানেক, হয়ত আর ও বেশি।
অনুরাগের ভাবান্তর দেখতে পেল না আয়না, পরের চিঠিতে। কারণ তাতে অনুরাগ লিখলো,
‘ লাখ পেলে পাবে। দেব। সমস্যা কি? সমস্যা তো নেই। যখন যা টাকা লাগবে বাগানে ফুল না আসা পর্যন্ত আমি দেব।
আয়না লিখলো।
‘ তো ওটা তো আপনার বাগান হচ্ছে। আমার বাগান তো হলো না।
অনুরাগ লিখলো,
‘ বাজে কথা বলো না মেয়ে। ওটা তোমার বাগান হবে। তোমার টাকাই তো তোমাকে দিচ্ছি। সমস্যা নেই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেব
আয়নামতীর বাগান।
আয়না চিরকুট পেল কিন্তু আর কোনোকিছু লিখলো না। যখন বাগান দেখতে গেল দেখলো পাশেই চৌধুরী বাড়ি। চৌধুরী বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে তো এখানকার পুরোটা দেখা যাবে। আয়না চোখ নামিয়ে নিল। এই এত বড় প্রাসাদে সে দাসী হয়ে থাকতো ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি।
ফজলু মিয়া আয়নাকে দেখে খুশি হলো। বলল
‘ ফুলবানু এই বাগানবাড়ির জমিটা আমি তোরে লিখা দিমু। তুই শুধু আমার রেণুরে দেইখা রাখিস। একটা ভালোর পোলা পাইলে বিয়া দিস। আমি বেশিদিন বাঁচুম না।
বলেই খুকখুক করে কেশে উঠলো ফজলু মিয়া। রেণু মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়না বলল
‘ সব জমি রেণুর নামে হবে।
রেণু বলল
‘ উকিল বাবু কইছে আঠারো বছর না হইলে করা যাইবো না।
আয়না কিছু একটা ভাবলো। বলল
‘ আচ্ছা এসব নিয়ে পরে কথা হবে। চল বাগান দেখে আসি।
রেণু এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ি করলো। ফর্সা গাল নেয়েঘেমে একাকার হয়ে গেল। তারপর কি যেন ভেবে রেণু দৌড়ে এল। আয়নার আঙুল ধরে যেতে যেতে বলল
‘ আপা তুমি জানো কাল ছোডসাহেব এখানে আইছিল। আমারে ফুলটুসি ডাকে।
আয়না বলল
‘ বাহ নামটা তো সুন্দর। ফুলটুসি! তোর স্কুলে তোরে কি নামে ডাকে?
রেণু বলল
‘ আমার আসল নাম তো রূপা। নানা আমারে রেণু ডাকে। ফুলের রেণু নাকি।
আয়না হাসলো। বলল
‘ আমি তোরে রূপা ডাকব তাহলে। নামটা খুব সুন্দর।
রেণু খুশি হয়ে বলল
‘ ঠিক আছে। আমি ও সবাইরে আমার নাম এইডায় কমু। সুন্দর নাহ?
আয়না বলল, হুমম।
রেণু বলল
‘ ছোডসাহেবের লগে একটা পোলা আইছে না? কি নাম যেন, ওমি ওমি। নাহ নাহ ওমি নাহ। অমি। ছেলেডা আমারে ছোডসাহেবের সাথে সাথে ফুলটুসি ডাকছে। আমার রাগ লাগছিল তখন।
আয়না খিক করে হেসে ফেলল। বলল
‘ অমি সাহেবের কি রূপাকে মন ধরেছে নাকি? হুহ হুহ?
রেণু মুখ কালো করে বলল
‘ ওগুলা তো বেয়াদব কথা আপা। তুমি কইয়ো না তো।
আয়না হাসিতে ফেটে পড়লো। চৌধুরী বাড়ির ছাদ থেকে কে যেন জোরে হাঁক ছেড়ে বলল
‘ এই আয়নামতী একটু আস্তে হাসো। তোমার হাসির জ্বালায় তো ঘরে থাকা যায় না। আশ্চর্য!
আয়না হাসি থামিয়ে রূপার দিকে চাইলো। বলল
‘ আমার হাসির আওয়াজ কি ওখানে যাবে? যত্তসব ফালতু কথা বলে এই চৌধুরী। মাথা পাগল একটা।
অনুরাগ চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তারপর বাগানের দিকে চোখ বুলিয়ে চলে গেল। রূপা বলল
‘ আপা ছোডসাহেবের বউ পালাইছে। আমি কাল স্কুল থেইকা আসার সময় দোকানে বসা লোকদের মুখে শুনছি।
আয়না তার মুখ চেপে ধরলো। বলল
‘ যে যা করার করুক। আমাদের কি? ওসবে কান দিস না। খবরদার ওসব আর মুখে আনবি না। ওদের বিস্তর টাকা পয়সা, বিয়ে দশটা করে দশটা তালাক দিলে ও সমস্যা নাই।
রূপা চুপ হয়ে গেল। কিছু বললো না। আয়না তার মাথায় গাট্টি মেরে বলল
‘ ভালো করে কথা বলা শিখ। উল্টাপাল্টা কথা আমার সাথে বলবি না। খুব মারব। চলিত ভাষা শিখে নে।
রূপা বলল
‘ আইচ্ছা।
আয়না ধমক দিয়ে বলল
‘ আচ্ছা ” হবে।
রূপা বলল
‘ আচ্ছা।

________________

পুরো গ্রামে পাবলিসিটি শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। শায়খ চৌধুরী আর নাওয়াজ শেখের পাবলিসিটি তো আছেই। সাথে মেম্বার পদপ্রার্থীদের ও। আহা ঘরে থাকা যায় না। অনুরাগ শায়খ চৌধুরীকে বলল
‘ বাবা এসবের তো দরকার নেই আর। আপনার বয়স হচ্ছে এগুলো বাদ দিয়ে রেস্টে থাকুন।
শায়খ চৌধুরী ছেলের উপর ক্ষেপে গিয়ে বললেন
‘ তোমার কথা কেন আমি শুনব অনুরাগ? বাড়াবাড়ি করো না। বলা যায় না, তোমাকে এমপির পদে দাঁড়ানো লাগতে পারে।। কাল তোমার মামার সাথে কথা বলেছি। এই যে এমপি খালিদ্দে আছে, শালা লুটপাট করে খায়। শালা সন্ত্রাস! তুমি কি ওসব সহ্য করবে?
অনুরাগ বলল
‘ মাঝেমাঝে আপনাকে আমি বুঝে পাইনা বাবা।
আনহিতা এসে অনুরাগকে টেনে নিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
‘ আমার একটাই ছেলে। আপনার কি মাথা খারাপ? ও রাজনীতিতে জড়াবেনা। আমি দেব না।
শায়খ চৌধুরী বলল
‘ সময় হলে তোমার ছেলে নিজেই দাঁড়াবে। সবসময় নিজেই তো বলে মানুষের জন্য কিছু করে কিছু করো। এবার দেখি সে কি করে?
অনুরাগ ভুরু কুঁচকে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। আনহিতা বলল
‘ সোহাগ ওসব কথা কানে নেবে না।
অনুরাগ মায়ের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বলল
‘ আহা মা আমি কি আর ছোট আছি? এবার আমাকে নিজের মতো করে বাঁচতে দাও। আর কত ভালো করবে আমার জন্য? ভালো করেছ তো, ফল ও পেয়েছি।
আনহিতা মাথা নামিয়ে নিল। বলল
‘ ঠিক আছে আর কিছু বলব না। তবে তোমার সব সিদ্ধান্ত যাতে ঠিক হয়। আমি তোমার মা, সবসময় তোমার ভালো চাই।
অনুরাগ বলল
‘ ঠিক আছে। মন খারাপ করোনা। ভালো লাগেনা।
আনহিতা মাথা তুললো। অনিমা এসে বলল
‘ ভাই ওসবে জড়াস না। দেখ টিভিতে দেখাচ্ছে এমপি খালিদুজ্জামান সন্ত্রাস হামলায় আহত হয়ে কক্সবাজার সেন্ট্রাল হসপিটালে ভর্তি। খুব মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।
অনুরাগ বলল
‘ ওর লোকই ওকে মারে। মানুষ ভালো না। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণেই এই দশা।

____________

আয়ানের ছাপাখানায় ভীড় দেখা দিল। ভোটের কাগজ ছাপানোর অনেক কাজ পড়েছে। আয়না ও হাত লাগিয়েছে। এখান থেকে গিয়ে আবার বাগানে যেতে হবে, যদি ও প্রফেসর লোক দিয়েছে। তারপরও আয়নার দেখা দরকার। দোকানে অনেক ভীড় হতে দেখে আয়ান আয়নাকে বলল
‘ টুনি তুই চলে যাহ। অনেক মানুষ আসছে।
আয়না নিকাব টেনে নিয়ে বলল
‘ কেউ তো দেখছেনা। কিচ্ছু হবে না।
আয়না দেখলো সব শায়খ চৌধুরীর ভোটের ব্যানার। আয়ানকে বলল
‘ ভাইয়া উনার প্রতিদ্বন্দ্বী কে?
‘ নামিরার বাবা।
‘ তো আমি কার পক্ষ নেব?
আয়ান বলল
‘ কারো না। শায়খ চৌধুরীর পক্ষে ও না নামিরার বাবার পক্ষে ও না। নামিরার বাবার সাথে খালিদুজ্জামানের হাত আছে,ওনি ক্ষমতায় আসলে অপব্যবহার করবেন সেটা আমি নিশ্চিত।
আয়না বলল
‘ যেখানে মূলে সমস্যা সেখানে এরা মেম্বার, চেয়ারম্যানরা তো এসব করবেই। এই এমপিগুলোই সব সমস্যার মূল। ওরা চাইলেই অসহায় মানুষদের জন্য অনেককিছু করতে পারে কিন্তু এরা তো শুধু নিজেই খেতে থাকে।
আয়ান বলল
‘ কাল মরতে মরতে বেঁচেছে খালিদুজ্জামান। মেরেই ফেলতো বিরোধী দলের নেতাখেতা।
আয়না বলল
‘ কেন যে ওসব করে কে জানে? মরার ভয় ও নেই।
আয়ান বলল
‘ এজন্যই দিনদিন দেশটা রসাতলে যাচ্ছে।
আয়ান বলল
‘ শায়খ চৌধুরীর ছেলে, মানে অনুরাগ চৌধুরীকে এমপি পদে দেখা যাবে আশা করা যাচ্ছে। ওদের ও অনেক উপরের লেভেলের মানুষের সাথে হাত আছে। পারবে।
আয়না বিস্ময় নিয়ে বলল
‘ ওই ভ্যাবলাকান্ত? নাহ নাহ এখন অবশ্য ভ্যাবলাকান্ত নেই। সে যাইহোক, আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে।
আয়ান বলল
‘ কেন? খুশি হসনি?
আয়না কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল
‘ আমার কি?
আয়ান হাসলো।

___________

ভোট খোঁজার জন্য নাওয়াজ শেখ গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় গেলেন শুধু উত্তর পাড়ায় যাননি। কারণ ওখানে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। তার আত্মসম্মানে লাগবে। নামিরা অনেক অপেক্ষায় ছিল। বাবা আসবে। সে বাবাকেই ভোট দেবে, আম্মা আব্বা আর আয়ানকে ও দিতে বলবে। কিন্তু না বাবা আসেনি। মন খারাপ হলো। ঘরে বসে একা একা কাঁদলো। বুকে যন্ত্রণা হলো। আয়ান দুপুরে খেতে এসে দেখলো নামিরার মুখ অন্ধকার। সে খেয়েদেয়ে রুমে আসলো। বেরোনোর আগে পেছন থেকে নামিরাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ে থুঁতনি ঠেকালো। জিজ্ঞেস করলো
‘ মন খারাপ?
নামিরা গলা একপাশে কাত করে দেখার চেষ্টা করলো আয়ানকে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ বাবা আজ এখানে আসেনি।
আয়ান হেসে ফেলল। বলল
‘ তো?
‘তো কি? আমি ওনার মেয়ে না? আমাকে না দেখলে চিল্লিয়ে বাড়ি একখান করতেন তিনি। সেই বাবা আমাকে দেখতে আসতে অপমানবোধ করেন এখন।
আয়ান বলল,
‘ রাজকন্যাকে বাবারা কুঁড়ে ঘরে দেখতে পারেন না মিরা। ওনারা চাই তাদের রাজকন্যা রাজপ্রাসাদে রাজপুত্রের কাছে থাকুক।
নামিরা ফিরলো আয়ানের দিকে। নাক টেনে বলল
‘ রাজকন্যাকে রাজপুত্রই পায়। কোনো সেনাপতি পায় না। এই বাড়ি আমার কাছে রাজপ্রাসাদ, আর তুমি রাজপুত্র। বাবার বুঝা উচিত, তার মেয়ে সুখ এই কুঁড়েঘরেই খুঁজে পায়। রাজার পোশাক পড়লেই রাজা হওয়া যায় না। তোমার গায়ে রাজার পোশাক নেই ঠিক, কিন্তু আমার কাছে তুমিই রাজা।
আয়ান কপাল মিলালো তার কপালে। কপালে চুমু এঁকে বলল
‘ আচ্ছা আমি আসি। মন খারাপ করে থাকবেনা আর। ঠিক আছে। কি খাবে? আসার সময় কিছু আনবো?
নামিরা হাসার চেষ্টা করে বলল
‘ নাহ কিছু লাগবে না।
আয়ান যেতে যেতে বলল
‘ আমি আনব।
নামিরা না চাইতে ও হেসে ফেলল।

________

বাগানে চারা রোপণ করা হয়েছে। আয়না এসে দেখলো বাগানের চারপাশটা ঘেরার কাজ চলছে। অনুরাগ তাকে এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
‘ যাও তোমার সব জরিমানা দিয়ে দিলাম। এবার আমার কাজ শেষ। ভাইরে ভাই এত কাজ আমি জীবনে করিনি।
আয়না বলল
‘ আপনি কোথায় করলেন? সব তো আপনার লোকই করলো।
অনুরাগ বলল
‘ নাহ নাহ আমি কোনো কাজ করিনি। সব ওরাই করলো। আমি বসে আঙুল চুষছিলাম।
আয়না মুখ ফিরিয়ে নিল। রূপা খিক করে হেসে দিল। অমি দৌড়ে এসে বলল
‘ ফুলটুসি তোমার পায়ে জুতো নেই কেন?
রূপা মুখ ফুলিয়ে আয়নার পেছনে লুকোলো। বলল
‘ আপা আমি এই ছেলেরে ঢিল মেরে মাথা ফাটাই দেব।
আয়না বলল
‘ তোকে তো ভালো কথায় বলছে। পায়ে জুতো কোথায়?
অমি অনুরাগের আঙুল ধরে দাঁড়ালো। আয়নাকে বলল
‘ রাগী আন্টি আপনার বাগানে আমি খেলতে আসলে বকবেন?
আয়নার ভুরু কুঞ্চন হলো। অনুরাগ তার পিঠ চাপড়ে বলল
‘ বকবে মানে? এত বড় সাহস? আয়নামতী তুমি ওকে বকলে তোমাকে আমি দেখে নেব।
আয়না বলল
‘ আশ্চর্য! আমি কখন বলেছি বকবো? ভারী পাজি মানুষ তো আপনি।
অনুরাগ বলল
‘ হয়েছে হয়েছে। তোমরা মেয়েরা কত সাধু তা জানা আছে। সবই ঠকবাজি।
আয়না বলল
‘ কি বললেন?
‘ অনুরাগ বলল
‘ কিছু বলিনি।
আয়না বাগানে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
অনুরাগ ডাকলো
‘ আয়নামতী শোনো?
আয়না ফিরলো। বলল
‘ কিহ?
অনুরাগ আবার মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ নাহ কিছুনা। তোমার সাথে আমার কিসের কথা?
আয়না বাগানের ভেতরে চলে গেল। অনুরাগ গিয়ে টিলার উপর দাঁড়ালো পেছনে হাত দিয়ে। যাতে বাগানের ভেতরটা দেখা যায়।
তারপর ফোন আসলো মুঠোফোনে। কথা বলতে বলতে দ্রুত পা বাড়ালো।
রহমত মিয়া এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
‘ আপা আপনের ভাই।
আয়না বলল
‘ কি হয়েছে ভাইয়া? কি হয়েছে?
রহমত মিয়া গামছা দিয়ে মুখ মুছে বললেন
‘ মারামারি লাগছে ছাপাখানার পাশে । আপনার ভাইয়ের দোকানে ও ভাঙচুর করছে। সব ভাঙি দিছে। গোলাগুলি হইছে। অনেক মানুষ মরছে। খালিদুজ্জামানরে নিয়া কথা বলায় ওর দলের মানুষ এসে মারামারি লাগায় দিছে। অনেক মানুষ মরছে। কারে যেন কুপায়ছে ও।
আয়নার দুচোখ টলটলে করলো নোনাজলে। সে বলল
‘ আমার ভাইয়া ঠিক আছে। কেউ মারেনি তো?
রহমত মিয়া চুপ থাকলো। আয়না দৌড় লাগালো। অনুরাগ ফোনে কথা শেষ করে আয়নার কাছে এল। বলল
‘ তুমি কোথায় যাচ্ছ? ওখানে অনেক মানুষ। আমি দেখছি।
আয়না বলল
‘ আমার ভাইয়ার যদি কিছু হয়?
অনুরাগ বলল
‘ কিছু হবে না। আমি সামলে নেব। ওখানে অনেক মানুষ। তুমি যেওনা।
আয়না বলল
‘ নাহ আমি যাব।
অনুরাগ আর না পেরে বলল
‘ গাড়িতে উঠো।
আয়না গাড়িতে উঠলো না। বলল
‘ আমি রিকশায় যাব।
অনুরাগ গর্জে বলল
‘ রিকশার চাইতে গাড়িতে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে পাগল। মাথা খেওনা তো। উঠো।
আয়না অন্য কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসলো। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলো লাশ নিয়ে টানাটানি পড়েছে। অনেক গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। আয়না দৌড়ে দোকানে ঢুকলো। দেখলো দোকানে ভাঙচুর হয়েছে। মনিটরটা বাঁকা হয়ে পড়ে আছে। প্রিন্টারমেশিন নিচে পড়ে আছে। ছোট ছোট পথশিশুরা মাউস নিয়ে খেলা করছে৷ খাঁ খাঁ করছে চারপাশ।
আয়না চেঁচিয়ে ডাকলো অনুরাগকে। বলল
‘ আমার ভাইয়া কোথায়? আমার ভাইয়া? আল্লাহ!
অনুরাগ বলল
‘ শান্ত হও। আমি দেখছি।
আয়না কান্নায় ভেঙে পড়লো। এতলোকের ভীড়ে আয়ান কোথায় তা খুঁজে পাওয়া গেল না। লাশের লাশ পড়ে রয়েছে রাস্তায়। পুলিশে পুলিশে থমথমে পরিবেশ। হাসপাতালে গেল অনুরাগ। আয়ানকে কোথাও পাওয়া গেল না। খালি হাতে শুকনো মুখে ফিরলো অনুরাগ। আয়না তখন ও দোকানে বসা ছিল। অনুরাগ এসে নরম গলায় বলল
‘ মর্গে গিয়ে দেখে আসতে হবে। হসপিটালে আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আয়না কান চেপে ধরলো। মাথা চেপে ধরলো। কাঁপতে কাঁপতে গাল বেয়ে উত্তপ্ত জল গড়ালো। সাথে সাথেই জ্ঞান হারালো সে। অনুরাগ ধরে ফেলল। মুখ ধরে ডাকলো। আয়নার সাড়া পাওয়া গেল না। অনুরাগ ভাবলো এই মেয়েটা মরেই যাবে একদিন। সে সাক্ষী থাকবে।
নামিরার কানে আসলো সেই খবর। আজহার সাহেব খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্ত্রী আর ছেলে বউকে নিয়ে চলে আসলো হাসপাতালে। আয়নাকে অনুরাগ সেখানে নিয়ে এসেছে। আয়শা বেগম পাগলের মতো প্রলাপ করছে। নামিরা এদিকওদিক দিশেহারার মতো তাকালো। মৃত ব্যাক্তিদের কান্নার আওয়াজে চারপাশটা আর ও ভয়ংকর হয়ে উঠলো।

মর্গে দুটো লাশ দেখানো হলো অনুরাগকে। একজনের চেহারা বুঝা যাচ্ছেনা। অপরজনের চেহারাটা রক্তে ভাসা। দুজনই তরুণ। হঠাৎ একজনের হাতের মোড়ানো থাকা একটা ঘড়ি দেখলো অনুরাগ। সেটি খুলে নিল। সেখানকার মানুষটিকে বলল
‘ এটা আমার লাগবে।
তারপর সেটি নিয়ে আসলো। রক্তে মাখামাখি ঘড়িটা। নামিরার কাছে এনে বলল
‘ এটা চেনেন?
নামিরা ঘড়িটার দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে । ফোটা ফোটা জল গাল বেয়ে গড়ালো পায়ের আঙুল অব্দি। বুক চিরে বেরিয়ে এল প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাওয়ার আর্তনাদের স্ফুলিঙ্গ।
অনুরাগ মুখ ঢেকে বসলো বেঞ্চে। মর্মাহত, জর্জরিত মানুষগুলো আর্তনাদে যন্ত্রণা ধরলো মাথায়।

চলবে
গল্পটা শেষ হওয়ার পথে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here