#আয়নামতী
#পর্ব_২
#পুষ্পিতা_প্রিমা
চৌধুরী বাড়িতে কোলাহল থামার নাম নেই। শায়খ চৌধুরীর চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হলেন তার বৃদ্ধ বয়স্কা মা শায়লা চৌধুরী। তিনি নাতবৌ দেখার জন্য বসে ছিলেন কিন্তু স্বয়ং কনে বিয়ে ভেঙেছে দিয়ে শুনে তিনি নিজের কানকে ও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমন কথা তিনি কখনো শুনেছেন বলে মনে পড়ছেনা। তার নাতিকে ফিরিয়ে দেওয়ার মত সাহস মেয়েটা পেল কোথায়? এত বড় স্পর্ধা?
অনিমা ও একপ্রকার রাগ ঝাড়লো বাবার উপর। বিয়েটা হয়ে যেত কি হত? তারা তো টাকা দেবে না বলেনি। অন্তত মেয়েটার তেজ কমানোর একটা সুযোগ থাকতো। বউ করে এনে দাসী করে রাখলে বুঝতো চৌধুরীদের সাথে বেয়াদবির পরিণাম কি হতে পারে? আস্ত একটা বেয়াদব মেয়ে কিনা আমার ভাইয়ের বউ হতো? তোমরা এই মেয়েকে কি দেখে বউ করে আনতে চেয়েছ? কি আছে সেই মেয়ের? এত দাপটের সাথে কথা বলে কোন সাহসে?
অনুরাগ সোফায় বসে আছে হেলান দিয়ে। সবার কথা সে চুপটি করে শুনে আছে। কি বলা উচিত তার সে বুঝে উঠতে পারছেনা। তবে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েটাকে পোহাতে হবে। সে দেখে নেবে কোথায় মেয়েটার বিয়ে হয়। কার সাথে হয়?
সে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল। শায়খ চৌধুরী ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন
‘ এই ছেলে আমার ভাবতেই অবাক লাগছে। বিয়ে করবেই মানেটা কি? কতগুলো মানুষের সামনে আমাকে অসম্মানি করলো। লেখাপড়া শিখিয়েছি কি আমার মুখের উপর কথা বলার জন্য? আমার বিপক্ষে কথা বলার জন্য? আমাকে অসম্মানিত করার জন্য? কেন এত শিক্ষিত করিয়েছি?
আনহিতা এবার মুখ খুললেন। বললেন
‘ ওকে কেন বকছেন? ওর কোনো দোষ নেই।
শায়খ চৌধুরী বললেন
‘ তাই নাকি? দোষ নেই? তোমার ছেলে যে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলে জেদ ধরেছিল? তখন কিছু বলোনি কেন? ভাগ্যিস মেয়েটা ফিরিয়ে দিয়েছে নাহলে তো এই বাড়ির বউ হয়েই আসতো মেয়েটা।
আনহিতা বলল
‘ আরেহ নিজের ছেলেকে ও চেনেন না? ও তো ওই মেয়েকে টাইট করার জন্য বিয়ে করতে চেয়েছিল। যাতে এখানে এনে বুঝিয়ে দিতে পারে চৌধুরীদের সাথে বেয়াদবির ফল কি হতে পারে?
শায়খ চৌধুরী থামলেন। শায়লা চৌধুরী বললেন
‘ এজন্যই আমি পইপই করে বলেছি ওই নোংরা পাড়ার মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনিস না। দেখেছিস এবার? ভাবতে পারছিস ওই মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে এলে কি করত? মেয়ে তো এখনো একটুখানি। মাত্রই স্কুল পাস করলো।
শায়খ চৌধুরী কিছু বললেন না। সব রাগ গিয়ে পড়ছে বন্ধু আশরাফউদ্দিনের উপর। শেষমেশ বন্ধু কিনা শত্রুর মতো কাজ করলো?
_____________
প্রায় সপ্তাহখানেক পার হওয়ার পর আজহার সাহেব খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। পায়ে ভীষণ আঘাত লাগায় তিনি আর হাঁটতে পারবেন না বললেন ডাক্তার। হুইল চেয়ারে বসে কাটাতে হবে বাকিগুলো দিন। আল্লাহ চাইলে উঠে দাঁড়াতে পারেন।
বাড়ি ফিরে সবার আগে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আজহার সাহেব। বললেন, আমি আর বাজারে যেতে পারব না? আমার ব্যবসার হাল কে ধরবে? আয়ান তো সেই ব্যবসা করবে না। তার পরিবারটা চলবে কিভাবে? মেয়েটার ও বিয়ে ও ভেঙে গেল।
বাবার এমন দুর্দশার জন্য নিজেকে দায়ী করলো আয়না।
আয়ান বাবাকে আশ্বাস দিল তার বন্ধুর বাবার একটা কোম্পানিতে তাকে চাকরি দেবে বলেছে। চাকরিটা হয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। কিন্তু আজহার সাহেব বললেন
‘ আমার ব্যবসা? আমার ব্যবসা কে দেখবে?
আয়ান চুপ করে থাকলো।
পেঁয়াজ কিভাবে বিক্রি করবে সে? সে পারবেনা। তার সব বন্ধু-বান্ধব তাকে বিদ্রুপ করে পেঁয়াজ বিক্রেতা ডাকবে তাছাড়া নামিরার বাবা চাচারা কি বলবে? পেঁয়াজ ব্যবসায় অত টাকাই বা কোথায়? ব্যবসা সম্পর্কে আয়ানের অত ধারণা ও নেই। পরিবারটা কি দু চার টাকায় চলবে? এখন আবার বাবার চিকিৎসা খরচ ও।
আয়ান জানালো চাকরি হয়ে গেলে ওখানে মোটা বেতনের মাইনে পাব আব্বা। তুমি চিন্তা করোনা শুধু দোয়া করো। আজহার সাহেব বললেন
‘ ঠিক আছে। সংসারের দায়িত্ব এবার থেকে তোর।
আয়ান বলল
‘ ঠিক আছে আব্বা।
আয়নাকে দেখে দুচোখ ভিজে উঠলো আজহার সাহেবের। মেয়েটার বিয়েটা আজ ও হয়ে উঠলো না। পাড়ার লোকেরা যা তা বলছে মেয়েটাকে। তার জন্যই মেয়ের বিয়েটা ভেঙে গেল। সবকিছু হলো তার জন্য। তার অঘটন না ঘটলে এসব কিছুই হতো না। বনেদী পরিবার থেকে সম্বন্ধ আসায় কত খুশি হয়েছিলেন তিনি। পুরো পাড়ার মানুষ অবাক হয়েছিল তার মেয়ের জন্য চৌধুরী বাড়ির ছেলের সাথে সম্বন্ধ আসায়। কিন্তু কি হয়ে গেল? শেষ রক্ষা আর হলো না।
আয়না বাবার গাল বেয়ে পড়া অশ্রু মুছে দেয়। সাহস যুগিয়ে বলে
‘ আব্বা আমাদের বাড়ির পেছনে যে ভিটে আছে ওটাতে গাঁদাফুলের চারা লাগিয়েছিলাম না? তোমার মনে আছে?
আজহার সাহেব মাথা নাড়লেন। আয়না বলল
‘ তুমি জানো ফুলচারাগুলোতে কতগুলো ফুল ধরেছে। কি সুগন্ধি চারপাশে। উঠোনে বাগানবিলাসের গাছ দেখেছ?
আজহার সাহেব মাথা নাড়লো। বলল
‘ হ্যা।
আয়না বলল
‘ বেলীফুলের গাছ দেখেছ?
আজহার সাহেব বললেন
‘ হ্যা দেখেছি তো । বেলীফুলের গাছ বেশি।
আয়না বলল
‘ ওই ফুলগুলো বেঁচে অনেক টাকা পেয়েছি আমি। ওই যে বাজারের মোড়ে ফুলের দোকান আছে নাহ? ওখানে বিক্রি করেছি। তারা বলেছে আর ও ফুল দিতে। আমি ভাবছি আমাদের বাড়ির চারপাশটা ফুলের বাগান করে ফেলব। অনেক জায়গা আছে তো। তাই না?
আজহার সাহেব মাথা নাড়লেন। মেয়ে তাকে খুশি করতে চাইছে তিনি বুঝতে পারলেন।
আয়না বাবার গাল দুহাতে আঁকড়ে ধরে ডাকল
‘ আব্বা?
আজহার সাহেব আওয়াজ করলেন।
‘ বল।
আয়না বলল
‘ তুমি আমি মিলে বাগান দেখাশোনা করব কেমন? তুমি হুইল চেয়ারে বসে বসে আমার বাগান পাহারা দেবে। পানির নল দিয়ে পানি দেবে। কি দেবে না?
আজহার সাহেব মাথা নাড়লো।
‘ দেব।
আয়না বলল
‘ বাগানের নাম কি দেব আব্বা?
আজহার সাহেব বললেন
‘ কি দিবি?
আয়না বলল
‘ আচ্ছা ওসব পরে। আগে বাগানের কাজে লেগে পড়ি। আমার একটা বন্ধু আছে বুঝলে, ওর পরিচিত এক কাকু একসময় ফুলচাষ করতো। ওনার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেব। তিনি আজকাল হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না । ঘরেই বসে দিনতিপাত করেন। ওনি নাকি বিনামূল্যে সব শিখিয়ে দেবেন আমাকে।
আজহার সাহেব বললেন
‘ আচ্ছা।
আয়না বলল,
‘ আব্বা শোনো যখন আমাদের অনেক বড় বাগান হয়ে যাবে, তখন আমরা নিজেদের একটা ফুলের দোকান দেব। কেমন?
আজহার সাহেব বললেন
‘ আচ্ছা।
আয়না বলল
‘ তুমি শুধু আচ্ছা আচ্ছা লাগিয়েছ কেন? কিছু তো বলো। তুমি জানো না তোমার একটা কথায় ও আমি কি পরিমাণ ভরসা পাই।
আজহার সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন
‘ তোর বিয়েটা কি আর,,,
আয়না থামিয়ে দিল আজহার সাহেবকে। ধমকে বলল
‘ সবসময় কেন বিয়ে বিয়ে করো আব্বা? আমি অনেক পড়তে চাই। আত্মনির্ভরশীল হতে চাই যাতে কেউ আমাকে হেয় করে কথা বলতে না পারে।
দেখো তুমি আমাকে খাইয়ে পড়িয়ে এতবড় করে আবার পরের বাড়ি পাঠাচ্ছ কি কথা শোনানোর জন্য? তুমি বলো, তারা যখন আমাকে হেয় করে কথা বলবে, কথায় কথায় ছোট করবে, অপমান করবে, আমার বংশ পরিচয় নিয়ে কটুক্তি করবে তখন তোমার ভালো লাগবে? আমি সহ্য করতে পারব? আব্বা দয়া করে এসব কথা আর তুলোনা। আমার শুনতে ভালো লাগেনা। তোমাকে এই অবস্থায় রেখে, ভাইয়াকে দুর্দশার মাঝখানে রেখে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না। ভাইয়া আমি থাকলে ভরসা পায়, সাহস পায়। আমাকে দূরে ঠেলে দিওনা আব্বা।
আজহার সাহেব বললেন
‘ ঠিক আছে। কিন্তু কথা দে যেদিন তোর মনের মত মানুষ আমি খুঁজে পাব সেদিন বিয়েতে তুই আর অমত করবি না।
আয়না হাসলো। বলল
‘ ওরকম রাজকুমার শুধু রূপকথার গল্পে পাওয়া যায় আব্বা। বাস্তবে সবাই টাকা খুঁজে, টাকা, টাকা। টাকা ছাড়া মানুষ কিছুই বুঝেনা আব্বা। যেমন এই মুহূর্তে আমি ও কিছু বুঝছিনা। আমার ও এখন প্রচুর টাকার দরকার। প্রচুর। এই কাগজের টাকা দিয়ে সব কেনা যায় আব্বা। সবটা৷
আজহার সাহেব বললেন
‘ কথা দিলি না যে।
আয়না হেলাফেলা করে কথা দিল। বলল
‘ কথা দিলাম। সেদিন আমি অমত করব না। তবে সেদিনটা কখনোই আসবে না আব্বা। আমি তোমাকে বলছি দিনটা কখনো আসবে না। না আসুক।
______________
দক্ষিণ পাড়ার মোড়ে দাঁড়ানো বোরকা পড়া মেয়েটাকে চিনতে অসুবিধা হলোনা নাছিরের। সে এগিয়ে গেল। নাম ধরে ডাকলো
‘ আয়না নাকি রে?
বোরকা পড়া আয়না ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো নাছিরকে। বলল
‘ হ্যা। বাড়িটা কোনদিকে?
নাছির বলল
‘ আমার সাথে আয়।
কাকু তোর কথা শুনে খুব খুশি হলো।
আয়না বলল
‘ কোনো টাকপয়সা দিতে হবে?
নাছির বলল
‘ নাহ। কাকু ফ্রিতে শেখাবে তোকে। কাকু তার ব্যবসাটা কাউকে শেখানোর জন্য অনেকদিন ধরে কাউকে খুঁজছে।
আয়না বলল
‘ তাহলে তো খুব ভালো।
দুইজনই ঢুকে গেল দক্ষিণ পাড়ায়। বেশকিছুদূর গিয়ে দেখলো একটা মাটির ঘর। বাইরে দাওয়ায় শুকনো মুখে বসে রয়েছে একজন বৃদ্ধ।
আয়না আর নাছিরকে দেখে ডাকলো
‘ বাছারা আইছিস?
নাছির বলল
‘ হ্যা কাকু। আয়নাকে ও নিয়ে আসছি। আমরা এক স্কুলেই লেখাপড়া করছি।
ফজলু মিয়া হাত নাড়িয়ে বলল
‘ এইদিকে আয় ফুলবানু।
আয়না খিক করে হেসে দিল। নাছির ও হাসল। ফজলু মিয়া বলল
‘ এদিকে আয়। মোড়া লইয়্যা বোস। তোরে আইজ থেইক্যা আমি ফুলবানু ডাকুম। বেজার হইবি?
আয়না মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ নাহ। নামটা তো খুব সুন্দর।
ফজলু মিয়া কাকে যেন ডেকে বলল
‘ রেণু দুইটা মোড়া লইয়্যা আয়। আর একটু চিড়া পানি দে।
আয়না বলল
‘ ওসবের দরকার নেই কাকু।
ফজলু মিয়া বলল
‘ দরকার আছে মা। আয়। বোস। মুখের ত্যানাটা সরা। বুক ভরে শ্বাস ল আগে। এইখানে আর কেউ নাই।
আয়না মুখের নিকাব সরালো। ফজলু মিয়া বলল
‘ তুই তো ফুলের মতো ছেড়ি। তোর কেমনে বিয়া ভাঙছে?
আয়না বলল
‘ ওসব কথা থাক। আমরা কাজের কথা বলি?
ফজলু মিয়া বললেন
‘ আইচ্ছা তোর খারাপ লাগলে আর কমু না। এবার বল তোর বাপের কত জমিজমা আছে?
আয়না নাছিরের দিকে তাকালো। তারপর বলল
‘ তেমন নেই। ওই বসতবাড়ির খালি জায়গা যতটুকু আছে, ওটাতেই করব।
ফজলু মিয়া বলল
‘ হুন আমার একটা নার্সারি আছিলো। ওইহানে দেশী বিদেশী ফুলগাছ লাগাইতাম। মাটি ও ভালা আছিলো তাই ফুল ও ধরছিল ভালা। তোরে আমি কতগুলো তকমা শিখায় দিমু ওগুলা মাইনা চললে তুই ভালা ফুলচাষ করতে পারবি।
আয়না বলল
‘ অল্প জায়গায় কতগুলো ফুল চাষ করতে পারব?
ফজলু মিয়া বলল
‘ অল্প জায়গায় ফুল চাষ অল্প অল্প হইবো। আগে অল্প অল্প করে শিইখ্যা ল। তারপর নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় বড় কইরা বাগান করবি। বুঝলি।
আয়না বলল
‘ ঠিক আছে।
ফজলু মিয়া তাকে কতগুলো বই দিল। চোখের চশমা নেড়ে বলল
‘ লিখাগুলো ছোড ছোড দেখায় । দেখিনা। তুই দেখবি। এইহানে লিখা আছে কোন ফুলের চাষে কি কি লাগবো। তুই তো স্কুল পাস করছস, পড়তে পারবি না?
আয়না বলল
‘ খুব পারব। দেখি দাও।
ফজলু মিয়া দিল। তখনি রেণু এল। আয়না জিজ্ঞেস করলো
‘ ও কে?
ফজলু মিয়া বলল
‘ আমার নাতনী। তাহার মা বাপ দুইটায় কলেরায় মারা গেছে। চাচারা রাখেনাই। আমি লইয়্যা আইছি। আমার লগে থাকে। স্কুলে পড়ে। দুই কেলাসে।
আয়না বলল
‘ দুই কেলাস মানে?
রেণু বলল
‘ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি আপা।
আয়না বলল
‘ ওহ বুঝেছি।
ফজলু মিয়া বলল
‘ আমি তোরে আমার ব্যবসা শিখায় দিমু। আমার ভিটেবাড়ির এখানে ও তুই চাষাবাদ করতে পারবি যখন তুই ব্যবসা শিখে যাবি, আর আমি মইরা গেলে আমার রেণুরে দেখিস।
আয়না বলল
‘ কোথায় যাবে তুমি কাকু? রেণুর খারাপ লাগবে। অমন কথা বলিওনা।
ফজলু মিয়া বলল
‘ সত্য তিঁতা লাগে কিন্তু সত্য সত্যই।
আয়না মাথা দুলালো। রেণু চিড়ামুড়ি দিল। সাথে ঠান্ডা জল। আয়না পানি খেল। চিড়ামুড়ি হাতে নিয়ে গালে দিতেই কোলাহল ভেসে আসলো। আয়না কপালে ভাঁজ ফেলে বলল
‘ কোথা থেকে আসছে কাকু?
ফজলু মিয়া বলল
‘ আর কইস না। ওই বাড়ির বউ আছে না? জামাই নষ্টপানি খায়, তারপর বউরে মারে কারণে অকারণে। যদি আমার পুত হইতো, আমি তো তারে কুপায় মাইরা ফেলতাম। বেচারী বউডারে দেখলে কষ্ট লাগে।
আয়না বলল
‘ মারে কেন? এমনি এমনি? মদ খেয়ে?
ফজলু মিয়া মাথা নাড়ালো।
নাছির বলল
‘ রোজ মারে। এমন গুন্ডা মানুষ আর দুটো নাই এই পাড়ায়। কেউ কিছু বললে তারে ধরে মারধর করে। গালাগালি করে। মা বোন তুলে গালি দেয়।
আয়না ব্যাগটা রেখে সেদিকে দৌড় লাগালো। দেখলো অনেক মানুষের ভীড়। ভীড় ঠেলে যেতেই দেখলো একটা মাতাল লোক বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ইচ্ছেমত পিটাচ্ছে তার বউকে। শাড়ি ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। রক্তে তড়বড় অবস্থা মহিলাটির নাকেমুখে। আয়না ভীড় থেকে বের হয়ে গেল। এদিকসেদিক দৌড়ে খুঁজে নিল একটি ছোট সাইজের ইট। তারপর ভীড়ের মাঝে ঢুকে ছুঁড়ে মারলো সেটি। তার আশপাশের কয়েকজন দেখলো তাকে। আয়না আঙুল দিয়ে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। লোকটি ততক্ষণে মাথার পেছনে হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। বিশ্রী গালাগালি করছে। আয়না দৌড়ে গিয়ে মহিলাটিকে ধরলো। পানি খাওয়ালো। সে ডাকতেই দুইতিনজন এগিয়ে এল। মহিলাটিকে ধরে নিয়ে যেতেই লোকটা বিশ্রী গালি দিতে লাগলো। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো আয়নার। সে বেড়ার ঘরটির দিকে তাকালো। বাইরে বসানো নিভে আসা মাটির চুলা থেকে আগুনে জ্বলজ্বল করা মোটা লাকড়িটা নিয়ে লাগিয়ে দিল লোকটার হাতে। লোকটা চিল্লিয়ে উঠলো। আশপাশের লোকজন মিটিমিটি হাসলো আয়নার কাজে। কেউ কেউ চরম অবাক। নাছির গিয়ে বলল
‘ হায়হায় কি করছিস?
আয়না বলল
‘ এদের এসব শাস্তি গুলো খুব কম পড়ে যাচ্ছে। জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেওয়া উচিত এদের অমানুষদের। নারীরা কি শুধু ভোগের জিনিস? শুধু হাতের পুতুল? তাদের কি তর্ক করার অধিকার নেই? কিছু বলার সুযোগ নেই? তারা কি সারাজীবন স্বামীর পদতলে মার খেয়ে খেয়ে থাকবে? স্বামী পূজো করবে?
নাছির বলল
‘ হাত পুড়িয়ে ফেলছিস তো?
দুইজন বৃদ্ধা এসে বলল
‘ খুব ভালো হয়েছে।
আয়না দুহাতে লাকড়িটা লাগিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিল। তারপর পায়ের তলায় দিল। লোকটা গড়াগড়ি খেতে লাগলো। চিৎকার করতে লাগলো।
আয়না তারপর মহিলাটির কাছে চলে গেল। বলল
‘ মার খেতে জানেন, দিতে জানেন না? আপনার দুহাত নেই? ওই দেখেন আমি কিভাবে মেরেছি, দেখেন পড়ে আছে। হাত পুড়িয়ে দিয়েছি।
মহিলাটি কাঁদার জন্য কথা বলতে পারলো না। আয়না বলল
‘ আপনাকে যেভাবে মারবে এবার থেকে আপনি ও সেভাবে মারবেন। বাঁশের কঞ্চি তো আর ও ছিল, আপনি নিতে পারেননি একটা?
মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে বলল
‘ পুরুষ মানুষের সাথে কি আমি পারুম?
আয়না বলল
‘ আমি পারিনি? ওই দেখেন মাথায় এমন মার দিয়েছি মাথা তুলতে পারছে না।
মহিলাটি কাঁশতে কাঁশতে জ্ঞান হারালো। সবাই ধরাধরি করে মহিলাটি পাশের হাসপাতালে নিয়ে গেল ভ্যানগাড়ি করে। আয়না হাত ঝেড়ে লোকটির কাছে গিয়ে বলল
‘ আর গায়ে হাত তুলবি?
লোকটা কি কি বলে যেন বিড়বিড় করলো। নাছির আয়নাকে টেনে নিয়ে এল। বলল
‘ বহুত বড় কাম করে ফেলেছিস বইন। আমার ভয় করছে এখন। চল, চল।
আয়না বলল
‘ কিসের ভয় আমার? কে বিচার করবে আমার? এসব অমানুষগুলোকে এভাবেই শায়েস্তা করা উচিত। বেয়াদব, অমানুষ।
নাছির বলল
‘ হয়ছে রে বইন। চল। চল। তোর ডরভয় নাই।
আয়না বলল
‘ আমি কলে যাব। মুখ ধুবো।
নাছির বলল
‘ চল।
রাস্তার পাশে কলে গেল আয়না। নাছির কল চাপলো। আয়না মুখ ধুলো। মুখ দিয়ে মুখ মুছতে রাস্তায় তাকালো। কাকে যেন দেখে মুখ মোচড়ালো।
নাছিরকে বলল
‘ চল বাড়ির দিকে যাই ।
নাছির বলল
‘ এতক্ষণে তোর মা বাবার কানে খবর পৌঁছে গেছে।
আয়না বলল
‘ তো? কি হয়েছে? আমি কি দোষের কিছু করেছি?
নাছির বলল
‘ তোর সাহস তো কম না রে আয়না।
হাসলো আয়না। বলল
‘ সাহসের কি আছে? অন্যায় সহ্য যে করে সে ও অপরাধী। ওই বেয়াদব লোকটার এবার যদি শিক্ষা হয় আর কি?
নাছির রাস্তার মোড়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
‘ যেতে পারবি এবার?
আয়না বলল
‘ হ্যা।
নাছির বলল
‘ আচ্ছা।
নাছির চলে গেল। আয়না কিছুদূর এগোতেই তারপাশ দিয়ে শাঁ করে একটি গাড়ি চলে গেল। বর্ষায় রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত তাই সব কাঁদা গিয়ে পড়লো তার বোরকায়। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না আয়নার মধ্যে। গাড়িটা থামলো কিছুটাদূরে। আয়না হেঁটে সেই গাড়ি অব্দি পৌঁছাতেই ডাক এল
‘ শুনুন?
আয়না ফিরলো না। থেমে গেল। বলল
‘ বলুন। এভাবে রাস্তায় কথা বলাটা মানানসই না।
অনুরাগ বলল
‘ আপনি কি ওখানে মারপিট করছিলেন?
কোনো জবাব দিল না আয়না। আজব! চৌধুরী বাড়ির ছেলে এই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেছে কখন থেকে?
আয়না বলল
‘ হ্যা মারপিট করছিলাম। আপনি দেখেছেন নাকি?
অনুরাগ হাসলো। বলল
‘ জ্বি দেখেছি। এত পুঁচকি একটা মেয়ের সাহস দেখে নিজে ও সাহস পেলাম।
হাসলো আয়না। মুখ বাঁধা থাকায় দেখলো না অনুরাগ। তবে বলল
‘ আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।
আয়না বলল
‘ কে জানে?
অনুরাগ কিছু একটা ভেবে বলল
‘ আপনি কি আয়নামতী ?
রেগে গেল আয়না। মানেটা কি? আয়নামতী আবার কেমন নাম? তাকে কি ব্যঙ্গ করে ডাকলো?
আয়না কাঠ কাঠ গলায় বলল,
‘ আমার নাম সুন্দর করে ডাকবেন।
চমৎকার করে হাসলো অনুরাগ। বলল
‘ উফফ আমি এত ব্রিলিয়ান্ট কখন থেকে হয়ে গেলাম? আপনাকে চিনেই ফেললাম।
বাহ আপনি তো খুবই ডেঞ্জারাস।
হেসে ফেলল আয়না। বলল
‘ আপনি বেঁচে গিয়েছেন তাই আরও খুশি লাগছে না? নাহলে আপনার দশা ও তো ওই লোকটার মতোই হত।
অনুরাগ বলল
‘ একদম না। আমি বউ পিটানোর মতো মানসিকতা পোষায় না। সো বউয়ের হাতে মার খাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
আয়না বলল
‘ তাই নাকি? পণ দাবি করে বিয়ে ভাঙার মতো মানসিকতা লালন করেন তাহলে?
থেমে গেল অনুরাগ। তার আত্মসম্মানে গিয়ে লাগলো কথাটা। আয়নামতীর উপর রাগ লাগলো। রাগ না দেখানোর জন্য সে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। অনুরাগ চলে যেতেই খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়লো আয়না। কোমর চেপে হাসতেই আশপাশের কয়েকজন লোক বলল
‘ এইডা আজহার মিয়ার ছেড়ি নাহ? নিজের বিয়ে নিজে ভাঙলো, আইজকে আবার ওই নষ্টব্যাডার হাত পুড়ালো। মাগোমা এমন তেজী মাইয়্যার কপালে জীবনে ও জামাই জুটবো না।
_____________
আয়না ঘরে ফিরতেই আয়শা বেগম তেড়ে এলেন। আয়নার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল
‘ তুই আজ বাইরে থাকবি। তোর ঘর নাই,ভাত নাই।
আয়না কোমরে হাত দিয়ে এদিকওদিক হাঁটলো। গলার স্বর টেনে ডাকলো
‘ ও আমমমা! আমি কি করেছি?
আয়শা বেগম বললেন
‘ হারামজাদি কি করেছিস মানে? তোর সাথে আমি কোনো কথা বলব না।
আয়না গলা টেনে ডাকল
‘ ভাবি? ও ভাবি? দরজা খুলে দাও।
নামিরা দৌড়ে এসে থমকে দাঁড়ালো আয়শা বেগমকে দেখে। মিনমিন করে বলল
‘ আম্মা দরজা?
আয়শা বেগম চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলেন। নামিরা কাঁপা-কাঁপা হাতে দরজা খুললো। আয়না ঢুকে পড়লো। নামিরার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল
‘ ও আম্মা ওভাবে তাকাও কেন?
আয়শা বেগম বলল
‘ তুই কি জামাই ছাড়া থাকবি? তুই যা যা করছিস তোরে বিয়ে করবে কে? কে করবে? পাত্রপক্ষ রাস্তার মোড় ফেলে বাড়িতে ঢুকতে পারবে? তার আগেই তো তাদের কান ঝালাপালা করে দেবে গ্রামের লোক।
আয়না বলল
‘ আম্মা খিদে পাইছে। বকো কেন এসময়?
আয়শা বেগম ধমক দিয়ে বলল
‘ চুপ হারামজাদি। তোর মতো কার ঝি অন্য পাড়ায় গিয়ে গাঁজাখোরের গায়ে হাত তুলে?
আয়না বলল
‘ মহিলাটিকে বেশি মারছিল আম্মা। তাই!
আয়শা বেগম গর্জে বলল
‘ চোপ বেয়াদব।
আয়না মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নামিরা বলল
‘ আচ্ছা আম্মা। এসব থাক। পরে কথা,,
আয়শা বেগম বলল
‘ আজ তোর ভাই আসুক। এমন মাইর দিতে বলব তোরে, শিক্ষা হয়ে যাবে একদম।
আয়না তার ঘরে যেতে যেতে বলল
‘ আসুক। তোমার ছেলেকে ও পিটাবো আমি।
নামিরা হেসে ফেলল। আয়শা বেগম ধমকে বলল
‘ হাসো কেন বউ?
নামিরা হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ আর হাসব মা আম্মা।
___________
কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান পড়বে।
দুহাত আর মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে চৌধুরী বাড়ির সামনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে এল মোটা একটি লোক। অনুরাগ দোতলার বারান্দার রেলিঙে হাতের ভর দিয়ে দূর আকাশের পাখি দেখছিল। হঠাৎ দারোয়ানের সাথে কার যেন চেঁচামেচি হচ্ছে দেখেই সে নিচে নেমে গেল। গেইটের কাছে যেতেই সবুজ রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়া একটা লোককে দেখলো। পেছনে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনুরাগ জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি চায়?
লোকটা ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাত দেখিয়ে বলল
‘ ছোডসাহেব এই দেইখেন আমার কি হাল কইরা দিল ওই পাড়ার একডা ছেমড়ি। হাত পুইড়া দিল দুইডা। পায়ের তলায় ও। মাথায় ইটপাটকেল মাইরা ফাটায় দিছে।
অনুরাগ এসব বিচার-আচারে জড়ায় না। তবে আজ তার বাবা বাড়িতে নেই। তাই সে বলল
‘ আপনার দোষ কি ছিল? সত্যি বলবেন।
লোকটা বলল
‘ আমি আমার বউরে মারছি। ওই ছেমরি আইসা কোথাথেইকা,,,
অনুরাগ বাকিটা নিজেই বলল।
‘ আপনাকে মাথায় ইট মেরেছে। তারপর জ্বলন্ত লাকড়ি দিয়ে হাত পুড়িয়ে দিয়েছে। পায়ের তলায় ও আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
লোকটা ঘনঘন মাথা নাড়লো। বলল
‘ হ্যা একদম। হাছা কথা।
খুব আয়েশি ভঙ্গিতে হাত ঝাড়লো অনুরাগ। বলল
‘ যে পথে এসেছেন সে পথে চলে যান। আপনি অন্যায় করে আবার বিচার চাইতে এসেছেন কোন সাহসে? আপনার বউকে তো মেরেছেন আপনি।
লোকটা কাঁচুমাচু করলো। অনুরাগ বলল
‘ যান। আপনার বউয়ের কাছ থেকে ক্ষমা চান। নইলে ওই মেয়েটাকে আমি আবার পাঠাবো আপনাকে মারার জন্য।
লোকটা ভয় পেয়ে গেল। অনুরাগ বলল
‘ কি বলেছি, শুনতে পেয়েছেন?
লোকটা ভড়কে গিয়ে বলল
‘ হ হ শুনতে পাইছি ছোডসাহেব।
অনুরাগ বলল
‘ যে মেয়েটা আপনাকে মেরেছে ওই মেয়েটাকে চেনেন?
লোকটা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ালো। বলল। ‘ কেউ কইতাছে না। আমার ও তেমন মনে পড়তাছেনা। ঝাপসা ঝাপসা দেখছিলাম।
অনুরাগ বলল
‘ ওই মেয়ের খোঁজ করবেন না। আমি জানতে পারলে ভালো হবে না।
লোকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল
‘ আইচ্ছা ছোডসাহেব।
অনুরাগ বলল
‘ যান।
লোকটা খুঁড়াতে খুঁড়াতে চলে গেল। অনুরাগ মাথা এপাশ ওপাশ ঝাঁকিয়ে জোড়ালো শ্বাস ফেলে বলল
‘ ওহে আয়নামতী । আপনি যে আমার শহরে আতঙ্কে পরিণত হচ্ছেন দিনদিন। কি করি আপনাকে নিয়ে?
চলবে
ওহে পাঠক, কিছু বলিয়া যান।