#আয়নামতী
#পর্ব_৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দুপুর দুটো নাগাদ আয়ান বাড়ি ফিরলো দোকান থেকে। মেজাজ চটে আছে। যে দোকানটাতে যন্ত্রপাতি বসিয়েছে সেই দোকানের মালিক দোকানটা আবার ছেড়ে দিতে বলছে। ব্যবসা শুরু হওয়ার আগেই এক একটা বাঁধা প্রতিকূলতা আসছে। বন্ধু শরীফ কাল জানালো তার খালাতো ভাই ও এমন একটা ছাপাখানা দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ চলাকালীন তুমুল মারামারি আর সংঘর্ষে সব যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে তছনছ। আয়ান হতাশায় ভুগলো। এতসব টাকা খরচ করে, নামিরার গয়না বন্ধক রেখে এতকিছু করলো। যদি এমন কিছু হয় তাহলে তো সব শেষ।
তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপুলেদের কথামতো কাজ করে না দিলে জিনিস ভাঙচুর করতে দুবার ভাববে না।
আয়শা বেগম আয়ানকে ফিরতে দেখে নামিরাকে ডাক দিল। নামিরা রান্নাঘরে ছিল। আয়শা বেগমের ডাকে হাত মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে এল। বলল
‘ কেন ডেকেছেন আম্মা?
‘ বাবু এসেছে। দেখো কি লাগে। আমি যাচ্ছি পাকঘরে।
নামিরা মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আয়ানের জন্য শরবত বানালো। গিয়ে দেখলো আয়ান খাটে বসে রয়েছে৷ বিমর্ষ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। নামিরা গিয়ে তার পাশে বসলো। শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ মন খারাপ?
আয়ান গ্লাস নিল না। তাকালো নামিরার দিকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে মেয়েটার৷ রান্নাঘরে ছিল তাই হয়ত। আয়ান বলল
‘ রান্না করতে পারো?
হেসে ফেলল নামিরা৷ বলল
‘ কালই তো আমার রান্না খেলে।
ভুরু কুঁচকালো আয়ান। বলল
‘ তাই নাকি? আম্মার রান্নার মতোই লেগেছিল।
‘ আম্মার কাছ থেকে শিখেছি তাই। আগে খেয়ে নাও তো।
আয়ান গ্লাস নিল। ঢকঢক করে তিন ঢোক খেয়ে বাকিটুকু রেখে দিল। তারপর বলল
‘ চাকরির খোঁজ করা দরকার। ছাপাখানাতে কাজ হবেনা বোধহয়।
নামিরা বলল
‘ কেন? এদিকে তাকাও। কে কি বলেছে তোমাকে?
আয়ান নামিরার দিকে ফিরল। বলল
‘ আমার ভয় লাগছে মিরা। যদি ঠিকঠাক ব্যবসা দাড় করাতে না পারি তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। তোমার গয়না,,
বাকিটুকু বলতে দিল না নামিরা৷ শাড়ির আচঁল টেনে আয়ানের কপাল মুছে দিতে দিতে বলল
‘ তুমি শুধু তোমার মনের কথা শোনো। নিজেই নিজের বন্ধু হও৷ নিজেই নিজের শক্তি হও। আমরা যখনই কিছু করতে যাই তখনই হাজার মানুষ হাজারটা কথা বলে, সব কি শুনতে আছে বরবাবু ?
আয়ান কিছুক্ষণ চুপ থাকলো৷ তারপর বলল
‘ তুমি এমন কেন মিরা? তোমার মা বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করেনা?
নামিরা বদনখানি নিমেষেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এল।
‘ ইচ্ছে করে। কিন্তু?
আয়ান বলল
‘ কি কিন্তু মিরা? আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়৷ মনে হয় কারো মা বাবার কাছ আমি তাদের সন্তানকে আলাদা করে ফেলেছি। আমার খারাপ লাগে মিরা। তুমি বুঝবেনা।
নামিরা বলল
‘ কি বলতে চাইছো তুমি?
আয়ান ওর দিকে ফিরলো। বলল
‘ মিরা তোমার উচিত তোমার মা বাবার কাছে যাওয়া। দেখে আসা৷
নামিরা কিছু বলল না। তার ও যেতে ইচ্ছে করে মা বাবার কাছে। কিন্তু সে যেতে পারেনা কারণ তারা বলে,চলে আয় একেবারে । এই শব্দটা সে শুনতে পারেনা। সে সহ্য করতে পারেনা। আয়ান নামিরাকে চুপ থাকতে দেখে ডাকল
‘ মিরা?
নামিরা চোখ তুলে তাকালো। আয়ান বলল
‘ দেখতে যাবে?
নামিরা কাঁপা গলায় বলল
‘ যদি আসতে না দেয়?
মৃদু হাসলো আয়ান৷ বলল
‘ আমি নিয়ে আসব। বাচ্চাদের মতো কেন কথা বলো মিরা।
নামিরা মৃদু মাথা ঝাঁকালো। বলল
‘ আচ্ছা যাব৷ তুমি যাবে না?
আয়ান মাথা দুলিয়ে বলল
‘ নাহ। তোমাকে দিয়ে আসব৷ আমার ওখানে কাজ নেই।
নামিরা বিমর্ষ চেহারায় তাকালো। আয়ান তার গালে হাত রেখে বলল
‘ মন খারাপ করোনা মিরা। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
নামিরা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভিজে আসা চোখ মুছলো।
____________
ফজলু মিয়ার বাগানবাড়িতে জমি চাষ চলছে। রহমত মিয়া নিজেই সব কাজ করতে পারবে বলেছে আয়নাকে। আয়না তাই আর কাউকে নিযুক্ত করল না। রহমত মিয়া যা দেয় তাতেই খুশি হয়৷ এখন কম দিলেও পরে কিছু টাকা বাড়িয়ে দেবে সে। রাস্তার পাশে দোকান থেকে গরম গরম সমুচা কিনে নিয়ে এল রেণু। আয়নাকে ডেকে বলল
‘ আপা সিংগারা পাইনায়৷ সমুচা লইয়্যা আইছি।
আয়না বলল
‘ সমস্যা নেই। আমি চুলায় চা বসিয়েছি। রহমত মিয়াকে চা করে দেই। এদিকে আয়। আমি চুলার আগুনটা ধরাতে পারছিনা।
রেণু চুলার কাছে আসলো। বলল
‘ তুমি তো রান্নার কাজ করোনা। তাই পারো না। আমি পারি। সরো। আয়না সরে পড়লো। রেণু মাটির চুলায় ফুঁ দিয়ে আগুন তুললো। তারপর চা করে রহমত মিয়াকে দিল। আয়নাকে বলল
‘ আপা চারা কখন কিনতে যামু? রহমত ভাইজান ও কি যাইবো?
আয়না বলল
‘ হ্যা। আমরা তিনজনই যাব। আমি কি একা আনতে পারব নাকি?
রেণু বলল
‘ ঠেলাগাড়ি লইয়্যা যাইবা? ভাইজানের ঠেলাগাড়ি আছে।
আয়না বলল
‘ ভ্যানগাড়ি আছে না?
রেণু বলল
‘ নাহ ওইডা ভাড়া লইয়্যা চালাইতো। ঠেলগাড়ি করে আনমু আপা। আমরা ও চইড়া চইড়া আসতে পারুম।
আয়না বলল
‘ ঠিক আছে। আজ যাব৷ কালকে চারা লাগিয়ে দেব। আমার সামনে পরীক্ষা বুঝলি। সব তোদেরকেই দেখতে হবে। তাছাড়া আমি তো এখানে এসে সারাক্ষণ বসে থাকতে পারব না।
রেণু বলল
‘ আমি আছি না৷ তোমার চিন্তা করবার দরকার নাই।
আয়না হাসলো। বলল
‘ আচ্ছা।
রেণু বলল
‘ একডা কথা জিগায়?
‘ বল।
‘ ছোডসাহেবের সাথে তোমার বিয়া হলে কি তুমি খুশি হইতা?
আয়না সরাসরি বলল
‘ নাহ।
‘ ক্যান?
‘ কারণ ওইটা শ্বশুড়বাড়ি নয় ওইটা আমার জেলখানা হতো। আমি এমনিতেও বিয়েতে রাজী ছিলাম না। আব্বার জন্য মত দিয়েছিলাম।
রেণু ঠোঁট গোল করে বলল
‘ ওহহ আইচ্ছা। তো তুমি ছোডসাহেবরে দেখোনাই বিয়ের আগে?
আয়না বলল
‘ ছবিতে দেখেছি। এর আগে দেখিনি। তাছাড়া উনি তো বোধহয় বিদেশ থেকে এসেছে। এখন এখানে চাকরি নিয়েছে।
রেণু বলল
‘ হ। চৌধুরীর পোলা নাহ? কিন্তু তোমার সাথে বিয়া হইলে আমি খুশি হতাম। এহন যদি অন্য কারো লগে বিয়া হয় আমার খারাপ লাগবো। ছোডসাহেবের লগে তোমারে মানায়।
আয়না হঠাৎ জোড়ালো ধমক দিল। এক ধমকে কেঁপে উঠলো রেণু। রহমত মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আয়না বলল
‘ সবসময় পাকা পাকা কথা। লেখাপড়ায় যদি এত মনোযোগী হতি তাহলে হতো। যত্তসব ফালতু কথা। ছোট মেয়ে ছোট ছোট কথা বলবি।
রেণু মুখ কালো করে ফেলল। চলে গেল। আপা তারে এইভাবে বকলো, সে আপার সামনে যাবেনা কখনো।
আয়না পরে ভাবলো সে কি একটু বেশিই বকে ফেলল? কত কাজে লাগে মেয়েটাকে। রেণু সেই যে রাগ করলো, আর আয়নার সামনে যেতে চাইলো না।
সন্ধ্যায় চারা কিনতে যাওয়ার সময় আয়না বাগানবাড়িতে এসে ফজলু মিয়াকে জিজ্ঞেস করল রেণু কোথায়?
ফজলু মিয়া বলল
‘ ফুলবানু তুই ওরে বকলি তো। তাই মেলা রাগ করছে। কাঁদছে ও।
আয়না তাকে খুঁজে বের করলো। রাস্তার পাশে ঘুরাঘুরি করছে মেয়েটা। আয়নাকে দেখে পালাতে চাইলো। আয়না তাকে দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। বলল
‘ আরেহ পাগলি আপার উপর রাগ করতে আছে?
ছোট্ট রেণু কেঁদে দিল। আয়না বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। আর কক্ষণো তোকে বকবো না আমি। কান্না বন্ধ কর।
রেণু অনেক্ক্ষণ পর কান্না থামালো। আয়না তার হাত ধরে হেঁটে গেল রাস্তার পাশে। রহমত মিয়া ঠেলাগাড়ি নিয়ে এসে বলল
‘ তোর গোসসা কি কমছেনি রে রেণু?
আয়না বলল
‘ আর বলবেন না, কি কান্না তার? আদর করি, আর বকতে পারব না? এটা কোনো কথা?
রহমত মিয়া হাসলো। আয়না রেণুকে নিয়ে ঠেলাগাড়িতে উঠে বসলো। বলল
‘ পারবেন আপনি?
রহমত মিয়া বলল
‘ বইসা থাকো। পারুম না ক্যান?
ঠেলাগাড়িতে চড়ে চড়ে আয়না আর রেণু চারার দোকানে চলে গেল। রজনীগন্ধার কন্দ, গাঁদা ফুলের চারা আর জারবেরার চারা কিনলো। ফেরার সময় আয়না অর্ধেক ঠেলাগাড়িতে চড়ে চড়ে আসলো। বাকিপথে নেমে গেল রহমত মিয়ার কষ্ট হবে ভেবে। ঠেলাগাড়ির পেছনে ঠেলে দিয়ে আসতেই শায়খ চৌধুরী দেখলো আয়নাকে। গাড়িতে বসা অবস্থায় চেয়ে রইলো। আয়না এদিকওদিক তাকিয়ে মুখ মুছলো। রহমত মিয়াকে বলল
‘ ভ্যানগাড়ি ভাড়া করলে ভালো হতো।
রহমত মিয়া বলল
‘ ভ্যানগাড়ি তো আমার না আপা।
আয়না পানি খেল সামান্য। রেণু বলল
‘ আপা আর তো বেশিদূর নাই। চলো চলো।
আয়না ঠেলাগাড়ি ঠেলে দিতেই চোখ গেল শায়খ চৌধুরীর দিকে। শায়খ চৌধুরী তাকে তাকাতে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। আয়না কপাল ভাঁজ করে চেয়ে রইলো৷ শায়খ চৌধুরীর গাড়ি এসে থামলো আয়নার কিছুটা দূরে। তিনি গলা বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
‘ এই মেয়ে এই এতগুলো চারা কোথায় যাচ্ছে?
আয়না জবাব দিল না। রেণু বলল
‘ আমাদের বাগানবাড়ীতে যাইতাছে।
শায়খ চৌধুরী রহমত মিয়াকে ডাকলো। বলল
‘ আমাদের বাগান বাড়িতে গিয়ে চারাগুলো দিয়ে আয় মালির কাছে। তোরা আরেক গাড়ি কিনে নে।
আয়না বলে উঠলো।
‘ অসম্ভব। এগুলো আমি কিনেছি। ওখানে চারা নেই তেমন। যেগুলো আছে ওগুলো ভালো না। আমি এগুলো বেছে বেছে নিয়েছি।
শায়খ চৌধুরী ধমকালেন রহমত মিয়াকে। বললেন,
‘ এই রহমত তোকে কি বললাম শুনিসনি? রহমত মিয়া ভয়ে ভয়ে জবাব দিল
‘ জ্বি বড়সাহেব। নিয়ে যাইতাছি।
শায়খ চৌধুরী গাড়ি থেকে নামলেন। জিজ্ঞেস করলেন
‘ কত টাকা এগুলো?
রহমত মিয়া বলল
‘ আড়াই হাজার টাকা হুজুর৷
শায়খ চৌধুরী তিন হাজার টাকা দিলেন আয়নাকে। বললেন
‘ এই মেয়ে নাও। আমার বাগানবাড়িতে কাজ চলছে, আজই চারা রোপণ করতে হবে। চারা কিনে নিও।
আয়নার ফোঁসফোঁস করলো রাগে।
তারপর আর দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে চলে গেল। শায়খ চৌধুরী টাকাগুলো রেখে দিলেন। বললেন
‘ বেয়াদব মেয়ে। আমি আর ও ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম।
ঘরে এসে আম্মা আব্বা ডেকে সারা হলো আয়না। আয়শা বেগম দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল
‘ কি হয়েছে রে?
আয়না রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল
‘ আমার সব চারা। সব চারা নিয়ে গেল ওই চৌধুরী। সব নিয়ে গেল। আমার চারা। আমি এদের একটাকে ও ছাড়ব না।
আয়শা বেগম বললেন
‘ তওবা তওবা। কেউ শুনলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। থাক গে, কপালে যা,,,
আয়না গর্জে বলল
‘ কপাল? আম্মা আমি কত কষ্ট করে টাকাগুলো যোগাড় করেছি জানো? মাটি যোগাড় করেছি। ওই চৌধুরীদের ছাড়ব না আমি।
আজহার সাহেব মেয়ের রাগ কেমন তা জানেন। তিনি ভয়ে ভয়ে থাকলেন, কি না কি করে বসে মেয়েটা।
রাতের খাবারটা খেল না আয়না। দরজা বন্ধ করে সেই ঢুকেছে আর খোলার নামগন্ধ নেই। যতই সে রাগ দেখাক, চৌধুরীদের সাথে তর্কে কি করে যাবে সে? টাকাগুলো না নিয়ে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। সবসময় রাগটাই সব কিছু সর্বনাশের মূল কারণ হয়। আয়না না পারলো চিৎকার করে কাঁদতে না পারলো কারো উপর রাগ ঝাড়তে।
পরদিন দুপুরবেলা রেণু এসে বলল
‘ আপা চৌধুরীদের বাগানবাড়িতে কোন গাছ লাগায় নাই। ওগুলা ওদের অন্য বাগান বাড়িতে পাঠাই দিছে।
আয়না বলল
‘ তোকে কে দেখে আসতে বলছে? ওসব বলবিনা আমার সামনে।
রেণু চুপ করে গেল।
রহমত মিয়া এসে হাসিহাসি মুখে বলল
‘ আপা চারা লইয়্যা আইছি। তাড়াতাড়ি আইসা দেখো।
আয়না উঠে দাঁড়ালো।
‘ চারা? কোথাথেকে? আমার চারা?
রহমত মিয়া বলল
‘ শহরের বাজার থেইক্যা দু’ঘন্টা ধইরা ভ্যানগাড়ি চালায় লইয়্যা আইছি। এগুলোতে ভেজাল নাই।
আয়না বলল
‘ টাকা কোথায় পেয়েছেন?
রহমত মিয়া চুপ করে থাকলো। আয়না ধমকে বলল
‘ কি হলো?
রহমত মিয়া পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে দিল। আয়না চট করে নিল কাগজটা। তাতে লিখা
‘ বাবার কাজে আমি দুঃখিত আয়নামতী। আপনি বাবার উপর রেগে থাকবেন না। রহমত মিয়া আমাকে এসে সব বলায় আমি সব জানতে পেরেছি এবং চারা কিনতে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনি মন খারাপ করবেন না।
আয়না কাগজটা মোচড়ে নিল। রহমত মিয়া বলল
‘ আপা আর রাগ কইরো না। দেখো আড়াইহাজার টাকার বদলে চারহাজার টাকার চারা পাইছো তুমি। তা ও ভালো মানের।
আয়না বলল
‘ আপনার ছোটসাহেবকে বলে দেবেন এসব চারা আমি নেব না। আমি চাইনা এসব। নিয়ে যান।
রহমত মিয়া বলল
‘ কিন্তু?
আয়না ধমকে বলল
‘ নিয়ে যান বলছি। যান দিয়ে আসুন।
আয়শা বেগম আর নামিরা হতভম্ব। চৌধুরী বাড়ির ছেলে আয়নাকে লিখা পাঠিয়েছে??
আয়শা বেগম ছিঃ ছিঃ করে উঠে বললেন
‘ আনা তোর সাথে ওই বাড়ির ছেলের কথা হয়? তুই?
আয়না বিরক্ত হলো মায়ের কথায়। বলল
‘ সবসময়ই খারাপ ধ্যানধারণা পুষে রাখো কেন আম্মা? লিখা পাঠিয়েছে তো কি হয়েছে?
রহমত মিয়া চারাগুলো নিয়ে চলে গেল। অনুরাগ রহমত মিয়াকে চারাসহ ফিরে আসতে দেখে বলল
‘ কি সমস্যা?
রহমত মিয়া বলল’
‘ আপা চারা রাখবোনা কইছে।
অনুরাগ বিস্ময় নিয়ে বলল
‘ কেন? আমি এমনি এমনি পাঠাইনি।
রহমত মিয়া বলল
‘ আপা মেলা রাগ কইরা আছে। কারো কথা শুনলেই খেঁকিয়ে উঠতাছে।
অনুরাগ বলল
‘ আমি গাড়ি নিয়ে আসি। তুমি আমার গাড়ির পিছু পিছু আসো।
রহমত মিয়া অবাক হয়ে বলল
‘ আপনে যাবেন ছোডসাহেব? আপনার বাবা যদি শোনে?
অনুরাগ বলল
‘ আমি সামলে নেব। এসো আমার পিছু পিছু। চারাগুলো নিয়ে আমি কি করব এখন। আয়নামতীর বুঝা উচিত ছিল।
আয়শা বেগমের প্যানপ্যানানি কানে ভেসে আসছে আয়নার। আজহার সাহেব কপাল ঢেকে বসে আছেন হুইল চেয়ারে। নামিরা কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। এসময় আয়ান থাকলে ভালো হতো। আজকে বিকেলে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কি হচ্ছে এসব? আয়শা বেগমের হঠাৎ হঠাৎ গর্জন আর কান্না গলা ভাসছে। এই মেয়ে দুখ সুখ বুঝেনা তাদের। মান সম্মান বুঝেনা। যা ইচ্ছে তাই করে। কখন যে একটা ভালো পাত্রে বিয়ে দিতে পারবেন কে জানে? তার উপর এত অশান্তি। যার সাথে বিয়ে ভেঙেছে তার সাথে আবার কিসের কথা?
টিনগেইটের অপর পাশ থেক গাড়ির হর্নের আওয়াজে হুশ ফিরল সবার। নামিরার বুক কেঁপে উঠলো। খুশিতে চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।
তার বাবা আসেনি তো? আয়শা বেগম বলল
‘ গাড়ি কার বউ? আল্লাহ আমার তো ভয় লাগতেছে।
রহমত মিয়া ঢুকলো। আয়নাকে ডাক দিয়ে বলল
‘ আপা একটু বাইর হোন। জরুরী দরকার।
আয়না বের হলো ঘর থেকে। বলল
‘ কি হয়েছে?
রহমত মিনমিন করে বলল
‘ একটু টিনগেট পার হইয়া আসেন।
আয়না বের হলো রহমত মিয়ার পিছুপিছু। গাড়ি দেখে বুঝে নিল সবটা। টিনগেইট পার হতে গিয়ে হলো না। ভালো করে মাথা ঢেকে নিল ওড়না দিয়ে। অনুরাগ ওড়নার খানিকটা অংশ দেখে গেইটের বাইরে থেকে বলল
‘ শুনতে পাচ্ছেন আয়নামতী?
আয়নামতী ডাকায় বিরক্ত হলো আয়না। দেখালো না। বলল
‘ বলুন ওখান থেকে। সামনে যেতে পারব না।
অনুরাগ ওখানেই দাঁড়িয়ে বলল
‘ আপনি চারাগুলো ফেরত পাঠিয়েছেন কেন?
‘ ইচ্ছে হয়েছে তাই।
‘ চারাগুলো রাখুন। প্রথম বার ফুল ফুটলে দেড় হাজার টাকার ফুল পাঠিয়ে দেবেন চৌধুরী বাড়িতে। ব্যস।
আয়না দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ পারব না।
অনুরাগ বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চারাগুলো রাখুন। ফিরিয়ে দেবেন না। আর যাইহোক রাগের বশে নিজের ক্ষতি করা আপনার মতো বুদ্ধিমতীর কাজ নয়।
আয়না চলে গেল। কাগজে কত টাকার ঋণ হয়েছে তা লিখে, সাথে লিখে দিল এই কাগজটা যত্ন করে রাখবেন। ঋণ শোধ করে দেব। আর আয়নামতী ডাকাটা বন্ধ করুন দয়া করে। আমি বিরক্ত হই৷ আপনার বুঝা উচিত। আয়না আবার বের হয়ে এল।
আয়শা বেগম চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আয়না কাগজটা রহমতের হাতে দিয়ে দিল। ঘরে চলে এল। অনুরাগ কাগজটা হাতে নিয়ে চলে গেল। একটু স্বস্তি পেল।
বাড়ি ফিরলেই আনহিতা হাসিহাসি মুখে বলল
‘ সোহাগ তোমার জন্য মেয়ে দেখেছি একটা। খুব সুন্দর, ভালো, শিক্ষিত একটা মেয়ে। এইবার খুব জমকালো ভাবে তোমার বিয়ে হবে। মেয়েটার ছবি তোমার ঘরে বালিশের নিচে রাখা আছে।
অনুরাগ চলে গেল ঘরে। আয়নার দেওয়া কাগজের লিখাটুকু পড়ে হাসলো। কাগজটার উল্টোপিঠে লিখলো
‘ আপনি সাহসী, স্পষ্টবাদী দেখেই মুগ্ধ হয়ে আমি আপনাকে আয়নমাতী ডাকি ‘ আয়নামতী। আপনি কেন অন্যকিছু মনে করছেন? আর যাইহোক আমি কখনোই আপনার অস্বস্তি আর বিরক্তির কারণ হব না। আমি কারো বিরক্তির কারণ হতে পছন্দ ও করিনা। সে যাইহোক,আপনি জয়ী হোন আপনার জীবনযুদ্ধে। এগিয়ে যান। শুধু থেমে যাবেন না প্লিজ। আপনাকে থেমে যাওয়া মানায় না।
লেখাটা আয়না পেল দুইদিন পর। তখন সে ব্যস্ত বাগানের কাজে। পড়ার সময়টুকু ও পেল না কিংবা সময়টুকু তার দিতে ইচ্ছে হলো না।
চলবে,,,