#আয়নামতী
#পর্ব_৩৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দিনটা শুক্রবার।
কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে রোদের একটুকরো ফালি এসে ঢুকে পড়লো ঘরে। ঘুম ভেঙে গেল রূপার। সায়ানের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। রূপা ঘুমঘুম চোখে হেঁটে গেল বাইরে। আয়শা বেগম তাকে দেখেই বলে উঠলো
‘ হারামজাদি বেলা কত হইছে খেয়াল আছে তোর? ঢুসে ঢুসে ঘুমাচ্ছিস? নামাজ কালাম তো নাই তোর। তোর আপা থাকলে এরকম করতে পারতি তুই? আমি কিছু বলছি না বলে কি পার পেয়ে গেছিস?
‘ বাবুকে কোলে দাও জেম্মা। কাল থেকে পড়বো। আপাকে বলিওনা।
‘ ধুরর হ । তোরে লাগতো না আমার। রহমত কোথায়? আমার বাছার খবর পাইনাই অনেকদিন। ওই চৌধুরীর বাড়িত ফোন লাগাইতে ইচ্ছা করেনা।
‘ ছোটসাহেবের কাছে তো ফোন দেওয়া যায় জেম্মা।
‘ ফোন ধরেনা ওই চৌধুরীর পোলা।
রূপা বলল
‘ জেম্মা আমি গিয়ে আপার খোঁজ নিয়ে আসি? বেশিদূর তো না।
‘ দরকার নাই। রাস্তাঘাট ভালা না। স্কুলে যাওয়ার পথে রহমতকে ডাইকা দিবি। আমি ওরে কমু।
‘ আচ্ছা জেম্মা।
আয়ান এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। রূপাকে বলল
‘ কি হয়েছে রে রূপা? আম্মা কাকে বকে?
রূপা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। বলল
‘ আমাকে।
‘ কেন?
আয়শা বেগম এলেন। সায়ানকে আয়ানের কোলে দিয়ে বললেন
‘ কেন আর জিগাইবিনা বাবু। একডা গেছে আরেকডা থাইকা গেছে জ্বালানোর লগে।
আয়ান হেসে মাথা চাপড়ে দিল রূপার। বলল
‘ কাল থেকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যাবি। ঠিক আছে।
‘ আচ্ছা ভাই।
সায়ান নিচু হয়ে গেল হঠাৎ। আয়ান বলল
‘ কি?
সায়ান রূপার মাথার চুল দুহাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। টানতে টানতে উহ আহ শব্দ করলো। রূপা ঠোঁট টেনে বলল
‘ আল্লাহ গো আমি মরে যাচ্ছি। ছাড় বাবু। নইলে খুব মারব।
সায়ান ছাড়লো না। রূপার কোলে গেল তারপর চুল ছাড়লো। আয়ান গালে আদর করে দিয়ে বলল
‘ রূপা ফুপীকে তো ভালোই চেনে।
নামিরা হাত মুছতে মুছতে এল। বলল
‘ সবাইকে চেনে শুধু তোমাকে চেনে না।
আয়ান তার পেছন পেছন গেল। বলল
‘ কি বললে মিরা? আমার ছেলে আমাকে চেনে না? তুমি দেখোনি কাল কিভাবে কোলে ঝাপিয়ে পড়েছিল? মিরা?
নামিরা জবাব দিল না। ঘরে পা রাখতেই আয়না তার কোমর আঁকড়ে ধরলো। কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে বলল
‘ আবার বলো কি বলতে চেয়েছ?
নামিরা বলল
‘ এসব কি হচ্ছে? কেউ দেখে ফেলবে। আয়ান?
আয়না ছেড়ে দিল। নামিরাকে সামনে ফিরিয়ে বলল
‘ ওরকম কেন বলেছ?
নামিরা বলল,
‘ সপ্তাহে একদিন দেখলে কি চিনবে সে সেটাই বলেছি।
‘ চাকরি তো মিরা।
‘ জানি আমি।
অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বলল নামিরা।
” আমার দিকে তাকাও মিরা।
নামিরা তাকালো। আয়ান নাকে নাক ছুঁয়ে বলল
‘ খুব শীঘ্রই এইখানে পোস্টিং নেব। ওই কোম্পানির একটা শাখা খুলছে এখানে। আমি বললেই দিয়ে দেবে।
‘ সত্যি?
‘ আমি তোমাকে মিথ্যে কখন বলি মিরা?
নামিরা আর কথা বলল না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে পড়ে রইলো। বলল,
‘ নামিরা আমি। মিরা নই।
‘ সবার তুমিটার নাম নামিরা হোক আর যাইহোক। কিন্তু আমার তুমিটার নাম মিরা। আমি এটাই ডেকেছি প্রথম। ডাকছি। ডাকবো। আমি এটাও জানি তুমি এই ডাকটা শোনার জন্য কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকো।
নামিরা একগাল হাসলো। আয়ানের মাথা টেনে এনে কপালে চুমু খেল। বলল
‘ আমি তোমার কাছে কেমন ধরনের স্ত্রী শ্বশুরের ছেলে?
‘ খুব জটিল প্রশ্ন মিরা।
‘ তুমি সহজ করে বলো।
‘ তুমি আমার কাছে ,,
‘ কি ?
‘ তুমি আমার,,,, আহ,,
‘ কিহ? ভাবতে এতক্ষণ লাগে?
‘ তুমি আমার কাছে ঠিক তেমনটা মিরা, ঠিক আমি চাই যেমনটা। তুমি আমার মনমাধবী মিরা।
নামিরা জোরে আয়ানের নাক টেনে দিল। বলল
‘ তাহলে কলেজে আমাকে দেখামাত্র পালিয়ে যেতে কেন? কত কষ্ট লাগতো আমার।
‘ সব এলোমেলো লাগতো। তুমি খুব পাজি ছিলে মিরা। সিনিয়রদের কেউ নাম ধরে ডাকে? ক্লাসমেট হলে একটা কথা।
নামিরা হেসে ফেলল। আয়ানের কলার টেনে এনে নাকে নাক ছুঁয়ালো। বলল
‘ আমি ডাকি। আমার বর, আমি যেমন ইচ্ছা তেমন ডাকব।
‘ তখন বর ছিলাম না তো।
‘ আমার ভবিষ্যৎ বর তো ছিলে। তাই অধিকার দেখিয়ে ডাকতাম। বিয়ের পরদিন আম্মা কি বলেছিল মনে আছে? বলেছিল, আজকালের পোলাপানের মুখে কিছু আটকায় না। জামাইর নাম ধরে ধরে ডাকে। ছিঃ ছিঃ এসব ভাবা ও যায় না।
আয়ান আওয়াজ করে হেসে উঠলো। বলল
‘ এখন সায়ানের আম্মার মতো লাগছে।
নামিরা একগাল হাসলো।
_____________
সাতকানিয়া থেকে অনুরাগ তার পরের দিন ফিরলো। ফেরার কথা ছিল রাতেই। কিন্তু কথার নড়চড় হয়ে গেল। আনহিতা তাতেই রেগে খুন। ছেলেকে দেখা দিলেন না আর। অনুরাগ অনেক করে মায়ের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলো। শেষমেশ আয়নাকে গিয়ে বলল
‘ আয়নামতী মাকে একটু ডেকে দাও না। রুম থেকে বেরই হচ্ছেনা৷ কাজের চাপে পড়ে আর ফিরতে পারিনি।
আয়না বলল
‘ আমি আপনার মায়ের সাথে কথা বলিনা।
অনুরাগ আচমকা এমন উত্তর শুনে থেমে গেল। নিজেকে সামলে বেশ নরম গলায় বলল
‘ কেন? আমার মা কি দোষ করেছে?
‘ আপনার মা কেন? আমি আপনার পরিবারের কারো সাথেই কথা বলিনা। আপনি সেটা জানেন না এমনটা নয়।
‘ তাহলে জমিলা আপা আর চামেলি আপার সাথে কেন বলো? আমার পরিবার অতটা নগন্য তোমার কাছে?
আয়না বলল
‘ রেগে যাচ্ছেন কেন আশ্চর্য? আমার বলতে ইচ্ছে করেনা তাই বলিনা। আপনি কি জোর করবেন আমায়?
অনুরাগ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। বলল
‘ তুমি আমার মায়ের একমাত্র ছেলের বউ। আর কোনো ছেলে নেই। আমি একটাই। আর তুমি ও একটাই। আমার মায়ের তো ইচ্ছা হয় ছেলের বউয়ের সাথে দুটো কথা বলতে। একটু গল্পগুজব করতে। তুমি তোমার মা ভাবিকে দেখোনি?
‘ আমার ভাইয়ের মতো নন আপনি। আর আমি ও আমার ভাবির মতো নই। আর আমার মায়ের সাথে কারো তুলনা হয় না।
কোথাও একটা ভীষণরকম আঘাত পেল অনুরাগ। সবার মা সবার কাছে অনন্য। কারো মায়ের সাথে কারো মায়ের তুলনা হয় না। আয়না বলল
‘ আমি আপনার মাকে ছোট করিনি প্রফেসর। আপনি আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না।
‘ ছোট করোনি, আলাদা তো করেছ। তোমার মা, আর আমার মা। তোমার মায়ের সাথে কারো তুলনা হয় না, আর আমার মায়ের সাথে হয়। এটাই তো বুঝাতে চেয়েছ।
শায়লা বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন
‘ কি হয়েছে দাদুভাই? বউয়ের সাথে এত কথা কাটাকাটি কেন?
আয়না রোষপূর্ণ চোখে চাইলো অনুরাগের দিকে। চোখের কোণায় জ্বলজ্বল করছে অশ্রুকণা । অনুরাগ বলল
‘ কিছু হয়নি। তোমাদের একটা বলি যে তোমাদের সাথে কথা বলেনা তার সাথে তোমরা ও বলবেনা। সামনাসামনি ও পড়বে না। মাকে ও বলে দেবে।
শায়লা বেগম কিছু বলতে চাইলো।
আয়না ফোঁপাতে ফোঁপাতে চলে গেল।
‘ এসব না বললেও হতো দাদুভাই।
‘ আমি বলতে চাইনি। বাধ্য করেছে বলতে।
‘ তোমার মা শুনলে আর ও রাগ করবে।
‘ করুক। দেখতে ও পাচ্ছি সেবা করে উল্টে দিচ্ছে তার ছেলের বউ। মরে গেলেও তো ওই মেয়ে পানি দেবে না আমার মাকে।
‘ আহা চুপ থাকো দাদুভাই।
অনুরাগ হনহনিয়ে চলে গেল।
রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে ও আয়নাকে কোথাও দেখলো না অনুরাগ। খুঁজলো ও না। মুখ হাত ধুয়ে মায়ের ঘরের দিকে গেল আবার। ঝগড়া হয়েছে শুনে আনহিতা নিজেই আসছিলেন। অনুরাগকে দেখে থেমে গেল।
বলল
‘ আসামাত্র ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছ? এই আমার সেই শান্তশিষ্ট ছেলেটা?
‘ তুমি দরজা খুলছো না। রাগ উঠেছিল মাথায়। কি বলে ফেলেছি জানিনা।
শায়লা বেগম এসে বলল
‘ সে ঠিক আছে। কটু কথা শুনিয়ে রাগিয়ে দিয়েছ, এইবার মিষ্টি কথা বলে রাগ ভাঙাও। মেয়ে মানুষের রাগ ভাঙাতে আদরই যথেষ্ট।
আনহিতা দ্রুত সরে গেল সেখান থেকে। অনুরাগ কপাল ভাঁজ করে বলল
‘ উফফ তুমি কি বুড়ি? নাকি ছোট্ট বাচ্চা দাদীজান? মায়ের সামনে কি উল্টাপাল্টা কথা বলো?
শায়লা বেগম হেসে ফেললেন। বললেন,
‘ তোমার সামনে তো বাচ্চাই ভাই। যাও যাও একটু সোহাগ টোহাগ করে রাগ ভাঙিয়ে ফেল তো। এরকম রাগারাগি ও মাঝেমধ্যে করা লাগে।
‘ আমার বউয়ের রাগ ওসব দিয়ে ভাঙেনা দাদীজান। বহুত ডেঞ্জারাস বউ আমার।
হেসে ফেলল শায়লা বেগম।
__________
অনুরাগ ঘরে গিয়ে অনেক্ক্ষণ বসলো। দেখলো আয়নার কোনো নামনিঃশ্বাস নেই। এই ঘর ছেড়ে সে যাবেই বা কই?
অনুরাগ রান্নাঘর ঘুরে এল। পেল না। ছাদটা ঘুরে এল। পেল না। আয়নামতী এমনিতেও ছাদে আসেনা। তবে ছাদ থেকে চলে যেতেই ওই দূরে বাগানের দিকে চোখ গেল অনুরাগের। আয়নাকে দেখলো। বাগানে। তাও বোরকা পড়া একটা মহিলা ও দুইজন লোকের সাথে। ফোন টিপে কাকে কি যেন বলল অনুরাগ। তারপর সোজা চলে এল নিচে। আয়না বাগান থেকে ফিরতেই অনুরাগ তার মুখোমুখি হলো। বলল
‘ কোথায় গিয়েছিলে?
আয়না তাকালো না। সোজা ঘরে চলে গেল। অনুরাগ তার পিছুপিছু গিয়ে বলল
‘ বাগানে কেন গিয়েছিলে?
‘ আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি।
অনুরাগ ক্ষেপে গেল। বলল
‘ আমাকে বলতে বাধ্য তুমি। আমি স্বামী তোমার।
আয়না সামনে ফিরলো। বলল
‘ কুহেলীর সাথে দেখা করতে গিয়েছি।
‘ কুহেলীকে পুলিশ খুঁজছে। তাকে পাওয়া গেলেই খালেকুজ্জামানের সব জারিজুরি শেষ। আমি ও তাকেই খুঁজছি। মিথ্যে বলবে না আয়নামতী।
‘ আপনার বিশ্বাস না হলে কিচ্ছু করার নেই আমার। আমি আপনাকে বিশ্বাস করাতে যাচ্ছি ও না।
অনুরাগের এবার মতিগতি ভাল ঠেকলো না। বলল
‘ কুহেলীর সাথে তোমার কি? কেন কুহেলীর সাথে তোমার যোগাযোগ থাকবে?
আয়না কোনো জবাব দিল না। অনুরাগ বলল
‘ ওর ঠিকানা দাও। আমি ওকে পুলিশে দেব। চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে থাকছে ওই নষ্ট মহিলা।
‘ আমার কাছে ঠিকানা নেই।
অনুরাগ হাতের বাহু ধরে তার সামনে নিয়ে এল আয়নাকে। আয়না আর্তনাদ করে উঠতেই ছেড়ে দিল অনুরাগ। বলল
‘ কি চাইছো তুমি আয়নামতী? আমার শত্রু সে, তোমার ও শত্রু হওয়া উচিত ছিল। আর তুমি তার সাথে,,
‘ আপনি ও আমার শত্রু। বন্ধু নন। কুহেলীর কেসটা নিয়ে নিন। ওর মায়ের ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। চিকিৎসা দরকার। ওকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে তাই কিছু করতে পারছেনা। ও ক্ষমা চেয়েছে।
অনুরাগ বলল
‘ কখনোই না। কখনো ওকে ক্ষমা করব না আমি। বাহ তুমি শেষমেশ পর দুঃখটাও বুঝলে। শুধু আমার বেলায় অবুঝ তুমি।
‘ প্রফেসর মানুষের ক্ষমা হয়।
‘ হয় তো। হয়। আমি ও জানি হয়। ভুলের ক্ষমা হয়। আমার ভুলটার ও ক্ষমা হয়। করেছিলে তুমি? করোনি। নিজেই তো করোনা, আর আমাকে কেন জ্ঞান দিচ্ছ? ওই কেসটা আমি তুলব না। আমি তুললেই বা কি হবে? কালারিং হয়ে গেছে কুহেলী সরকার।
‘ ওর মা খুব অসুস্থ প্রফেসর। ওর অন্য কোনো ভাইবোন ও নেই।
‘ তো আমি কি করব? আমার প্রাণ নিতে চেয়েছিল ওই মহিলা। কুহেলী এসেছিল আমার জীবনে, তাই সবকিছু এত এলোমেলো। নয়ত সব গোছানো থাকত। তুমি ও থাকতে। এই লোক দেখানো তুমি নয় বরং আসল তুমিটা থাকতে।
‘ আপনি কেসটা তুলে নিন। সব মিটমাট হয়ে যাবে।
‘ জীবনে ও নেব না।
‘ কুহেলীর মা ও একজন মানুষ প্রফেসর। কুহেলীর মা না ভেবে একজন সাধারণ মানুষ মনে করুন ওনাকে। কেসটা তুলে নিন।
‘ আমি পারব না। চরম শাস্তি দেব আমি কুহেলীকে।
আয়না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। অনুরাগ চলে যেতে যেতে থেমে গেল আয়নার কথায়।
‘ যে জোর করে বিয়ে করতে পারে তার দ্বারা সবই সম্ভব। জেনেশুনে একটা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া ও সম্ভব। অমানুষ।
অনুরাগ ফিরতি পথে ফিরে এল। বলল
‘ কি ডেকেছ?
‘ অমানুষ।
রাগ-ক্ষোভে এদিক-ওদিক তাকালো অনুরাগ। বলল
‘ এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। বাড়ি থেকে। অমানুষের ঘরে তোমাকে থাকতে হবে না৷ যাও বেরিয়ে যাও। আমি অমানুষ। ঠিক আছে আমি অমানুষ। অমানুষের সঙ্গে থাকার দরকার নেই। সংসার করার দরকার নেই।
আয়না হতবাক হয়ে তাকালো। সামান্য কথায় এত কথা শোনানোর কি ছিল? সে ভুল কিছু তো বলেনি।
‘ আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
অনুরাগ বজ্রগম্ভীর গলায় বলল,
‘ দিচ্ছি। আমার শত্রুর সাথে যার লেনাদেনা তার সাথে আমার কি? চলে যাও যেখানে ইচ্ছে। তোমাকে দেখতেও চাই না আমি।
আয়না চলে গেল সেখান থেকে। আনহিতা,অনিমা আর শায়লা বেগম এত চেঁচামেচি শুনে চলে আসলো। শায়লা বেগম বলল
‘ তোমাদের হয়েছেটা কি দাদুভাই?
অনুরাগ গর্জে বলল
‘ আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? ওই মেয়েকে জিজ্ঞেস করো৷ শেষমেশ ওই কুহেলীর সাথে হাত মিলিয়েছে।
আনহিতা বলল
‘ কুহেলী? ওর সাথে কুহেলীর সাক্ষাৎ হলো কোথায়? ওকে চলে যেতে বলেছ তুমি? যদি চলে যায়?
অনুরাগের গলার স্বর নরম হয়ে এল। বলল
‘ ইচ্ছে করলে চলে যাবে। আমার কি? এত যত্ন-আত্তির করে ঘরে শত্রু পুষতে পারব না মা।
কপালে হাত দিয়ে বসলো আনহিতা। অনিমা বলল
‘ কুহেলী কি মধু খাইয়েছে কে জানে তোর বউকে। শয়তানি তো শয়তানি বুদ্ধিই দেবে।
ছোটখাটো ব্যাগটাতে যা পারলো সবটা ভরে ফেলল আয়না। তারপর বোরকা গায়ে দিয়ে নিচে চলে আসলো। আনহিতা হতভম্ব হয়ে বলল
‘ এসব কি হচ্ছে? সামান্য কথা কাটাকাটির জন্য? বৌমা এগুলো তো রাগের বশে বলেছে অনুরাগ। এভাবে যেতে নেই বৌমা। কি বলবে সবাই?
আয়নার দুচোখ লাল টকটকে। বলল
‘ আমাকে দূর হয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমি এতিম নই যে এত কথা শোনার পর ও এখানে পড়ে থাকব। আমি নিজ থেকে ও আসিনি এই বাড়িতে। জোর করে আনা হয়েছে।
আনহিতা অনুরাগের কাছে গেল। বলল
‘ আহা আটকাচ্ছ না কেন অনু? কি হচ্ছে এসব?
‘ যাক। দরকার নেই কাউকে আমার।
আয়না একমুহূর্ত ও দাঁড়ালো না। বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। আনহিতা বলল
‘ একা একা কিভাবে যাবে? আল্লাহ কি হচ্ছে এসব? তোমরা কি পাগল হয়ে গেছ?
অনুরাগ ঘরে চলে গেল।
ড্রাইভার আয়নার পিছু পিছু গিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ বৌরাণি আমি গাড়িতে করে দিয়ে আসি? এত রাগারাগির কি দরকার? দুদিন পরে স্বামীর ঘরে তো আবার ফিরতেই হবে।
আয়নার ফোঁপানি উঠলো। ওই অভদ্র লোকটার কাছে কখনোই ফিরব না আমি। ড্রাইভার হেসে ফেলল। বলল
‘ আমার বউ ও সবসময় এই কথায় বলে। দুইতিনদিন পার হতে না হতেই নিজেই ফিরে আসে।
আয়না ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা ধরলো। ড্রাইভার আর না পেরে একটি রিকশা ডেকে তুলে দিল। বলল
‘ বৌরাণিকে একদম তাদের বাড়ির উঠোনে গিয়ে রেখে আসবি।
রিকশাওয়ালা নিয়ে গেল। অনুরাগ এসে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল
‘ কোথায়?
‘ আমি রিকশাতে তুলে দিয়েছি।
‘ কে বলেছে তুলে দিতে? ওহ শিট! আমি বেঁধে রাখতাম ঘরের ভেতর। ধ্যাত।
‘ আপনি কি বউ মারছেন নাকি সাহেব? চোখমুখের তো বেহাল অবস্থা।
অনুরাগ ধমকালো।
‘ একদম চুপ। আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি বউ পিটাতে পারব? আমি ভদ্রলোক। ওসব করিনা। একটু গলার আওয়াজ বড় করে কথা বলেছি ওতেই বউ বাপের বাড়ি উঠেছে। এত জ্বালা নিয়ে মানুষ থাকতে পারে ভাই?
অনুরাগ ও চলে গেল আয়নাদের বাড়ি। আয়শা বেগম বলল
‘ চৌধুরীর পোলা আমার মেয়েরে কি কইছো? আসছে পর্যন্ত কেঁদে যাচ্ছে। কটু কথা শুনাইছো। আমি কখনো শুনাইছি? তোমারে অত সাহস দিল কেডা? হাত টাত তো ভাঙায় ফেলছ।
অনুরাগ মাথা চুলকাতে থাকলো। আয়শা বেগম বলল
‘ তোমার শাস্তি হইতাছে আইজ আর কোথাও যাইতে পারবে না। শ্বশুরবাড়িতে থাকা লাগবো। থাকবা?
‘ আজ?
‘ না করবানা। তোমার বউয়ের কি ব্যারাম হইছে সেটার ঔষধ ও কিনে আনবা।
‘ জ্বি আচ্ছা।
আয়না অনুরাগের সামনে একবার ও গেল না। নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। বাইরে ও যায়নি। রাতে বিরাট আয়োজন হলো জামাইয়ের জন্য। নামিরা, রূপা আর আয়শা বেগম তিনজন মিলে করেছেন যা করার। আয়না উঁকি ও দেয়নি। যে তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলে তাকে এত অ্যাপ্যায়ন করার কি দরকার?
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে আয়নার দেখা পেল অনুরাগ। রান্নাঘরের দিকে হনহনিয়ে যেতে দেখা গেল আয়নাকে। অনুরাগ ঘরে ঢুকে বসলো। রূপা আর সায়ানের সাথে অনেক সময় কাটালো। আয়না ততক্ষণে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়ে ফেলেছে। সায়ান ঘুমিয়ে পড়লে রূপা তাকে নিয়ে চলে গেল। অনুরাগ এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ আমি ঘুমাবো কোথায় ভাই? শাড়ি চুল সব আমি শোবার জায়গায়।
আয়না নড়লো না। অনুরাগ শাড়ি আর চুল সরিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আয়না খানিকটা কাছে এসে ডাকল
‘ রাগীসাহেবা আমার দিকে কি একটু ফিরবেন?
আয়না শুনলো কি শুনলো না। অনুরাগ তার কোমরে টেনে নিজের কাছে আনলো। কানের কাছে গিয়ে বলল
‘ আয়নামতী আমি কেসটা তুলে নিয়েছি।
আয়না সাথে সাথে ফিরলো তার দিকে। একেবারে মুখোমুখি । নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে সংঘর্ষ তখন।
‘ মিথ্যে বলছেন।
‘ মিথ্যে বলে তোমার থেকে দূরে কেন থাকব?
‘ কোনো অভিযোগ রাখেননি?
‘ কুহেলীর উপর কোনোকালেই আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। সব অভিযোগ তোমার উপর।
‘ আমাকে ছাড়ুন। ওভাবে ধরেছেন কেন?
অনুরাগ আরও নিবিড়ভাবে ধরলো তাকে। একদম বক্ষপটে আবদ্ধ করে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল
‘ হাজারবার ধরব। তুমি হাজারবার দূরে গিয়ে দেখাও। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঠিকই আমার কাছে ফিরে আসবে।
চলবে,,