#আয়নামতী
#পর্ব_৩৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা
চৌধুরী বাড়ির চারদিকে মেহমান। অথিতিরা এখনো আসছে। বাড়ির বিশাল উঠোনের প্যান্ডেলের নিচে খাওয়া দাওয়া চলছে বিস্তর।
আয়শা বেগম আর নামিরা পুরো চৌধুরী বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে। সায়ান অমির সাথে। অনেক্ষণ অনিমার কোলে ও ঘুরেছে। মেজবানে আসা অনেক অচেনা মানুষের কোল চড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। নামিরা খুঁজলে ও পাচ্ছে না তাকে। রূপা ও আছে যে সায়ানকে কোলে নিচ্ছে তাদের পিছুপিছু। আয়ান কিছুক্ষণ পরপর এসে দেখে যাচ্ছে ছেলে কার কোলে।
আয়না পরিবারের সবাইকে পেয়ে গল্পে বসেছিল। শায়লা বেগম এসে বললেন
‘ নাতবৌ শাড়ি টারি পড়ে সেজেগুজে নাও। তোমাকে আমার বাপের বাড়ি থেকে অনেকে এই প্রথম দেখবে।
আয়না সেই থেকে গোসল নিল। চুল শুকালো। চুল আঁচড়ালো। তারপর অনুরাগের দেওয়া সেই ব্যাগটা হাতে নিল। এত জিনিস আনা লাগে। পাগল মানুষের কাজকাম।
সোনালি রঙের কারুকাজ শাড়ি কালো পাড়টাই। লাল শাড়ি। বেশ ভারী। সুন্দর। দেখে মনে হচ্ছিল তেমন ভার হবে না। কিন্তু গায়ে দিতেই মনে হলো রাজ্যের ভার যেন।
নেয়েঘেমে অনুরাগ ঘরে এল। কপালের ঘামে চুল ভিজে গেছে। ডোরাকাটা সাদা কালো শার্টটা পিঠে লেগে গিয়েছে।
বাড়ির ভেতরে মেহমান ঢিপঢিপ করছে। এদিকওদিক যাওয়া যায় না। কাজের চাপে বেহুশ হবার পালা। শাড়ি পড়া আয়নাকে দেখে আঁড়চোখে কপাল কুঁচকে তাকালো অনুরাগ। বিড়বিড় করে বলল
‘ মহারাণীকে লালকালো শাড়িতে জম্পেশ লাগছে। স্যালুট মাই পছন্দ।
পরক্ষণেই নিজেই নিজের মাথা চাপড়ে বলল
‘ এই প্রফেসর বউ দেখলেই তোর মাথা ঢিলা হয় ক্যান ভাই? তোরে এসব মানায় না। ইয়াকক। উহুম উহুম।
মুখে হাত দিয়ে আওয়াজ করলো অনুরাগ।
‘ চামেলি আপাকে পাঠাবো নাকি? শাড়ি পড়ায় অসুবিধা হচ্ছে বোধহয়।
আয়না কুঁচি ঠিক করে নিচু হয়ে পিন করছিল। বলল
‘ দরকার নেই। বকবক করতে করতে মাথা খায়।
‘ তাইলে আমি একটু শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কেউ আসলে বলবে আমি নেই।
‘ মিথ্যে বলব?
‘ জামাইর জন্য বলবে।
‘ আশ্চর্য!
‘ চুপ থাকো। আমি ঘুমাই। তোমার হাতটা কম নাড়াও। ঝনঝন আওয়াজ চুড়ির। উফফ জ্বালা।
‘ এনেছেন কেন?
‘ একশ বার আনব।
উল্টো শুয়ে থাকলো অনুরাগ। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
‘ কতগুলো মানুষ রেখেছে৷ আপনি কি কাজ করে উল্টিয়ে দিয়েছেন? যে এভাবে নেয়েঘেমে এসেছেন। শার্টটা পাল্টান।
‘ আর বলো না। আমি হাঁটতে হাঁটতেই ক্লান্ত। কোনো কাম কাজ করার আগেই ক্লান্ত।
‘ নবাব সাহেব।
‘ নবাব সাহেবা।
মুখ মোচড়ালো আয়না। বলল
‘ তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে যান। শার্টটা পাল্টান। কি হলো?
অনুরাগ উঠে গেল। হনহনিয়ে শার্ট নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ প্রফেসর! তোর বউ আস্ত একটা অজগর।
আয়না শব্দহীন হেসে ফেলল। এত পাগলছাগল মানুষ নিয়ে সংসার করা যায়?
কালো একটি শার্ট গায়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো অনুরাগ। মুখ ভেজা, চুল ভেজা। আয়না তাকে দেখে ভাবলো,এভাবে চুল ধুতে হয় আশ্চর্য তো!
ধপাস করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো অনুরাগ। বলল
‘ শান্তি।
‘ মাথা না মুছে শুয়েছেন কেন? আমার বিছানা ভিজিয়ে ফেলছেন। উঠুন। আরেহ উঠুন না। মাথা মুছুন আগে। প্রফেসর?
অনুরাগ বেডশীট মাথা মুছতে মুছতে বলল
‘ আমাকে ভয়াবহ এক রোগে ধরেছে আয়নামতী । আমি কখনোই এরকম ছিল না। আমার আজকাল অগোছালো থাকতে ভালো লাগে। বউকে জ্বালাতে ভালো লাগে। বউয়ের কাজকাম বাড়ায় দিতে ভালো লাগে।
আয়না বলল
‘ শয়তানে পেয়েছে।
খিক খিক করে হাসা শুরু করলো অনুরাগ। বেডশিটটা পুরো কুঁকড়ে গেল। আয়না বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ আমার কুঁচিটা হচ্ছেনা ঠিকঠাক। আপনার এসব ভালো লাগছে না আমার।
অনুরাগ মাথা তুলে আয়নার দিকে তাকালো। আয়না শাড়ির আঁচলটা ফেলে ঝাঁপিয়ে দিল নিজেকে। বলল
‘ ওভাবে কি দেখেন?
‘ আমার বিয়ে করা বউকে দেখি ভাই। তোমার কি তাতে?
‘ পারলে আমার কুঁচিটা ঠিক করে দিন। আমাকে যেতে হবে।
‘ বললাম না। যেই শুয়েছি সেখানে ও জ্বালা। কেউ দেখতে পারেনা আমার ভালা।
‘ বেশি কথা বলেন কেন?
বিছানা থেকে নেমে এল অনুরাগ। ঢিলে পায়ে হেঁটে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসলো আয়নার সামনে। কুঁচি গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে পিনআপ করে দিল। বলল
‘ এবার ঠিক আছে?
আয়না মাথা নাড়িয়ে হাসলো। বলল
‘ কুহেলীর শাড়ি ও এভাবে ঠিক করে দিতেন নাকি?
অনুরাগের চেহারায় কালো ছায়া পড়লো । আয়না হেসে ফেলল। বলল
‘ করেননি বললেই তো হয়। আমি কষ্ট পাওয়ার মতো কিছু বলিনি।
‘ দিয়েছি অনেক বার। কোমরে ও গুঁজে দিয়েছি। গয়না পড়িয়ে দিয়েছি। নূপুর পড়িয়ে দিয়েছি। বিয়ের দিন আংটি পড়িয়ে দিয়েছি। কতবার চুল আঁচড়ে দিয়েছি। আরেহ সে কত রঙ লীলা প্রেম লীলার কাহিনী। সব তোমাকে বলতেই লজ্জা করে।
‘ হয়েছে হয়েছে।
আয়নার গলা আধভাঙা।
‘ কেমন বেয়াদব ছিলেন সেটা বুঝতে পারছি আমি। আর বিবরণ দিতে হবে না।
‘ আমার বিয়ে করা বউ ছিল। যা ইচ্ছা তাই,,
‘ বললাম তো ভালো কাজ করেছেন। আশ্চর্য আমি ওসব শুনে কি করব?
‘ তুমিই তো জিজ্ঞেস করলে।
এক এক করে চুড়ি খুলতে শুরু করলো আয়না। অনুরাগ বলল
‘ আবার কি হলো?
‘ আমি পড়িনা এসব চুড়ি। লাল কালো চুড়ি কেউ পড়ে নাকি? ওসব কুহেলী পড়তো। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন কখনো আমি কেমন চুড়ি পছন্দ করি?
‘ আরেহ মাথা খারাপ নাকি? খুলবে না আয়নামতী। খবরদার। আমি জানি এসব তোমার পছন্দ হয়েছে। আয়নামতী?
আয়না সবটা খুলতেই থাকলো। নাকের ডগায় টসটসে রাগ। চেপেচুপে থাকা তীব্র অভিমান। ক্রোধ, আক্রোশ।
অনুরাগ এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরে ফেলল চট করে। টেনে হাতটা তার পিঠের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁত চেপে বলল
‘ সমস্যা কি? হাহ?
আয়না সেই হাতটা দিয়ে অনুরাগের পিঠের শার্ট খামচে ধরলো। বলল
‘ শার্টটা ছিড়ে ফেলব একদম। ছাড়ুন।
অনুরাগ কথা দিল না। হাতটা ছাড়লো না। সামনে এনে উপর করে ধরলো। খুলে ফেলা চুড়িগুলো আবার পড়িয়ে দিতে দিতে বলল
‘ হায়রে মেয়ে মানুষ! এদের মন বুঝা দায়। আমি কই যাই ভাই? কোথাও শান্তি নাই।
‘ হাতটা ছাড়তে বলেছি। প্রফেসর?
‘ ডাকটা সুন্দর। ভালো লাগে শুনতে। বারবার ডেকো।
‘ আপনি ছুঁবেন না বলে এখানে এনেছেন আমায়৷ এখন আর ও বেশি বেশি,,
আর কিছু বলতেই দিল না অনুরাগ। বলে বসলো
‘ আরেহ আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছি এইবার আর ও বেশি বেশি করে ছুঁবো। আমার বউ, আমি ছুঁবো না তো কে ছুঁবে? আমি ছুঁবো, ছুঁবো,ছুঁবো। বেশি বেশি করে। অনেক বেশি।
‘ আমার হাতে লাগছে।
‘ তুমি চুড়ি না পড়লে আমার আর ও বেশি লাগবে। আমি পছন্দ করে এনেছি। শুধু কুহেলী কুহেলী করো কেন সবসময়? একটা নষ্টা কীটের সাথে নিজের তুলনা করতে বাঁধে না?
উত্তর এল না আয়নার কাছ থেকে।
‘ চেইন আর আংটিটা বানাতে দিয়েছি বিয়ের পরদিন। পছন্দ হয়েছে তোমার? ইউনিক ডিজাইন দিয়েছি।
‘ পছন্দ হয়নি।
অনুরাগ আর জবাব দিল না। ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে চেইন আর আংটিটা নিল। আয়না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বলল
‘ আপনি এখান থেকে চলে যান তো। মাথা খারাপ করতে এসেছেন।
কাঁধে বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া লাগলো ঠিক তখনি। কেঁপে উঠে আয়না বলল
‘ কি করছেন?
অনুরাগ চেইনের হুক লাগিয়ে দিতে দিতে বলল
‘ একদম চুপ। বাঁচাল মেয়ে মানুষ। বউ হয়েছ নইলে এক চড় দিয়ে সোজা করে ফেলতাম। তোমার মতো পুঁচকি মেয়েকে এক ধমকে সোজা করার মতো রেকর্ড আছে ভার্সিটিতে। খোঁজ নিও।
রাগে ফোঁসফোঁস করলো আয়না। চলে যেতে চেয়ে ও যেতে পারল না। অনুরাগ চেইনটা ধরে আছে এখনো। পালাতে গেলেই গলায় ব্যাথা পাবে।
‘ হয়েছে আপনার? যেতে তো দিন।
তখনি উদরে বলিষ্ঠ আঙুলের কিলবিল বিচরণে, গায়ে শিহরণ জাগলো আয়নার। চোখ হলো স্বাভাবিকের চাইতে বড়। শুকনো ঢোক নেমে গেল কন্ঠনালি বেয়ে।
ঝামটি মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো আয়না। অনুরাগের হাতের উপর নিজের দুহাতের বল প্রয়োগ করে বলল
‘ আমি ছাড়তে বলেছি। উফফ জ্বালাতে এসেছেন আমায়।
অনুরাগ হাতটা তুলে ধরলো তার। কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিল। কানের কাছে আলগা চুলগুলো বেরিয়ে পড়লো তার তপ্ত নিঃশ্বাসে। গন্ধরাজের তীব্র ঘ্রাণ এসে নাক বন্ধ করে দিল আয়নার। হাতটার উপর বেশ দীর্ঘ এক ভেঁজা চুম্বন বসলো ঠিক তখনি। চট করে হাত নামিয়ে নিল আয়না।
‘ আমাকে যেতে দিন।
অনুরাগ যেতে দিল না। ঝুমকো কানের দুলটা ফুঁ দিয়ে নাড়িয়ে দিল। দুলতে লাগলো সেটি। পানি মুড়ে থাকা চুলগুলো ঘাঁড়ে ছোঁয়া পেল। ভেজা চুলের পানি, আর উষ্ণ অধরের প্রতিটি ছোঁয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠলো আয়না। ডান গালে পাশটায় এসে ঠেকলো একটি হাতের তালু। বাম পাশটায় কাঁটাতারের মতো বিঁধে গেল কিছু। নরম গালটাতে মৃদুভাবে নিজের সদ্য ছোটছোট করে রাখা দাঁড়ি দিয়ে ঘষে দিল অনুরাগ। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল আয়নামতী। কি যেন বিড়বিড় করলো। নিঃশব্দ হাসলো অনুরাগ। নিজের দিকে চট করে ফিরিয়ে নিল আয়নাকে। দু’হাতে কোমড় টেনে এনে নাক ঠোঁট ডুবালো গলায়।
‘ আমি ভিজে যাচ্ছি। চুল ভেজা আপনার। সরুন।
‘ মুছবার দরকার পড়বেনা।
হাত পা জমে গেল আয়নার। যে স্পর্শগুলো, ছোঁয়াগুলো, বাকশক্তি কেড়ে নেয়, যে চাহনি এলোমেলো করে দেয় সবটা, যে উষ্ণ সোহাগে পাথর মনে ভাঙন ধরে, আর যে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে থাকলে নিজেকে সুরক্ষিত মনে হয়, আর শক্ত বুকে মাথা ঠেকলেই শান্তি অনুভব হয় সেসবকেই ভালোবাসা বলে বুঝি?
ভালোবাসা পাওয়া মানুষগুলো নয়, বরং নিঃস্বার্থে ভালোবাসতে জানা মানুষগুলো খুব সুন্দর হয়।
ভাবনার রেশ কাটতেই আয়না বন্ধ চোখের পাতায় পেল কোমল ছোঁয়া। গন্ধরাজের ঘ্রাণ তখন তীব্র। একেবারে ভেতর কাঁপিয়ে দেওয়া। আয়নার ঠোঁটের কোণায় আলতো হাসির দেখা মিললো। চট করে চোখ মেলে অনুরাগকে দেখে বলল
‘ পাগলরা নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। আপনি সুস্থ একজন মানুষ৷
‘ একটা কথা বলি। কান দাও, চুপিসারে বলি।
আয়না কান দিল। অনুরাগ ফিসফিস করে বলে গেল,
‘ অনুরাগ চৌধুরী আয়নামতী ছাড়া পুরো পৃথিবীর সামনে সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ।
কানে ঠান্ডা ছোঁয়া না মেখেই নিজেকে সরিয়ে নিল আয়না। অনুরাগের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল
‘ আপনাকে আমি ওসব ভালো টালো বাসি ন…..
বাকিটা কি বলতে চাইলো কে জানে? তবে বলতে পারলো না অনুরাগের কারণে। কারণটা ও ভীষণ ব্যক্তিগত।
চলবে,
৪০ পর্বে সমাপ্তি 🥰🥰