#আয়নামতী
#পর্ব_৩৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ, আর দরজার ফটক দিয়ে বারান্দায় এসে পড়া রোদ্দুরের উঁকিঝুঁকি ঘরের ভেতরও । বারান্দায় লাগানো বাগানবিলাসের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো হাতের কনুইয়ে। কপাল কুঞ্চিত হয়ে পড়লো আয়নার। গায়ের উপর চেপে বসেছে ভারী কম্বল। শীতের আগমনী বার্তা আর প্রচন্ড জ্বরে উত্তপ্ত শরীরে প্রচন্ড রকম কাঁপছে সে। ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকালো মাথার উপরে। কিছুদিনের চেনাপরিচিত ঘরটা দেখে হাঁফ ছাড়লো। বাম হাতের শক্তি দিয়ে কম্বল সরাতে গিয়ে আর ও বেশি ব্যাথা অনুভব হলো তার। তবে সরাতে পারলো। বিছানা থেকে নেমে পায়ে স্যান্ডেল পড়তেই হাজির হলো অনুরাগ। গায়ে ছাইরঙা ঢিলেঢালা শার্ট। মাথার চুলগুলো অবিন্যস্ত। দায়সারা চোখে তাকালো আয়নার দিকে। একটু তীর্যক চোখে তাকিয়ে ড্রয়ার থেকে চাবি জাতীয় কিছু খুঁজে আবার চলে গেল। আয়না ভাবলো
‘ আশ্চর্য! আমার সাথে কথা বললো না কেন?
ভাবনার রেশ না কাটতেই অনুরাগ আবার ফিরে এল। ডাকল
‘ আয়নামতী?
‘ কি ?
অনুরাগ জবাব দিল না। আয়না হেঁটে বাথরুমে ঢুকলো। মুখ হাত ধুয়ে আসতেই অনুরাগ নিজের কাজ করতে করতে পুনরায় ডাকল
‘ আয়নামতী?
‘ কি হয়েছে? আশ্চর্য!
অনুরাগ বেশ বিরক্ত। বলল
‘ আহা! উত্তর দাও কেন? আমি ডাকতেই থাকব, তুমি শুনতেই থাকবে।
‘ যতসব পাগল।
বলেই হনহনিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল আয়না। অনুরাগ তার পিছুপিছু দাওয়া করে বলল
‘ আয়নামতী সবাইকে কিছু বলবে না। আমি যা বলার বলেছি। জোর করলে ও চুপ থাকবে।
আয়না চট করে পিছু ফিরলো। হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় অনুরাগের মুখোমুখি পড়লো। ভুরু উঁচিয়ে বলল
‘ আমাকে কথা বলতে কখনো দেখেছেন তাদের সাথে?
অনুরাগ বোকাসোকা হাসলো। ঘরের দিকে ইশারা করে বলল
‘ তাহলে তো আমি এখন নিশ্চিন্তে ঘরে যেতে পারি রাণীসাহেবা?
‘ কেন নয়?
চলে গেল অনুরাগ। আয়না ও চললো। তবে খাবার টেবিলের কাছাকাছি যেতে না যেতেই শায়লা বেগমের মুখোমুখি হতে হলো।
‘ নাতবৌ হাত পা ভেঙে এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার?
আয়না জবাব দিল না৷ আনহিতা পা টেনে টেনে আসলো। বলল
‘ বৌমা তোমার বাড়িতে জানিয়েছ? মানে ওনারা তো চিন্তায় থাকবেন।
অনুরাগের গলা ভেসে আসলো।
‘ আমি জানিয়ে দিয়েছি মা । বলেছি সব ঠিকঠাক আছে। ওর অসুস্থতার খবর যেন না যায়। ওর পরিবার চিন্তায় পড়বে।
আনহিতা আরও কিছু বলতে চাইলো তবে আয়নার গম্ভীর মুখখানা দেখে আর কিছু বলার সাহস করে উঠলো না। শায়লা বেগম অনুরাগের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মিনমিন করে বলল
‘ দাদুভাই এর সাথে কিভাবে থাকো? আমি কথা বলতো গেলেই গুলিয়ে ফেলি। কি ভয়ানক মেয়েরে বাবা।
অনুরাগ মাথা একটু নিচু করে ফিসফিসিয়ে বলল
‘ আতঙ্কের অপর নাম আয়নামতী দাদীজান। জ্বালারে জ্বালা, মুক্তি নাই শালা।
ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল শায়লা বেগম। নাতির কান টেনে ধরে একটু নিচে নিয়ে আসলো। ফিসফিস করে বলল
‘ আমাদের একটা খেলার সাথী এনে দিতেই তো পারো। মেয়ে মানুষের স্বামী সংসারে মন বসে কোলে বাচ্চাটাচ্চা এলে।
অনুরাগ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। বলল
‘ অন্তত শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে বাঁচতে দাও ভাই। কুবুদ্ধি শিখিয়ে মারার পরিকল্পনা করছ?
শায়লা বেগম আবারও হেসে ফেললেন।
__________
বাড়ির ডাক্তার এসে ব্যান্ডেজ পাল্টে দিল আয়নার ডাম হাতটার । ঠিকঠাক ঔষধ খেতে বলল। অনুরাগ বলল
‘ রাগ কমার ঔষধ থাকলে দিয়ে যান ডাক্তার। কারণে অকারণে রাগা ও একটা রোগ। তাই না?
‘ হ্যা। রোগ তো বটে।
আয়না সেখান থেকে উঠে ঘরে চলে গেল। ডাক্তার বলল
‘ এখন ও কি রাগ দেখালো?
অনুরাগ বলল
‘ হ্যা। বললাম না হাঁটতে, বসতে, খেতে, ঘুমাতে ও রাগ। আমি রাগের রাজ্যে বসবাসরত এক অসহায় জীব।
ডাক্তার হেসে উঠলো উচ্চস্বরে।
_______________
মাত্র এশার আজান পড়েছে। অনুরাগ বাড়ি ফিরলো মাত্রই। বোয়ালখালী গিয়েছিল সকালে। ঘরে গিয়ে আয়নাকে দেখলো না। বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নিল। অনেক্ক্ষণ সময় পার হওয়ার পর ও আয়নাকে দেখলো না। তখন বসার ঘরে চলে এল। আনহিতা বলল
‘ সোহাগ খেতে দেব কিছু? মুখ হাত ধুয়েছ?
‘ আয়না ঘরে নেই মা।
‘ সে কি? কোথায় গেল তাহলে?
‘ কেন রান্নাঘরে নেই?
‘ না নেই তো।
অনুরাগ বিরক্ত হলো। বলল
‘ একটা মানুষ কি হাওয়া হয়ে গেল বাড়ি থেকে? আশ্চর্য!
অনিমা বলল
‘ বাইরে দেখ। তোর বউকে উঠোনের দিকে বের হতে দেখেছি আমি।
অনুরাগ কোনো কথা না বলেই বের হয়ে গেল। দারোয়ান বলল
‘ বৌরাণি তো বাগানের দিকে গিয়েছেন স্যার।
অনুরাগ আবার বাগানের দিকে রওনা দিল। এত রাতে ওইদিকে কি আয়নামতীর? সাহস তো কম না। বাগানের অনেকটা কাছাকাছি যেতেই সে থামলো। দেখলো আয়না বেরিয়ে আসছে,সাথে কালো বোরকা পড়া একটা মেয়েমানুষ । আয়নার গায়ে শাড়ি আর পড়নে পাতলা চাদর।
অনুরাগ আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বোরকা পড়া মেয়েটি চলে গেল দ্রুত। আর আয়না চলে এল বাড়িতে।
অনুরাগ তার পেছন পেছন বাড়ি চলে এল। আয়না তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল
‘ কখন ফিরেছেন?
‘ অনেক্ক্ষণ। কোথায় গিয়েছিলে তুমি এমন সময়?
আয়না চাদরটা রেখে দিল। বলল
‘ বাগান দেখতে গিয়েছি। আপনি এত জেরা করছেন কেন? আমি কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব নাকি?
‘ হাত পা গুটিয়ে রাখতে কখন বলেছি? তুমি সঠিক কথাটা কেন বলছ না? মিথ্যে অপছন্দ আমার আয়নামতী।
আয়না তেড়ে এল। বলল,
‘ সত্যমানব সাজতে আসবেন না একদম। কতটা অপছন্দ করেন সেটা ভালো করেই জানা আছে আমার। মিথ্যে বলে ডেকে নিয়ে গিয়ে জোর করেননি আমার উপর?
‘ একবার করেছি। অনুতপ্ত ও হয়েছি। পছন্দ ধরে রাখতে অপছন্দের কাজ করা যায়।
‘ হ্যা হ্যা সব করা যায়। শুধু আমিই কিছু পারিনা। করেন আপনার যা ইচ্ছা। আমাকে ও বাঁধা দেবেন না।
বলেই আয়না চলে যাচ্ছিল। অনুরাগ হাত ধরে টান দিল৷ সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে বলল
‘ আমাকে আবার কি শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছ আয়নামতী?
আয়না শান্ত চোখে তাকালো। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
‘ অনেক সুযোগ ছিল আমার কাছে। চাইলেই শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু আমি চাইনি। কারণ শাস্তি আপনি এই মুহূর্তে ও পাচ্ছেন। আশ্চর্য আমি আপনাকে কোনোরকম শাস্তি দিচ্ছি না তারপরও আপনি পাচ্ছেন৷ এখানেই শান্তি লাগছে আপনার।
‘ সবাই তো বুঝতে পারো। তাহলে এই শাস্তি শেষ হবে কখন?
‘ হবে না কখনো।
অনুরাগ মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ আচ্ছা।
______________
প্রায় অনেকগুলো দিনপর আয়না নিজের বাগানবাড়ি দেখতে গেল। নিজ হাতে যত্ন না করলে ভালো ফুল হলেও তার মন ভরেনা। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বাকি রয়ে গেছে। আয়না ভাবলো সব পারিশ্রমিক একসাথে শোধবোধ করে দেবে কিন্তু গিয়ে জানতে পারলো অনুরাগ সব মিটমাট করে ফেলেছে। আয়না ওদের উপর রাগারাগি করলো। রহমত আয়নার কাছ থেকে এমনিতেই লুকিয়ে থাকার চেষ্টায় থাকে ওই ঘটনাটির পরে। মনে হয় আয়না তার উপর প্রচন্ড রেগে আছে।
আয়না বিষয়টা ধরতে পারলে ও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চাপা রাগ এখনো আছে তার। রহমত ওইদিন তাকে সাহায্য করলে বিয়েটা হত না। রহমত ও সেদিন হাত মিলিয়েছিল প্রফেসরের সাথে।
বিছানায় বসে পায়ে মোজা পড়ছিল অনুরাগ। বাইরে যেতে হবে তাকে। যা ঘটে গেছে। এইবার একটু শক্তপোক্তভাবে মাঠে নামা দরকার। নিজের দুর্বলতাগুলো ঢেকে রাখা দরকার। আয়না ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই অনুরাগকে দেখলো। বলল
‘ ওদের টাকা দিতে কে বলেছে? আমার হয়ে টাকা কেন দিয়েছেন? ওইটা আমার ব্যবসা। আপনি মাঝখানে এক একটা কাজ করে সব এলোমেলো করে দেন কেন? আমি আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিনা। আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!
‘ আমি বেরোচ্ছি আয়নামতী। বাড়ি ফিরে তোমার সাথে কথা সেড়ে নেব।
‘ কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
‘ সাতকানিয়ার দিকে যাব। ফিরে আসব।
‘ যান তবে একলা নয়।
‘ একলাই যাইতে হবে। সঙ্গে কেহ নাই।
‘ মশকরা করবেন না প্রফেসর। অনেক মানুষ আছে আপনার। আপনি বেশি পন্ডিতগিরি দেখান।
‘ ভয় পাচ্ছ? হারানোর?
‘ থাকলেই তো হারাবে।
অনুরাগ মোজা পড়ে জুতো পায়ে দিল। এগিয়ে এল আয়নার দিকে। বলল
‘ আছি তো।
আয়না চোখ তুলে তাকালো। বলল
‘ শত্রুদের সাথে লড়তে শিখুন। এসব ছাড়ুন।
‘ কোনগুলো ছাড়তে বলছ? তোমাকে?
‘ আপনার পাগলামিগুলোকে।
অনুরাগ চুপ করে থাকলো। আয়না চলে যেতে উদ্যত হলো। অনুরাগের কথায় থামতে হলো।
‘ ভালোবাসতে বারণ করছ?
আয়না ফিরলো তার দিকে। বলল
‘ পাগলামো কমাতে বলেছি। এসব পাগলামোকে ভালোবাসা বলেনা। আপনি অবুঝ নন।
‘ তাহলে কোনগুলোকে বলে? ভালোবাসা বলতে কি বুঝো তুমি? এমন তো নয় কেউ একজনকে খুব ভালোবেসেছিলে। যদি বাসতে তাহলে নাহয় মেনে নিতাম। আমি তোমার কাছ থেকে শিখবো না, বরং তুমি নিজেই আমার কাছ থেকে শিখবে আয়নামতী ভালোবাসা ঠিক কাহাকে কয়?
‘ বারবার আয়নামতী বলে ডাকবেন না। ভালো লাগেনা আমার।
‘ মায়ায় পড়ে যাচ্ছ বুঝি?
‘ মায়া হলে মায়া। কিন্তু ভালো কখনো বাসব না আপনাকে।
‘ বাসতে হবে না শুধু মায়ায় পড়ে দেখো। দূরে যেতে ঠিক কতটা কষ্ট লাগে।
‘ লাগেনা আমার। লাগবে ও না৷
‘ তোমার চোখ কথা বলে আয়নামতী। আর আমি তা পড়তে পারি। আমি তুমি নামক আয়নাটিতে আজকাল নিজেকে খানিকটা হলে ও দেখতে পাচ্ছি। তোমার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে অনুভব করতে পারছি। এসব মিথ্যে নয়। বরঞ্চ এর থেকে সত্যি আর কোনোটাই নয়।
‘ আপনার ভুল ধারণা। আমি হয়ত সম্পর্কটা মেনে নেব পরিস্থিতির চাপে কিন্তু আপনাকে নয়। কখনোই না।
‘ সম্পর্কটা মানেই বিয়েটা। আর বিয়ে মানেই দুটো মানুষ। সেই মানুষগুলো আমি আর তুমি আয়নামতী। আমি তুমি ছাড়া সম্পর্কের সংজ্ঞাটা মিলবে না। আমি তো বলেছি, তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবেনা। শুধু থেকো।
শুধু থেকে যাও আমার কুঁচকে যাওয়া ওই বিছানার চাদরটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য। আমার এলোমেলো হয়ে থাকা ঘরটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য। ভালোবাসতে তো বলছিনা। বাইরে থেকে নেয়েঘেমে আসলে শুধু একগ্লাস ঠান্ডা পানি বাড়িয়ে দিও৷ শাড়ির আঁচলটা বাড়িয়ে দিয়ে মুখটা মুছে দিও। মুখ ফুটে দুটো ভালো কথা না বলো কিন্তু চোখ নামিয়ে একটুখানি ভরসা দিও। নিজ থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিতেও বলছিনা। শুধু আমি ধরলে না হয় আরেকটু শক্ত করে ধরো। তোমাকে খুব কাছে আসতে ও বলছিনা। আমি গেলে অন্তত দূরে ঠেলে না দিতে অনুরোধ করছি। ভালো না বাসাটা অপরাধ নয় আয়নামতী, ভালো বাসতে না দেওয়াটাই অপরাধ।
আয়না একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। রান্নাঘরে গিয়ে চামেলিকে বলল
‘ আপনাদের বড়মাকে গিয়ে বলে আসুন ওনার ছেলে আবারও একা একা বের হচ্ছেন৷
চামেলি বলল
‘ আইচ্ছা। কিন্তু আপনেও তো বলতে পারেন।
আয়না ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চামেলি দ্রুত পা বাড়ালো।
অনুরাগ নিচে নেমে এল৷ আনহিতাকে ডাক দিল। তখনি দারোয়ান একটা ফাইল নিয়ে বাড়িতে এল। বলল
‘ বৌরাণির নামে এসেছে।
অনুরাগ নিয়ে নিল। খুলে দেখতেই পেল একটি চিঠি। আয়না এসে কেড়ে নিল সেটি। খাবার বক্স হাতে দিয়ে বলল
‘ বাইরের খাবার খাবেন না । সাবধানে যাবেন। তাড়াতাড়ি ফিরবেন।
বলেই দোতলায় চলে গেল আয়না। অনুরাগ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। শায়লা বেগম বলল
‘ বউ তো ভালোই খেয়াল রাখে।
অনুরাগ মৌন স্বরে বলল
‘ হু। কিন্তু আমি খাবারগুলো নিয়ে যেতে পারব না। ডিনার সবার সাথে সাড়তে হবে।
চলবে,,,,