উত্তরণ পর্ব-৩০

0
659

#উত্তরণ
পর্ব_৩০

ঘরে বজ্রপাত হলেও উজান এতটা চমকাতো না যতটা ও হিয়ার প্রশ্নে চমকে ওঠে. ওর কথা জড়িয়ে যেতে থাকে. প্রানপনে নিজেকে হিয়ার সামনে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে উজান.

উজান: ক۔۔কি ফালতু বকছেন? আমি আ۔۔۔আপনাকে কো۔۔۔কোলে তুলতে যাবো কেন? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি?

হিয়া বেশ উপভোগ করে উজানের তোতলানো۔۔۔

হিয়া: তাই? স্বপ্ন? উহুঁ۔۔۔۔(নিজের একটা আঙ্গুল উজানের প্রায় নাকের ডগায় নাড়িয়ে) একদম মিথ্যে বলবেন না. যেই দেখলেন আমার জ্ঞান নেই, অমনি সুযোগ বুঝে আমাকে কোলে তুলে নিলেন? এখন আবার অস্বীকারও করছেন? আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি۔۔۔

উজান রীতিমতো ঘামতে থাকে۔۔
উজান: আমি কে۔۔۔কেন মিথ্যে বলবো?

হিয়া: কারণ আপনি লজ্জা পাচ্ছেন۔۔۔۔۔ এই আপনার কপালে ঘাম কেন?

উজান হাত দিয়ে ঘাম মুঝে: কোথায়? আপনি আজকাল বেশি বেশি দেখছেন? ঘামবো কেন আমি?

উজান জোরের সঙ্গে কথাগুলো হিয়াকে বললেও কথার জড়তা থেকে ওর ভগ্ন দশা স্পষ্ট.

হিয়া: কারণ আপনার মিথ্যে ধরা পরে গেছে.

উজানের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা۔۔

উজান: আমি কেনো মিথ্যে বলতে যাবো? আর আপনাকে কোলেই বা কেন নিতে যাবো?

হিয়া: কারণ আমি তখন অজ্ঞান, আর এখানে মনে হয় স্ট্রেচারের ব্যবস্থা নেই, তাই অগত্যা কোলে করে আনা ছাড়া উপায় নেই. এদিকে অন্য কেউ আমাকে কোলে তুলুক সেটা আপনি চাননি তাই۔۔۔۔۔ এনিওয়ে, এখন এক কাপ চা আর একটু খাবার পাওয়া যাবে কি? ভীষণ দরকার.

উজান: যাচ্ছি۔۔۔

উজান ওখান থেকে প্রায় দৌড়ে বাইরে এসে জোরে জোরে শ্বাস নেয়, তারপর চোখ বড় বড় করে, নিজের ডান হাত দিয়ে বুকের বাম দিকটা হালকা মালিশ করে ওখান থেকে চলে যায়. উজানের হাতের শক্ত মুঠোয় চিপটা ধরা. ওদিকে হিয়াও উজানের এই পালানো দেখে হেসে গড়িয়ে পরে.

কিছুক্ষন পরে একজন এসে হিয়া কে ওর সাথে যেতে বলে. হিয়া বিনাপ্রশ্নে তাকে অনুসরণ করে একটা অন্য ঘরে এসে পৌঁছোয়. এই ঘরটা আরো ছোটো. ঘরে একটা সিঙ্গেল বেড, একটা রাইটিং ডেস্ক, একটা চেয়ার আর একপাশে ওর লাগেজগুলো রাখা, ব্যস۔۔۔

লোকটি হিয়াকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়, একটু পরে ফিরে আসে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল আর একটা প্যাকেট নিয়ে. সেগুলো কে রাইটিং ডেস্কের উপর রেখে চলে যায়.

হিয়া লক্ষ্য করে এই লোকটি হিয়ার সাথে একটিও কথা বলেনি ওর সাথে এই ঘরে আসতে বলা ছাড়া, তবে তার দৃষ্টিতে একটা সম্ভ্রম ফুটে উঠেছিল হিয়ার প্রতি, যার কারণ হিয়ার অজানা.

বাসবীর কয়েকদিন যাবৎ উজানের সাথে কথা হয়নি তাই ঠিক করে আজ একবার কথা বলবে. একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে ফোনটা করেই ফেলে উজানকে. উজান তখন হিয়ার কাছ থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছিলো, এমন সময় বাসবির ফোন.

উজান: হ্যাঁ মা বলো۔۔
বাসবী: মা ফোন না করলে কি মাকে একটা ফোন করা যায় না ?
উজান: সরি মা. আসলো একটু ব্যস্ত ছিলাম. তাছাড়া তোমার কলেজে তো এক্সাম চলছিল তাই আরোই ফোন করিনি.
বাসবী: এক্সাম স্টুডেন্টরা দেয়, টিচাররা না.

উজান হাসে. উজানের হাসির আওয়াজ বাসবির কানেও পৌঁছোয়. খুশি হয় বাসবী, ছেলেকে তো হাসতে দেখাই যায়না.

বাসবী: এখন তো ফোনই ভরসা, ছেলেকে তো আর দেখতে পাইনা۔۔۔

উজান কিছু একটা দ্রুত চিন্তা করে۔۔
উজান: আমি না আসতে পারলে তুমি চলে এসো۔۔

বাসবী অপ্রস্তুত হয়ে পরে: আমি এখন ছুটি পাবো না রাজা, এক্সামের খাতা গুলো দেখতে হবে. তাছাড়া প্রেসারটাও একটু বেড়েছে, ডাক্তার বেশি মুভমেন্ট বারন করেছে. তুই সাবধানে থাকিস, এখন রাখি কেমন? আবার পরে কথা বলবো. সময় পেলে ফোন করিস.

বাসবী ফোন রেখে দেয়. উজান আবার তাকে সেই কলকাতায় যেতে বলছে যে জায়গাটা পঁচিশ বছর আগে ছেড়ে এসেছিলো. বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট অনুভাব করে. ভয় হয় আবার কলকাতায় পা রাখতে, যদি সমরেশ ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, কি করবে ও? কিভাবে সামলাবে নিজেকে? কেউ না জানলেও বাসবী তো জানে, এই পঁচিশ বছরে সমরেশের প্রতি ওর ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি. বাসবী এখনো জানেনা উজানের সাথে সমরেশের দেখা হয়েছে কিনা. নিজের ভাবনায় তলিয়ে যায় বাসবী۔۔

উজান বাসবীর এই অনীহার কারন খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারে কিন্তু ও জানে ওর পরিকল্পনা সফল করার জন্য ওকে বাসবীকে কলকাতায় আনতেই হবে, আর ও এও জানে এই ব্যাপারে কে ওকে সাহায্য করতে পারে. ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসির রেখা টেনে উজান অফিসের দিকে এগোয়.

উজান অফিসে পৌঁছোয় তারপর নির্দিষ্ট টীম কে চিপ টা হ্যান্ডওভার করে বলে সেটা সিআইএ কে পাঠিয়ে দিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব. সিআইএ ডিকোড করার পর ওদের কাজ শুরু. হাতে সময় খুব কম.

এদিকে সমরেশ কারোর সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পরে۔۔۔

সমরেশ: তুমি আমাকে এতো বড় খবর টা জানলেনা?۔۔۔۔۔۔আগে প্রব্লেম থাকলেও এখন তো নেই۔۔۔۔۔۔তুমি জানতে উজান আমার ছেলে?۔۔۔۔۔۔ও একা?۔۔۔۔۔۔۔ কি? হিয়াও? কেন?۔۔۔۔۔۔۔۔ওহ গড, তোমরা কি করে ভাবলে যে হিয়া যুক্ত থাকতে পারে?۔۔۔۔۔۔۔তাহলে?۔۔۔۔۔۔অসাধারণ, আমাকে একবার জানালে এতো কিছু ঘটতোই না۔۔۔۔۔۔۔۔দেখো, কর্তব্যের খাতিরে আমার সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়েছি কিন্তু আজ যখন আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি তখন তাকে আর একবার হারানোর রিস্ক কিছুতেই নিতে পারবোনা۔۔۔۔۔۔۔۔ বাসবী নিশ্চয় এবারও কিছুই জানেনা۔۔۔۔۔۔۔ ও আর কত কষ্ট পাবে বলতে পারো?۔۔۔۔۔۔۔۔না না, উত্তেজিত হয়োনা বললেই তো আমি শান্ত হতে পারবোনা, আমি এক্ষুনি উজানের কাছে যেতে চাই۔۔۔۔۔۔কখন জানাবে?۔۔۔۔۔۔۔ ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করবো۔۔۔۔۔

ফোন রেখে দেয় সমরেশ. দুশ্চিন্তায় ঘেমে যায় ও, উজানের কিছু হলে আর বাসবী কে সামলাতে পারবেনা. পুরোনো স্মৃতি গুলো ভিড় করে আসে মনে۔۔۔

সমরেশ পেশায় পাইলট হলেও ইন্টেলিজেন্স এর লোক. এই বিশেষ পেশার নিয়ম তো বটেই, কিন্তু পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থেও পরিবারের কাছে লোকাতে বাধ্য হয়েছিল ওর আসল পরিচয়. বাসবী আর চার পাঁচটা সাধারণ স্ত্রী দের দলে পড়েনা. তার সুতীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে কাজ করা ছিলো বেশ কঠিন. সমরেশের এই নিয়ে বেশ গর্বও হত.

সমরেশের গোপনীয়তা ধীরে ধীরে ধরা পড়তে থাকে বাসবীর কাছে. প্রথম প্রথম বাসবী উপেক্ষা করলেও একসময় সে নিশ্চিত হয়. সমরেশের সাথে আলোচনাও করে এবিষয়ে, কিন্তু সমরেশ এড়িয়ে যায় যা বাসবীর সন্দেহ কে আরো বহু গুনে বাড়িয়ে দেয়. সমরেশ ঘুনাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি তার এই গোপনীয়তা তাদের সম্পর্কে ইতিমধ্যে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে.

বাসবীর স্থির বিশ্বাস জন্মায় যে সমরেশ কোনো এমন কোনো কাজের সাথে যুক্ত যেটা ও সবার থেকে লুকিয়ে বেড়ায় আর সেটা কোনো অন্যায় কাজ হবার সম্ভবনাই বেশি. আর্মির মেজর ছিলেন বাসবীর বাবা, তার সন্তান হয়ে কোনো অন্যায় বা অপরাধের সাথে আপোষ করতে নারাজ বাসবী একসময় সিদ্ধান্ত নেয় সমরেশ কে ছেড়ে যাবার. সমরেশ নিজের সত্যিটা চেয়েও বলতে পারেনি বাসবী কে, আবার ডিভোর্সও দেয়নি. বাসবী ও জোর করেনি, শুধু শর্ত রেখেছিলো সমরেশ যেন কোনোদিন তাদের খোঁজ না করে. তারপর বাসবী তার বাবার কাছে নৈনিতাল এ চলে যায় ছোট্ট রাজা কে নিয়ে.

সেই ছোট্ট রাজা আজ এতো বড় হয়ে গেছে. বাবার পথেই চলছে সে আর তার কারণও সমরেশ জেনেছে. সমরেশের সব থেকে কাছের বন্ধু ও সহকারী এখন এই ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের একজন বড় কর্তা. তার অনুপ্রেরণাতেই আজ উজানও সমরেশের পথে. উজানের কাছে যেমন সমরেশের এই পরিচয় প্রকাশিত নয় ঠিক তেমনই উজানের পরিচয়ও সমরেশ আজই প্রথম পেলো۔۔۔

দেখা যাক এরপর কোন পথের বাঁকে মোড় নেয়– উজান-হিয়া-সমরেশের জীবন–!!

(পাঠকগণ সবাই কমেন্ট করবেন—আর কপিবাজ পাবলিকদের সু-স্বাগত কপি করার জন্য🥴)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here