উমা [কপি করা নিষেধ] ২২তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)

উমা [কপি করা নিষেধ]
২২তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)

উমার উপর সুপ্ত রাগ থেকেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ লক্ষী দেবীর। উমা বাধ্য নারীর ন্যায় হেসেলে চলে গেলো। আজকাল মন বড্ড দূর্বল হয়ে গেছে। লড়তেও ইচ্ছে হয় না। রুদ্র এর সাথে কথা হয় নি সেদিনের পর থেকে। উমা রান্না ই করছিলো হঠাৎ ফুলির মা ছুটে আসলো হেসেলে। তার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। যেনো ভুত দেখে পালিয়ে এসেছেন। তরতর করে ঘামছে সে। উমা ব্যগ্র কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে ফুলির মা?”
“বউ ঘরে চলো, রুদ্র দাদায় ফিট খাইয়ে পইড়ে গেছে”

ফুলির মার কথা শুনে চমকে উঠে উমা। রুদ্র এবং তার সম্পর্কটা সেদিনের পর থেকে যেনো থেমে গিয়েছে। তাদের সম্পর্কটা অন্য সম্পর্কের ন্যায় স্বাভাবিক হবার জন্য গুটি গুটি পা বাড়াচ্ছিলো, উমা তাকে নিজ জীবনের একজন অতপ্রত মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলো। কিন্তু সবকিছু যেনো কাঁচের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। রুদ্রের নির্লিপ্ত চিত্তের স্বীকারোক্তিতে কতটা সত্যতা এবং কতটা ছলনা সেটা বোধগম্য হচ্ছে না উমা, বিমর্ষ আহত হৃদয়টা পুনরায় আহত হবার ভয়ে এক লুকোনো প্রকোষ্ঠ্যে নিজেকে আটকে ফেলেছিলো। কিন্তু ফুলির মার ব্যাগ্র কন্ঠে কথাটা কর্নকুহরে যেতে নিবৃত্ত চিত্ত অস্থির হয়ে উঠলো উমার। চুলোর রান্নাটা সেভাবে রেখে ছুটলো সে রুদ্রের নিকট। নিজ ঘরে পৌছাতেই নজরে পড়লো শ্বশুর, শাশুড়ি এবং পিসি শাশুড়ি সেখানে গোল বেধেছেন। রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে রয়েছে, ডাক্তার ডাকার জন্য দীপংকরকে পাঠানো হয়েছে। দীপংকর অভিনব সিংহ এর খুড়তোতো ভাইপো। সে ছোট বেলা থেকেই অভিনব সিংহের কাছেই মানুষ। সে মূলত গুদামে থাকতো। কিন্তু আজকাল ঘরের থাকা শুরু করেছে। অভিনব সিংহ পুলিশি কান্ডের পর ঘর থেকে বের হন না। দীপংকর তাকে সকল কার্যে সাহায্য করে। অপরদিকে রুদ্রের ভাব যেনো এমন যেনো কিছুই ঘটে নি। সে তার মতো কাজে লিপ্ত। কালীগঞ্জের বাড়িতে কাজ শুরু করে দিয়েছে, নিজের দোকানেও মনোনিয়োগ করছে। রুদ্রের এমন পরিবর্তন অভিনব সিংহকে বড্ড ভাবাচ্ছে।

রহিম ডাক্তার এলো। নাড়ি মেপে বললো,
“প্রেসার কম অভিনব বাবু। ছেলে মানুষের এত কম প্রেসার হলে তো মূর্ছা যাবেই। রুদ্রকে এখন থেকে দিনে তিনটে করে ডিম এবং এক পোয়া দুধ খেতে হবে। দুদিন বিছানায় গড়ালেই ঠিক হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা”

রহিম ডাক্তারের ফর্দ শুনে খিঁচিয়ে উঠলো রুদ্র। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমি কি রাক্ষস নাকি?”
“রাক্ষস হবে কেনো? আমি তাই বললাম যা তোমার শরীরের দরকার। উমা মা, তুমি একটু খেয়াল রেখো তো। রুদ্র যেনো খাবারটা সময় মতো খায়।“

উমা ঘাড় কাত করলো। লক্ষী দেবী মুখ বাকালেন, মনে মনে বললেন,
“ও রাখবে খেয়াল। আমার ছেলেটার মাথা গিলতেই তো এসেছে এই মেয়ে।“

রহিম ডাক্তার যাবার পর অভিনব সিংহ থমথমে গলায় বললো,
“দেখেছো রুদ্র কি হয়েছে? টাগড়া ছেলে কিনা মূর্ছা গেছো। আমি বলি কি কালীগঞ্জ যাবার জিদ ছাড়ো। অতদূরে যেয়ে কি হবে বলো। এর চেয়ে তুমি গুদাম সামলাও। বউ মা না হয় আশেপাশের কোনো কলেজে ভর্তি হবে।“
“আপনি জানেন, আমাদের গ্রামে কলেজ নেই। কলেজ অধিকাংশ শহরের দিকে। ভালো কলেজ একখানা আছে তাও কালীগঞ্জে। আমি উমার পড়াশো্নার সাথে কোনো প্রকার হেলদোল করবো না। আমি আর শাশ্বত তো ঐ কলেজেই পড়েছি। উমাও পড়বে। আমরা তো ওখানেই থাকতাম। আপনি ও জানেন কালীগঞ্জ থেকে গ্রামে আসতে পৌনে এক ঘন্টা লাগে, আর রাস্তাটাও দূর্গম। আমি চাই না উমা প্রতিনিয়ত এতো কষ্ট করে যাতায়াত করুক। তাই কালীগঞ্জে আমার আর উমার যাবার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।“

জড়তাহীন কন্ঠে কথাটা বলে রুদ্র। অভিনব সিংহ কোনো কথা বললেন না। হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন। লক্ষী দেবী হিনহিনে স্বরে বললেন,
“তুমি খোকার কাছে থাকো। আমি হেসেলে গেলুম, ডিম সিদ্ধ পাঠাচ্ছি। খাওয়ায়ে দিবে খোকাকে”

উমা ঘাড় কাত করলো। সকলে চলে গেলে সে বিছানার কাঠ ধরে দাঁড়ালো। রুদ্র কোমল দৃষ্টিতে তাকালো তার ষোড়শী বউ এর দিকে, মেয়েটির শ্বেত মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। হাতে এখনো হলুদ লেগে আছে। হয়তো ছুটার সময় হাত ধোওয়ার কথাটাও স্মরণ ছিলো না তার। রুদ্র নমনীয় স্বরে বললো,
“শুনো”
“কিছু লাগবে?”
“হু”

উমা এগিয়ে গেলো তার কাছে। ব্যস্ত স্বরে বললো,
“কি লাগবে?”

রুদ্র কিছু বললো না, শুধু শান্ত নজরে উমাকে দেখতে লাগলো সে। পাঁচ দিন হয়ে গেছে মেয়েটি তার সাথে কথা বলে না। অন্য সময় হলে তাকে জোর করত, কিন্তু উমার মন যে অবাধ্য। অবাধ্য মন জোর করে দখল করা সম্ভব নয়। মেয়েটির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম খাটে না, খুব অন্য রকম সে। শান্ত দীঘির ভেতরেও সমুদের উত্তলতা তার মাঝে। কেবল একখানা মাংসের দলা নয়, যাকে গায়ের জোরে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসবে রুদ্র। উমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার অন্তরে নিজের দখল অসম্ভব। রুদ্রকে চুপ থাকতে দেখে উমা বলে,
“কি লাগবে বললেন না যে? বলুন, আমি এনে দিচ্ছি”
“বেশ, আমার একটা সুযোগ চাই।“

নির্লিপ্ত চিত্তে কথাটা বলে রুদ্র। তার কাতর দৃষ্টি ছিন্নভিন্ন করছে উমাকে। উমা নত মাথায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখটা জ্বলছে। বুক চিরে এক দলা কান্না পাচ্ছে। বা পাশে প্রচন্ড বিষাদ বেদনা অনুভূত হচ্ছে তার। রুদ্র তার হাতটা টেনে ধরলো। আকুল কন্ঠে বললো,
“আমি কি শেষ সুযোগ পাবার অযোগ্য উমা?”

দ্বিধায় জর্জরিত উমা, কি উত্তর দিবে বুঝে উঠছে না। মস্তিষ্ক বাড়ে বাড়ে বলছে রুদ্র মিথ্যুক, একজন পাষান কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সে বদলাবে না কখনোই। অপরদিকে হৃদয় বলছে, একটিবার সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হবে। ষোল বছরের জীবনে খুব কম মানুষই উমার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রুদ্র তাদের পাশে একজন। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেনো, হয়েছে তো। রুদ্র যেমনই হোক সে উমার সামনে নিজেকে খুলে ধরেছে। তার সকল সত্যি উমাকে বলেছে সে। তবে কি একটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নয় সে। কাঁপা জড়ানো কন্ঠে উমা বলে,
“আমি সত্যি জানি না, আপনাকে কি উত্তর দিবো। আপনাকে বোঝার ক্ষমতা যে আমার নেই, যতবার বুঝতে চেয়েছি আহত হয়েছি। পুনরায় বিশ্বাস করার সাহস আমার স্নায়ুকোষে নেই। আপনার রাগ, ক্রোধের কোনো সীমা নেই। রাগ হলে আমাকে হয়তো………”
“ আদপি না, নিজের প্রানপাখির ক্ষতি করার মতো সাহস যে আমার নেই উমা”
“তাহলে কেনো বা্রে বারে আমাকে আহত হতে হয়। আজ আপনি এ কথা বলছেন, কাল পুনরায় আপনি হয়তো কাউকে পিঠাবেন, কারোর রক্ত আপনার হাতে লাগা থাকবে। পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমার এমন অনিশ্চিত জীবন চাই না রুদ্র। যে জীবনে সুখের মাত্রা ক্ষনস্থায়ী, আমার এমন জীবন চাই না। আমি এই ছোট জীবনে সুখের দেখা খুব কম পেয়েছি। এভাবেই আমি অভ্যস্ত। স্বপ্ন দেখার মনটা আমার মরে গেছে। পুনরায় স্বপ্ন দেখতে ভয় হয়। এই বুঝি আকাশ সমান আখাঙ্খাটা এক ঝটকায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।“

উমা জল ছেড়ে দিলো। কোমল গাল বেয়ে নোনাজলের স্রোত গড়াচ্ছে। উমার জল যেনো তীরের মত বিধছে রুদ্রের বুকে। নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না সে। তড়িৎ গতিতে উমাকে জড়িয়ে ধরলো সে। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে বললো,
“কথা দিচ্ছি উমা, আর কখনো তোমাকে অভিযোগের সুযোগ দিবো না। কখনো তোমার কাজলকালো চোখে অশ্রুর বিন্দু জমতে দিবো না। কথা দিলাম”

উমা মুখ তুলে চাইলো। রুদ্র তখন পরম আদরে তার অধরজোড়ায় গভীর ছোয়া একে দিলো। আজ কেনো যেনো উমা বাধা দিলো না। অভিমানের প্রাচীর ভাঙ্গছে ধীরে ধীরে। ঘরের নৈঃশব্দ্যতা ভালোবাসার উষ্ণ আবেশে মুখোরিত হলো……………

চলবে

[ প্রথমেই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তকাল দুতো পর্ব দেওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আমি একটা পর্ব ই দিয়েছি। আমার একটি দূর্ঘটনায় আমার মোবাইল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস আমার কিছু হয় নি আলহামদুলিল্লাহ। মোবাইল ভেঙ্গে যাবার কারণকে আমি গতকাল গল্পটা দিতে পারি নি। তার আজ পুষিয়ে দেবার চেষ্টায় আছি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

২২তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/428110048910773/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here