উমা [কপি করা নিষেধ] ২২তম_পর্ব

উমা [কপি করা নিষেধ]

২২তম_পর্ব

রুদ্রের শান্ত কন্ঠ গায়ে কাঁটা দেয় উমার। রুদ্রের চোখজোড়া স্থির। সে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। রুদ্র এবার উঠে দাঁড়ালো, উমার মুখোমুখি হয়ে ধীর স্বরে বলল,

“আমি আগেও বলেছি, আজ আবার বলছি, আমি মানুষটা ভালো নই। খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা তোমার কাছে এসেই থেমে যায়। আমি এই প্রথম কাউকে মারি নি। আমি সেদিন যখন কাজে গিয়েছিলাম, বাবার কাজে তখন ও কাউকে মেরে এসেছি। সেই লোকটা এখন হাসপাতালে। আমি তো মারার জন্য ফেলে আসতে চেয়েছিলাম। দীপঙ্কর ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বললাম। এবার সিদ্ধান্ত তোমার, যদি তোমার মনে হয় আমি ভুল তাহলে আমি ভুল। আমার কিছুই বলার নেই।“

রুদ্র সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। উমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ষোড়শীর পরিশ্রান্ত দৃষ্টিত চেয়ে থাকে মাটির দিকে। ঘরে তীব্র নীরবতায় লাল ঘরটা ছেয়ে আছে। শুধু বা পাশের দেয়ালের দোলনঘড়িটার টিকটিক শোনা যাচ্ছে। রুদ্র বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায়, সিগারেটের প্যাকেটটি খুলে একটা নিকোটিনের দলা আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বালায়। সুগাঢ় আধারে ধপ করে একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে, তার উদাসীন কাতর চাহনীতে তাকিয়ে থাকে আধারের মেঘের মাঝে উঁকি দেওয়া এক চিলতে রুপালী চন্দ্রের দিকে। সিগারেটের জ্বলন্ত নিকোটিনের ধোয়া আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে রুদ্রের মনের সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস।

১৩.

টঙ্গে বসে রয়েছে শাশ্বত, অবশেষে শাহাদাতের খোঁজ পাওয়া গেলো। কিশোরগঞ্জের এক প্রতন্ত হাসপাতালে সে ভর্তি। অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরনের জন্য কোমায় চলে গিয়েছে সে। ডাক্তার কিছুই বলতে পারছে না, তার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তবে তার চিকিৎসার কোন ত্রুটিও হচ্ছে না। তাকে একজন অর্থবান ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেই তার চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিয়েছেন। শাহাদাতকে কিশোরগঞ্জের মত জায়গায় পাওয়াটা বেশ অবাক করছে শাশ্বতকে। ডাক্তারদের বক্তব্য সে একটি সড়ক দূর্ঘটনার কারণেই আহত হয়েছে। সঠিক সময়ে তাকে হাসপাতালে আনার কারণে সে বেঁচে গিয়েছে। ব্যাপারগুলো খুব সাজানো লাগছে। যেনো বহির্গত কেউ একের পর এক দাবার ঘর সাজিয়ে রেখেছে। সেই অনুযায়ীই কাজ করা হচ্ছে। সকল ঘটনাগুলো দাবার গুটির মত এক এক কদম করে আগাচ্ছে। বুঝতে পারলেও প্রমান করার উপায় নেই। বাপ ছেলে সুন্দর মত পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। শাহাদাতের দূর্ঘটনাটি হয়েছে রুদ্রের বিয়ের রাতে। সেই রাতে রুদ্র বাড়ি ফেরে নি রাতে। দুপুরে মামামশাই শহরে চলে যান। সবকিছু একই মালায় বাঁধা, অথচ প্রমাণের উপায় নেই। শাশ্বত এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সকলে তাকে উম্মাদ ভাববে। যে কাগজ গুলো সে অভিনব সিংহের ঘর থেকে পেয়েছিলো, তাতে অভিনব সিংহকে হাতে নাতে ধরার কোনো উপায় নেই। এদিকে রকিবুল মাষ্টার ও চুপ মেরে আছে। সে যেনো অন্যায়ের বিপক্ষে থেকেও অন্যায়কেই বাহবা দিচ্ছে। হাতের চায়ের কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই চা টা খাওয়া হলো না শাশ্বতের। এর মাঝেই সুরেলা চিকন কন্ঠ কানে আসে।

“এক খানা কলা পাউরুটির দাম পাঁচ টাকা? একি ডাকাতি করছো গো তৈয়ব ভাই”

“দাম বাড়লে আমি কি করাম, পাউরুটি আসে প্যাকেট বিশ টাকা। পিচ তিন টাকা, কলা দুই টাকা। আমার ও তো পেট বুন্ডি। আচ্ছা যাও আমি তোমারে চার টাকায় দিতাছি, এই বার লইবা?”

“তিন টাকাই আছে আমার কাছে। আমার ক্ষুধা লেগে তাই নিচ্ছি নয়তো এই ডাকাতির শেষ দেখতাম।“

শাশ্বত খেয়াল করলো ছোট মেয়েটি সমানে দোকানীর সাথে দু টাকার জন্য ঝগড়া করে যাচ্ছে। মেয়েটিকে বড্ড পরিচিত লাগছিলো শাশ্বতের, পরমূহুর্তে মনে পড়লো মেয়েটি আর কেউ নেই সেই পেয়ারা বনে খুদে পেত্নী। দোকানী তৈয়ব যখন মেয়েটিকে বুঝাতে অসমর্থ হলো তখন শাশ্বত তাকে বললো,

“তৈয়ব ভাই, ছেড়ে দাও। বাচ্চা মেয়ে, দু টাকার জন্য মাথা খাচ্ছো কেনো? আমি দিয়ে দিচ্ছি”

দোকানীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, আমতা আমতা করে বললো,

“জ্বে আচ্ছা।“

দোকানীর কথা বলার প্রায় সাথে সাথে মেয়েটি তেজী গলায় বলল,

“আমার উপর উদারতা প্রয়োগ করার চেষ্টাও করবেন না। আমার খাবারের দাম আমি ই দিতে পারবো। আপনাদের কাছে এই দুটাকাটা মাথা খাওয়া লাগলেও আমার কাছে এটা আগামীদিনের খাবার কেনার টাকা। ভগবান পয়সা দিছে তো তাই গুরুত্ব নেই। এই হলো এই সমাজের সমস্যা, গরীবের টাকা নেই। ধনীর টাকার মূল্য নেই“

মেয়েটির তীব্র প্রতিবাদে হতবাক হয়ে গেলো শাশ্বত। ছোট মেয়ের এতটা আত্নসম্মান তাকে বিস্মিত করলো। মেয়েটি কলা পাউরুটি নিয়ে হনহন করে চলে গেলো। দোকানী আমতা আমতা করে বললো,

“কিছু মনে কইরো না শাশ্বত দা, রাজীর স্বভাব এমন ই। একটু মুখড়া কি না।“

“কোন বাড়িতে থাকে গো?”

“আরে নিখিল দায়ের মেয়ে, রাজশ্বী। উমার ছোট বোন, দুই বোন দু রকম। একজন শান্ত দীঘি তো অপরজন উত্তল সমুদ্র।”

শাশ্বত কিছু বললো না, হাটু অবধি আটপৌড়ে ভাবে শাড়ী পরা মেয়েটির যাবার পানে চেয়ে রইলো সে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। এই হাসির অর্থ তৈয়ব বুঝার উর্ধ্বে।

চুলোর মৃদু আঁচে খাসির মাংস রান্না করছে উমা। আজ তার শ্বশুর মসাই এর বেশ মাংসের ঝোল খাবার ইচ্ছে হয়েছে। তিনি সকালে নিজ মর্জিতে খাসির মাংস কিনে এনেছেন। লক্ষী দেবী উমার হাতে বাজারের ব্যাগখানা ধরিয়ে দিলেন। উমার সাথে পাত্তে কথা বলেন না তিনি। এক শীতল যুদ্ধ চলছে তাদের মাঝে। তার ধারনা তার ছেলেকে হাতিয়ে নেবার বাজে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই ষোল বছরের মেয়েটি। তার পতী বলেছিলেন,
“ছেলে বিয়ে দিলে রুদ্রের উদাসীনতা কমবে।”

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কমার বদলে ছেলেই হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। রুদ্রকে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করার পর ও যে উমাকে নিয়ে কালীগঞ্জে চলে যাবার বায়না ধরেছে। সেখানে নাকি উমার পড়াশোনা ভালো হবে। আরে ভাই পড়াশোনা করে কি হবে! আজ অবধি কি করেছে এতো শিক্ষা দিয়ে। সেই তো হেসেল ই টানবে উমা। উমার উপর সুপ্ত রাগ থেকেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ লক্ষী দেবীর। উমা বাধ্য নারীর ন্যায় হেসেলে চলে গেলো। আজকাল মন বড্ড দূর্বল হয়ে গেছে। লড়তেও ইচ্ছে হয় না। রুদ্র এর সাথে কথায়া হয় নি সেদিনের পর থেকে। উমা রান্না ই করছিলো হঠাৎ……..

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

২১তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/426922705696174/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here