উমা [কপি করা নিষেধ] ২৫তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
২৫তম_পর্ব

উমাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখে শাশ্বত বলে,
“চিন্তা করো না উমা, সব ঠিক হয়ে যাবে।“

শাশ্বতের শান্তনা আদিক্ষেতা ঠেকলো রুদ্রের কাছে। সে তাকে কিছু বলার পূর্বেই ডাক্তারের আগমন ঘটলো। চিন্তিত মুখে তিনি দাঁড়ালেন পরিবারের লোকের সামনে। ডাক্তারকে দেখে রুদ্র এগিয়ে গেলো তার কাছে। উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“রোগী কেমন আছে?”

ডাক্তার মুখোভাব অপরিবর্তনীয় রেখে উত্তর দিলো,
“ভালো না, হার্টের ব্যামো। অনুমান করছি, হার্ট এট্যাক করেছে। রিপোর্ট আসতে দুদিন লাগবে। তত সময় না হয়, হাসপাতালেই থাকুক। আমাদের পর্যবেক্ষনে থাকলে বোধ করি খারাপ কিছু হবে না। তবে বলি কি, শহরের দিকে নিতে হবে। হার্টের ব্যাপার গুলো কিছুই বলা যায় না৷ তাই আপনাদের সিদ্ধান্ত ই সব কিছু। চেয়ারম্যান সাহেবের উপস্থিতিতে বলি, অবস্থা কিন্তু ভালো নেই।”

ডাক্তারের কথায় রতী চাপা আর্তনাদ করে উঠলো৷ রাজশ্বী উমার হাত চেপে ধরলো। উমা নীরব কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। মস্তিষ্ক ফাকা ফাকা লাগছে। বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। কিন্তু সে কাদলে ছোট ভাই বোনগুলোর কি হবে! তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই সারা শরীর হিম ধরে যাচ্ছে। তাই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখলো সে। রুদ্র একবার উমার পানে চাইলো। তারপর ডাক্তারের সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলো। এদিকে অভিনব সিংহ এবং লক্ষী দেবী এগিয়ে এসে উমার কাছে দাঁড়ালেন। অভিনব সিংহ গম্ভীর স্বরে বললেন,
“বউ মা আমাদের যেতে হবে। বিকেল হতে চললো। এখন না বের হলে রাত হয়ে যাবে। রুদ্র এবং শাশ্বত তো আছেই। তারাই দেখে নিবে। বলি কি! ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে না হয় তুমি আমাদের সাথে চলো।”
“আমি যাবো না বাবা, বাবাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কি করে যাই। শুধু শুধু ছটফট করবো। এর চেয়ে বরং আমি থেকে যাই উনার সাথে। আপনার বরং মাদের নিয়ে যান। এতো মানুষের তো এখানে কাজ নেই।”

উমার কথায় মোটেই রাজী হয় না রতী৷ সে নিখিলকে ছেড়ে যাবে না। বলা তো যায় না কখন কি হয়। বিধানা না করুক যদি কিছু হয়ে যায় শেষ দেখাটাও মিলবে না। উমা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“বাড়ি যাও মা, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো। দেখবে সুস্থ হুয়ে বাবা ফিরবে। কেঁদো না, কেঁদে কি হবে বলো। বিধাতা যা ঠিক করে রেখেছেন সে তো হবেই তাই না? গোপালটার মুখটা মলিন হয়ে গেছে। বেঁচারার পেটে কিছু পড়েছে কি না সন্দেহ। তুমি বরং ওদের নিয়ে বাড়ি যাও, বুঝলে। কেঁদো না মা। আমি আছি তো।”

এই প্রথম মায়াময়ী চাহনীতে রতী উমার দিকে তাকায়। উমার কথাগুলো যেনো মনে এক অনন্য শক্তি সঞ্চার করলো৷ মনের আঙ্গিনায় নিভু প্রদীপখানা যেনো তেজ পেলো। অবশেষে রাজশ্বী, গোপালকে নিয়ে অভিনব সিংহের সাথে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রতী। উমা হাসপাতালের বারান্দায় বসে রইলো৷

শাশ্বত অভিনব সিংহ দের এগিয়ে দিতে গেলো। রাজশ্বী ফুপিয়ে উঠছিলো বলে তাকে একটা মাম পানির বোতল কিনে দিলো শাশ্বত। রাজশ্বী নতজানুতে গ্রহন করলো সেটা। শ্যাম মুখখানা কে বেশ পরিশ্রান্ত লাগলো শাশ্বতের কাছে। শ্যাম মুখখানা যেনো আরো বেশি কালো লাগছে, চোখজোড়া কোঠরে চলে গেছে। অবশ্য হৃদয় যখন বেদনাচ্ছন্ন হয়ে থাকে তখন চেহারায় মলিনতা ফুটে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। শাশ্বত স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“পেত্নীরা মানসিকভাবে এতোটা দূর্বল হয় জানা ছিলো না। এতোটা ভেঙ্গে পড়লে চলবে কি করে?”

রাজশ্বী অবাক নয়নে তাকালো শাশ্বতের দিকে। লোকটির কথায় খানিকটা লজ্জাও পেলো সে। শাশ্বত যে তার দিদির দেবর হবে সেটা ভাবে নি সে। রাজশ্বীর নত মুখখানা দেখে শাশ্বত নীরব থাকলো। যাবার পূর্বে নীচু কন্ঠে একটাই কথা বললো রাজশ্বী,
“দিদির দিকে খেয়াল রেখেন”

কথাটা খুব ধীর হলেও শাশ্বতের কর্ণকুহরে ঠিক পৌছালো। শাশ্বত স্মিত হাসির বিনিময়ে সম্মতি জানালো। রাজশ্বীদের বিদায় দিয়ে হাসপাতালে ফিরলো সে। উমা তখনো বসে আছে বারান্দায়৷ তার দৃষ্টি শূণ্য। অশান্ত লাগছে। মনটা হাসফাস করছে তার। শাশ্বত এসে তার পাশে বসলো। কিন্তু তাতে উমার কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে আগের ন্যায় স্থির রুপেই বসে রইলো। হাসপাতালের বারান্দায় এক ভয়ংকর নীরবতা বিরাজমান। এই নীরবতার গাঢ়ত্ব যেনো বাড়ছে সময়ের সাথে সাথে। এক অদ্ভুত জায়গা এই হাসপাতাল, সুখ দুঃখগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। কারোর চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে তো কারোর খুশির কল্লোল। একজনের কিছুক্ষণ পূর্বে পুত্র সন্তান হয়েছে তো একজনের স্ত্রী মাত্র শ্বষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বারান্দা থেকে শব্দ গুলো কানে আসছে উমার। অপ্রকাশ্য এক অনুভূতি যেনো তাকে ঘিরে রেখেছে। চোখ থেকে নোনা জল গড়াচ্ছে না, কিন্তু বুকের বিষাদের কালো ঢেউ উঠছে। উমা তাকিয়ে রইলো মোজায়িকের মেঝের দিকে। মনে মনে এক আকুল নিবেদন ই করলো,
“বাবাকে সুস্থ করে দাও ঠাকুর।”

রুদ্র ফিরলো ডাক্তারের সাথে কথা বলে। শাশ্বত তখন উমার জন্য কিছু খাবার কিনে তার হাতে ধরালো। মেয়েটির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কিছু খায় নি। তাই রুদ্র ফেরার পূর্বেই শাশ্বত ই তার জন্য খাবার কিনে আনলো। কিন্তু গলা দিয়ে রুটির টুকরোটা যেনো নামছে না উমার। সে ধীর স্বরে বললো,
“খাবো না শাশ্বত বাবু, জোর করবেন না দয়া করে।”
“এ বললে হবে? দুপুরে খেয়েছো বলে তো মনে হলো না। এখন বিকেল চারটে বাজে। এই বনরুটিখানা খেয়ে নাও।”
“গলা দিয়ে যে কিছুই নামবে না। ভয়ে গলাটা কাঠ হয়ে আসছে। উনি ফিরুক, শুনি ডাক্তার বাবু কি বললো!”
“বেশ, রুটিখানা রাখলুম। খেয়ে নিও।”

শাশ্বতের সাথের উমার কথাবার্তা সহ্য হচ্ছে না রুদ্রের। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোনো কান্ড করতে বিবেকে বাধছে। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে উমার সম্মুখে দাঁড়াতেই উমা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। আবেগী গলায় বললো,
“ডাক্তার কি বললো?”

রুদ্র কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,
“অবস্থা সুবিধার নেই। আমি আইসিউ তে রাখতে বলেছি। ওয়ার্ডে রাখাটা বুদ্ধিমানের হবে না। তবে আমার মনে হয় ঢাকায় নেওয়া উচিত। এখানের ডাক্তারের চামড়া মোটা, গরজ কম। হার্টের ব্যাথা ক্ষণে ক্ষণে উঠছে। পড়ে সময় দিবে না। হুট করে কিছু হয়ে গেলে আমাদের করার কিছুই থাকবে না।”
“অতদূর নিবেন কি করে?”
“এম্বুলেন্সে বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। ফেরিতে রোগী দেখালে ছেড়ে দেয়। আমি বলি কি, আজ রাত এখানে থাক। সকালেই ব্যাবস্থা করি। আমি বলে এসেছি৷ রিপোর্ট ওরা সকালেই পেয়ে যাবে। এখান থেকে মোটামোটি চিকিৎসা দিয়েই সকালে নিয়ে যাবো। কিন্তু আমার চিন্তা সেটা না। হুট করে এমন টা হলো কেনো? উনার কি আগে সমস্যা ছিলো?”
“বুকে ব্যাথা ছিলো, ঔষধ খেতো। কিন্তু এতোটা সাংঘাতিক হবে বুঝতে পারি নি।”
“তুমি চিন্তা করো না। আমরা সকল চেষ্টা করবো। বিধাতা চাইলে ঠিক সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি৷ তুমি খেয়ে নাও। আমি একটু শাশ্বতের সাথে কথা বলে আসছি।”

উমা মাথা নাড়ালো। রুদ্র শাশ্বতের উদ্দেশ্যে বললো,
“একটু শুনে যা তো”

শাশ্বত কথা না বাড়িয়ে রুদ্রের পিছু পিছু গেলো। উমা থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়ালো তারা। শাশ্বত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“হুট করে ডাকলি যে? ওখানেই বলতি। উমা তো ওখানে একা। ডাক্তার ডাকলে তখন সমস্যা হবে।”
“আমার বউ এর প্রতি এতো দরদ দেখাবার তো প্রয়োজন নেই। কেনো করছিস এগুলো। ভাবিস না আমি কিছু বুঝি না”
“কি বুঝিস?”
“এই লুকিয়ে লুকিয়ে বই দেওয়া, হেসে হেসে কথা বলা আমি দেখি না ভাবছিস? সবই দেখি। আমার সাথে লড়বি সরাসরি লড়। ওকে ভায়া করছিস কেনো? আমার কোনো গোপন খবর ই উমা তোকে দিবে না।”

শাশ্বত কিছুক্ষন চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মুখিটা লাল হয়ে আছে ক্রোধে। শাশ্বত একটি তাচ্ছিল্যময় হাসি হাসলো। তারপর বললো,
“তাহলে তুই বলে দে, মামা মশাই এর পুলিশে ধরাবার পেছনে কি তোর হাত ছিলো?……..

চলবে

[ সকাল থেকে কারেন্ট ছিলো না। মাত্র আসলো। তাই তাড়াতাড়ি পোস্ট দিলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

২৪তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/429704572084654/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here