উমা [কপি করা নিষেধ] ২৬তম_পর্ব

উমা [কপি করা নিষেধ]
২৬তম_পর্ব

শাশ্বত কিছুক্ষন চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মুখিটা লাল হয়ে আছে ক্রোধে। শাশ্বত একটি তাচ্ছিল্যময় হাসি হাসলো। তারপর বললো,
“তাহলে তুই বলে দে, মামা মশাই এর পুলিশে ধরাবার পেছনে কি তোর হাত ছিলো? আমি তো পুলিশকে কোনো খবর দেই নি, তবে এতোটা নিখুঁত খবর দিলোটা কে? মামা মশাই এর একজন ই বিশ্বস্ত কুকুর রয়েছে সে হলো তুই”

শাশ্বতের প্রশ্নে ঈষৎ বিস্মিত হলো রুদ্র। কিন্তু বিস্ময়ের কোন সুক্ষ্ণ রেখাও আনলো না মুখোভাবে। উলটো বিদ্রুপের হাসির প্রলেপ একে বলল,
“তোকে কি খবরের কাগজের দপ্তর থেকে ছাটাই করে দিয়েছে? দেখি তো বাড়িতেই বসে থাকিস, তা কি বাড়ি বসে বসে কি বোমকেশ হবার সখ জেগেছে নাকি? আবল তাবল বকছিস তাই”
“আমি আবল তাবল বকছি?”
“বকছিস না? ছেলে হয়ে বাপ কে কেউ জেলে দেয়?”
“তোদের বাপ ছেলের কি সম্পর্কের টান বলে কিছু আছে? তোরা তো শুধু সুযোগ খুজিস, কিভাবে অন্যকে চুষে নিজের ফয়দা করা যায়। ভুল বললাম? তুই খুব ভালো করেই জানিস মামা মশাই তোকে কোনোভাবেই নিজের পথের কাঁটা হতে দিবেন না। তাই তো তুই মামা মশাইকে শাহাদাতের কেসে ফাসালি। শাহাদাতকেও হাসপাতালে পাঠানোর পেছনে তোর হাত আছে। মামামশাই ভেবেছিলো ছেলেতো তার শত্রুতে শাস্তি দিয়েছে। তাই দুপুর হতে না হতে তিনি শহরে ছোটেন। তিনি আসলে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে ছেলে তো তাকেই নিজের রাস্তা থেকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তুই ভালো করেই জানিস, মামা মশাই এর নামে অপবাদ দিলে তাকে পার্টির লোকেরা এবার অন্তত দাঁড়াতে দিবে না। সেও খানিকটা ভয় পাবেন। সেই সুযোগে তোর হাতে খড়ি হবে পার্টিতে। ঠিক না?“

রুদ্র কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশ্বতের চোখের দিকে। শাশ্বতের কথায় এক অন্য আত্নবিশ্বাস রয়েছে। সে নির্ভীক, তার চোখে ভয়ের ক্ষীন রেখাও নেই। রুদ্র এবার শব্দ করে হেসে উঠে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে,
“তুই তাহলে আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছিস? আমি ত ভেবেছিলাম তুই শুধু রকিবুল মাস্টারের সাথে হাত মিলিয়ে বাবার পর্দা ফাঁশ করার ধান্দায় এসেছিস। এখন তো দেখছি আমাকেও ছাড়ছিস না। ভালো ভালো। তবে এতোক্ষন যা বললি, তুই সেটা প্রমান করতে পারবি না। কারন আমি বাবার ন্যায় কাঁচা খেলোয়ার নই। শোন আমি কি বলি, অহেতুক আমাদের পেছনে লাগিস না। কর্ম কর, ভালো সাংবাদিক তুই অথচ আমাদের পেছনে হাত পা ধুয়ে পড়েছিস। সত্যি বলছি সময় নষ্ট। কারণ আমি থামছি না, আমার খেলায় যে আসবে হয় তাকে সরে যেতে হবে নয়তো আমি সরিয়ে দিবো।“

বেশ ঠান্ডা কন্ঠে কথাগুলো বললো রুদ্র। শাশ্বত চোখ কুচকে তাকিয়ে রয়েছে রুদ্রের দিকে। রুদ্রের মতো জেদী মানুষের দ্বারা এমন কথা বলা অস্বাভাবিক নয়। কথা শেষ হবার পর শাশ্বতের উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। উমার কাছে যাবার জন্য পা বাড়ানোর সাথে সাথে শাশ্বত পেছন থেকে বলে উঠলো,
“তুই য়ার মামা মশাই এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই জানিস তো। একেবারে বাপের বেটা কি না”

কথাটা শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় রুদ্র,। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করে শাশ্বতের দিকে। কিন্তু শাশ্বত তা উপেক্ষা করে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“ ভাবিস না তুই আর মামা মশাই আলাদা, ক্ষমতার জন্য যেমন মামা মশাই সকলকে ব্যাবহার করেন ঠিক তেমন ই তুই ও করিস। যেমনটা এখন উমাকে করছিস। আমি তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি রুদ্র। শুধু নিজের লাভের জন্য ই তুই উমাকে ব্যাবহার করছিস। এই ষোড়শী মেয়েটি কেবল ই তোর দাবার গুটি। সুযোগ এলে ওকে বলি দিতেও দুবার ভাববি না।“

রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শাশ্বত তার পাশ কাটিয়ে চলে যায় বারান্দার দিকে। শাশ্বতের শেষ কথাটা কর্নকুহরে ঝংকার তুলছে। সত্যি কি সে তার বাবার মত? সত্যি কি সময় আসলে সে উমাকে ও বলি দিবে? প্রশ্নগুলো সময়ের জন্যই তোলা থাক। সময় সব প্রশ্নের উত্তর এক এক করে দিয়ে দিবে।

রাত ঘন হচ্ছে, ঘুমের ঔষধ দেবার কারণে ঘুমোচ্ছেন নিখিল বাবু। তার ঠিক পাশে বসে আছে উমা। রোগীদের একজন কে তার পাশে থাকতে দিচ্ছে। তাই উমাই থাকছে আজ রাত্রি। শাশ্বত এবং রুদ্র উভয় ই বাহিরের বেঞ্চিতে অপেক্ষারত। দুজন দুজনকে সহ্য না করলেও উমার খাতিরে মুখ বুঝে একই সাথে রয়েছে। রোগীদের জন্য রাত্রী খুব বিপজ্জনক। বেশিরভাগ অঘটন এই কালো রাত্রীতেই ঘটে। তাই রাত্রী সজাগ এবং সচার থাকাটা জরুরী। উমার দুপুর থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি, রুদ্র জোর করে হাতে ঠান্ডা বনরুটি ধরিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা বনরুটিখানা দাত দিয়ে কাটতে চাচ্ছে না। তবুও পে্টের ক্ষুদা এক অসহনীয় যন্ত্রনা। উমা খানিকট জোর করেই খেলো রুটিটা। নিখিল নাকে অক্সিজেন লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছে। উমা শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। কাঁচা পাকা চুল গুলোয় ক্ষনে ক্ষনে হাত ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মেয়ে বড় হলে পিতা হয়ে যায় পুত্র। উমার ক্ষেত্রেও সেটাই, তার অচেতন পুত্রকে ক্ষনে ক্ষনে আদর করে দিচ্ছে সে। তার বারে বারে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। অসহায় মুখখানি দেখলেই কান্নার বেগ বাড়ছে। হ্যা্, নিখিল মানুষ হিসেবে অত্যন্ত অপদার্থ, কিন্তু সে একজন পিতা। আর সন্তানের কাছে পিতা যেমন হোক না কেনো সে তার সর্বোমূল্যবান ব্যাক্তি। উমা ও ব্যতিক্রম নয়, তাই তো পিতার এই দূর্সময়ে তার হাত খানা ধরে ক্লান্ত মেয়েটি অশ্রুসিক্ত নেত্রে রাত্রীযাপন করছে। হুট করেই নড়ে উঠলো হাতখানা, উমাও নড়ে উঠলো। মিহি কন্ঠে বলল,
“বাবা কিছু লাগবে?”

নিখিল চোখ খুললো। প্রথমে কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে চাইলো, হয়তো ঠাহর করতে পারে নি। উমা ধীর স্বরে বলল,
“আমি উমা, আমাকে চিনতে পারছো?”

নিখিলের চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। কাঁপাহাতে উমারহাত খানা আকড়ে ধরলো। কিছু অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেলো ঠিক ই কিন্তু বোঝা গেলো না। শ্লেষ্মা জড়ানো গোঙ্গানি বুঝতে পারলো না উমা। সে এগিয়ে গেলো। মুখের কাছে কান ঠেকালো। নিখিল গো গো করছে, উমা বুঝতে পারলো বাপের কষ্ট হচ্ছে। তাই মৃদু স্বরে বললো,
“কথা বলো না বাবা, কষ্ট হবে”

কিন্তু নিখিল থামলো না, সে কাঁদছে এবং গোঙ্গাচ্ছে। বারে বারে মাস্ক খোলার জন্য মরিয়ে হয়ে উঠছে। এক অস্থির অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে। যেনো এখন কথাখান না বললে তার শান্তি নেই। উমার বুকটা হুট করেই কেঁপে উঠলো। যেনো এক অদ্ভুত শক্তি তার আসে পাশে ঘিরে আসছে। প্রান যাবার সময় কি এমনটা হয়? নিখিলের অস্থিরতা বাড়লো। উমা সময় ব্যয় না করে হাক দিল রুদ্রকে,
“শুনছেন, বাবা যেনো কেমন করছে।“

রুদ্রের চোখ বুঝে আসছিলো। উমার ডাকে ঘুম পালিয়ে গেলো। সে ছুটে গেল উমার কাছে, শাশ্বত ডাক্তার ডাকতে গেলো। সরকারি হাসপাতালে এই এক সমস্যা, ডাক্তার পাওয়া যায় না। নার্স এলো হেলেদুলে। নিখিল যথারীতি হাসফাস করছে। গো গো আওয়াজটা বাড়ছে। নার্স তার অবস্থা দেখে একটা ইঞ্জেকশন দিলো। কিন্তু কাজ দিলো না। নার্সের মুখে চিন্তা দেখা গেলো। সে ওয়ার্ড বয়কে ডাকলো। উমা এদিকে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বুকটা লাফাচ্ছে, এক অজানা অস্থিরতা কাজ করছে। নিঃশ্বাস যেনো আটকে আসছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। কি করলে বাবাকে ঠিক করবে তার জানা নেই। রুদ্র উমার হাত শক্ত করে ধরলো। কঠিন সত্যের জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার ষোড়শী নয়। বেঁচারি নিজ পিতার এমন শেষ মূহুর্তটি ঠিক নিতে পারবে কি জানা নেই। ওয়ার্ড বয় এলো, বুকে বেশ কিছুবার আঘাত করলো। প্রায় আধা ঘনটা যমে কোস্তাকোস্তি করলো, অবশেষে……………

চলবে

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

২৫তম পর্বের লিংক https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/430900231965088/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here