উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৩১

0
448

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩১
_________________

জোনাস হোয়াইট রঙের কাপটাতে গ্রিন টি ঢাললো ইরতিজার জন্য। কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“তুমি আর কিছু খাবে টিজা?”

ইরতিজা কঠিন মুখে বসে রয়েছে। পাথুরে দৃষ্টি জোনাসের উপর। জোনাসের এখানে আসা সে মেনে নিতে পারছে না। সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেয়েছে এটা শুনে যে–জোনাস না কি নিজের গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করবে সিয়াটলে। সিয়াটল ইউনিভার্সিটিতে এডমিট হয়েছে সে। ইরতিজা ভাবছে ছেলেটার মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে। এত পাগলামি করার মানে কী? কিছুক্ষণ আগে যে পাগলামিটা করলো সেটার জন্য তো ইরতিজা নিজের মেজাজ সংযত রাখতেই হিমশিম খাচ্ছিল। জোনাস তাকে জো/র করে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে। ঠিক সেই আগের বার যেরকম মুখ চে/পে ধরে নিয়ে এসেছিল, ঠিক এবারও তাই করেছে। ইরতিজা বাসার বাইরে থাকা ডাস্টবিনে কিছু খালি খাবারের প্যাকেট ফেলতে এসেছিল। ঠিক সে সময়ই পিছন থেকে জোনাস তার মুখ চেপে ধরেছিল। অসভ্যর মতো আচরণ হয়েছে জোনাসের!

জোনাস থাকে একটা দুই তলা বাড়ির চিলেকোঠায়। একটা কামরা। কামরার পাশে একটুখানি কিচেনের মতো জায়গা আছে। জায়গাটা পরিসরে ছোটো হলেও খুব পরিপাটি।

ইরতিজা বললো,
“আমি মনে করি তোমার এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো জন।”

“চলে যাব বলে আমি আসিনি। তোমার জন্যই এখানে আসা আমার। সুতরাং এমন কথা বলো না।”

“আমার জন্য কেন আসবে তুমি এখানে?”

“কারণ দূর থেকে তোমাকে ঘৃণা করতে কষ্ট হয়। কাছাকাছি থাকলে রোজ তোমার সাথে দেখা হবে, আর দেখলেই ঘৃণাবোধ হবে মনে। দূর থেকে ঘৃণা করার চেয়ে কাছাকাছি থেকে ঘৃণা করাটা সহজ না?”

জোনাসের কথাগুলো ইরতিজার মনে ঘৃণার সৃষ্টি করছে। সে মুখে স্পষ্ট ঘৃণা এবং বিরক্তি ফুঁটিয়ে তাকিয়ে রইল।
জোনাসও নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল ইরতিজার দিকে। হঠাৎই কী মনে করে আসনকৃত টুলটা নিয়ে এগিয়ে এলো ইরতিজার দিকে। একেবারে ইরতিজার কাছে এসে বসতেই ঘাবড়ালো ইরতিজা। ভীষণ চমকে উঠলো। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এলো তার,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং জন?”

ইরতিজা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াতে চাইলো টুল ছেড়ে, কিন্তু ওঠার আগে জোনাস তার হাত দুটো খপ করে ধরে ফেললো।
ইরতিজা এতে আরও বেশি চমকে উঠলো। জোনাস বললো,
“আমি কাছে আসলেই তুমি চলে যেতে চাও কেন টিজা? আমি তো তোমায় ভালোবাসি না। মানুষ ভালোবাসার মানুষের কাছে এলে এমন পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করে। তবে কি তুমি আমায় ভালোবাসো?”

ইরতিজা এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই হঠাৎই এমন একটা কথা তাকে পুরো স্থির করে দিলো। তবে তার অন্তরিন্দ্রিয়তে এমন কোনো অনুভূতির ঝলকানি হলো না যা দ্বারা তার মনে হবে জোনাস ঠিক বলছে। ভালোবাসার অনুভূতি কেমন হয়? ইরতিজা নিজের মাঝে খারাপ লাগা এবং বিদঘুটে অনুভূতি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেল না। ভালোবাসার অনুভূতি নিশ্চয়ই এমন নয়। ইরতিজার মনে হচ্ছে সে ইতোমধ্যে ভালোবাসার অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু যার জন্য সেই অনুভূতি সেটা জোনাস নয়।

ইরতিজা কিছু না বলে তাকিয়ে ছিল। জোনাস ইরতিজার পুরো বদনখানিতে চোখ বুলিয়ে বললো,
“তুমি কি আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গেছো সুইটহার্ট?”

“তোমার চোখ ভুল দেখছে।”

জোনাস স্মিত হেসে বললো,
“আমার আগে এত রোগ ছিল না। তুমি রিজেক্ট করে দেওয়ার পরই নানান রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। দেখেছো, চোখেও ইদানিং ভুল দেখতে শুরু করেছি।”

“হাত ছাড়ো।”

“ধরে রেখেছি না কি?”

ইরতিজা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। জোনাস শক্ত করে তার হাত দুটি ধরে রেখেছে। ইরতিজা চোখ কঠিন করে তাকালো।
জোনাস ছেড়ে দিলো হাত। বললো,
“এই হাত ছেড়ে দেবো, আবার ক্ষণে ক্ষণেই আঁকড়ে ধরবো। কিন্তু এমন একটা সময় আসবে, যখন আমি পুরো তোমাকেই ব’ন্দি করে ফেলবো আমার অন্তঃখাঁচায়। তখন ‘ছাড়াছাড়ি’ হয়ে যাবে অতীত। আঁকড়ে ধরাই হবে বর্তমান, ভবিষ্যৎ।”

ইরতিজা ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
“তুমি একজন সাইকোলজিস্টের কাছে যাচ্ছ না কেন জন? আই থিংক তোমার ট্রিটমেন্ট দরকার!”

“আমাকে পা’গ’ল বলছো?”

“বলতে বাধ্য হচ্ছি। তুমি আগে এমন ছিলে না। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছো এখন। এই তুমিটাকে চিনে উঠতে এবং মানতে এখন খুব কষ্ট হয় আমার!”
ইরতিজার কণ্ঠে গভীর বেদনার স্পর্শ। চোখের কার্নিশে বিন্দু বিন্দু জল জমলো। আসলেই পুরোনো প্রিয় বন্ধুটা খুব পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন! অতীতের সুন্দর বন্ধুত্বটা এখন কদর্য হয়ে উঠেছে!

“আমার এমন হওয়ার পিছনে তুমিই দায়ী। সেদিন আমাকে গ্রহণ করে নিলে সবকিছু সুন্দর থাকতো। তুমি অযথাই আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিয়েছো!”

“আমি না, তুমি। তোমার করা ওই কাজটা আমি কোনোদিন ভুলবো না। তুমি আমার পরিবারের মাঝে ভুল একটা ধারণার সৃষ্টি করিয়ে আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছো!”

“আমি ভুল কিছু করিনি।”

“এখনও বলছো তুমি ভুল করোনি?”

জোনাস কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলো খানিক সময়। অতঃপর বললো,
“তোমার রেডমন্ডের ওই নিউ ফ্রেন্ডটা খুব অ’স’ভ্য টিজা।”

ক্যানিয়লের সম্পর্কে জোনাসের মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনতে একদমই ভালো লাগলো না ইরতিজার। কথাটার জন্য তার রাগও হলো জোনাসের উপর। বললো,
“নিজে কতটা অ’স’ভ্য সেটা আগে চিন্তা করো। অন্যের ব্যাপারে পরে চিন্তা করবে। আর হ্যাঁ, রেডমন্ড এসেছো ভালো কথা, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো সেটাও ভালো কথা। কিন্তু দয়া করে আমাকে আর জ্বালাতন করো না। আর কখনও সামনে এসো না আমার!”

ওই কথাটুকু বলেই বেরিয়ে এলো ইরতিজা। অন্তঃকরণে দোল খাচ্ছে কষ্টের হাওয়া। জোনাসের কাছ থেকে দূরে থাকাই তার জন্য ভালো। জোনাসকে না দেখলে, জোনাসের সাথে কথা না হলে তার মনে পড়ে না জোনাসকে। বুকে কষ্ট অনুভবও হয় না। অথচ জোনাস তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এখান অব্দি চলে এসেছে। এমন কেন করলো জোনাস? ইরতিজা এটা নিয়ে এখন আর ভাবতে চাইলো না।

জোনাস যে বাড়ির চিলেকোঠাটা ভাড়া নিয়েছে সেটা একেবারে ইরতিজাদের এরিয়ার পিছনের দিকে অবস্থিত। এ বাসার ছাদ থেকে দেখা যায় দূরে লেকের টলমলে জল। ওদিকটার সৌন্দর্যে তাকিয়ে ইরতিজার হঠাৎ ক্যানিয়লের কথা মনে পড়লো। গতরাতে ফোন করে কী অদ্ভুত একটা কথা বললো ক্যানিয়ল তাকে। ইরতিজা বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো।
সন্ধ্যার আবছা আলোয় মৃদু শীতল হাওয়ার পরশ যখন ইরতিজার মনকে উদ্বুদ্ধ করলো, তখন তার মনে হলো–হ্যাঁ, তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছে! কিন্তু কখন, কীভাবে এই প্রেমের জন্ম হলো জানে না। কী অদ্ভুত! ধীরে ধীরে মানুষের অনুভূতি কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকে!
ইরতিজার মনে সহসা কথাগুলো জাগ্রত হয়ে ওঠে,
‘ধীর লয়ে প্রেম আসিয়া বসত গড়িছে মনে,
হে বিদেশি পা’জি, আমি ভালোবেসে ফেলেছি তোমারে!’

শেষের কথাটাতে ইরতিজা নিজেই হেসে উঠলো। বিদেশি পা’জি! ক্যানিয়লের সাথে নামটা আসলেই সুন্দর মানায়।

__________________

আজ আবারও একটা হুমকিমূলক কল এসেছে ক্যানিয়লের কাছে। নাইলা সালেমের মতিগতি সে ঠিক বুঝতে পারছে না। নাইলা সালেম এসব অব্যাহত রেখে কি এটা প্রমাণ করতে চাইছে যে, সে আসলে এসবের পিছনে নেই? কিন্তু এটা প্রমাণ করতে চেয়ে যে লাভ নেই, সে জানে এসবের পিছনে নাইলা সালেমই আছে! ক্যানিয়ল বাসা থেকে বের হলো। আজ সে নিজের মেইন বাড়িতে ছিল। লনে নেমে দেখলো পুরো ফ্যামিলি আজ লনে উপস্থিত আছে। আজ ছুটির দিন যে। ভাই-বোনদের ভিতর একটা খেলায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। মূলত ব্যাডমিন্টন খেলা হবে। ভাই-বোনদের সাথে এই খেলাটায় কখনও অংশগ্রহণ করেনি ক্যানিয়ল। সামুরার সাথে খেলেছে বেশ কয়েকবার। এছাড়াও স্টিভেনের সাথেও খেলাটা খেলা হয়েছে অনেক। পরিবারের সকলের উপস্থিতিতে লনটাকে কেমন অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। তাদের ফ্যামিলি তো বিশাল বড়ো ফ্যামিলি। তবে ড্যাড নেই এদের ভিতর। ক্যানিয়ল আরও একটা বিশাল শূন্যতা লক্ষ করলো। তার মমও নেই! বুক কেমন ব্যথা করে উঠলো। সকলের চক্ষুর পাশ কাটিয়ে ক্যানিয়ল গ্যারেজের দিকে এগোচ্ছিল। ইয়াদার বড়ো ছেলে এবং ভাই-বোনদের ভিতর সবচেয়ে সিনিয়র ভাইটা অকস্মাৎ ডেকে উঠলো ক্যানিয়লকে,
“হেই ক্যানি…”

ক্যানিয়ল পিছন ফিরে একটু জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ইয়েস…”

“মিরান্ডার সাথে তোমার ঝগড়া হয়েছে কোনো বিষয়ে?”

“ঝগড়া? আমার মনে হচ্ছে না লাস্ট পাঁচ মাসে ওর সাথে আমার কখনও ঝগড়া হয়েছে।”

“কিন্তু মিরান্ডা আমাকে এমনটাই বলেছে। যাই হোক, ও তাড়াতাড়িই ফিরে আসছে দেশে। তোমাকে জানাতে বললো।”

“স্বাভাবিক। বিদেশ গিয়েছে তো ফিরে আসার জন্যই। পার্মানেন্ট থাকবে এমন কোনো নিয়ত করে তো যায়নি।”

“কথা সেটা না। ও ফিরলে খুব তাড়াতাড়িই ওর সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।”

ক্যানিয়ল নিঝুম হয়ে গেল। নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো কী যেন চিন্তা করলো খানিক সময় ধরে। তারপর চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার মনে হচ্ছে না আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করবো!”

কথাটায় উপস্থিত সকলে চমকালো। যারা আরকি মনোযোগী ছিল ওদের কথাবার্তায়। মাদার সোফিয়া, ইয়াদা এবং নাইলা সালেম একসাথে বসে ছিলেন একটা টেবিলকে ঘিরে থাকা চেয়ারে। মাদার সোফিয়া ক্যানিয়লের কথা শুনে এগিয়ে এলেন,
“কী বলছো উমরান?”

“স্যরি মাদার সোফিয়া, এই বিয়েটা বোধহয় হবে না। কারণ আমি যে চাই না এই বিয়েটা হোক।”

“চুপ করো, তোমার ড্যাড কথাটা শুনলে কতটা রেগে যাবে ভেবেছো?”

“তিনি রেগে যাবেন, আমাকে মৃ’ত্যুদণ্ড দেওয়ার জারি তো প্রদান করবেন না। সুতরাং ভাবনা কীসের? আমি মৃ’ত্যু’কে ভয় করি মাদার সোফিয়া। অন্য কিছুকে ভয় করে জীবন অসুখী করতে পারব না।”

“মিরান্ডাকে বিয়ে করে তুমি অসুখী হবে বলে তোমার ধারণা?”

“হয়তো ধারণাটা সঠিক, হয়তো বা না। হয়তো আমি কাউকে পছন্দ করি, হয়তো বা না!”

বলে ক্যানিয়ল পা বাড়িয়ে দিলো। ওর শেষের কথাটা শুনে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলে গেল ছেলেটা?
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ক্যানিয়ল। গাড়িটা ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে। ওর পাশের সিটটাতে পড়ে আছে এক গুচ্ছ ভায়োবিন ফুল। সঙ্গীহীন মানবটা যেন এই এক গুচ্ছ ফুলকেই আজকের মতো নিজের সঙ্গী করে নিয়েছে। আজ সে বেলভিউ সময় কাটাতে যাবে। আর তার সাথে থাকবে এই একগুচ্ছ ভায়োবিন ফুল।
সে একাকী স্বভাবের। কিন্তু হঠাৎ করে তার এই স্বভাবটাকে আর পছন্দ হচ্ছে না। কেন সে বরাবর বিষাদের সুবিশাল আকাশ মাথার উপর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? সে খুব করে চাইতো, একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র একদিন হুট করে তার বিষাদের আকাশে জ্বলে উঠে চমকে দিক তাকে। কিন্তু সেই নক্ষত্র দেখা যায়নি। বছরের পর বছর কেটেছে। তবে সে তার ভাবনার মতোই হুট করে একটা জিনিস দেখে চমকে উঠেছে ঠিকই। সে দেখতে পেয়েছে তার বিষাদের আকাশে খুব ঝাপসা করে যেন একটা নক্ষত্র দেখা যায় আজকাল। কী আজব, না?
ক্যানিয়ল হঠাৎ কল করে বসলো ইরতিজাকে। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো দেরি করে।
ক্যানিয়ল বললো,
“হেই ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে, ঘুমিয়ে আছো এখনও? আমার সাথে এমন আজব খেলা করা বন্ধ করো। নাহলে একদম জানে মে/রে ফেলবো তোমাকে।”

ফোনের ওপাশে থাকা ইরতিজার শরীর এমন বি’ভী’ষি’কাময় কথার দরুণ কেঁপে উঠলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here