উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৩৮

0
480

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৮
_________________

পুলিশ স্টেশনে কথা কাটাকাটি গেল কিছুক্ষণ যাবৎ। ক্যানিয়লকে এবার সহজে ছাড়তে চাইলো না তারা। মি. হেনরি এবং মুহাম্মদ ইসহাকের পার্সোনাল সেক্রেটারি মি. পল অনেক রকম ভাবে বোঝালো পুলিশদের। তবুও তারা সহজে মানতে চাইলো না। অনেক টাকার চুক্তি হলো। প্রতিবার ক্যানিয়লের এই ব্যাপার মেটাতে যত ডলার খরচ হয়, এবার খচর হলো তার তিনগুণ বেশি। তারা ক্যানিয়লকে পুনরায় এমন ঘটনার সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে বললো। কিছু ঘটলে তারা দেখবে। ক্যানিয়ল তাদের এ কথায় কোনোরকম গুরুত্বই দেয়নি! ইরতিজাও আছে এখানে। সাক্ষ্য দিতে হয়েছে তার। ক্যানিয়লকে মুক্ত করার ঝামেলা এখনও শেষ হয়নি। ইরতিজা দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে। ক্যানিয়ল আছে পুলিশের সম্মুখের চেয়ারে।

হঠাৎ থমথমে পুলিশ স্টেশনটি একজন নয়ন মুগ্ধকর রমণীর আগমনে যেন হেসে-খেলে উঠলো। সর্বপ্রথম ইরতিজার দৃষ্টি পড়লো সেই রমণীর উপর। গ্লো পিংক কালারের ব্লেজার পরা মেয়েটি। চুল পনিটেল করে বাঁধা। চোখে কালো রোদ চশমা। মেয়েটিকে চিনতে বেশি সময় লাগলো না ইরতিজার। মেয়েটার নাম মিরান্ডা। একজন বিখ্যাত ব্যালে ড্যান্সার। আর সেই সাথে তার আরেকটা পরিচয় হলো সে ক্যানিয়লের উডবি ওয়াইফ!
মিরান্ডা এসেছে সেদিকে লক্ষ করেনি ক্যানিয়ল, তাই মিরান্ডা এসে পিছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরলেই চমকে উঠলো সে। তাকিয়ে দেখলো মিরান্ডা।

“তুমি?” অবাকের সুর ক্যানিয়লের গলায়।

“দেশে ফিরে নিজের উডবিকে থানায় দেখতে পাওয়াটা দুর্ভাগ্য!”

মিরান্ডা ক্যানিয়লের গালে ঠোঁটের স্পর্শ করতে চাইলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো ক্যানিয়ল। গলা জড়িয়ে ধরা মিরান্ডার হাত দুটোও ছাড়িয়ে নিলো বিনা বাক্য ব্যয়ে। মিরান্ডাও আর কথা বললো না তার সাথে। একটা খালি চেয়ার টেনে বসে যোগ দিলো পুলিশদের সাথে কথোপকথনে। এই কথোপকথন চললো আরও কিছুক্ষণ। কথার সমাপ্তি ঘটার পর যখন উঠে দাঁড়ালো তখন মিরান্ডার চোখ পড়লো ইরতিজার উপর। ইরতিজা এখানে আছে সেটা সে খেয়াল করেনি এতক্ষণ। ইরতিজাকে দেখে ক্ষুব্ধতার ঝড় ক্রমশ আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছিল মিরান্ডার। সে ইরতিজাকে কিছু বলবে বলে এগোচ্ছিল। তিন কদম হেঁটে আসলেই ক্যানিয়ল তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে বাধা দিলো। মিরান্ডা একটু রাগি চোখেই তাকালো ক্যানিয়লের দিকে।

“দেশে ফিরে প্রথমে নিজের উডবি হাসব্যান্ডকে ভালো করে দেখা উচিত তোমার। উডবি হাসব্যান্ডের যার প্রতি অনুভূতি আছে তাকে নয়। আগে আমাকে ভালো করে দেখবে চলো।”

ক্যানিয়ল মিরান্ডাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো। আসার আগে মি. হেনরিকে বললো ইরতিজাকে বাসায় পৌঁছে দিতে।
ক্যানিয়ল মিরান্ডার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। পাশেই মিরান্ডা শ্লেষাত্মক হেসে বললো,
“প্রেমিকার প্রতি এত যত্নশীল যে হবু স্ত্রীকে প্রেমিকার কাছ অবধি ঘেঁষতে দিলে না?”

“এবার আমি ঘেঁষতে দিইনি। এরপর থেকে তুমি ঘেঁষার চেষ্টা করবে না।”

মিরান্ডা উচ্চৈঃশব্দে হেসে উঠলো। সেই হাসি থামলো কিয়ৎক্ষণ পর। হাস্যভাবের কিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্টও আর তার মাঝে অবলোকন করা যাচ্ছে না এখন। মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। বললো,
“চেষ্টা করবো এবং ঘেঁষবোও। তুমি আটকাতে পারবে না। আর এই আটকাতে না পারার আফসোস তোমাকে খুব যন্ত্রণা দেবে একটা সময়।”

“হিংসাত্মক হয়ো না মিরান্ডা, আমি তবে হিংস্র হতে বাধ্য হবো!”

“হিংস্র? কী করবে তুমি? অন্যদের যেভাবে মা’রো, আমাকেও সেভাবে মা’র’বে?” চেঁচিয়ে উঠলো মিরান্ডা।

ক্যানিয়লের মেজাজ এত খারাপ হয়ে গেল যে সে নেমে গেল গাড়ি থেকে। উইন্ডো দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে বললো,
“এর আগে আমি তোমার প্রতি অনুভূতি অনুভব করতে ব্যর্থ ছিলাম। আর এখন নিজেই চাইছি না তোমার প্রতি আমার কখনও অনুভূতি জন্মাক।”
বলে সে গাড়িতে হাত দিয়ে খুব জোরে একটা শব্দ করে চলে গেল।
মিরান্ডার মুখ মন্ডল তখন কাঁপছিল রাগে। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্যানিয়ল চোখের আড়াল হলো।

________________

মেরিমুর পার্কটা বিশাল এরিয়া নিয়ে তৈরি। তবে ইরতিজা পার্কটার ভিতরের একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া হাঁটাহাঁটি করে না। এখানে হাঁটার জন্য একটা রোড আছে। রোডের পাশে সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ স্থান। রয়েছে দুটো আপেল গাছ সহ আরও বিভিন্ন গাছপালা। একটা আপেল গাছ ছাড়িয়ে এসে কিছুদূর হাঁটার পর আরেকটা আপেল গাছ দেখা যায়। গাছগুলো এখন শূন্য। গ্রীষ্মকালে থোকায় থোকায় সবুজ আপেল ধরবে। আর তা পেকে গেলে ধারণ করবে লাল বর্ণ। গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই ইরতিজার। এই পার্ক থেকে সেই অভিজ্ঞতাটা লাভ করা যাবে। অনেক আপেল তলাতেও পড়ে থাকে। কিন্তু খাওয়ার মানুষ কই?
এই পার্কে ইরতিজার একটা প্রিয় স্থান আছে। সেই জায়গাটায় প্রচুর গাছ। বসার জন্য একটা বেঞ্চিও আছে। নীরব বসে থেকে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পার্কটিতে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায় সর্বত্র। ইরতিজা এখানে এলে চুপচাপ বসে থেকে পাখির সেই ডাক শোনে, আর দু চোখে জায়গাটার সৌন্দর্য ধারণ করে। আজ সে একাই এসেছে পার্কে। জুহিকে ডেকেছিল। কিন্তু জুহির মনটা কোনো এক কারণে প্রচণ্ড খারাপ। মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে জুহি বলেনি সে সম্পর্কে কিছু। শুধু বলেছে,
“ডিস্টার্ব করো না টিজা। আমায় কিছুটা সময় একলা ছেড়ে দাও।”
ইরতিজা এরপর আর কথা বাড়ায়নি। তবে সে বুঝতে পেরেছে জুহির মন খারাপের কারণটা আন্দ্রেজ হবে সম্ভবত। সে জুহির কাছ থেকে প্রস্থান করে নওরিনের কাছে যায়। গিয়ে বুঝতে পারে নওরিনেরও কোনো একটা কারণে মন খারাপ। অগত্যা সে একাই চলে আসে পার্কে। আজকের দিনে সবার এত মন খারাপ কেন ভাবছে ইরতিজা। তার নিজের মনটাও কেমন কেমন করছে। মনটার যেন অসুখ হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর মনটার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে মনে হচ্ছে! আজ হঠাৎ মিরান্ডাকে দেখার পর থেকেই এমন হচ্ছে তার।
উদাসী, আনমনা চিত্তে বসে রইল ইরতিজা। ক্ষণকাল পর অকস্মাৎ তার ঘাড়ের পিছন থেকে কেউ মুখ এনে কানে ফিসফিস করে ডাকলো,
“পাকিস্টানি গার্ল!”

ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল ইরতিজা। ভয় পেলেও ক্যানিয়লকে দেখার পর খানিক স্বস্তিবোধ ফিরে এলো। তবুও ভয় তো সে পেয়েছেই। ভয়ের ধুকপুকুনিটা গেল না সহজে।

ইরতিজার চিৎকার করে ওঠার ব্যাপারটায় ভীষণ বিরক্ত হয়ে ক্যানিয়ল বললো,
“আমার চেহারা কি কুৎসিত যে আমার চেহারা দেখে তুমি ভয়ে চিৎকার করে উঠেছো?”

“জানলে কী করে যে আমি এখানে আছি?”

“জানতাম না তো। আমি তো গত আধ ঘণ্টা ধরে পার্কের এ কর্ণার থেকে ও কর্ণার ঘুরছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম এ কর্ণারে একটা রেড ফেইরি বসে আছে। রেড ফেইরিটাকে চেনা চেনা লাগলো দূর থেকে দেখে। একটু সময় দেখার পর বুঝলাম এ তো কোনো রেড ফেইরি নয়, এ তো আমার ভায়োলেট কুইন!”

ইরতিজা লাল হিজাব পরে আছে বলে ক্যানিয়ল ‘রেড ফেইরি’ কথাটার ব্যবহার করেছে। তবে ইরতিজা অবাক হয়েছে ক্যানিয়লের শেষের বলা কথাটা শুনে। ‘আমার ভায়োলেট কুইন’! ক্যানিয়ল তাকে নিজের বলে দাবি করছে? ক্যানিয়লের এমন দাবির অংশ হয়ে নিবিড় ভালোলাগার দোলায় হৃদয় দুলে উঠলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে।

ক্যানিয়ল বেঞ্চির পিছন ঘুরে সামনে এসে বসলো বেঞ্চিতে। ইরতিজার এক হাত ধরে টান দিতেই ইরতিজা ধপ করে বসে পড়লো ক্যানিয়লের পাশে। হঠাৎই বিব্রত বোধ এসে ঘেরাও করলো ইরতিজাকে। ক্যানিয়ল ওর দু চোখে শান্ত দৃষ্টি রেখে নিবিড় কণ্ঠে বললো,
“আমি কী যেন বলতে চাই তোমাকে, কিন্তু তোমার চোখের দিকে তাকালেই ভুলে যাই কী বলার ছিল!”

বিব্রতবোধটা এবার কাঁটা হয়ে সারা শরীরে বিঁধে বসলো। পর্যাপ্ত অক্সিজেনের যেন অভাব লেগেছে এমন মনে হলো তার। কারণ স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না সে! চাচ্ছে এই মুহূর্তে ক্যানিয়লের দৃষ্টির সীমা হতে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু সে নিজেই ক্যানিয়লের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। দুই জোড়া আঁখি কিছু সময় একত্রিত হয়ে রইল। এরপর ক্যানিয়ল চোখ সরিয়ে নিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। এতক্ষণ যেন সে মনের ভুলেই তাকিয়ে ছিল ইরতিজার চোখের দিকে। ভীষণ লজ্জাবোধ করলো সে! কয়েকটা মুহূর্ত চুপচাপ কেটে গেল।
এক সময় ক্যানিয়ল বললো,
“জোনাকির মেলা কখনও দেখেছো ইজা?”

“জোনাকির মেলা?”

“হুম। আমার ট্রি হাউজে বেশিরভাগ সময়ই জোনাকির মেলা বসে। কখনও একা একা দেখি সেই মেলা, কখনো বা সামুরা সাথে থাকে। তবে আমি চাইছি আমার নতুন একজন সঙ্গী হোক।”
ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে ফিরে বললো,
“উইল ইউ বি মাই নিউ পার্টনার?”

ইরতিজার বক্ষৎপঞ্জর মৃদু কেঁপে উঠলো। চমকালো সে। মুখের বাক্যরা সব নিশ্চল হতে শুরু করেছিল। কিন্তু তার আগেই দ্রুত উত্তর দিলো সে,
“নো, ইট’স নট পসিবল। জোনাকিরা তো রাতে আসে। আর রাতে তোমার সাথে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।”

“কেন? আমি কি ভাল্লুক? তোমাকে রাতের অন্ধকারে খেয়ে ফেলবো?”

“আমার ফ্যামিলির কেউ কখনও চাইবে না আমি একটা অপরিচিত ছেলের সাথে কোথাও যাই। রাত একেবারেই মানবে না তারা।”

“আমি তোমার অপরিচিত?”

“আমার ফ্যামিলির কেউ তোমার সাথে পরিচিত নয়।”

“তাহলে চলো আগে তোমার ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হই। তাদের মেয়ে এত গভীরভাবে যার প্রেমে পড়েছে তাকেই চেনে না তারা? না, এটা একটা সমীচীন ব্যাপার হলো না! তোমার অবশ্যই তাদের জানালো উচিত ছিল তুমি একজন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ছেলের প্রেমে পড়েছো।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার হাত ধরে ওকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সামনে কয়েক পা এগোলেই ইরতিজা উল্টো ক্যানিয়লের হাত টেনে ধরে বললো,
“না ক্যানিয়ল, এমনটা কখনও করা যাবে না, ভুলেও করা যাবে না। একটা সামান্য দুর্ঘটনা থেকে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে! আবার কিছু একটা ঘটলে শুধু আমার জীবনের বিধ্বস্ত ভগ্নাংশটুকুই খুঁজে পাওয়া যাবে, আমি বিলীন হয়ে যাব একেবারে!”

ক্যানিয়ল অবাক হয়ে বললো,
“কেন বিলীন হয়ে যাবে?”

“আমার বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে আমায়!”

ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো না ইরতিজার জীবন কীভাবে বিলীন হবে। আর বিলীন হয়ে যাওয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়ারই বা কী সম্পর্ক? সে এগুলো নিয়ে ভাবলোও না। তার ধারণা ইরতিজা যা বলেছে তা ইরতিজার নিজেরই বোধগম্য নয়। অযথাই না বুঝে একটা কথা বলে দিয়েছে। সে শুধু একটু নিকটে এগিয়ে এসে শুধালো,
“আমি থাকতে কার সাহস হবে তোমাকে বিয়ে করার? আমার আকাশে ইতোমধ্যে তুমি নিজের আলোর চিহ্ন ফেলে রেখেছো। এটা মুছে ফেলার উপায় নেই। আর তোমাকে ছেড়ে দেওয়ারও উপায় নেই। তোমাকে কেবল আঁকড়ে ধরে রাখা যায়। কার সাহস হবে আমার আঁকড়ে ধরা মানুষকে বিয়ে করবে?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here