উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৩৭

0
505

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩৭
_________________

কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। গাঢ় কুয়াশায় বাইরেটা ঢাকা পড়েছে। আজ হঠাৎ করেই এত কুয়াশা পড়লো। এতদিন এত কুয়াশা পড়তে দেখা যায়নি। একটু পর পর একটা দুটো গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে যাচ্ছে। এই কুয়াশার মাঝে গাড়ি চালাতে হয় খুব সাবধানে, সচকিতভাবে।
আজাদ চৌধুরীও এখন বেরিয়ে পড়বেন। যাওয়ার আগে দুই মেয়ের জন্য দুই কাপ কফি তৈরি করলেন। শারমিন আহমেদ থাকা সত্ত্বেও সে মাঝে মধ্যেই মেয়েদের নিজ হাতে চা অথবা কফি বানিয়ে খাওয়ায়। নওরিন ঘুমাচ্ছিল। আজাদ চৌধুরী নক করার পর উঠে দরজা খুললো। নওরিনের ঘুম ঘুম চোখ দেখে আজাদ চৌধুরী বললেন,
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে?”

নওরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

“কাজ নেই আজকে?”

“ছুটি নিয়েছি।”

“তুমি কি কোনো কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?” নওরিনকে দেখে হঠাৎ এমনই মনে হলো তার।

নওরিন একটু অপ্রস্তুত বোধ করলো। হ্যাঁ সে একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। কিন্তু সেটা বাবাকে বলা ঠিক মনে হলো না। সে দুই পাশে হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো,
“নাথিং। কোনো বিষয় নিয়েই দুশ্চিন্তা করছি না।”

আজাদ চৌধুরীর মন থেকে সংশয় গেল না। তবুও সে মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললেন,
“ছুটির দিন ভালো কাটুক ডিয়ার।”

নওরিনও হাসলো বাবার সাথে সাথে। কিন্তু বাবা চলে যাওয়া মাত্রই তার মুখ আবার আঁধারে ঢাকলো।

ইরতিজা জানালার ধারে বসে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতিতে তাকিয়ে ছিল। এর মাঝে কানে এলো,
“মে আই কাম ইন?”

দরজায় তাকিয়ে দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছে। একটুখানি হেসে বললো,
“কামিং।”

আজাদ চৌধুরী ভিতরে ঢুকলেন। কফির কাপটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। ইরতিজার সামনে এসে ওর মুখটা দেখলেন ভালো করে। বললেন,
“তুমিও কি তোমার বোনের মতো কোনো কারণে চিন্তিত?”

চমকে গেল ইরতিজা। বাবা কী করে বুঝতে পারলো? বিষয়টা গোপন রেখে গেল ইরতিজা। বললো,
“নাথিং।”

“তোমার বোনও একই কথা বলেছে, ‘নাথিং’!”

“আসলেই কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না।”

“আমার মেয়েরা মিথ্যা বলায় খুব পারদর্শী, যেটা বুঝতে পারছি আজকাল।”

ইরতিজা ধরা পড়ে গিয়ে মাথা নুইয়ে ফেললো। কিয়ৎকাল নত অবস্থায় থেকে হঠাৎ সোজা হয়ে বসে সবল কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ আমি চিন্তিত ছিলাম। এটা নিয়ে ভীষণ ভেবেছি আমি। খুব ভালো করে ভেবেছি। আর সব ভেবেচিন্তে যে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছি সেটা হলো, আমি সাজিদকে একদমই বিয়ে করতে পারবো না।”

“কিন্তু বিয়ে করতে হলে একদমই করতে হবে। আমার ধারণা মতে ‘একটুখানি’ বিয়ে করা যায় না।”

“তুমি কি এটাকে মজা ভাবছো আব্বু? আমি সিরিয়াসলি বলেছি। ইট’স নট আ জোক!”

“হ্যাঁ তুমি হয়তো জোক করছো না, কিন্তু এটা অনেকটা তার মতোই শোনালো।”

অসহায়ত্ব যেনো দুই হাত দিয়ে ইরতিজার মুখটা লেপ্টে দিয়ে গেল। তা দেখে একটু সিরিয়াস হলেন আজাদ চৌধুরী। জিজ্ঞেস করলেন,
“কেন বিয়ে করতে চাও না এর উপযুক্ত কারণ কি তোমার কাছে আছে?”

ইরতিজা নিরুত্তর রইল।

“বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা যেন অবশ্যই জোনাস না হয়!” আজাদ চৌধুরী বললেন।

ইরতিজা যারপরনাই অবাক।
“কী বলছো আব্বু! এটার কারণ জোনাস কেন হবে? কারণটা অবশ্যই ও নয়। সাজিদকে বিয়ে না করার তেমন কোনো কারণও নেই। কিন্তু…”

আজাদ চৌধুরী থামিয়ে দিলেন ইরতিজাকে,
“নিজের কথার মাঝখান থেকে যে যত বেশি ‘কিন্তু’ শব্দকে এড়িয়ে চলতে পারবে, আমি মনে করি তার জীবন তত বেশি সুন্দর। তুমিও নিজের জীবন সুন্দর করার চেষ্টা করো ইরতিজা। ইনশাআল্লাহ তুমি সুখী হবে!”

“কিন্তু আমি যদি ‘কিন্তু’ শব্দটা এড়িয়ে যাই তাহলে এটা আমার পিছনেই পড়ে থাকবে। জীবন সুখীর বদলে আরও কিন্তুপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ এটার কোনো সমাধান হয়নি। আমি এড়িয়ে গেছি কিন্তুকে। ওই কিন্তুতেই আটকে গেছে সবকিছু, সমাধানহীন। যতক্ষণ না এটা নিজের সমাধান খুঁজে পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে।”

আজাদ চৌধুরী এবার সঙ্গে সঙ্গে কোনো দ্বিরুক্তি করলেন না। বেশ কিছু সময় নীরবতা পালন করে বললেন,
“আমি কাকে বেশি ভালোবাসি ইরতিজা? তোমাকে? না কি নওরিনকে?”

“আমাদের দুজনকেই প্রচণ্ড রকম ভালোবাসো, কিন্তু আমি আমার জন্য ভালোবাসাটা একটু বেশি দেখতে পাই।”

“এমনটা কি হওয়ার কথা? সম্পর্ক অনুযায়ী তো আমার নওরিনকে বেশি ভালোবাসা উচিত। কারণ ও আমার মেয়ে।”

“আমিও তোমারই মেয়ে আব্বু।” গলা চড়াও করে বলে উঠলো ইরতিজা। ভীষণ জোর লক্ষ করা গেল তার গলায়।

আজাদ চৌধুরী স্মিত হেসে বললেন,
“হ্যাঁ তুমি আমার মেয়ে। আর আমি তোমার বাবা। যে বাবা তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। যে তোমাকে এতটা ভালোবাসে সে নিশ্চয়ই চাইবে না তুমি খারাপ থাকো। চাইবে?”
প্রশ্নটা ইরতিজার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

ইরতিজা বললো,
“চাইবে না।”

“আমি সাজিদের মাঝে ওই জিনিসটা দেখতে পেয়েছি, যেটা দেখে আমার মনে হয়েছে আমার মেয়ে একশ ভাগ ভালো থাকবে এর কাছে। এমন একটা নিশ্চয়তার স্থান ছেড়ে দিয়ে আমি অন্য স্থানের দিকে পা বাড়ালে সেটা এমন নিশ্চয়তার না’ও হতে পারে। তো অযথাই অমন সংশয়ের দিকে আমি কেন এগোবো?”

“এমনটা তোমার কাছে মনে হচ্ছে…”

ইরতিজা আর কিছু বলার আগেই আজাদ চৌধুরী বললেন,
“যেতে হবে আমাকে। এমনিতেই অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছি।”
তিনি ইরতিজার কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ইরতিজার এই মুহূর্তে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কাঁদতে পারলো না। শুনতে পেল জুহি তাকে ডাকছে। সে ব্যাগ পত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, সাথে কফির কাপটা নিতেও ভুললো না।
লনে এসে দেখলো জুহি এবং রিশন দাঁড়িয়ে আছে। জুহির গায়ে একটা রেড জ্যাকেট সাথে রেড টুপি। ব্লন্ড কালার করা চুলগুলো দুই কাঁধ বেয়ে সামনের দিকে নেমেছে। গতকালই এই কালার করেছে চুলে। ভালোই লাগছে ওকে এই চুলে দেখতে। রিশনের গায়ে একটা নেভি ব্লু জ্যাকেট। প্রায় এই রকমই একটা জ্যাকেট জোনাসেরও আছে। জ্যাকেটটা শুধু একবারই দেখেছিল জোনাসের গায়ে। যেদিন প্রথম জোনাসের সাইকেলে চড়েছিল সেইদিন। রিশনের সমস্যা কী? মাঝে মাঝেই সে জোনাসের মতো করে ওর গাল টেনে দেয়! আজ আবার জোনাসের মতো জ্যাকেটও পরেছে! অবাক বিষয়!
ইরতিজা সামনে এসে দাঁড়াতেই রিশন ইরতিজার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ আমার জন্য কফি নিয়ে আসার জন্য।”
বলেই কাপে চুমুক দিলো।

এক চুমুক খেয়ে কাপটা আবার ফিরিয়ে দিলো ইরতিজাকে। ইরতিজা কাপটা ধরলো না। বললো,
“এটা আমার আব্বু বানিয়েছিল, আমার জন্য।”

“ও তাহলে তোমার কফি খেয়ে ফেললাম? ইট’স অল রাইট। আঙ্কল তোমার জন্য কফিটা বানিয়েছিল। আর তুমি কী? তুমি হচ্ছ একজন মানুষ। অতএব বলা যায় আঙ্কল একজন মানুষের জন্য কফিটা বানিয়েছিল। আমিও তো একজন মানুষ। সেই হিসাবে তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য নেই।”
বলে হাসলো রিশন।

ইরতিজা তাজ্জব বনে গেল! কী বললো রিশন? মাথার উপর দিয়ে গেছে সব।

জুহি বিরক্ত নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ইউ জাস্ট শাট আপ ননসেন্স!”

ননসেন্স বলায় খেপে গেল রিশন। খ্যাপা দৃষ্টি জোড়া জুহির উপর নিক্ষেপ করতেই ইরতিজা বুঝতে পারলো এখানে একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি হতে চলেছে। সে একদমই চাইছে না কোনো গণ্ডগোলের সৃষ্টি হোক। তাই সে এক মুহূর্ত ব্যয় না করে দুই হাত দিয়ে জুহি এবং রিশনের একটা হাত আঁকড়ে ধরে সামনে এগোতে এগোতে বললো,
“আমদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো তাড়াতাড়ি।”

ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশের আগে গাড়িতে বসে ইরতিজা মুখ ঢেকে নিয়েছে হিজাব দিয়ে। ক্ষতটা গতকালকের পাওয়া। এখনও বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে। ক্ষতটা সে কাউকে দেখাতে চাইছে না। দেখা মাত্রই তো কেউ কেউ প্রশ্ন করে বসবে। সাজিদের মতো অন্য কিছুও ভেবে বসতে পারে তারা!
ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা তিনজন। বেথ নামের বান্ধবিটা ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। একটা খবর জানালো। খবরটা ক্যানিয়ল সংক্রান্ত। গতরাতে ক্যানিয়ল একটা ছেলেকে প্রচণ্ড মা/র/ধ/র করেছে। বলা হয়েছে আজ পর্যন্ত ক্যানিয়ল যত জনকে মে’রে’ছে তার ভিতর এই ঘটনাটা সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিক!
খবরটা শুনেই গা শিউরে উঠলো জুহির। চোখে-মুখে ভয় ছেপে গেছে মেয়েটার!
ওদিকে ইরতিজাও ভীষণ চমকে গেছে খবরটা শুনে। সেই সাথে একরাশ চিন্তার মেঘ এসে তার ছোট্ট আননখানিতে দখল গেড়ে বসেছে। তার বুঝতে বেশি সময় লাগলো না ক্যানিয়ল কাকে এমন বাজে ভাবে মেরেছে। ওই ছেলেটা বেলিক। হ্যাঁ, বেলিকই এটা। ইরতিজা পিছন ঘুরে দৌড়ে যেতে লাগলো। জুহি অবাক হয়ে পিছন থেকে বলে উঠলো,
“কোথায় যাচ্ছ?”

“ক্যানিয়লের কাছে।”

“ক্যানিয়ল? তুমি পাগল? ওর কাছে কেন যাচ্ছ তুমি? হি ইজ আ সাইকো! সাইকো না হলে এমন ভাবে মা’র’তে পারতো বেচারা ছেলেটিকে?”

ইরতিজা আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। আজ নিজেকে তার বড্ড নির্দয় বলে মনে হচ্ছে। কারণ বেলিকের খবরটা শুনে তার একটুও খারাপ লাগছে না। বরং কেন যেন আনন্দ উপলব্ধি হচ্ছে। ক্লাসরুম, ক্যাম্পাস খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে ক্যান্টিনে পাওয়া গেল ক্যানিয়লকে। স্থির হয়ে দাঁড়ানো মাত্রই হাঁপাতে লাগলো ইরতিজা।
ক্যানিয়ল অবাক হয়ে দেখছিল ইরতিজাকে। আজ একটা সিলভার রঙের হিজাব পরেছে ও। হিজাবের সাথে সিলভার রঙের সুন্দর একটা ব্যান্ডও পরেছে। ক্ষণকাল পার হলে সে বললো,
“তোমার এমন ভাবে ছুটে আসার কারণ বুঝতে পারছি না পাকিস্টানি গার্ল! কী ঘটেছে?”

“বেলিককে মেরেছো তুমি?” প্রশ্নটা করার সময়ও হাঁপানো ভাবটা কমেনি ইরতিজার।

“তা তো জানি না। তবে একটা লম্পটকে মে’রে’ছি। যে মারটা তার প্রাপ্য ছিল, সে মারটা পরিশোধ করেছি। বাস, এটুকুই তো ঘটনা।”

“নিষ্ঠুরের মতো এত বেশি কেন মেরেছো ওকে?”

“এটা ওর প্রাপ্য ছিল।”

“কেন প্রাপ্য ছিল?”

“কারণ আমি চাইছিলাম তাই।”

“আমার সাথে ওরকম আচরণই কি আজ ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী?”

ক্যানিয়ল অবজ্ঞাত কণ্ঠে বললো,
“অবশ্যই না। তুমি কে যে তোমার জন্য আমি ওকে এভাবে মা’র’বো?”

“তাহলে কার জন্য মেরেছো?”

“নিজের জন্য।”

“যেমন?”

“ও আমার মানুষের সাথে বাজে আচরণ করেছিল! মানুষটা আমার হওয়ার কারণেই এত মার খেয়েছে। নয়তো শাস্তিটা এর থেকে ছোটো হতো।”

“আমি তোমার মানুষ?”

“নও?”

ইরতিজা ক্যানিয়লের পাশের চেয়ারটায় বসে ওর দিকে খানিকটা এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“হাত ভে/ঙে দেবো ছেলে, আর কখনও উত্তর না দিয়ে এমন পাল্টা প্রশ্ন করলে। তোমার এমন প্রশ্ন আমায় বিভ্রান্তিতে ফেলে!”

ইরতিজার কথা শুনে কিছুক্ষণ বিমূর্ত হয়ে বসে রইল ক্যানিয়ল। ইরতিজার চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির হয়ে ছিল। হঠাৎ হেসে বললো,
“আমাকে আঘাত করারও দুঃসাহস আছে তোমার?”

“আছে।”
বলে ক্যানিয়লের বক্ষ বরাবর ঘু’ষি মা’রার একটা চেষ্টা চালালেই ক্যানিয়ল হাতটা খপ ধরে ফেললো। বললো,
“কিন্তু আমার সাহস নেই তোমাকে আঘাত করার। আমি পারবো না তোমাকে আঘাত করতে। আঁকড়ে ধরার বস্তুকে আঘাত করবো কীভাবে?”

ক্যানিয়ল ইরতিজার মুখের সামনে থেকে হিজাবের অংশটা সরালো। খুব সাবধানে সরিয়েছে, যাতে করে হিজাবটা ঠিকঠাক থাকে। গালের লালচে ভাবটা এখন আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে ঠোঁটের ক্ষতটা এখনও গাঢ় ভাব। জিজ্ঞেস করলো,
“এখনও ব্যথা অনুভব হয়?”

ইরতিজা না বোধক মাথা নাড়লো।

“তাহলে আমি কেন ক্ষতহীন হয়েও তোমার ক্ষত দেখে ব্যথা অনুভব করছি ইজা?” গভীর কণ্ঠে বললো ক্যানিয়ল।

ইরতিজার হৃদয়ে মৃদু ঝিরিঝিরি কাঁপন সৃষ্টি হলো। নিঃশ্বাসের পালা ভারী হয়ে আসছে তার। এই মুহূর্তটায় মনে হলো ক্যানিয়ল তার জনম জনমের আপন কেউ। অথচ ক্যানিয়লের সাথে তার পরিচয় দীর্ঘ কোনো সময়ের নয়। হৃদয়ের কাঁপন ক্রমাগত বাড়ছিল। যেমন হাওয়া এসে ফুলের ডাল হতে কোমল পুষ্পপাপড়ি ঝরিয়ে দিয়ে যায়, তেমনি তার হৃদয়েও অনুভূতি বর্ষণ হতে লাগলো।
পরিবেশটা গুমোট হয়ে উঠেছিল, তাই পরিবেশ হালকা করতে ইরতিজা বললো,
“পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলে?”

“না। তবে যেতে হবে। সকালে কল করেছিল। একটু পর…হয়তো বা এখনই এসে পড়বে পুলিশ। মনে হচ্ছে এবার সহজে ছাড়া পাবো না। একটা দুটো দিন আটক থাকতে হতে পারে।”

কথাটা শুনে ইরতিজার মুখ কালো হয়ে গেল। সে আর কিছু না বলে বসে রইল চুপ করে।
ক্যানিয়ল মজা করে বললো,
“তুমি কিন্তু আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে, যাতে আরও দীর্ঘদিন পুলিশ স্টেশনে থাকার সৌভাগ্য হয় আমার।”

জুহি, রিশন, বেথ, আন্দ্রেজ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ক্যানিয়ল আর ইরতিজাকে। তাদের সকলের মনে একই চিন্তার উদয় হচ্ছে। জুহির মনটা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল। উদীয়মান চিন্তাটা সত্যি হওয়ার আশঙ্কায় নয়, এটা আন্দ্রেজের জন্য হচ্ছিল। আন্দ্রেজ তার পাশেই দাঁড়ানো। সে নিচু স্বরে আন্দ্রেজকে বললো,
“সবাই সবার অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে, উঠছে এবং উঠবে। শুধু আমাদের অনুভূতিই কোনোদিন সচেতনতা পাবে না!”
তার কণ্ঠে মিশে আছে অবসাদের আভাস। যেটা খুব উপলব্ধি করতে পারলো আন্দ্রেজ। সে পাশ ফিরে তাকালো ক্ষণিকের জন্য। তারপর এ জায়গা হতে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
জুহিও ওর পিছন পিছন এসে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো,
“মার্টা কী এমন বিশেষ, যেটা আমি হতে পারি না তোমার কাছে? কোন বিষয়টা আমার মাঝে কম আছে? মার্টা আমার থেকে বেশি সুন্দর এটাই কারণ আমাকে রেখে ওকে পছন্দ করার?…উত্তর দিচ্ছ না কেন ড্যাম?”

আন্দ্রেজ দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেকের মনোযোগই তার আর জুহির উপর এসে পড়েছে। ভীষণ অপমান বোধ হলো আন্দ্রেজের। লজ্জা, অপমানে মাথাই নত হয়ে আসছে তার। তবুও সে সেসব উপেক্ষা করার চেষ্টা করে বললো,
“সিনক্রিয়েট করো না জুহি। সব জায়গা সিনক্রিয়েট করার জন্য উপযুক্ত নয়।”
বলে সে আবারও হাঁটতে লাগলো।

জুহির হৃদয়ে এই সময় যে কী অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটা কেউ দেখছিল না। শুধু হৃদয় দহনের যন্ত্রণা সে একা ভোগ করছিল, আর একা দেখছিল হৃদয় কীভাবে দগ্ধ হচ্ছে।
আন্দ্রেজের ফেলে রেখে যাওয়া পথে হঠাৎ কয়েকজন ইন্সপেক্টরের পদচারণ পড়লো। সচকিত হয়ে উঠলো জুহির চোখের তারা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here