একগুচ্ছ_ভালোবাসা লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী) পর্ব : ২

২+৩
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ২
মহিলাটি চমকে গিয়ে বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর চোখ নিচে করে ছাতার দিকে তাকিয়ে সালাম নিয়ে বললেন….
–“আমি তোমার ছাতা নিলে তুমি বাড়ি কি করে যাবে গো মেয়ে?”
আমি এক গাল হাসলাম। তারপর সরু গলায় বললাম,,,
–“আমি তো চলে যেতে পারব। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও সমস্যা হবে না। আপনার তো হাঁটুতে ব্যাথা। তাই বলছি আপনি আমার ছাতা নিয়ে যেতে পারেন।”

আমার কথা শুনে আবারও বিস্মিত চোখে তাকালেন উনি। এবার উনার চোখগুলো যেন আগের চেয়েও বিস্মিত। উনার বিস্মিত চোখজোড়া দেখে আমার চোখজোড়া সরু হয়ে গেল। আমি কি কিছু ভুল বলে ফেললাম নাকি? উনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন…
–“তোমার নাম কি বাছা?”
–” জ্বি! অনুশ্রী আহমেদ অনু।”
আমার কথা শুনে উনি নিজের চশমায় হাত লাগিয়ে ভালো করে তাকালেন। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,,,
–“ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো হবে না। আমায় বাড়ি যেতে হবে। নাহলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”
আমি উনার কথা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ হয়ে গেলাম। আশেপাশে তাকালাম। একটা সিএনজি দেখে মহিলাটির দিকে তাকালাম। বুঝতে পারছি না উনি কি সিএনজি তে যেতে রাজি হবেন? দেখে তো বেশ বড়লোক মানুষ মনে হচ্ছে। তবুও সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম আমি।
–“আন্টি, কিছু যদি মনে না করেন তবে আপনি সিএনজি করে যেতে পারেন। আমি ব্যবস্থা করে দিই?”

উনি আমার গাল চেপে হালকা হাসলেন। তারপর বললেন,,,
–“তাহলে তো ভালোই হয়। বেঁচে থাকো। আজকাল তোমার মতো ভালো মনের মেয়ে খুব কম দেখেছি।”
আমি মুচকি হাসলাম। সিএনজিতে থাকা ড্রাইভারের সাথে কথাবার্তা বলতেই বৃষ্টি কমে এলো। আন্টির কাছে গিয়ে ছাতা দিয়ে নিয়ে এসে উনাকে সিএনজিতে বসালাম। তারপর নিজের মাথার ওপর ছাতা ধরে বললাম,,,
–“তাহলে আসি আন্টি?”
কথাটা বলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে নিলাম আমি। সাথে সাথে উনি আমার হাত ধরে বসলেন। আমি উনার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই হুট করে উনি বললেন….
–“তোমার বাড়ির এড্রেস টা একটু বলো তো অনুশ্রী!”
আমি উনার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমার নিরবতা দেখে আন্টি আবারও বললেন….
–“কি হলো বলবে না? তোমার বাড়িতে এক কাপ চা খেতে গেলে কি খুব সমস্যা হবে?”
–“না না একদমই না। সমস্যা হবে কেন আন্টি? আমি বলছি।”
উনি তড়িঘড়ি করে উনার পার্স থেকে একটা ছোটখাটো প্যাড আর কলম বের করলেন। আমি আরেকদফা চমকে গেলাম। তারপর উনাকে ঠিকানা বলে বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম নিজের বাড়িতে।

বাড়িতে আসতেই মামি মার নানানরকম খোঁটা দেওয়া কথা শুরু হলো। আসতে এতো লেট হলো কেন, কি করছিলাম, ছাতা থাকা সত্ত্বেও কেন এতো দেরি হলো ইত্যাদি ইত্যাদি! সেসব কথায় আমি পাত্তা দিলাম না। এসব কথা শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত। চলে এলাম নিজের ঘরে। পাঁচ মিনিটের জন্য গা এলিয়ে দিলাম। জানি কিছুক্ষণ পরই মামি মা কাজ করার জন্য ডেকে বসবেন। তাই এখনই শুয়ে পড়লাম।

এভাবে কাটল আরো দুটো দিন। পরেরদিন সকালে গভীর ঘুম থেকে এক প্রকার জোর করেই উঠিয়ে দিলো মামি মা। আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে মামি মাকে বললাম,,
–“মামি মা! সবে তো ৮ বাজছে। আজ তো অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য কোনো কোচিং নেই। আর এখন তো কাজ করি না আমি। সময় হলে করে দেব মামি মা। কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছি।”

আমার কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকালো মামি মা। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলে উঠল,,,
–“নবাবজাদি আসছে। তাকে ৮:৩০ এর আগে কাজ করানো যাবে না। শোন আমার বাড়িতে বসে অলক্ষ্মীর মতো অন্য ধ্বংস করেছিস। আমার তো মনে হয় আমার স্বামীও মরেছে তোর জন্য।”
মামি মার শেষ কথা শুনে ঘুমটা ছুটে গেলো আমার। চোখ ঢলতেই পানি এসে জমা হলো। ছলছল নয়নে মামি মার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
–“এসব কি বলছো তুমি মামি মা? মামার মৃত্যুতে আমি দায়ি? মামার ক্যান্সার হয়েছিল। এটাও আমার দোষ?”
–“তা নয়ত কি? তোর মতো অলক্ষ্মী ঘরে থাকলে তো মানুষ মরবেই। নিজের মাকে তো খেয়েছিস। নিজের মামাকেও খেয়ে নিলি। এখন আমাকে বা আমার ছেলেকে খাওয়ার আগে তোর বিদায় করতে হবে আমায়। এই নে শাড়ি।”

কথাটা বলে মামি মা তার হাতে থাকা একটা মিষ্টি রঙের শাড়ি বেডে ফেলে দিলো। আমার ছলছল নয়নটা বিস্মিত হয়ে গেল মূহুর্তেই! মামি মা লাস্ট আমায় কবে কাপড় কিনে দিয়েছিল সেটা ঠিকঠাক মনে পড়ে না। আজ হঠাৎ শাড়ি? ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না আমার মামি মা কে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মামি মা নিজে থেকে বললেন,,,
–“তোকে বিদায় করার সময় এসে গেছে। অনেক হয়েছে এই বাড়িতে বসে বসে খাওয়া এখন যা খাবি শ্বশুড়বাড়ি। পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। তুই ভালো করে রেডি হয়ে নে। পাত্রপক্ষর যেনো পছন্দ হয় তোর। নয়ত আজ তোর কপালে দুঃখ আছে।”

কথাটা বলে গটগট করে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মামি মা। আমি মামি মার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম। বিয়ে? পাত্রপক্ষ? তার মানে মামি মা এখন আমায় বিয়ে দেওয়ার প্লান করছে? আমি যে বিয়ে করতে চাই না। আমি পড়ালেখা করতে চাই। চাকরি করতে চাই। এখন কি আমার এসব স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে? না কিছুতেই না।
আমি বেড থেকে উঠে দরজা লাগিয়ে দিয়ে শাড়িটা নিয়ে দরজা ঘেঁষে বসে পড়লাম। আর মনে মনে পণ নিলাম বিয়ে করব না কিছুতেই।

প্রায় ১৫ মিনিট সেভাবেই বসে থাকার পর ওপাশে কেউ দরজার কড়া নাড়াতেই আমি শিউরে উঠলাম। মামি মা ওপাশ থেকে জোরালো গলায় বলল,,,
–“সারাজীবনের মনে দরজা দিয়ে বসলি নাকি? রেডি হসনি?”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। আমার জবাব না পেয়ে এবার মামি শ্বাসিয়েই বলে উঠলেন,,
–“আর দশ মিনিটে মাঝে তোকে নিতে আসব আমি। আজ পাত্রপক্ষকে ঘুরে যেতে হলে এই বাড়িতে শেষ দিন।”
মামি মার শ্বাসানো কথায় ভয়ে কেঁপে উঠলাম। মামি মার বিশ্বাস নেই। হয়ত আজ সত্যিই বের করে দিতে পারেন? তখন কোথায় যাব আমি? আমার যে আর থাকার মতো জায়গা নেই।
উঠে দাঁড়িয়ে যত দ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিলাম। শুধু শাড়ি পরতেই মামি মার আগমন ঘটল। আমি দরজা খুলে দিলাম।

মামি মা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমায় মাথা থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে নাক শিটকালো। বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,,
–“অর্কমার ঢেঁকি। শাড়ি পড়েই চুপ হয়ে গেছিস? সাজগোছ তো কিছু করিসনি। গলায় মালা বা হাতে চুড়ি অবধি দিসনি। পাত্রপক্ষকে কি বুঝাতে চাস? তোকে আমি কিছু দিই না? কষ্টে রাখি?”
আমি মামি মার কথায় মাথা নিচু করে ফেললাম। হঠাৎ মামি মা আমার গাল ধরে টিপ পড়িয়ে দিল। হালকা লিপস্টিকও লাগিয়ে দিল। তারপর আমার গাল ছেড়ে আলমারিতে গিয়ে হাত দিতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম,,,
–“মামি মা। আলমারিতে কি খুঁজছ? ওখানে আমার মায়ের জিনিস আছে।”
–“তোর মায়ের তো অনেক গয়নাগাটি ছিল। সেসব কোথায়?”
–“সেটা নিয়ে তুমি কি করবে?”

মামি মা ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বললো,,
–“মরণ! তোর মায়ের ওসব পুরোনো ডিজাইনের জিনিস নিয়ে বড়লোক হব না আমি। তোকে পড়িয়ে দেব।”
আমি আমতা আমতা করতেই মামি মা এক প্রকার টেনেহিঁচড়ে গয়না বের করে ফেলল। আমায় হালকা ওজনের গলার মালা আর চুড়ি পড়িয়ে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে।

আমাকে সবার সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলতেই কানে কানে বললো,,,
–“মনে রাখবি পাত্রপক্ষকে তোর যেন পছন্দ হয়।”
তারপর উনাদের সামনে ঠেলে দিল মামি মা।
আমি সামনে যেতেই মাথা নিচু করে সবাইকে সালাম দিলাম।
সবাই সালাম দিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। তবে আমি উনাদের দিকে এক নজরের জন্যও তাকাতে পারলাম না। চোখ ইতিমধ্যে পানিতে ভরে গেছে। পাত্রপক্ষের সামনে নিজের স্বপ্নগুলে জলাঞ্জলি দেওয়া যে কত কষ্টের সেটা খুব ভালোভাবে অনুভত করতে পারছি।

হঠাৎ একজন মহিলা আমায় জিজ্ঞেস করলেন,,,
–“নাম কি তোমার?”
–“অনুশ্রী আহমেদ অনু।”
–“কোন ক্লাসে পড়?”
–“এইসএইসি পরিক্ষা দিয়েছি।”

এবার কিছুটা বয়স্ক গলা শুনে চোখ থেকে পানির রেশ কেটে গেল গোলগোল চোখ করে তাকালাম সামনে থাকা ব্যক্তির দিকে। একজন মহিলা বসে আছেন। বয়স আনুমানিক ৪০ তো হবেই। অন্য সোফায় একজন লোক বসে আছেন। অর্ধবয়স্ক লোক বলা চলে। আর সবার মাঝে বসে আছেন সেদিনের দেখা হওয়া ওই আন্টি টা! উনাকে এখানে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আন্টি হেসে বলে উঠলেন,,,
–“চমকে গেলে বুঝি? বলেছিলাম চা খেতে আসব একদিন।”
আমি উনার কথার কি উত্তর দিব বুঝতে পারছি না। দুনিয়ার এতো কথা থাকতেও আমি এমন কোনো কথা খুঁজে বের করতে পারলাম না যেই কথা উনাকে বলা যায়। তার মানে এজন্যই উনি বাড়ির এড্রেস লিখে নিয়েছিলেন? এখন নিজের কপালে নিজেকেই ঢিপ দিতে ইচ্ছে করছে।
চোখ ঘুড়িয়ে আশেপাশে তাকাতেই মামি মার দিকে চোখ পড়ল আমার। আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। আমার থেকে চোখ সরিয়ে আন্টির দিকে হাসোজ্জল চেহারা নিয়ে তাকালো মামি মা। তারপর বলল,,
–“মেয়ে পছন্দ হয়েছে তো?”
আন্টি তড়িঘড়ি করে বললেন,,,
–“পছন্দ তো সেদিনই হয়েছিল যেদিন ওকে প্রথম দেখেছিলাম। ওর ব্যবহার আর ওর চেহারা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। কি বলিস নেত্রা?”

কথাটা বলে উনার পাশে থাকা মহিলার দিকে তাকালেন আন্টি। মহিলাটি আমায় ইশারায় ডাকলেন। আমি বাঁকা চোখে মামি মার দিকে তাকালাম। মামি মা আমাকে ওইদিকে যেতে বললো। আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। মহিলাটি আমাকে কাছ থেকে থেকে থুতনি ধরে বললেন,,,
–“ঠিক বলেছো মা। ও আমাদের অনুরাগের জন্য পারফেক্ট। একদম তার মতোই চেহারা তাই না?”

‘তার মতো’ এই অক্ষরটা মাথায় ঢুকল না আমার। কার মতো বোঝাতে চাইছেন উনি? আমায় উনার পাশে বসিয়ে দিলেন মহিলাটি। তারপর আন্টি মামি মার দিকে চেয়ে বললেন,,,
–“দেখুন মিসেস. রাহমান! আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আর পাত্র মানে অনুরাগেরও কোনো আপত্তি থাকবে কিন্তু বড় কথা হচ্ছে অনুশ্রীর কোনো আপত্তি আছে কি না। কারণ ও সদ্য ফুটফুটে কম বয়সী মেয়ে। এই জেনারেশনে মেয়ে। আর আপনাকে তো সবই বলেছি আমি। আমার ছেলেটার প্রথম বউ চলে যাওয়ার পর একদমই খাপছাড়া হয়ে গেছে। সারাদিন অফিস আর অদ্রিজা মানে ওর আর ওর প্রথম বউয়ের মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকে। ওর জীবন তো এভাবে একা থাকলে হবে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনুশ্রীকে অনুরাগের জীবনসঙ্গী বানাতে। এখন আপনারা রাজি তো? অনুশ্রী তুমি রাজি হবে তো?”

আমি আন্টির কথা শুনে অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে চেয়ে রইলাম। একজন মেয়ের সংসারে আমাকে নতুনভাবে ঢুকতে হবে? অন্য মেয়ের জায়গা, অন্য মেয়ের স্বামীকে এখন আমার বলে গছিয়ে দেওয়া হবে কথাটা যেন কিছুতেই মানতে চাইছে না আমার মন। মামি মা অস্থির গলায় বলল,,,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ। ওর মামা মরে যাওয়ার পর থেকে আমিই তো ওর একমাত্র অভিভাবক। আর আপনি যখন ওকে পছন্দ করেছেন। ও ভালো থাকবে। কি তাই না অনুশ্রী মা??” (দাঁতে দাঁত চেপে)

আমি মামি মার কথায় হ্যাঁ বা না কিছুই করলাম না। কারণ আমি চাই না অন্য মেয়ের সংসারে ঢুকতে। চাই না আমি। বুকের মাঝে চাপা থাকা উত্তেজনা কাজ করছে আমার ঘেমে যাচ্ছি আমি। আমার নিরবতা দেখে যেন ওই নেত্রা নামক মহিলাটি কিছু বুঝতে পারলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,,,
–“নার্ভাস হতে নেই। তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্তও নিও না। আমরা চাই না তোমায় জোর করতে। আই থিংক তোমার সময় নেওয়া উচিত।”
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি এক চিলতি হেসে বললেন,,,
–“আমায় আপুনি বলে ডাকতে পারো। আমি পাত্রের বড় বোন হই। নেত্রা। মা, আমি বলি কি অনুশ্রীকে সময় দেওয়া উচিত।”
–“ঠিকই বলছিস। মিসেস. রাহমান, আমরা অনুশ্রীকে সময় দিই। আজকের দিনটা সে ভাবতে থাকুক। কালকে বিকেলের মধ্যে অনুরাগও রাজি হয়ে যাবে। তখন আমরা বরণ দেখা করতে আসব ওকে নিয়ে। আজ আসি।”

মামি মা জোর করে হেসে বলল,,
–“জ্বি। অবশ্যই। ও সময় নিয়ে ভাবুক। শেষমেশ তো মনে হয় রাজিই হবে।”
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে গেলেন সবাই।

সবাই যেতেই আমার ওপর এক প্রকার ঝড় বয়ে গেল। মামি নানানরকম কথা বলে আমায় শ্বাসিয়ে থাপ্পড় কষিয়ে নিজের কাজ করতে চলে গেল। আমি নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়ে শাড়িটা খুলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। নিজের ঘরে একা মন খুলে কাঁদব সেটার জো পর্যন্ত নেই। কিছুক্ষনের মাঝেই ডাক পড়ল। রান্না করতে হবে আমায়। নিজের কষ্ট আর চাপা কান্নাগুলো চাপাই থেকে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেলাম আমি।

ভাবতে ভাবতে সময়টা কেটে গেল। আমাকে ভাবতে দেওয়ার সময়টা পুরোপুরি ভাবে ফুরিয়ে এলো। অবশ্য আমি জানি আমায় বিয়েতে রাজি হতে হবে। নয়ত ফুটপাতে জায়গা হবে আমার।
মামি মার ধমকানি শুনে পরের দিন বিকেলে রেডি হতে শুরু করলাম আমি। আমারই মায়ের একটা আকাশী রঙের শাড়ি বের করে দিয়ে গেছেন মামি মা। পাত্রপক্ষ ঠিক করেছে ওরা এখানে আসবে না। রেস্টুরেন্টে দেখা করবে। সেখানে আমরা ঠিকঠাক কথা বলে নিতে পারব। সেই কারণে রেস্টুরেন্টে যেতে হবে আমায় আর মামি মাকে।

শাড়ি পড়ে চোখে শুধু কাজলটুকু দিয়ে নিলাম। আর মামি মার দেওয়া কিছু গয়না। তারপর মামি মার সাথে বেরিয়ে পড়লাম রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। মামা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম মামা মা আমাকে নিজের বাড়ির গাড়ি করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। তাও আমাকে বিদায় করার তোড়জোড় করতে। বাস্তবতা এতটা নিষ্ঠুর না হলেও পারত! আমি কি কারোর দ্বিতীয় বউ হওয়ারই যোগ্য? প্রথম বউ হতে পারতাম না?

রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে আনুমানিক আধঘন্টার মতো লাগল। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই ওখানে আগে থেকে বসে থাকা আন্টি আর আপুনি নেত্রা এবং তার স্বামীকে দেখতে পেলাম। বাঁকা চোখে তাকিয়ে যখন দেখলাম পাত্র আসেনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
উনাদের দিকে এগিয়ে যেতেই উনাদের মুখে হাসির রেখা দেখতে পেলাম। আমি সালাম দিতেই আমায় আন্টি বললেন,,,
–“তোমার জায়গা আজ আমাদের সাথে নয়। তুমি ওইখানে যাও। ওই টেবিলে গিয়ে বসো (ইশারা করে)। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুরাগ আসবে। তোমাদের একা কথা বলার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আর তোমার মামি মা এখানে আলাদা কথা বলতে চাই।”

আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালাম মামি মার দিকে। মামি মা আমায় চোখ রাঙিয়ে আন্টির দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় যেতে বললেন। ধীরে ধীরে পা ফেলে আমি সেখানে গিয়ে বসলাম।
বুকটা ঢিপঢিপ করছে আমার। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের টেনশন দূর করার চেষ্টা করছি। তবুও বুকটা ঢিপঢিপ করছে যেন। না জানি লোকটা এসে আমায় কি বলবেন। আদোও উনার প্রথম বউয়ের জায়গায় আমায় মানতে পারবেন কি না। আরো নানানরকম কথা মাথায় ঘুরছে। চোখের পলক ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চোখে কি যেন পড়ল। সাথে সাথে চোখ খিঁচে বন্ধ করলাম আমি।
তাকানোর চেষ্টা করতেই চোখটা জ্বালা করতে শুরু করল আমার। দেরি না করে এক চোখ পাকিয়ে কোনোমতে ওয়েটারকে বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম।

চোখে পানির ঝাপটা দিতে থাকলাম। হালকা জ্বালা কমলেও পুরোপুরি কমল না। একাধারে দু মিনিট পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বাইরে চলে এলাম আমি। এখনো পুরোপুরি ভাবে চোখ জ্বালা কমেনি। ঠিক করে আশেপাশে তাকাতেও পারছি না। হুট করে আমার পায়ের হিলটা পিছলে কোনো জায়গায় পড়তেই নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললাম আমি। গিয়ে পড়লাম কারো গায়ের ওপরে। নিজের ব্যালেন্স রাখতে তার জামা খামচে ধরলাম আমি।

চলবে….🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
____________________________________________

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ৩
আমার সামনে থাকা লোকটাও কয়েকধাপ পিছিয়ে গেলেন। অপ্রস্তুত ভাবে আমার বাহুতে হাত রাখলেন। নাকে অদ্ভুত সুগন্ধি এসে ঠেকল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটাকে ঠেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম আমি। বাম পাশের চোখেটা আধো আধো চোখে খোলার চেষ্টা করে চোখমুখ লাল করে রাখা একটা এঙ্গরি ম্যানকে দেখতে পেলাম আমি। ডান পাশের চোখ মেলার চেষ্টা করতেই অবশেষে চোখটা মেলতে পারলাম। তবুও চোখে এখনো হালকা জ্বালাপোড়া করা বিদ্যমান!
মূহুর্তের মাঝে আমার পিছলে পড়া দেখে সবাই ছুটে এলো। নেত্রা আপুনি আমার বাহুতে হাত রেখে বলল,,,
–“তোমরা ঠিক আছো? অনুশ্রী? তুমি ঠিক আছো তো? ব্যাথা পাওনি তো?”
আমি নাবোধক মাথা নাড়ালাম। আপুনি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো…
–“ভাই তুই ঠিক আছিস তো?”

আপুনির মুখে ‘ভাই’ নামটা শুনে চোখজোড়া বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তার মানে সামনে থাকা লোকটায় পাত্র? দ্যা গ্রেট আজমাইন অনুরাগ চৌধুরী! লোকটা গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো,,,
–“আই এম ওকে নেত্রাদি।”
–“দ্যাটস গুড। বাট অনুশ্রী তুমি দেখতে পাওনি ওইখানে কফি পরে ছিল। একে তো স্লিপারী টাইলস তার ওপর কফি। ভাগ্যিস অনুরাগ সময়মতো এসেছিল নাহলে পরে তোমার কি অবস্থা হত ভেবে দেখেছো?”
আমি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে ধীর গলায় বললাম….
–“আসলে আমার চোখে কি যেনো পড়েছিল ঠিক করে দেখতে পাইনি। তাই কফি পড়ে থাকা জায়গাতে পা দিয়ে ফেলেছি।”

আন্টি অপ্রস্তুত হাসলেন। তারপর হালকা কেশে বলে উঠলেন,,
–“আচ্ছা। তোমরা কথা বলো এখন। অনুরাগ তো এসেই গেছে। আর ওয়েটার ওটা পরিষ্কার করে নেবে।”
আমি মাথা নাড়ালাম। উনারা আমাকে আর মি. চৌধুরিকে ছেড়ে নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসলেন। আমি বাঁকা চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে নিলাম। উনার পরণে ওফ হোয়াইট শার্ট তার ওপর কালো কোট, কালো প্যান্ট, হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। আর চেহারার কথা হয়ত যা বলব কম পড়ে যাবে। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ। ফরসাও বলা চলে। প্রশস্ত কপাল, খাঁড়া নাক, হালকা বড় বড় চুল আর গাল ভর্তি দাঁড়ি। উচ্চতায় আনুমানিক ৫ ফুট ৯ বা ১০ ইঞ্চি তো হবেনই। সব মিলিয়ে প্রেমে পড়ার মতো একটা মানুষ। তবে ঠোঁটে যদি হালকা হাসি থাকত তবে মন্দ হত না। হাসিটা থাকলে তার সৌন্দর্যটা বরণ বৃদ্ধিই হত।

এক মিনিটের মাঝে অলরেডি ১০ বার নিজের হাতে থাকা ঘড়ি চেক করেছেন উনি। যেন উনার সময় টা তরতর করে বয়ে চলে যাচ্ছে। অতঃপর হুট করে আমার দিকে এক নজর তাকালেন অনুরাগ। তারপর টেবিল আর চেয়ারের দিকে তাকালেন। বুঝতে পারলাম উনি হয়ত বসার কথা বলতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না।
আমি নিজে থেকে সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। উনিও আমার পেছন পেছন এসে আমার ওপর পাশে বসে টেবিলে হাত রাখলেন। স্তব্ধ ভঙিতে বসে থাকলেন উনি।

প্রায় ১০ মিনিট হয়ে গেল। উনার ফোনে কিছুক্ষণ আগে ফোন আসাতে কেটে গিয়ে উনি এখন ফোন চাপছেন। এদিকে আমি ভ্যাবলাকান্তের মতো বসে রয়েছি। না আমি মুখ দিয়ে কথা বলতে পারছি আর না উনি কিছু বলছেন। এভাবে পুতুলের ন্যায় বসে থাকতে মটেও ভালো লাগছে না আমার। সামনে একজন মানুষ বসে আছেন আর তাও আমায় চুপচাপ থাকতে হচ্ছে বিষয়টা মটেও মানতে পারছি না। উনি কি কথা বলতে জানেন না? বোবা নাকি? হয়ত তাই ই হবে। না না! বোবা তো নয়। নেত্রা আপুনির সাথে তো তখন কথা বলল। তবে কি কিছুক্ষণের জন্য উনি বোবা হয়ে গেলেন?
আমি জোর কদমে মাথা নাড়ালাম। এতোক্ষণ কি সাংঘাতিক ব্যাপার ভাবছিলাম উফফ….! লোকটা নিশ্চয় নিরামিষ মার্কা হবেন। উনার সাথে বিয়ে হলো আমার জীবনটাও নিরামিষময় হয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার কাছে ফোনও নেই যে আমিও উনার মতো বসে বসে ফোন চাপব। মামি মা আমার ফোনটা ভেঙে ফেলেছিলো। তারপর আর ফোন নামক জিনিসটা হাতে ধরতে পারিনি।

আমার ভাবনার মাঝে হালকা শব্দ হতেই অপ্রস্তুত হয়ে অনুরাগের দিকে তাকালাম। উনি ফোন রেখে দিয়ে আমার দিকে শক্ত চেহারা নিয়ে তাকালেন। উনার চোখমুখ বলে দিচ্ছে এবার উনি সিরিয়াস কিছু কথা বলবেন। আমিও সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম।
আচমকা উনি বলে উঠলেন,,,
–“আপনি কি রাজি আছেন বিয়েতে?”
আমি উনার কথা শুনে আশেপাশে চোখ ঘুরাতে লাগালাম। কি বলা উচিত আমার? হ্যাঁ বলব? অন্যের সংসারে পা রাখতে বার বার মনটা বাঁধ সাধছে। তবুও আমার উপায় নেই। চোখ বন্ধ করে কিছুটা দৃঢ় গলায় বললাম,,,
–“জ্বি।”
উনি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। আমার দিকে গম্ভীর ভাবে তাকালেন। যেন আমার উত্তরটা উনার তেমন পছন্দ হয়নি। থমথমে গলায় বললেন,,,
–“ওকে। বাট আমার সম্পর্কে আপনি সব জানেন তো? আমার ৬ মাসের একটা বেবি আছে? আর আমার অনামিকা আই মিন আমার স্ত্রী গত হয়েছে?”
–“হুমম আমি সব জানি। আমি জেনেশুনেই রাজি হয়েছি বিয়েতে।”
–“আপনাকে আমি বিয়ে করব বাট আপনাকে আ…”
উনার কথাগুলো পূর্ণ হলো না। ফোনের স্ক্রিন ওন হয়ে রিংটোন বাজতে শুরু করল। আর উনার কথা বন্ধ হয়ে গেল। উনি দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ফোনটা ধরে কপাল ভাঁজ করলেন। কয়েক সেকেন্ড পর উনি বললেন,,,
–“ওর হয়ত খিদে পেয়েছে নৌশিন। তুমি খাওয়ানোর চেষ্টা করেছো?”

কথাটা বলে আবারও চুপচাপ ওপাশের কথা শুনতে থাকলেন উনি। ওপাশে কে উনাকে কি বলল তা শুনে পাইনি আমি। তবে উনার কপালের ভাঁজ আরো দৃঢ় হয়ে গেল। ফোনটা কেটে দিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন। উনার ব্যবহারে আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম। উনি আন্টির কাছে গিয়ে আন্টিকে কিছু একটা বলে বিদ্যুৎতের গতিতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি তখনও উনার পানে তাকিয়ে থম মেরে বসে রইলাম।

বিয়ের আগে সেদিনই উনার সাথে প্রথম ও শেষ কথা হয় আমার। হুট করেই বিয়ে ঠিক করে ফেলল মামি মা। যেন তাড়াতাড়ি আমায় বিদায় দিতে পারে। আমিও সব মেনে নিলাম। কারণ আর অন্য কোনো রাস্তা নেই আমার কাছে। খুব সাদামাটা ভাবেই আমার আর মি. চৌধুরির বিয়েটা হয়ে গেল। উনার মতেই খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে হয়। উনি চান নি জাঁকজমকপূর্ণ কোনো বিয়ে করতে।

বিয়ের পর ভেবেছিলাম একটু হলেও কষ্ট থেকে বাঁচতে পারলাম আমি। কিন্তু জানা ছিল না যে আমার কপালে সুখ নেই।
বিয়ের দিন বাবা নামক মানুষটা এসেছিল। অনেকদিন পর তাকে দেখে অভিমানে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। বাবাই আমায় অনুরাগের হাতে তুলে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো। তারপর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম আমি। কিন্তু আফসোস! আমাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কেউ উপস্থিত ছিল না সেখানে। এমনকি আমার স্বামীও আমায় শান্তনা দেয়নি। আমার দিকে এক নজরের জন্যও তাকান নি পর্যন্ত।

অবশেষে শ্বশুড়বাড়ি পৌঁছোতেই যখন মেইন দরজার সামনে দাঁড়ালাম তখন আমার আগেই অনুরাগ বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আমার শ্বাশুড়ি মা আমায় বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসতেই একটা বাচ্চার তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আওয়াজটাকে অনুসরণ করে আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম একটা মেয়ে ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এলো। মেয়েটা বাচ্চাকে থামাতে পারছে না কিছুতেই! বরণ বাচ্চাটার কান্নার বেগ বেড়েই চলেছে। বাচ্চাটাকে দেখে আমার বু্কটা ধুক করে উঠল। ছোট থেকেই বাচ্চা খুব পছন্দ আমার। ওদের ফোকলা দাঁতের হাসিটা কত সুন্দর হয়!

মেয়েটা বাচ্চাকে সোজা করে কোলে নিয়ে অনুরাগের দিকে ইশারা করে বলল,,,
–“ওইযে তোমার পাপা। দেখো তোমার পাপা এসেছে তো।”
অনুরাগের গম্ভীর মুখটাতেও মুচকি হাসি ফুটে উঠল। এই প্রথম যেন হাসতে দেখলাম উনাকে। বুঝতে দেরি হলো না যে ওই বাচ্চাটাই অদ্রিজা! উনার সন্তান। অনুরাগ দ্রুত অদ্রিজাকে কোলে তুলে নিলেন। অদ্রিজার ছোট্ট দুটো গালে চুমু খেয়ে বললেন,,,
–“আমার অদ্রিজা মা টা কাঁদে কেন? এইযে তার পাপা এসেছে। এখন তো তার পাপা তার কাছেই থাকবে!”
কথাটা বলে অদ্রিজার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন অনুরাগ। আমি পিপাসু দৃষ্টিতে অদ্রিজার দিকে চেয়ে থাকলাম। বড্ড ইচ্ছে করছে অদ্রিজাকে ছুঁয়ে দেখতে!
অদ্রিজার কান্না যেন আরো দ্বিগুন বেড়ে গেল। সবার কান ফেটে যাবার উপক্রম। মেয়েটা যেন তার বাবাকে সারাদিনের অভিযোগ দিয়ে চলেছে কান্নার মাধ্যমে।
অদ্রিজার কান্না দেখে আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। বায়না ধরা গলায় বলে উঠলাম,,,
–“অদ্রিজাকে আমার কোলে দিবেন?”
আমার কথায় সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। অনুরাগও আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি কি কিছু ভুল বলে ফেললাম নাকি?
নিজেদের বিস্ময় কাটিয়ে ফেলে মা বলে উঠলেন,,,
–“কিরে অনুরাগ! মেয়েটা অদ্রিজাকে কোলে নিতে চাইছে ওর কোলে দে।”
নেত্রা আপুনিও অপ্রস্তুত গলায় বললেন,,
“হ্যাঁ হ্যাঁ। অনুরাগ দে ওর কোলে। আফটার অল, এখন থেকে তো অনুশ্রীই অদ্রিজার মা।”
অনুরাগ আমার থেকে চোখ সরিয়ে অদ্রিজাকে এগিয়ে দিতেই আমার সাবধানে ওকে কোলে নিলাম। অনুরাগ সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,,,
–“নট এট অল। আমার মেয়ের মা অনামিকা ছিল আছে আর থাকবে। মাইন্ড ইট।”
কথাটা বলে উনি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে চলে গেলেন। আমি হা হয়ে তাকিয়ে থাকলে মা এসে আমার কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বললেন….
–“এখনো অনামিকা কে ভুলতে পারেনি ছেলেটা। তুমি কিছু মনে করো না অনুশ্রী মা! আমার বিশ্বাস আছে তোমার ওপর। তুমি ঠিক অনুরাগের মনে জায়গা করে নিতে পারবে।”
আমি উনার কথায় মাথা নিচু করে মৌনতা অবলম্বন করলাম।
.
বর্তমান….
নিজের অতীতগুলো ঝালাই করতে করতে হঠাৎ করেই চোখটা লেগে এলো আমার। একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি।

সকালটা হতেই তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল আমার। কেন না তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস আগে থেকেই রয়ে গেছে। চোখ কচলে হাই তুলে উঠে বসলাম আমি। বেডে চোখ পড়তেই ঘুমন্ত অনুরাগকে দেখে হাই তোলা মুখটা ঠুস করে বন্ধ হয়ে গেল আমার। তারপর একটা ছোট্ট শ্বাস নিলাম। ভাগ্যিস লোকটা ঘুমোচ্ছে। নয়ত আমার এই হাই তোলা দেখলে নির্ঘাত লজ্জায় পড়তাম! অনুরাগ বেহুঁশের মতো পড়ে থেকে ঘুমোচ্ছেন। আমি ঢ্যাপঢ্যাপ করে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মটেও মনে হবে না উনি এতোটা নির্দয় আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। হয়ত উনি আসলেই নির্দয় আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষই নন। আমার ক্ষেত্রেই হয়ত এমন কঠোর উনি। কিন্তু কেন উনি আমার প্রতি কঠোর? আমি হয়ত বা উনার অনামিকার জায়গায় এসে জুড়ে বসেছি তাই।

দরজায় শব্দ হওয়াতে ভাবনায় ছেদ ঘটলো আমার। কেউ ডাকছে। তাড়াতাড়ি করে উঠে চাদর, কম্বল আর বালিশ বেডে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। দরজা খুলতেই নৌশিনকে দেখতে পেলাম আমি। নৌশিন হলো অনুরাগের ছোট ভাইয়ের বউ। বেশ মিশুকে মেয়েটা। আর শান্তও বটে। আমাকে দেখে হালকা হেসে সে বলে উঠল,,,
–“ঘুম হলো নতুন ভাবি?”
আমি মাথা নাড়ালাম। নৌশিন হাত নাড়িয়ে বলল,,,
–“তাহলে ফ্রেশ হয়ে চলে এসো নিচে।”
–“ঠিক আছে।”
নৌশিন যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। দরজা লাগিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে অনুরাগের দিকে তাকালাম। নজর সরিয়ে লাগেজ খুলে নিজের একটা শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম আমি।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আমি আশেপাশে তাকালাম। অনুরাগ এখনো ঘুমোচ্ছেন। আমি পা টিপে টিপে হেঁটে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। বেডের ঠিক পাশেই ড্রেসিংটেবিল টা রাখা হয়েছে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছি আর চুলগুলো ঝাড়ছি আমি। আমার অজান্তেই চুলে লেগে থাকা পানিগুলো অনুরাগের মুখে গিয়ে পড়ল। সেটা আমি লক্ষ্য না করে নিজের কাজই করে গেলাম।
ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে চমকে গিয়ে অনুরাগের দিকে তাকালাম আমি। উনি চোখ বন্ধ করে বিরবির করছেন। উনার চোখমুখে পানির ফোঁটা দেখে নিজের চুলগুলোতে হাত দিলাম।

–“সকাল সকাল দুষ্টুমি শুরু করলে অনামিকা?”
কথাটা বলে হাতটা নাড়াতে নাড়াতে আমার দিকে হাতাতে থাকলেন উনি। আমি হুরমুর করে উঠে দাঁড়ালাম। অবশেষে আমার হাত ধরে এক টান মারলেন চোখ না খুলেই। আমার চোখজোড়া রসগোল্লার আকৃতি হয়ে গেল। আর আমার মাথায় থাকা একগুচ্ছ ভিজে চুল গিয়ে পড়ল উনার মুখে। উনি চোখ খুলতে খুলতে আমার গালে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,,,
–“ডু ইউ নো অনামিকা? তোমার এই একগুচ্ছ ভিজে চুল আমার কাছে #একগুচ্ছ_ভালোবাসা।”

কথাটা বলে পুরোপুরি ভাবে চোখ খুলতেই আমাকে এক ধাক্কা দিলেন। আমি নিচে পড়ে গেলাম। উনি উঠে বসে পড়লেন। আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,,,
–“অনামিকা! কোথায় গেল অনামিকা? এক্ষুনি তো এখানেই ছিল। ওর বদলে তুমি এলে কি করে?”
কথাটা বলে আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন উনি।
আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। আমায় ফেলে দিয়ে যেন কোমড়টা ভেঙেই ফেলেছেন উনি। কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,,,
–“আপনার প্রিয় অনামিকা ছিল না এখানে। আমিই ছিলাম। বুঝতে পারিনি আপনার মুখে আমার চুলের পানির ছিটে পড়ে গিয়েছিল।”

উনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,,,
–“তুমি এই ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসেছিলে?”
–“হ্যাঁ। এখানে নয়ত কোথায় বসব? আর তো সেকেন্ড ড্রেসিংটেবিল দেখতে পাচ্ছি না আমি।”
উনি সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তেড়ে এলেন। আমি পিছিয়ে গেলাম। আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন,,,
–“তোমাকে আগেই বলেছি অনামিকার কোনো জিনিসে তোমার অধিকার ফলানোর চেষ্টা করবে না। তবুও কেন বসেছো এখানে ডেম ইট?”

উনার কথায় আমার মাথায় টগবগ করে আগুন জ্বলে উঠল। মানে টা কি? অনামিকার জিনিসে হাত লাগাতে যেন আমি মরে যাচ্ছি! রাগের বশে এবার আমিও উনার দিকে তেড়ে আসতেই উনি এবার পিছিয়ে গিয়ে বেডে বসে পড়লেন। যেন আমার এই অগ্নিমূর্তি রুপ কোনোভাবেই এক্সপেক্ট করেন নি উনি। আমি বেডের ওপর একটা ঘুষি মেরে রাগে কটমট করে বললাম,,,
–“লিসেন,, আমি আপনার অনামিকার কোনো জিনিসে হাত লাগাতে মরে যাইনি। এতোই যখন ভালোবাসা তাহলে এসব জিনিস নিজের কলিজার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখুন। আর আমায় অন্য ড্রেসিংটেবিল আসবাবপত্র এনে দিন। এমন ভাব করছেন যেন আমি একটু ড্রেসিংটেবিলে নিজের চেহারা আর বেডে একটু বসলেই জিনিসগুলো আমার হয়ে যাবে। শুনুন আপনার মনে যদি অনামিকার জন্য ভালোবাসা থেকেই থাকে তাহলে সেটা এভাবে নয় অন্যভাবে প্রকাশ করুন। যে কেউ এসব আসবাবপত্র ব্যবহার করতে পারে কিন্তু আপনার মন তো সবাই ব্যবহার করতে পারবে না। তাই এতো হাইপার হওয়ার কোনো মানে নেই।”

কথাটা বলে উনার রিয়েকশন টুকুও দেখার জন্য এক সেকেন্ডও থাকলাম না। দ্রুত গতিতে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে নামতেই অনুরাগ কে ভেঙিয়ে উনার মতো করে মুখ করে বললাম,,,
–“তোমাকে আগেই বলেছি অনামিকার কোনো জিনিসে তোমার অধিকার ফলানোর চেষ্টা করবে না। আহা! কথার কি বাহার তার। (ভেংচি কেটে) নিজেই তো আমার হাত টেনে নিজের ওপর ফেলেছিলি। তারপর ফেলেও দিলি। তার ওপর বড় বড় কথা শোনালো। যত্তসব!”

কথাটা বলে নিচে নামতেই নেত্রা আপুনিকে দেখে নিজের মুখ বন্ধ করলাম আমি। নয়ত আরো দুই চারটা কথা শুনিয়ে দিতাম উনাকে। নেত্রা আপুনি অদ্রিজাকে কোলে নিয়ে আছে। সে অদ্রিজার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,,,
–“কে বড় বড় কথা শোনালো অদ্রিজা?”
আমি হকচকিয়ে গেলাম আপুনির কথা শুনে। তবে সব কি শুনে ফেলল নাকি? আপুনি আবার আমায় এক হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,,
–“কি হলো? বললে না যে।”
–“কই? কে কথা শোনাবে আপুনি?” (জোর করে হাসার চেষ্টা করে)
আপুনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে সন্দেহি নজরে তাকালো। তারপর সরু গলায় বলল….
–“সত্যিই করো কথা বলোনি?”
–” না তো। ওই দেখো অদ্রিজার হয়ত খিদে পেয়েছে। দেখো নিজের আঙ্গুল মুখে দিয়ে বসে আছে।”
আপুনি অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলল,,
–“হ্যাঁ তো। ঠিকই বলেছো।”
আমি একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। কথা ঘুরিয়ে ফেলতে পেরেছি আমি। তারপর হাত বাড়িয়ে অদ্রিজাকে কোলে নিয়ে বললাম,,,
–“আমি ওকে খাইয়ে দিচ্ছি আপুনি।”
কথাটা বলে অদ্রিজাকে নিয়ে চলে আসলাম আমি।

চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here