একগুচ্ছ_ভালোবাসা লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী) পর্ব : ৪

৪+৫
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ৪
অদ্রিজাকে খাইয়ে দিচ্ছি আমি। সে খুব সুন্দর মতো খাচ্ছে। তার সাথে মুখে আশেপাশে খাবার লাগানো তো আছেই। মুছে দিলে আবারও একই কান্ড করছে সে। তার সাথে যেন পা দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। আবার ওর মুখের সামনে গিয়ে চামুচ ধরলাম। ওর মুখে খাবার পুরে দিতে যেতেই ও মুখ সরিয়ে নিল। ফলস্বরূপ ওর গালটা খাবার ভরে একদম আলুথালু অবস্থা হয়ে গেল।
আমি অসহায় মুখ করে পুচকিটার দিকে তাকালাম। এই ছিল তার মনে? আমার অবস্থা দেখে ফিক করে হেঁসে দিলো আপুনি। তারপর আমার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছুরি ধরে আরেক হাতে আপেল নিয়ে বলল,,,
–“কি এতেই হাঁপিয়ে গেলে? কিন্তু কি বলো তো অনুশ্রী সত্যিটা তেঁতো হলেও ওকে তোমাকেই মানুষ করতে হবে। তার সাথে আমার ভাইটার মনের মাঝে জায়গা করেও নিতে হবে। এত্তগুলা দায়িত্ব তোমার। জানি অনুরাগের মনে জায়গা করে নিতে তোমার খানিকটা কষ্ট হবে কিন্তু কি জানো তো? আমার আর মায়ের বিশ্বাস একদিন অনুরাগ তোমাকে ছাড়া কিছুই বুঝবে না।”
আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হাসলাম। আপুনির এতোগুলো কথার উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শব্দ আমার কাছে নেই। তাই হাসাটাই শ্রেয়।

আপুনি ছুরি টেবিলে রেখে ওই হাতটা আমার কাঁধে রাখল তারপর বলল,,,
–“আমি জানি তোমার বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো নয়। এটাও জানি অদ্রিজাকে নিজের মেয়ে হিসেবে এক্সেপ্ট করতে তোমার সময় দরকার। কিন্তু অদ্রিজা এখন ছোট। ওর একটা মায়ের দরকার। আর অনুরাগের একটা কেয়ার করার মানুষ দরকার। অনামিকা যাওয়ার পর ছেলেটা বেশ একরোখা, বদমেজাজি হয়ে পড়েছে। দিন শেষে ওর মুখে এক ফোঁটা হাসিও দেখতে পাওয়া যায় না। আর ছোট্ট কতটুকুই বা বোঝে? অনুরাগ অফিস সেড়ে এসে ওর সাথেই সব কথা বলে।”

কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আপুনি। আমি অদ্রিজাকে কোলে তুলে নিতেই ও আমার গলার চেইন ধরে নাড়তে থাকল। আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে থাকল। আমি আপুনিকে আশ্বস্ত করে বললাম,,,
–“অদ্রিজাকে আমার মেয়ে হিসেবে এক্সেপ্ট করতে সময় লাগবে না বরং আমি ওকে আমার মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়েছি। তুমি চিন্তা করো না। অদ্রিজাকে আমি নিজের বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করব। আর তোমার ভাইয়ের প্রতিও নিজের দায়িত্ব পালন করে যাব।”

আমার কথায় যেন আশ্বস্ত হয়ে গেল আপুনি। স্বস্তির হাসি হাসলো সে। আমি অদ্রিজার কান্ড দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার চেইন মুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে। আমি ওর হাত থেকে চেইন সরিয়ে নিয়ে ওর মুখে খাবার জন্য চামুচ ধরলাম। ও সাথে সাথে হা করে খেয়ে নিল। ছোট মানুষ। তাই দাঁত হালকা হালকা উঠেছে তার। তবে চিবিয়ে খাবার শক্তিটা এখনো হয়নি। তাই ওর জন্য স্পেশাল ভাবে ঝাল ছাড়া খিচুড়ি তৈরি করে সেটা ব্লেন্ড করে নিয়েছি। আমার মনে হয় এতে ওর ভেতরে শাক সবজির সব রকম পুষ্টি যাবে।

অদ্রিজাকে খাওয়ানোর মাঝেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হলেন অনুরাগ। খাবার টেবিলে এসে হুরমুর করে বসলেন উনি। তারপর চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,,,
–“নৌশিন! নৌশিন! খেতে দাও। আমাকে অফিসে যেতে হবে।”
আমি উনার দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারও অদ্রিজাকে খাওয়ানোর দিকে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। আপুনি অনুরাগের উদ্দেশ্যে বিস্মিত গলায় বলে উঠল,,,
–“কি বলছিস ভাই? তোর না সদ্য বিয়ে হয়েছে? এখন নতুন বউকে ছেড়ে তুই অফিস যাবি?”
–“হ্যাঁ। তো সমস্যা কি? আমি কি ওর জন্য নিজের কাজের লস দেব নাকি?”

কথাটা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন অনুরাগ। সাথে সাথে আপুনি চিৎকার করে মা কে ডাকতে শুরু করলো,,,
–“মা! দেখো তোমার ছেলের কান্ড। আজকে অফিস যাচ্ছে ঢ্যাং ঢ্যাং করে।”
অনুরাগ আপুর কথায় পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমিও উনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম সাথে সাথে নজর সরিয়ে নিলাম। উনি আমাকে খুঁচিয়ে আপুনিকে বললেন,,,
–“এটা তুই কার হাতে অদ্রিজাকে খাওয়াতে লাগিয়ে দিয়েছিস নেত্রাদি? ও খাওয়াতে পারবে অদ্রিজাকে?”
–“অবশ্যই পারবে। বরণ আমার আর নৌশিনের থেকে ভালো করে খাওয়াচ্ছে অনুশ্রী। আর অদ্রিজাকে দেখেছিস? ও নিজেও কত হেসেখেলে সুন্দর ভাবে ওর নতুন মায়ের হাতে খেয়ে নিচ্ছে? আর তুই শোন আমার কথা নৌশিন নৌশিন বলে চেঁচাস না। এবার তোর যা লাগবে অনুশ্রীকে বলবি। নৌশিন বেচারিকে শান্তি দে এবার।”

কথার মাঝে নৌশিন দুটো প্লেট নিয়ে এসে রান্নাঘরে রাখতেই অনুরাগ নৌশিনকে বলল,,,
–“নৌশিন। আমাকে খাবার দিতে কি খুব সমস্যা হয় তোমার?”
নৌশিন মাথা নাড়িয়ে বলল,,,
–“একদমই না তো ভাইয়া। আমার সমস্যা হবে কেন?”
অনুরাগ আর কোনো উত্তর না দিয়ে খেতে শুরু করলেন। মুখে খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললেন,,,
–“অর্ণব(অনুরাগের ছোট ভাই) ঘুম থেকে উঠেনি এখনো? অফিস যেতে হবে সেটা কি ভুলে গেছে নাকি?”

নৌশিন কিছু বলার আগেই অর্ণব তাড়াহুড়ো করে এসে অনুরাগের পাশের চেয়ারে বসে দাঁত কেলিয়ে বলল,,,
–“একদমই ভুলিনি ভাইয়া। এইতো একদম রেডি হয়ে এসেছি।”
অনুরাগ অর্ণবের দিকে হালকা চোখ বুলিয়ে নিজের খাবারের দিকে মনোযোগ দিলেন।

খাওয়াদাওয়া সেড়ে সবার হাজার বারণ সত্ত্বেও অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন উনি অর্ণবের সাথে। এদিকে আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কেন না উনি আমার আশেপাশে থাকলে সব সময় অস্বস্তি বোধ হয়। অকারণেই ঘামতে থাকি আমি। তাই উনি যাওয়াতে আমার সুবিধায় হয়েছে বটে। তার ওপর উনি বাড়িতে থাকলে নির্ঘাত সব সময় আমার কানের কাছে এসে চিল্লিয়ে বলতেন এটাতে হাত দিও না। ওটাতে হাত দিও না। ওটা আমার অনামিকার। উনার এসব চিৎকার থেকেও বেঁচে গেলাম আমি।

অনুরাগ যাওয়ার সাথে সাথে আপুনিও নিজের বাড়িতে যাওয়ার তোরজোর শুরু করল। তার নিজেরও তো স্বামী সংসার আছে। এখানে আর কত থাকবে?
আমি তবুও আপুনির কাছে গিয়ে বায়নার সুর তুলে বললাম,,,
–“আরো কয়েকদিন থেকে যাও না আপুনি।”
–“না গো অনুশ্রী! আমার ছেলেটা আবার আমি না থাকলে বড্ড অসুবিধা হয়। খুব এলোমেলো ছেলে ও। সঠিক সময় ওকে সঠিক জিনিস হাতের কাছে এগিয়ে দিতে হয়। বোঝোই তো! কল করে বার বার একই কথা গেলে আমায় নিয়ে যেতে নতুন মামিকে আমিও দেখতাম। আর এখানে নিয়ে আসলে ওর প্রাইভেট টিউশনি মিস যেতো। তাই আজই যেতে হবে।”

আমি নিজের মুখটা ভার করে বললাম,,,
–“আচ্ছা ঠিক আছে। আবার আসবে কিন্তু। তোমার ছেলেকে নিয়ে।”
–“তা তো আসবই। কিন্তু তোমাদের সাজানো গোছানো সংসার দেখতে আসব।”
–“সেটা আর এই জন্মে সম্ভব বলে তো মনে হয় না।” (বিরবির করে)
আমার বিরবির কথা যেন হালকা আন্দাজ করতে পারল আপুনি। আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,,
–“কিছু বললে?”
–“কই না তো।” (হাসার চেষ্টা করে)
আপুনি আর কিছু না বলে নিজের কাজ করতে লাগল। আমিও চলে এলাম অদ্রিজাকে নিয়ে নিজের রুমে। না না নিজের রুম নয় অনুরাগ আর অনামিকার রুম! এই রুমটাকে নিজের রুম বলে আমি তখনই স্বীকার করব যখন অনুরাগ আমায় স্বীকার করবেন। কিন্তু জানি এটা একটা দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। কখনোই পূরণ হবে না হয়ত! কারণ অনামিকার প্রতি উনার ভালোবাসা। ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি যেটা শুধু একজনের প্রতিই হয়। যদি সেটা সেকেন্ড কোনো মানুষের জন্য ফিল হয় তবে সেটাকে ভালোবাসা বলে না! আসলেই কি তাই?

রুমে এনে অদ্রিজাকে শুইয়ে দিতেই অদ্রিজা জোরে শব্দ করে কেঁদে দিল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে থামানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ হলো না। ওর কান্নার বেগ যেন আরো বাড়ল এবং বাড়তেই থাকল। না পেরে ওকে হম্বিতম্বি করে কোলে নিলাম আমি। আমি কোলে নিতেই এতোক্ষণের তীক্ষ্ণ শব্দের কান্না সেকেন্ডেই চুপ হয়ে গেল। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওমা! পাজি মেয়েটা হাসছে! আমি ওর দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকাতেই ও আমার ঘাড় জড়িয়ে ধরে নিজের মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করতে লাগল।
এই বয়সেই এতো ফাজিল ভাবা যায়? ইট মিনস বাপ কা বেটি! বাপ যেমন আসার পর থেকে আমার জীবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে ফেলল তার মেয়েটাও জ্বালানো শুরু করে দিয়েছে অলরেডি। এই দুজনের জ্বালানি সহ্য করতে করতে আমার অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে পড়বে সেটা আমি আন্দাজ করতে পারছি।

অদ্রিজা আমার কোলে যখন চুপ করে আছে তখন ওকে নিয়েই পুরো রুমটা ঘুরতে লাগলাম। কালকে এতোসব ঘটনার মাঝে রুমটা ঠিকঠাক ভাবে চোখ বুলায়নি আমি। তাই আশেপাশে দেখতে থাকলাম অদ্রিজাকে কোলে নিয়ে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে রুমের কালারসহ রুমের ফার্নিচার সব সাদা কালো। রুমের দেওয়াল টাতে সুন্দর করে সাদাকালো পেইন্টিং করা। তাছাড়া কাবার্ড, আলমারি, টেবিল, সোফা,বেড সবই সাদা নয়ত কালো। অদ্ভুত! এমনকি বিছানার চাদরও সাদাকালো। উনার জীবনে কি সাদাকালো ছাড়া অন্য কোনো রঙ নেই? নাকি সেই সাদাকালো টিভির যুগেই নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছেন? হু নোস?

অবশ্য সাদা কালো রঙটা আমারও প্রিয়। দুই রঙটার প্রতি আমার অদ্ভুত আকর্ষণ। সে যাই হোক, আমি দেয়ালের একপাশে অনুরাগের ছবিগুলো দেখতে থাকলাম। বেশির ভাগ ছবিতেই উনার মুচকি হাসিটা ছবিটা প্রাণবন্ত করে রেখেছে। অথচ এখন উনাকে হাসতে দেখিনি বললেই চলে। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। চোখজোড়া গোলগোল করে দেখলাম ছবিটা। এটাই তবে সেই অনামিকা? হুমম তাই হবে। ধীরে ধীরে ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। অজানা টানে ছবিতে হাত দিয়ে বুলিয়ে দিলাম। দেখতে বেশ রুপবতী অনামিকা। তারওপর কালো রঙের শাড়িটা পড়ার কারণে ওর রুপটা জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। তার পাশেই কালো পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনুরাগ। উনি অনামিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। হাতটা মিলিত হলে হয়ত ছবিটার সৌন্দর্য আরো বেড়ে উঠত! তবে মিলেনি।

চোখজোড়া সরিয়ে ফেললাম আমি। অন্য ছবিগুলোতে মনোযোগ দিলাম। এবার অনামিকা সাদা রঙের কামিজ পড়ে আছে। ছবিটা তার অজান্তে তোলা। সে কপালে হাত দিয়ে হাসছে। কি সুন্দর হাসি তার! ওর হাসিটা দেখে যে কেউ প্রেমে পড়তে দুবার ভাবতে না। ছবিটা দেওয়াল থেকে খুলে নিলাম আমি।
অদ্রিজা ছবিটা ছোঁয়ার আগেই হাত দূরে সরিয়ে নিলাম। ওকে বেডে বসিয়ে হাতে ছবি নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালাম আমি। ছবিটা ড্রেসিংটেবিলে ধরে সামনে তাকালাম। খানিকটা হাসার চেষ্টা করলাম। কাকতালীয় ভাবে হলেও অনামিকার চেহারার সাথে আমার চেহারা কিছু মিল আছে। যেমন ওর ঠোঁটের ওপর তিল আছে। আমারও ঠোঁটের ওপরেই তিল আছে। হাসলে ওর গজ দাঁত বেরিয়ে থাকে আমার ক্ষেত্রেও একই কান্ড। আপুনি ঠিকই বলেছিল অনামিকা আর আমার মাঝে মিল আছে। কিন্তু মিল থাকলেই তো আমি অনামিকা হয়ে যাব না!
ছবিটা ভিজে কাপড় দিয়ে মুছে ছবিটা অদ্রিজার সামনে ধরলাম। অদ্রিজা থাবা দিয়ে ধরল ছবিটা। আমি অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
–“অদ্রিজা! দেখো তো এটা কে? এটা তোমার আম্মু। সুন্দর না? একদম তোমার মতো সুইট। দেখেছো?”
অদ্রিজা কিছু না বলে তার ছোট নজর দিয়ে ছবিটার আশেপাশে দেখল। তার আঙ্গুল দিয়ে ছবিটা বুলিয়ে দিয়ে আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাল। তারপর অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠলো,,,,
–“মু অঅম্মু! মুমু।”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,,
–“আম্মু। বলো আম্মু।”
ওকে ভালো করে বলানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। আগের মতো অস্পষ্ট করেই বলে যাচ্ছে। এমন করতে করতে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল মেয়েটা। আমি ওকে কোলে নিয়ে আলতোভাবে ওর মাথা বুলিয়ে দিতে থাকলাম।

এভাবেই ওকে নিয়ে সারাটাদিন কোন দিক দিয়ে কোটে গেল সেটা বুঝতেই পারলাম না। ওদিকে আপুনিও নিজের বাড়িতে চলে গেল। এমনকি কালকে মাও গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। ভাবতেই খারাপ লাগছে আমার। এতোবড় বাড়ি জুড়ে শুধু আমি, নৌশিন, অর্ণব আর ওই গোমড়ামুখো থাকব। তাও তো নৌশিন আর অর্ণব নিচে থাকে আর অনুরাগের রুমটা ওপরে। সারা বাড়ি অলরেডি খাঁ খাঁ করছে। কাল মা গেলে আরো ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়িটা!

অদ্রিজাকে খাইয়ে ওকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ও আমার বুকে মাথা রেখে লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপ করে আছে। সারাদিনে একবারও ঘুমায়নি মেয়েটা। হয়ত এই কারণে ক্লান্ত। পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত চলে গিয়েছে। চাঁদটাকে হালকাভাবে দেখা যাচ্ছে আর তার সাথে সন্ধ্যাতাঁরাটাও যেন জ্বলজ্বল করছে। আমি অদ্রিজাকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিতেই অদ্রিজা মাথা উঠালো। আমি ধীর গলায় বললাম,,,
–“দেখেছো? তোমার আম্মুকে? ও তোমায় কিন্তু সব সময় দেখে অদ্রিজা! এইযে তুমি দুষ্টুমি করো। খাও না ঠিক করে সেটাও কিন্তু দেখতে পায়। তখন আম্মু খুব রেগে যায়।”

আমার কথায় অদ্রিজা কি বুঝল জানি না। তবে আমার দিকে টলটলে দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর আবারও আমার বুকে মাথা রাখল।
এভাবেই অদ্রিজাকে নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলাম আমি। হঠাৎই কারো বিকট চিৎকারে পেছন ঘুরে তাকালাম। অনুরাগ ধপধপ করে আমার কাছে এগিয়ে এসে অদ্রিজাকে একপ্রকার কেঁড়েই নিল আমার কোল থেকে। ব্যাপারটাতে আমার শাড়ির আঁচল টা পড়ে গেল আমার কাঁধ থেকে। মূহুর্তের মাঝে মাথা গরম হয়ে এলো আমার। রাগে নয় লজ্জায়। লজ্জায় কানের দুপাশ থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। ওদিকে অনুরাগও অদ্রিজাকে নিয়ে ফিট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন উনি ওখানেই মূর্তি হয়ে গেছেন। পরক্ষণেই কাশতে শুরু করলেন উনি। শুধু কাশি নয় মহাকাশি! আমি তড়িঘড়ি করে নিজের আঁচল কাঁধে তুলে নিলাম। ওদিকে যেন উনি কাশতে কাশতে শহীদই হয়ে পড়বেন। এবার উনি যক্ষা রোগীর সর্ব উৎকৃষ্ট আওয়ার্ড ছিনিয়ে নিতে চলেছেন। কিন্তু তার আগেই আমি দৌড়ে গিয়ে উনার হাতে পানি গ্লাস তুলে দিলাম।

উনি আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে ফেললেন দুই ঢকে। পানি খেয়ে শান্ত হলেন উনি। তারপর আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটা কুৎসিত কথা ছুঁড়লেন।
–“কি সমস্যা? শরীর দেখিয়ে আকর্ষণ করাতে চাইছো?”
অনুরাগের এই এক বাক্যের কথাটা আমার গায়ে তীরের মতো বিঁধল। সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে তাকালাম উনার দিকে। রাগে কটমট করে বললাম,,,
–“কোনো দরকার নেই আপনাকে আকর্ষণ করার। আপনার মতো বুড়োতে আকর্ষণ করতে বয়ে গেছে আমার। নেহাত সেফটিপিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই।”
কথাটা বলে অন্য দিকে তাকালাম আমি। উনি যেন আমার কথা সহ্য করতে পারলেন না। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,,
–“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বুড়ো? সিরিয়াসলি? আমাকে দেখে বুড়ো লাগে তোমার? হাউ? আমার বয়স ৩৬। তাও আমাকে দেখে কারোর মনে হবে না আমার বয়স ৩৬। আমি আগের মতোই ড্যাশিং আছি বুঝলে?”

আমি এবার ভেংচি কাটলাম। আর বললাম,,,
–“নিজের প্রশংসা তারাই করে যাদের প্রশংসা অন্য কেউ করে না।”
উনি এবার আমাকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। তারপর বিরবির করে বললেন,,,
–“তোমার সাথে কথা বলায় বেকার। বিয়ের আগে তো বড্ড সাধাসিধে মেয়ে মনে হয়েছিল কিন্তু কে জানত ভেতরে ধানি লঙ্কা লুকিয়ে আছে।”
–“যে আমার সাথে যেমন ব্যবহার করে তার সাথে আমিও তেমনই ব্যবহার করি হুহ। যে যেমন ব্যবহারের যোগ্য। আপনি তো নিজেই অদ্রিজাকে ছিনিয়ে নিলেন কোল থেকে যার কারণে আমার ওই অবস্থা হলো। ভালো করে বললেন কি দিতাম না?” (ভ্রু কুঁচকে)

অনুরাগ আমার কথা শুনতে শুনতে অদ্রিজার হাতে চুমু খেয়ে নিলেন। অদ্রিজা আধো আধো গলায় বলার চেষ্টা করছে,,,
–“পা পা পা পাপা।”
অনুরাগ অদ্রিজার কথায় মুচকি হেসে আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন,,,
–“বিশ্বাস নেই তোমার প্রতি আমার। একে তো অদ্রিজা তোমার নিজের মেয়ে নয়। সৎমা তুমি ওর। আজকাল সৎমায়ের অত্যাচারের চিত্র চারিদিকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। তাই বিশ্বাস করি না তোমাকে। দ্যাটস ফর হোয়াই তুমি আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবে।”

অনুরাগের কথায় মুখটা মলিন হয়ে গেল আমার। কিছু একটা ভেবে মলিন হাসলাম। তারপর বললাম,,,
–“ঠিকই বলেছেন। সৎমা নামটাই শেষের দিকে মা লাগানো থাকলেও সেটার মর্যাদা দিতে জানে না অনেকে। তারা শুধু ভাবে সে অন্যের সন্তান। সে তার সতিনের সন্তান। তাহলে কেন সতিনের সন্তানকে পালতে যাবে? কিন্তু কি জানেন তো এই সৎমা নামের মর্যাদা আমি দেওয়ার চেষ্টা করব। সৎমা নাম থেকে আমি সৎ জিনিসটা মুছে ফেলার চেষ্টা করব। জানি পারব না। মা হওয়া এতোটাও সহজ নয়। কেননা, অদ্রিজা আমি দশমাস দশদিন পেটে ধরিনি। অনামিকা ধরেছিল। যে অদ্রিজার জন্মধাত্রী মা। বাট আমি অদ্রিজার পালিত মা হতেই পারি। কিঞ্চিৎ বিশ্বাস রাখলেও চলবে। কখনো অদ্রিজার অযত্ন রাখব না। আমি জানি সৎমায়ের অত্যাচার আর ব্যবহার ঠিক কেমন হয়। কষ্ট বুঝি আমি। আর এই কষ্ট টা এই ছোট্ট অদ্রিজাকে আমি পেতে দেব না। চিন্তা করবেন না।”

কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। কাঁদতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। তবুও ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্নাটা ধরে রেখেছি। আমার অবাধ্য চোখজোড়া থেকে পানি ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে। দুহাত দিয়ে সেটা বারে বারে মুছে যাচ্ছি। আমার কষ্টটা কি আদোও কেউ বুঝবে?
.
নৌশিনকে রাতে ডিনারের জন্য হেল্প করছি। এরই মাঝে খেয়াল করলাম নৌশিন আমার দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও কিছু একটা বলতে চাইছে। এবার আমিই ওকে বললাম,,,
–“কিছু বলবে নৌশিন?”
নৌশিন হকচকিয়ে উঠল। অতঃপর আমতা আমতা করে বলল,,,
–“ওই আরকি। একটা প্রশ্ন করার ছিল!”
–“হ্যাঁ বলো।”
নৌশিন শুকনো গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,
–“অনুরাগ ভাইয়া তোমায় মেনে নিতে পারেনি তাই না?”
অদ্রিজার জন্য দুধ গরম করছিলাম আমি। ওর প্রশ্নে থমকে গেলাম। চোখ তুলে নৌশিনের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করলাম।
–“প্রথমজনকে ভুলে দ্বিতীয়জনকে মেনে নিতে সময় তো লেগেই যায়। আর সেখানে তো অনুরাগকে যতদূর দেখেছি তাতে মনে হয় অনামিকাকে উনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে। এতে তো অনামিকাকে উনি ভুলতে তো পারবেনই না। তাই না? উনার মনের কোণে যদি আমার একটু হলেও ঠাঁই হয় তাতেই তো নিজেকে ধন্য মনে করতে হয়।”

কথাগুলো বলে দুধের পাতিলটা নামিয়ে নিলাম আমি। ফিডারে ভরে নৌশিনের দিকে তাকাতেই নৌশিন বলে উঠল,,,
–“তোমার চিন্তাভাবনা গুলোও না অনামিকা ভাবির মতো! কত সুন্দর করে অনুরাগ ভাইয়াকে বুঝে ফেলতে পারো তুমি ঠিক যেমন অনামিকা ভাবি ভাইয়াকে বুঝত। আই হোপ অনুরাগ ভাইয়া একদিন না একদিন তোমাতে ঠিক পাগল হবে।”
আমি নৌশিনের কথায় শুধু হাসলাম। তারপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রুমে ঢুকলাম।

রুমে ঢুকতেই আশেপাশে তাকালাম আমি। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে যখন অনুরাগকে দেখতে পেলাম না তখনই ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম উনি ওয়াশরুমে।
বেডের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম অদ্রিজা পা নাড়িয়ে একা একা খেলছে। তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। ওকে উঠিয়ে বসালাম। বেশ ভালোভাবেই বসতে শিখেছে মেয়েটা। তবে বসিয়ে খাওয়ানোটা ঠিক হবে না। এতে ছোট বাচ্চার পেটে চাপ পড়ে। তাই আবারও শুইয়ে দিতেই ও অস্থির ভঙিতে বলার চেষ্টা করল,,,
–“মা…মা…মাম্মা!”
কথাটা বলে হাত ওপরে তুলল অদ্রিজা। আমি ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকলাম। ও কি আমায় মাম্মা বলল? আবারও একই সুরে অদ্রিজা মাম্মা ডাকতে লাগল। আমার চোখেমুখে ঝলক দিয়ে উঠল আনন্দের। সত্যিই বাচ্চার মুখে মাম্মা বা মা শব্দটা যে এতো শ্রুতিমধুর লাগে জানা ছিল না। আমি উত্তেজিত হয়ে অদ্রিজাকে বললাম,,,
–“তুমি আমায় মাম্মা ডাকলে সোনা?”
অদ্রিজা এবার আমার কোলে আসতে চাইল। আমি ওর দিকে চেয়ে হেসে ওকে খাওয়াতে শুরু করলাম। খেতে খেতে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়াতে থাকল। কোনোমতে ওকে খাইয়ে দিতেই অর্ণব হাজির হলো রুমে।

–“আসব?”
–“হ্যাঁ এসো না।”
অর্ণব হেসে দিয়ে এগিয়ে এলো। অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে অদ্রিজার উদ্দেশ্যে বলল,,
–“কি নতুন মাম্মার হাতে খাওয়া হচ্ছে?”
অদ্রিজা কিছু না বুঝেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। অর্ণবও হাসল। তারপর অদ্রিজাকে কোলে তুলে নিয়ে আমাকে আবদারের সুরে বলল,,,
–“ওকে আমার ঘরে নিয়ে যাই প্লিজ, নতুনভাবি? সারাদিন অদ্রিজা মামুনির সাথে সময় কাটানো হয় না।”
–“হ্যাঁ। তবে ওকে দেখে রেখো প্লিজ! কান্না করলে আমার কাছে নিয়ে এসো।”

অর্ণব অদ্রিজাকে নিয়ে চলে গেলো অদ্রিজাকে নিয়ে নানামরকম কথা বলতে বলতে।
আমি উঠে পড়লাম বেড থেকে। তারপর ভাবলাম কাপড়গুলো তো লাগেজেই পড়ে আছে। সেসব গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কাপড় ভাঁজ করে আলমারির এক সাইডে রেখে দিলাম।

কাজ শেষে যেই ঘুরে দাঁড়ালাম চোখের সামনে ভাসতে লাগল উদাম দেহ। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম এটা তো অনুরাগ! উনি এভাবে? জাস্ট তোয়ালে পড়ে?
অনুরাগও যেন খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলেন। দ্রুত প্রশ্ন করলেন,,,
–“তু..তুমি এখানে কি করছো?”
–“আমি তো এসেছিলাম অদ্রিজাকে খাওয়াতে। আপনি এভাবে?”
কথাটা বলে চোখটা ঢেকে নিলাম হাত দিয়ে। সামনে কিছু না দেখেই চলতে শুরু করলাম হনহন করে। ফলস্বরূপ, আমার সাথে দেওয়ালের সজোরে ধাক্কা লাগল। সাথে সাথে কয়েকধাপ পিছিয়ে পিছলে পড়তে নিলাম আমি। হাতটা কোনো কাপড়ের সাথে ঠেকতেই কোনোকিছু না ভেবেই ধরলাম তবুও যদি পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারি! কিন্তু লাভ হলো না কাপড়টা সহ নিচে পড়ে গেলাম। মুখে পড়ল ভিজে কাপড়টা।

কোমড়ে ব্যাথা পেলাম বেশভাবে। কোমড়ে হাত দিয়ে বুলাতে বুলাতে হাত দিয়ে আমার চোখ থেকে ভিজের কাপড় সরিয়ে ফেললাম। চোখ মেলতেই আমার চোখ এবার রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। অনুরাগও ঠিক আমার মতো করেই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একবার আমার দিকে দেখছেন আরেকবার নিজের দিকে। আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিলাম।
–“আআআআআআআআ!”

চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. সরি কালকে গল্প দিতে পারিনি। আসলে গল্প লিখেছিলাম তবুও ফোন ওফ হয়ে যাওয়ায় গল্প ডিলেট হয়ে গেছিল তাই আর লিখিনি।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
____________________________________________
#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ৫
আমি আর অনুরাগ একসাথে নিজের কন্ঠস্বরের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করছি। অনুরাগের চিৎকার থেমে গেলেও আমার চিৎকারটা আগের মতোই সচল! চোখের সামনে ভাসছে আগের দৃশ্য। অনুরাগ মূহুর্তের মাঝে আমার হাতে থাকা টাওয়ালটা ছিনিয়ে নিয়ে পড়ে নিলেন। তারপর তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে উঠিয়ে নিতেই আমার মুখ চেপে ধরলেন দেওয়ালের সাথে ঠেকিয়ে। আমার মুখ একহাতে ধরে নিজের আরেক হাত নিজের ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে আতঙ্কিত গলায় বললেন,,,
–“হুঁশশ! চুপ করো প্লিজ। তোমার সামনে তো আমার মান সম্মানের জগাখিচুরি হয়েই গেছে এবার আর কারো সামনে নিজের মান সম্মান নিয়ে খেলা করতে চাচ্ছি না। সো প্লিজ চিৎকার করো না। তোমার চিৎকারে সবাই আমার রুমটাতে হানা দেবে।”

আমি শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে উনার কথা শুনছি। আর উনার লাগানো প্রথম ছোঁয়া উপভোগ করছি। বড্ড শীতল সেই ছোঁয়া! এই প্রথম অনুরাগ আমার এতো কাছে এসে নিজে থেকে আমায় স্পর্শ করলেন। তাই আমি তার স্পর্শতেই মত্ত। হার্টবিট টা নিজের অজান্তেই ফাস্ট হয়ে গেল। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। উনিও বকবক করতে করতে আমার চাহনি দেখে থেমে গেলেন। আমার দিকে অদ্ভুত নজরে তাকালেন।
দরজায় কেউ নক করতেই আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে আমার থেকে নিম্নে দুই হাত দূরত্বে দাঁড়ালেন উনি। দরজার ওপাশ থেকে অর্ণবের গলায় শুনতে পেলাম।

–“ভাইয়া! নতুন ভাবি ঠিক আছে? একটু আগে চিৎকার শুনলাম যে।”
আমার বদলে অনুরাগ চেঁচিয়ে বললেন,,,
–“হুমম ঠিক আছে। কি হবে আবার? একটু পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে তাই চিৎকার করছিল।”
ওপাশ থেকে অর্ণব খানিকটা চিন্তিত সুরে বলল,,,
–“ভাবি ঠিক আছে তো? ব্যাথা পায়নি তো?”
–“তোকে এতো ভাবতে হবে না। নিজের বউয়ের খেয়াল রাখ গিয়ে। আমি সামলে নিয়েছি।”
কথাগুলো খানিকটা রাগ দেখিয়েই বলে উঠলেন অনুরাগ। আমি শুধু চোখ গোলগোল করে চেয়ে উনাদের কথপোকথন শুনলাম। ওপাশ থেকে আর অর্ণবের গলা পাওয়া গেল না। তার মানে সে চলে গিয়েছে।
অনুরাগ আমার দিকে লাজুক চোখে তাকালেন। তারপর তড়িঘড়ি করে কাবার্ড থেকে টাওজার বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। উনি যাওয়ার সাথে সাথে নিজের মুখ লাল করে সোফায় বসে পড়লাম মাথায় হাত দিয়ে। আসলে সেকেন্ডের মাঝে কি না কিই হয়ে গেল ভাবা যায়?

আমার ভাবনার অন্ত না হতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন অনুরাগ। আমার দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে গিয়ে আলমারির কাছে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলতেই নিজের কাপড় ঘাটতে লাগলেন। আমি তখনও ভাবছি। হঠাৎই আমার মুখে এসে একটা কাপড় পড়ল। আমি হকচকিয়ে গেলাম ভাবনার মাঝেই। আবার তখনকার মতো মুখে তোয়ালে পড়ল নাকি? মূহুর্তের মাঝে মুখ থেকে কাপড় সরাতেই কাপড় হাতে চলে এলো। একি এটা তো আমার শাড়ি!
প্রচন্ড কৌতুহলি হয়ে অনুরাগের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই আমার চোখ চড়কগাছে পরিণত হলো। আমার সুন্দর ও ভাঁজ করে রাখা জামা ও শাড়ি একে একে ফ্লোরে ফেলে দিচ্ছেন উনি। আমি তৎক্ষনাৎ উঠে দৌড়ে গিয়ে উনার হাত ধরে বেজায় রেগে বললাম,,,,
–“কি সমস্যা আপনার? এভাবে আমার কাপড়গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন কেন? এগুলো ভাঁজ করে কত সুন্দর করে রেখেছিলাম!”
কথাটা বলে উনার দিকে তাকাতেই উনি আমার থেকে হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,,,,
–“ডোন্ট ফরগেট দ্যাট যে এটা আমার আর অনামিকার রুম। সো এটা অনামিকা আর আমার জামা কাপড় রাখার পারসোনাল আলমারি। এখানে তোমার কোনো অধিকার নেই। আই থিংক কাবার্ডেও তুলে রেখেছো কাপড় তাই না? ওসবও বের করে নাও। আর এটা এক মূহুর্তের জন্য ভুলবে না আমি শুধু নামেই তোমার হাজবেন্ড। নাথিং মোর। সো যখন তখন আমার হাত ধরবে না। আমার থেকে অন্তত ১ হাত ডিস্টেন্স রাখবে। গট ইট?”

কথাটা বলে যেতে নিলে আমি দুর্বল গলায় বলে উঠলাম,,,
–“তবে কোথায় রাখব এতো কাপড়? লাগেজে রাখা তো যাবে না। আমি তো আপনার আর অনামিকার রাখা কাপড়গুলো উল্টাপাল্টা করিনি। শুধু একটু খানি জায়গা করে নিয়েছি। অনামিকা আর আপনার আলমারি আপনাদেরই আছে। আমি ভাগ বসাতে চাই না আপনাদের ভালোবাসাতে। কারণ আমি জানি আমি কখনোই কারো প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারব না শুধু হতে পারব প্রয়োজন। তবুও আমার দায়িত্ব কর্তব্য এক মূহুর্তের জন্যও ভুলব না। প্রয়োজন হওয়াটাই যদি আমার ভবিতব্য হয় তবে আমি রাজি কিন্তু একটু আমার এসবের জন্য নিজের স্পেসটুকু চাই। আমি সেটাও চাইনি। শুধু একটু জায়গা চাই।”

আমার কথাগুলো দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন অনুরাগ। তারপর নিজের হাতে থাকা টিশার্ট পড়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বার বার এই লোকটার সামনে দুর্বল হয়ে পড়ি। কেন কেন কেন? উনার প্রতি বারে বারে এক অজ্ঞাত টানটা অনুভব করি বিয়ের পর থেকে। কই বিয়ের আগে যেদিন উনার সাথে আমার দেখা হয় সেদিন তো এমন টান অনুভূত হত না। তবে বিয়ের পর এমন কেন হয়? বিয়ে নামক সম্পর্ক টাই কি এমন? পরিপূরক মানুষটার সাথে অজান্তেই মনের টান সৃষ্টি হয়? নাকি উনার মায়ায় জড়িয়ে পড়ছি আমি? দেরি না করে নিজের কাজ করতে শুরু করলাম। কাপড়গুলো আগের মতো ভাঁজ করতে লাগলাম আনমনে।

অদ্রিজাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে অর্ণব। তার পাশেই আনমনা হয়ে বসে আছে অনুরাগ। অদ্রিজার অদ্ভুত শব্দোচ্চারণে হালকা হাসলেও ওর মন অন্যকোথাও পড়ে আছে। অনুশ্রীর সাথে এমন ব্যবহার করাটা কি সত্যিই ঠিক হলো? ওর তো কোনো দোষ নেই। একজন মানুষ হিসেবে ওর যা যা প্রয়োজন ও তো সেসবও চায়নি আর যতটুকু চেয়েছে তা দেওয়া কি প্রযোজ্য নয়? হুমম প্রযোজ্য। প্রচন্ড ভুল করে ফেলেছে অনুরাগ রাগের মাথায়। অনামিকা চলে গেলেও বারে বারে অনামিকা নামটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। যার কারণে অনুশ্রীর সাথে এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারেনি ও। এবার সত্যিই ওর ক্ষমা চাওয়াটা দরকার বলে মনে করছে সে।
নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অদ্রিজার দিকে তাকালো অনুরাগ। অদ্রিজা বার বার পাপা শব্দটা করছে ওদিকে অর্ণব বার বার অদ্রিজাকে শেখানোর চেষ্টা করছে পাপা না বলে যাতে চাচ্চু বলে। কিন্তু অদ্রিজা শুধু অর্ণবের দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে নিজের মুখে আঙ্গুল পুরে দিয়ে একই কথা বলছে পাপা।
অনুরাগ মলিন হেসে অদ্রিজাকে কোলে তুলে নিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বলল,,,
–“নিজের বেবিকে পাপা বলা শেখা। বলদ। আমার মেয়েকে চাচ্চু বলা শেখাতে আসছে।”

অনুরাগের কথা শুনে ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল অর্ণব। শেষমেশ কি না তার আপন ভাই তাকে বলদের উপাধি দিয়ে ফেলল? রাগান্বিত কন্ঠে বলল,,,
–“ভাইয়া! আমাকে বলদ বলার আগে ভাবা উচিত আমি তোমারই ভাই।”
–“ফার্স্টলি তো তোকে আমার ভাই বলে কোনোদিনই মনে হয় না। কজ দেখ তুই তো কাজে এতোটা কেয়ারলেস যে এখনো তোকে প্রমোশন টুকু দিতে পারলাম না। সেকেন্ডলি তোকে বলদ উপাধি দেওয়া ছাড়া অন্যকোনো উপাধি দেওয়ার মতো খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ তোর বিয়ে হয়েছে কত বছর হলো? ২ বছর। অথচ নৌশিনসহ আমাদের সুসংবাদ পর্যন্ত দিতে পারলি না। এদিকে আমি এক বাচ্চার বাপ। ভেবে দেখেছিস তোর ক্ষেত্রে বলদ নামটাই সব থেকে বেশি যায়?”

কথাটা বলে অদ্রিজাকে আদর করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে চলে এলো অনুরাগ। এদিকে অর্ণব মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। আজকে নিজের ভাই কি না এভাবে অপমান করে ছাড়ল? নাহ এভাবে নিজের প্রেস্টিজকে পানচার হতে দেওয়া যায় না কিছু তো একটা করতেই হবে…..!

কাপড় ভাঁজ করা শেষে নিজের লাগেজটা বের করলাম আমি। এতো অপমানিত হয়ে আলমারি আর কাবার্ডে কাপড় রাখার চেয়ে লাগেজে কাপড় রাখা ভালো।
শাড়ি হাতে নিয়ে লাগেজের ভেতরে রেখে দিলাম। তারপর ঘাড় ঘুড়িয়ে আরো শাড়ি জামাকাপড় হাতে তুলে লাগেজে রাখতেই দেখলাম আগে লাগেজে রাখা শাড়িগুলো নেই! সেকেন্ডের মাঝে কোথায় উধাও হয়ে গেল শাড়িটা? আলমারি খোলার শব্দ এসে কানে ঠেকল। পেছন ঘুরলাম আমি। অদ্রিজাকে খাটে বসে থাকতে দেখে বামপাশ ঘুরতেই দেখলাম অনুরাগ আমার শাড়ি আলমারিতে তুলছেন। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। একটু আগেই আমার কাপড় ওখানে রাখতে দিবে না বলে যা নয় তাই বলে গেল আর এখন কি না নিজের ইচ্ছেতে কাপড় রাখছেন? আসলে উনার মাথায় কখন কি চলে যা বোঝার সাধ্য হয়ত বা আমার নেই।

দুম করে দাঁড়িয়ে অনুরাগের কাছে গিয়ে খিটখিটে গলায় বললাম,,,
–“কি হলো? শাড়ি ওখানে রাখছেন যে! আমি তো লাগেজে ভরছিলাম। ওটা তো আপনার আর অনামিকার আলমারি না?”
উনি শাড়ি রেখে আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার লাগেজের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও উনার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন,,,
–“হুমম তবে এখানে তো তোমারও কাপড় রাখতে হবে। আই থিংক আমি তখন একটু বেশি করে ফেলেছিলাম সো আই এম সরি। তুমি ঘরের সব জিনিস ব্যবহার করতে পারো বাট হ্যাঁ আমার সাথে একসাথে বেডে ঘুমাতে পারবে না। এখন চটপট করে নিজের কাপড়গুলো তুলে ফেল আলমারি আর কাবার্ডে হ্যাঁ?”

আমি গম্ভীর গলায় বললাম,,,
–“নো থ্যাংকস লাগবে না আপনার আর অনামিকার আলমারি।”
–“এজন্যই তোমার সাথে আমি কথা বাড়াতে চাই না জানো তো? মানে তুমি একটা কথা সহজভাবে নিতেই জানো না। বললাম তখন রেগে ছিলাম সো কি বলতে কি বলেছি। তুমি আলমারিতে কাপড় রাখবে?”
আমি আর কিছু বললাম না কাপড়গুলো সব আলমারিতে আর কাবার্ডে রাখলাম।

ঠান্ডাতে জমানো রাতটা! কম্বলের মধ্যে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছি আমি। শীতটা যেন কাটছেই না। হাত পা বরফের ন্যায় ঠান্ডা। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি। ঠান্ডার কারনে ঘুম নামক জিনিসটাও চোখ থেকে বিদায় নিয়েছে। চোখ বন্ধ করে মুখটাও কম্বলের নিচে লুকিয়ে রেখেছি অনেকক্ষণ ধরে। নাহ এবার শ্বাস নেওয়ার দরকার! কম্বলটা মুখ থেকে সরিয়ে মিটিমিটি চোখে বেডের দিকে তাকালাম। অদ্রিজা নিজের ছোট্ট শরীরটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তার পাশে অনুরাগ নেই! কোথায় গেলেন উনি আবার? ধরফরিয়ে উঠে বসলাম আমি। চোখ কচলিয়ে টেবিলে থাকা ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় ৪ টা বেজে ২৫ মিনিট। ভোর হবে কিছুক্ষণ পর। এ সময় লোকটা কোথায় যেতে পারেন? ওয়াশরুমে?
উঠে দাঁড়িয়ে অদ্রিজাকে কম্বল ভালো করে জড়িয়ে দিলাম আমি। তারপর ওয়াশরুমে উঁকি মারতেই হতাশ হলাম। অনুরাগ নেই। এবার খানিকটা চিন্তা হতে শুরু করল আমার। হাজার হলেও লোকটা আমারই স্বামী। উনি মানুক আর না মানুক। আমি মানি। আলমারি থেকে শাল নিয়ে গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম রুম থেকে।

অনেক দিন পর নিজের সুন্দর গোলাপি ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়েছে অনুরাগ। ছাঁদে মনের সুখে সিগারেটের মাঝে মগ্ন অনুরাগ। জলন্ত সিগারেটের সাথে তার মনটাও পুড়ছে বেশভাবে। মনে বাড়ছে দহন। অনামিকার জন্য। ও যদি চলেই যাবে তবে তার মনে এতো ভালোবাসা কেন তৈরি করে দিয়ে যাবে? এতোটাই ভালোবাসা কেন তৈরি করে দিয়ে গেল যে এখন তার বদলে অন্যকাউকে মানতে পারছে না! আজ সত্যি বলতে অনুশ্রীর অভিমানে সে অনামিকাকে দেখেছে। অনামিকাও ঠিক একই ভাবে অভিমানী কথাগুলো বলতো। যখন অনুশ্রী বলেছিল ‘নো থ্যাংকস। লাগবে না আপনার আর অনামিকার আলমারি।’ তখনই এক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল ওটা অনামিকা! তবে না সে অনুশ্রী ছিল। হয়ত তার মা ঠিকই বলে অনুশ্রী দ্বিতীয় অনামিকা। কিন্তু সে তো তার প্রিয়তমা অনামিকাকে ভালোবেসেছিল। এই দ্বিতীয় অনামিকা কে নয়!

–“আবার সিগারেট ধরিয়েছো?”
এই কথাটা কানে এলো অনুরাগের। কন্ঠটা খুব চেনা। তৎক্ষনাৎ অনুরাগ ঘাড় ঘুড়িয়ে রেলিংয়ের দিকে তাকালো। হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেল তার। কাঁপা কাঁপা সুরে বলল,,,
–“অ…অনামিকা!”
–“হুমম আমি। না এসে পারলাম কোথায়? ঘরে এতো সুন্দর বউ থাকতে সিগারেট খেতে নেই বুঝলে?”
কথাটা বলে মুচকি হাসল অনামিকা। অনুরাগ অবাক চোখে অনামিকাকে দেখছে। অনামিকার পরনে অদ্ভুত সাদা শাড়ি। মিটিমিটি হাসছে সে। অনামিকা বলে উঠল,,,
–“কি দেখছো ওমন করে?”
–“তো….তোমাকে। আমি জানতাম তুমি ফিরবে। জানো তো অদ্রিজা এই ছয় মাসে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। অদ্রিজা তার মাকে দেখে ভীষণ খুশি হবে জানো তো? দেখবে না চলো চলো।
কথাটা বলে অনামিকার দিকে এগিয়ে আসতে নেয় অনুরাগ। সাথে সাথে অনামিকা থামিয়ে দেয় তাকে। অনামিকা গম্ভীর গলায় বলে,,,,
–“না অনুরাগ। আমার যাওয়ার সাধ্য নেই। তাছাড়া অদ্রিজার তো মা হয়েছে অনুরাগ। সে তো আমার থেকেও বেশি যত্নে রাখছে আমাদের মেয়েটাকে।”
–“কার কথা বলছো তুমি?”

অনামিকা হালকা হেসে বলল,,,
–“অনুশ্রী! বড্ড মিষ্টি মেয়েটা। আমার মনে হয় জানো তো ও আমার মতো করেই অদ্রিজাকে ভালোবাসে। শোনো অনুরাগ আমি তো তোমার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। কিন্তু আমার জন্য তাকে দূরে ঠেলে দিও না। ওর তো কোনো দোষ নেই।”
অনুরাগ খানিকটা রেগে যায়। উত্তেজিত হয়ে বলে,,,
–“এসব কি বলছো তুমি অনামিকা? কি বলতে চাইছো তোমার জায়গা ওকে দেব? কখনোই না। আমি তোমায় ভালোবাসি।”
–“আমি সেটা বলিনি অনুরাগ। আমি নেই তোমার জীবনে। তবে অনুশ্রী তো আছে। বড় ভালো মেয়েটা। একটা কথা ভেবে দেখেছো? ও কিন্তু পারলে জোর করে তোমার থেকে স্বামীর অধিকার চাইতেই পারত। বাট ও সেটা করেনি। কারণ ও জানে তুমি আমায় ভালোবাসো। তবে ও তো একটা মেয়ে। আমি বুঝি। ওর ও তো ইচ্ছে হয় কারো কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে। তুমি ওর সাথে ভালো ব্যবহার করে দেখো ও তোমায় নিরাশ করবে না। একটুখানি ভালোবাসার চেষ্টা করো ওকে। ও তোমায় ভালোবেসে ভরিয়ে দেবে। যে চলে গেছে তার জন্য যে আছে তাকে পায়ে ঠেলো না। ও তোমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার আপন করে নাও। আমি ওর মাঝেই সারাজীবন থেকে যাব। ও যদি কখনো দূরে চলে যায় তখন কিন্তু হাজার কেঁদেও লাভ হবে না। আমি জানি তুমি একদিন ওর সামনে #একগুচ্ছো_ভালোবাসা নিয়ে হাজির হবে। ধরে নিও আমি সেদিনই সব থেকে বেশি খুশি হবো।”

কথাটা বলে আলতো হাসে অনামিকা। তারপর আস্তে আস্তে কোথাও মিলিয়ে যায়। অনুরাগ দৌড়ে গিয়ে অনামিকা দাঁড়িয়ে থাকা জায়গা টাই হাতরায়। কিন্তু নেই অনামিকা সেখানে। অনুরাগ চিৎকার দিয়ে বলে,,,
–“অনামিকা! অনামিকা। কোথায় গেলে তুমি? প্লিজ সাড়া দাও।”
আশেপাশে পাগলের মতো খোঁজ করে অনুরাগ। কিন্তু পায় না।

সারাবাড়ি খোঁজ করেও অনুরাগ কে পেলাম না আমি। অবশেষে ছাঁদে চলে এলাম আমি। ছাঁদে আসতেই অনুরাগকে পাগলের মতো আচরণ করতে দেখে ভয়ার্ত চোখে তাকালাম। বার বার অনামিকার নামজপ করছেন উনি। ছুটে গেলাম উনার কাছে। উনার সামনে দাঁড়াতেই উনি ইশারা করে বললেন,,,,
–“আমার অনামিকা কোথায় গেল অনু? জানো তো এখানটাই ছিল। ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার সাথেই কথা বলছিল। আমি সিগারেট খাই জন্য হয়ত রাগ করে চলে গেল। ওকে ফিরে আসতে বলো না অনু!”

কথাটা বলে আমার দিকে অস্থির চাহনি নিয়ে তাকালেন উনি। আমি আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু কাউকে পেলাম না। বুঝতে পারলাম উনি ভুল দেখেছেন। এটা একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। আমরা যাকে খুব ভালোবাসি সে যদি হঠাৎ করে আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন আমরা মাঝে মাঝে নিজের মতো করে তাকে কল্পনা করে দেখি। যেটা আমাদের চোখের ভুল। কারণ আমরা তার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারি না। উনার ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে বুঝতে সময় লাগল না।
আমি উনার দিকে শান্ত ভাবে তাকিয়ে বললাম,,,
–“অনুরাগ,, আপনি ভুল ভাবছেন। এখানে কেউ নেই আপনি আর আমি ছাড়া। অনামিকা আসেনি এখানে।”
উনি জোর দিয়ে বললেন,,,
–“না ও এসেছিল এখানে। কেন বিশ্বাস করছো না?”
–“আসেনি। আপনি দেখুন আশেপাশে। আসলে তো পালিয়ে যেতে পারবে না এখান থেকে। দেখুন তো কোথায় অনামিকা?”
আমার কথায় আশেপাশে তাকালেন অনুরাগ। অনামিকাকে দেখতে না পেয়ে নিচু দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন,,,
–“নেই। হয়ত আমি ভুল দেখেছি। আসেনি অনামিকা এখানে।”
–“হুমম। আপনি এখানে কি করছিলেন বলুন তো? ঘুম ভাঙতেই আপনাকে দেখতে পেলাম না। তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এলাম। আর আপনার গায়ে তো টিশার্ট ছাড়া কিছুই নেই। ঠান্ডা লাগছে না? চলুন ঘরে।”
উনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন। আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম। আমার ঘাড়ে পানি জাতীয় কিছু এসে পড়ল। উনি কাঁদছেন! ভালোবাসা এতো অসহায় কেন হয়? আজ যদি অনামিকা থাকত আমি এখানে থাকতাম না। আর আমি এখানে না থাকলে হয়ত……!
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে উনাকে কাছ থেকে অনুভব করলাম চোখ বন্ধ করে। অতঃপর চোখ খুলে শান্ত ভঙিতে বললাম,,,
–“ঘ..ঘরে চলুন। অদ্রিজা একা আছে।”
আমার কথায় যেম হুঁশ আসে অনুরাগের। মূহুর্তেই আমায় ছেড়ে দিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে।

আমিও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে যাই। রুমে ঢুকতেই অনুরাগ অদ্ভুত আবদার করে বসেন।
–“অনু! আমাকে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে দেবে?”
আমি শুকনো ঢক গিললাম। এটা অনুরাগ তো? যে কিনা কয়েক ঘন্টা আগেই আমাকে বলেছিল উনার থেকে ১ হাত দূরে থাকতে আর এখন কি না নিজেই কাছে ডাকছেন?
উনার কথায় ধ্যান ভাঙল আমার।
–“কি হলো দেবে না? আচ্ছা নো প্রবলেম।”
কথাটা বলে অদ্রিজার পাশে শুয়ে পড়তে লাগলেই আমি জোরে বলে উঠি,,,
–“না না। আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারেন।”
কথাটা বলে এগিয়ে গেলাম আমি। উনি আমার হাত ধরে বেডে বসিয়ে আমার কোলে নিশ্চিন্তে মাথা রাখলেন। তারপর ছোট বাচ্চার মতো করে বললেন,,,
–“মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে?”
আমি মাথা নাড়িয়ে উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলাম। উনি চোখ বন্ধ করে বললেন,,,
–“জানো তো? অনামিকা বলতো আমরা যখন খুব কষ্টে থাকি তখন যদি কোনো বিশ্বাসযোগ্য মানুষের কোলে মাথা রাখি তখন আমাদের কষ্টগুলো একটু একটু করে মুছতে শুরু করে।”
–“আমি কি আপনার বিশ্বাসযোগ্য মানুষের তালিকায় স্থান করতে পেরেছি?”

প্রশ্নটা ছুঁড়লাম উনার দিকে। কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না। জিজ্ঞেসু চোখ নিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখন আমার উত্তর কে দেবে? মনটা যে জানতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে আমি কি অনুরাগের বিশ্বাসযোগ্য মানুষের তালিকায় স্থান করতে পেরেছি?

সকাল সকাল অদ্রিজাকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি। মেয়েটা খাচ্ছে না। অথচ পেটে খিদের চোটে তিন চারটে ভাঁজ পড়েছে। ওদিকে মা নাকি আজকে গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন সেই নিয়ে তোরজোর চলছে। উনার নাকি শহরের পরিবেশ মটেও ভালো লাগে না। গ্রামের ভিটে টাতেই শান্তি খুঁজে পান তিনি।
–“সোনা একটু তো খাও! কি হয়েছে খাচ্ছো না কেন?”
কথাটা বলে অসহায় ভাবে তাকালাম অদ্রিজার দিকে। অদ্রিজা আমার অসহায় চেহারা দেখে ফোকলা হাসি দিল। আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,,,
–“দুষ্টু! আমার অসহায়তার মজা উড়ানো হচ্ছে?”
আমার কথায় আরো কিটকিটিয়ে হেসে দিল অদ্রিজা। আমিও ওর হাসি তে হেসে দিলাম। এরই মাঝে অনুরাগ এসে চেয়ারে বসে পড়লেন। মুখটা তার গম্ভীর!

আমি উনার দিকে একটু তাকিয়ে অদ্রিজাকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলাম। বাড়ির মেইন দরজার কলিংবেল বাজলো। দরজার দিকে তাকাতেই আবারও চোখ সরালাম। একজন গিয়ে বাড়ির দরজা খুলে দিল।
আমি তখনও অদ্রিজাকে নিয়ে ব্যস্ত।

–“নুড়ি!!”
কারো পরিচিত কন্ঠে হকচকিয়ে উঠলাম আমি। আমি কি ঠিক শুনলাম? চেয়ার থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অদ্রিজার মুখ মুছিয়ে দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে মেইন গেটের সামনে দাঁড়ালাম। সামনের মানুষটাকে দেখে চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো আমার। কোনোমতে বললাম,,,
–“বর্ণদা!!”

চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here