একজন রূপকথা পর্ব-১০

0
2018

#একজন_রূপকথা
#পর্ব_১০
#নুশরাত_জেরিন

শোভন বেশ কয়েকদিন ধরে কথার কাছে কবিতার বিষয়টা বলতে চাচ্ছে , পারছে না, কোথাও যেনো বাঁধছে। স্ত্রীর ছোট বোনের চরিত্র সম্পর্কিত কথা স্ত্রীকে বলা যায় না, তার উপর যদি হয় নিজেও জড়িত। কথার হয়তো তার উশখুশ করাটা নজরে পড়লো। রাতে ঘুমোবার সময় শোভনকে জেগে বসে থাকতে দেখে সে বলল,
“ঘুমাবেন না, জেগে বসে আছেন কেনো?”

শোভন আমতাআমতা করলো, তার ঘুম আসছে না। কথাকে বিষয়টা না জানানো অবদি শান্তি ও লাগছে না।
সে বলল,
“এইতো ঘুমাবো, এখনই।”

“আজ এত রাত অবদি জেগে আছেন? শরীর খারাপ করলো নাতো?”

কথা বিছানায় উঠে এসে শোভনের কপালে হাত রাখলো। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। তবে কী হলো।
সে বলল,
“কাল অফিস নেই?”

“আছে তো।”

“তবে ঘুমাচ্ছেন না কেনো? সকাল সকাল উঠতে হবে তো।”

শোভন আকস্মিক কথার একহাত চেপে ধরলো। তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা। কথা নিজেও চমকে গেছে।

“কী হয়েছে? এমন করছেন কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“আমাকে তুমি বিশ্বাস করো কথা?”

শোভনের আকুল কন্ঠস্বর শুনে কথা কিছুটা কেঁপে উঠলো। এমন ভাবে বলছে কেনো লোকটা? কি হলো তার? বিশ্বাসের কথা কেনো উঠবে? পরক্ষনেই নিজেকে সামলালো। সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
“নিজের থেকেও বেশি, আপনি জানেন না?”

“আমি তোমার বা কবিতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে মানতে পারবে?”

কথা এবার মন থেকেই হাসলো।
“কী আশ্চর্য! আমার যেকোনো বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ অধিকার আছে আপনার!”

“আর কবিতার?”

“বা রে কবিতা আমার বোন হলে আপনার বোন নয় বুঝি? আপনি কী আমাদের পর?”

শোভন তড়িৎ কথা ঘোরালো, বিষয়টা এগিয়ে নিতে তার বুক কাপছে, অসস্তি হচ্ছে।

“পর নয় বলছো? তাহলে আপনি আজ্ঞে করো কেনো?”

কথা লাজুক হাসলো।
“কতবার যে চেষ্টা করেছি তুমি করে বলার, আপনার অগোচরেই চেষ্টা করেছি, পারিনি। তাছাড়া সম্বোধনে কী যায় আসে? ভালবাসা মেশানো থাকলেই তো হলো।”

শোভন মৃদু হাসলো।

সেদিন বলতে না পারলেও পরদিন ঠিকই সে কথার সামনে মনের কথাটা প্রকাশ করলো। একেবারে হড়বড় করে বলল,
“কবিতার বিয়ে ঠিক করেছি কথা, ভাল ছেলে, আমারই অফিসের ম্যানেজার। আমার চেয়েও উচু পদ, ভালো বেতন। কবিতার ছবি দেখে খুব পছন্দও করলো। দাবিদাওয়া তার কিচ্ছু নেই, শুধু কনে সুন্দরী হলেই চলবে।”

কথা সামান্য অবাক হলেও শোভনের আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া করলো না। শোভন ভেবেছিলো কথা রাগারাগি করবে অথবা অভিমান। তাকে না জানিয়ে তার নিজের বোনের বিয়ে ঠিক করেছে, এতটুকু রাগ করার অধিকার তার অবশ্যই আছে। অথচ কথা মৃদু গলায় বলল,
“ভালো করেছেন, আমিও কবিতার জন্য ছেলে দেখার কথা বলতে চেয়েছিলাম। ”

শোভনের খুব বলতে ইচ্ছে হলো,
“কেনো কথা? কেনো ছেলে দেখতে বলতে চেয়েছিলে? কবিতার পড়াশোনা তো শেষ হয়নি, অনার্স ও কমপ্লিট হয়নি। তুমি না বলেছিলে ওর অনার্স শেষ হবার আগে বিয়ে দেবে না। তবে কেনো?”

মনের কথা মুখ ফুটে বের হলো না। পাছে অপ্রত্যাশিত কিছু শুনে ফেলে।

কথা বলল,
“বিয়ের পর পড়াশোনাটা করতে দেবে?”

“হু।”

“ওর সব শখ আহ্লাদ পূরণ করবে?

” হু।”

“সুখে রাখবে?”

“সে আর বলতে।”

কথা উদাস গলায় বলল,
“আমি নিজেকে এককালে চালাক ভাবতাম জানেন! অথচ আমি বড্ড বোকা, একটু বেশিই হয়তো। যে আমার ক্ষতি চায় আমি তবু কেনো তার ভালো চাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারি না? বলতে পারেন?”

শোভন উত্তর দিতে পারলো না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরলো।

মেয়েটার নাম মালোতি। খুব বেশি বয়স না, কবিতার থেকে দু-এক বছরের বড় হতে পারে। তবে সাজপোশাক দেখলে বয়স আরও বেশি লাগে। মলিন রংচটা শাড়ির ওপর মোটা চাদর টাইপের ওড়না পরে সে কাজে আসে। সারাদিন রান্না বান্না থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ সামলায়, বিকেলে বাড়ি ফিরে যায়। শোভন তাকে কোথা থেকে এনেছে সেটা কথা জানে না, জানতেও চায়নি৷ উল্টো সে শোভনের উপর বেজায় ক্ষেপে আছে। লোকটা সত্যি সত্যি কাজের মেয়ে নিয়ে এলো? কেনো? কথা কাজ পারে না?
শোভন নির্দোষ ভঙ্গিতে বলল,
“আমার উপর রাগ না দেখিয়ে মাকে বলো, তার কথা শুনতেই তো মালোতিকে নিয়ে এলাম।”

কথা তার শাশুড়ীকে সোজাসুজি কিছু বলতে পারলো না। তিনি কখন ভালো মনে থাকেন আর কখন রেগে যান বোঝা যায় না। তবে এক ভরা দুপুরে চুলে তেল লাগিয়ে দেবার সময় মিনমিন করে বলল,
“মালোতিকে রাখার কী দরকার আছে মা? আমিই তো কাজ করতাম। তাছাড়া কী এমন কাজ আছে, অতটুকু করতে কোনো কষ্টও হতো না। শুধু শুধু আপনার ছেলের টাকা নষ্ট হচ্ছে। ”

রোজিনা বেগম কথার কথায় কান দিলেন না।নিজের মতো বললেন,
“কাজের মেয়েটা বড্ড বেয়াদব, এটাকে তাড়িয়ে অন্য মেয়ে খুজতে হবে।”

কথা উত্তর দিলো না। কেননা শাশুড়ীর সাথে সেও একমত। মালোতি নামের মেয়েটা কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলে না, নিজের মতো কাজ করে চলে যায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ত্যাড়াবেকা উত্তর দেয়। এই তো সেদিন যখন রোজিনা বেগম তার নাম জিজ্ঞেস করলো তখন সে কড়া গলায় বলল,
“নাম না জেনে কাজে রাখছেন? এত ভালো মানুষ আপনারা? বাহ্!

রোজিনা বেগম দাতে দাত চিপলেন,
” বেয়াদব মেয়ে মানুষ।”

“জ্বি আমি বেয়াদব, আর কিছু বলবেন? তরকারি কাটতে অসুবিধা হচ্ছে। ”

কথা নিজেও আগবাড়িয়ে তার সাথে কথা বলতে গেলো না। তবে একটা বিষয় ঠিক লক্ষ্য করলো। মেয়েটা কথাগুলো স্পষ্ঠ শুদ্ধ ভাষায় বলে, ব্যক্তিত্ব টাও চোখে পড়ার মতো। এ বাড়ি থেকে সে এক দানা খাবারও কখনও মুখে তোলে না। কেউ খেতে বললেও না। তার এক কথা, এ বাড়িতে টাকার বিনিময়ে কাজ করতে এসেছি, বাড়তি সুবিধা কেনো নেবো? পরে খোটা শোনার জন্য?”

তাছাড়া তার কাজে খুশি হয়ে মাস শেষে যখন কিছু বাড়তি টাকা যোগ করে দেওয়া হলো। তখন সেটাও সে ফিরিয়ে দিলো। কথার সাথে সাথে রোজিনা বেগমও অবাক হলেন। মেয়েটা বেয়াদব হলেও আত্মসম্মান প্রবল।

এরমাঝে কবিতার বিয়ের ব্যাপারটা চাপা পরে গেলো। শোভন নিজেও এ ব্যাপারে আর কথা বলল না।

—-;

ছুটির দিনে বিকেল বেলাটা শোভন ছাদে কাটায়। অফিসে নিয়মিত বদ্ধ রুমে যান্ত্রিক জীবন কাটাতে কাটাতে সে হাপিয়ে ওঠে। একটু খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। আর্থিক কারনে দুরে কোথায় বেরিয়ে আসা সম্ভব না।
সেইজন্য ছাদের খোলা আকাশটায় তাকিয়ে নিজেকে হালকা করার প্রয়াস চালায়।
নিচে একবার কথাকে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসেছে। এখনও কথা আসেনি। মিনিট দশেক তো হলোই।
সে আবার ডাকতে পা বাড়ালো। কবিতা এসেছে, হাতে চায়ের কাপ। শোভন বলল,
“কথা কোথায়? তুমি কেনো চা নিয়ে এসেছো?”

কবিতা নিঃশব্দে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। ঠোঁটের কোনে তার মৃদু হাসির রেখা। বলল,
“আজ আমায় নিয়ে ঘুরতে যাবে?”

শোভন থমকালো, চমকালো, হতবাক হলো। কবিতা তাকে তুমি করে বলছে?
কবিতা এবার একটু কাছ ঘেঁষে দাড়ালো।
“বললে না? যাবে? তার আগে এই চা টা খেয়ে দেখো, আমি নিজে বানিয়েছি, নিজের হাতে। নাও!”

শোভন হাত এগোলো না। বরং গুটিয়ে নিলো। তার মাথা কাজ করছে না। একটা মেয়ে এতটা নির্লজ্জ, এতটা সার্থপর, লোভী কী করে হতে পারে? কষ্ট হয় না? আয়নার সামনে দাড়ালে চোখে চোখ রাখতে ইতস্তত লাগে না?

কবিতা চায়ের কাপ পাশে রেখে শোভনের দিকে খানিক ঝুকে পড়লো। ততক্ষণে ওড়না গড়িয়ে পড়েছে নিচে। কবিতার চোখে মুখে অর্থবহ হাসি।
তবে সেটা বিষাদে রুপ নিতে সময় লাগলো না।
শোভনের পুরুষালী হাতের চড়টা ততক্ষণে তার দুগাল লাল করে ফেলেছে।
পেছন থেকে ভেসে এলো ভগ্ন এক কন্ঠস্বর,
“কবিতা?”

,

,চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here