একজন রূপকথা পর্ব-৯

0
1956

#একজন_রূপকথা
#পর্ব_৯
#নুশরাত_জেরিন

কবিতা ছোটবেলা থেকেই ভীতু ধরনের। সবকিছুতেই সে ভয় পেতো। মামিকে ভয় পেতো, টিকটিকি দেখলে চিৎকার করতো, অন্ধকারে ভুত আসবে ভেবে কথাকে জড়িয়ে ধরতো। আর কথা ছিলো উল্টো, সাহসী। কবিতাকে ছোটবেলা থেকে আগলে রাখা ছিলো তার কাজ। অথচ সময়ের বিবর্তনে সেই ভীতু কবিতাই এমন সাহসী হয়ে উঠবে কে জানতো! শোভনের সেদিনের বলা কথাগুলো তার কানে ঢুকেছিলো কীনা বোঝা গেলো না। সে নিয়মিত সাজগোছ করে শোভনের আশপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করলো, রান্নাঘরে কথা যখন চুলোর ধুয়োয় চোখে অন্ধকার দেখতো তখন কবিতার চোখ নিষিদ্ধ স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করলো।
শোভন এসব সহ্য করতে পারছে না আবার বলতেও পারছে না। কথাকে সে ভালবাসে। আর কথা ভালবাসে কবিতাকে। কবিতার এমন বিশ্রী রূপের মুখোমুখি দাড়ালে কথা ভেঙে পরবে নাতো! সে শঙ্কা নিয়ে ভাবলো একবার রোজিনা বেগমের সাথে কথা বলবে।

রোববারের দিনটা কবিতা তার বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটায়। ভার্সিটি গেলেও ক্লাস করে না। আগে তার এত বন্ধু বান্ধব ছিল না, ইদানীং জুটেছে। সবগুলোই বখাটে ধরনের। শোভন খোঁজ খবর নিয়েছিলো এর আগে।
সে বেছে বেছে রবিবারই ছুটি নিয়েছে। মায়ের রুমে কবিতা থাকে, তার সাথে আলাদা কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় না, সেইজন্য এই ব্যবস্থা।
রোজিনা বেগম দুপুরে খাবার পর মাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। শোভন ঠিক তক্ষুনি ঘরে এলো। ডাকলো,
“মা?”

রোজিনা বেগম একগাল হাসলেন,
“এতদিন পর মায়ের কথা মনে পড়লো?”

শোভন চেয়ার টেনে বসলো। তার চোখে মুখে অস্থিরতা উপচে পড়ছে, তারপরও শান্ত ভাবে কথা বলার চেষ্টা চালালো,
“এতদিন পর কোথায় মা, সকালেও তো কথা বললাম তোমার সাথে।”

রোজিনা বেগম আবারও হাসলেন।
“আসল কথাতো বলিসনি?”

“আসল কথা মানে?”

“তোর মনে আছে শোভন, ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে যখন পা বা হাত ছিলে বাড়ি ফিরে এসে আমার বকা থেকে বাঁচতে হাত লুকিয়ে রাখতি। আমার নজর থেকে বাঁচার সে কী আয়োজন তোর! এতকিছুর পরও আমার নজর ঠিকই সেই কাটা হাতের উপর পড়তো। তুই বন্ধুদের কাছে বলে বেড়াতি, মায়েদের নজর হয় চিলের মতো, ছেলেমেয়েদের মুখ দেখলেই তারা সব বুঝে ফেলে, মুখ ফুটে বলার প্রযোজন পরে না।”

শোভন বলল,
“তুমি সব আগেই বুঝতে পেরেছো, তাই না মা।”

রোজিনা বেগম উত্তর না দিয়ে উঠে বসলেন। শরীরটা তার খুবই খারাপ। রাতে জ্বর এসেছিলো, কথা সারারাত জলপট্টি দিয়েছে। এ কথা শোভন জানে না৷ মায়ের অসুস্থতার কথা জানলে সে বিচলিত হয়ে পরে, নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়। তাছাড়া সামান্য জ্বর, এতে এতলোক জানানোর ই বা দরকার কী। কথা মেয়েটাই বাড়াবাড়ি করলো, রাতভর সেবা করে কাটালো। শোভনকে কী বলে এসেছিল কে জানে!

শোভন বলল,
“এখন কী করবো মা?”

তার কন্ঠে কী যেন ছিল। কষ্ট কিংবা অসহায়ত্ব।
রোজিনা বেগম বললেন,
“যা করবি কর, শুধু কথাকে কোনোরকম কষ্ট দিবি না।”

“সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি মা, কী করবো?”

“দুইবোনকে বিয়ে করে ঘর সংসার কর।”

রোজিনা বেগমের হেয়ালি কথা শুনে শোভন চমকে উঠলো।
“বলো কী!”

রোজিনা বেগম এ পর্যায়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
বললেন,
“তো কী বলবো, এসব কথা আমায় কেনো জিজ্ঞেস করবি? ঘরে বউ আছে না? বউয়ের বোনকে নিয়ে সমস্যা, সমাধান তো বউয়ের সাথে আলোচনা করেই করতে হবে নাকি? ওকে বলেছিস?”

“কথা তো কিচ্ছু জানে না!”

“জিজ্ঞেস করেছিলি?”

“উহু, ভয় করে মা। মেয়েটা এতটা ভালবাসে কবিতাকে, বিশ্বাস করে…. হুট করে কিভাবে বলবো…”

রোজিনা বেগম কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে রইলেন। বললেন,
“কবিতার জন্য ভালো ছেলে দেখা শুরু কর। বিয়ে দিয়ে দে।”

“কথা মানবে?”

রোজিনা বেগম চোখ গরম করলেন। সব বিষয়ে এদের সমস্যা থাকবেই। সমস্যা ছাড়া যেনো বাচেই না।
“আমি বুঝিয়ে বলবো ওকে।”

সকাল থেকেই কথার দিন শুরু হয়েছে প্রচন্ড খারাপভাবে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেই বেজে গেলো নয়টা। রোজিনা বেগম অসুস্থ মানুষ,ডায়েবিটিস এর রোগী। এত বেলা পর্যন্ত না খাওয়া, নয়টায় উঠে রান্না হবে কখন আর খাওয়া হবে কখন? শোভন কথাকে টু শব্দটি না বললেও রোজিনা বেগম খুব করে বকলেন। তার একটিমাত্র ছেলে, ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না, সারাদিন অফিস করবে কিনা না খেয়ে?
শোভন কোনোরকমে বুঝ দিলো। বলল,
“না খেয়ে থাকবো কেনো মা? যাওয়ার পথে খেয়ে নেবো তো।”

রোজিনা বেগম দমলেন না।
বললেন,
“সে খাবি কী না খাবি আমি জানি না ভেবেছিস? বাইরের খাবার মুখে তুললেই তোর পেটে অসুখ হয়, ঘরের খাবার ছাড়া বাইরের খাবার রুচবে মুখে?”

শোভন তবুও যেমন তেমন বুঝিয়ে অফিস গেলো। কবিতা ভার্সিটি যাবার আগে আরেকদফা ঘ্যানঘ্যান করলো।
“আমি না খেয়ে ভার্সিটি যাবো আপা? তুই দিন দিন এমন দায়িত্বজ্ঞ্যানহীন কেনো হয়ে যাচ্ছিস বলতো? এভাবে তোর সংসার টিকবে? আন্টি তো আগে থেকেই তোকে পছন্দ করে না এরপর তো ভাইয়ার চোখেও খারাপ হয়ে যাবি।”

কথা উত্তর দেবার আগেই রোজিনা বেগম ফুসে উঠলেন।
“আমি তোমার বোনকে পছন্দ করি না কে বলল তোমায়? আমি বলেছি? তার সংসার টিকবে নাকি টিকবে না সে ব্যাপারে তোমায় ভাবতে কে বলেছে?”

কবিতা থতমত খেয়ে চটজলদি বেরিয়ে পড়লো। আজকাল আন্টিটা তার সাথে বেশ কড়া গলায় কথা বলে। আগে খুব ভালবাসতো, ইদানীং কী হয়েছে কে জানে!

কথা নিজেও তার শাশুড়ীর মনোভাব বুঝতে পারে না। অদ্ভুত মহিলা, কখন যে রাগী মুডে থাকে আর কখন ভালো মুডে সে কথা নিজেও বোধহয় তিনি জানেন না।

তবে বিকেলে আরেক কান্ড ঘটে গেলো। রাতের রান্না করার সময় সবজি কাটার মুহূর্তে বেখেয়ালি ভাবে হাতটা কেটে গেলো কথার। এ নিয়ে রোজিনা বেগম আরেকদফা চিল্লা চিল্লি শুরু করলেন।
তিনি বরাবরই শান্ত গলায় কড়া কথা বলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
বললেন,
“বাবার বাড়িতে নাকি নিজে রান্না করতে, তবে এখন এই হাল কেনো সংসারের? সামান্য সবজি কাটার কাজটুকুও করতে পারো না, কী পারো তুমি? পড়াশোনায় ও তো তেমন ব্রিলিয়ান্ট ছিলে বলে শুনিনি।”

কথা এ পর্যায়ে মন খারাপ করে ফেললো। সকাল থেকে একের পর এক বকাঝকা শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মামি যদিও এর থেকে বেশি বলতো, তবুও এ বাড়িতে এসেছে অন্য মন মানুষিকতা নিয়ে। লড়াই করার মনোভাব তো সেই মামা বাড়িতেই ফেলে এসেছে।
শোভন অফিস থেকে ফিরতে রোজিনা বেগম তার কাছেও কথার নামে অভিযোগ তুলে ধরলেন।
মেয়েটা বড্ড বেখেয়ালি, নিজের প্রতি খেয়াল তো নেই ই সংসারের প্রতিও নেই।
শোভন ক্লান্ত শরীরে সোফায় গা এলিয়ে বসে বলল,
“তবে এখন কী করতে বলো?”

রোজিনা বেগম থমথমে গলায় বললেন,
“কাজের মেয়ের খোঁজ কর।”

কথা বাঁধা দিলো,
“না না কাজের মেয়ে কেনো লাগবে? আমি কাজ পারবো তো, আজ একটু ভুল করে ফেলেছি, আর কখনও হবে না মা।”

রোজিনা বেগমের কন্ঠ আরো কড়া শোনালো,
“সে কথা বোঝার জন্য আমি আছি, আমি এ বাড়ির কর্তী।সিদ্ধান্ত নেবার হলে আমি নেবো।”

শোভনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কাজের মেয়ে আনবি তো?”

“হ্যাঁ, মা কালই খোঁজ করবো।”

রোজিনা বেগম এবার একটু শান্ত হলেন। কথাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আর তুমি? বসে বসে মুখ দেখছো কেনো আমার? হাত থেকে কত রক্ত পড়ছে সে খেয়াল আছে? এসো ব্যান্ডেজ করে দেই।”

শোভন হেসে ফেললো,
“দজ্জাল শাশুড়ী হতে চেয়েও ক্যারোক্টারে পুরোপুরি ঢোকাটা হচ্ছে না তো মা।”

রোজিনা বেগম কড়া চোখে তাকালেন।
কথা নিজেও হাসলো। তবে মনে মনে। তার শাশুড়ী কাজের মেয়ে যে তার কথা ভেবেই আনতে বলেছে একথা কথার বুঝতে খানিক সময় লাগলো বৈকি। সংসারের কাজ তো আর কম না। সবার ভালবাসা প্রকাশের ভঙ্গি এক হয় না সে কথা সে শুনেছে তবে আজ স্বচক্ষে দেখেও নিলো।

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here