একটুখানি পর্ব : ১১

0
808

একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব :১১
কলরব হাসি চেপে রাখতে পারছে না কিন্তু হাসতেও পারছে না। কারণ কলরব মুচকি হেসে চলে যেতে পারবে না। তার হাসি বেশ জোরেশোরেই। স্কেলটা হাতে নিয়েই কলরব কোনোরকমে নিজের রুমে ফিরে এলো।দরজাটা দিয়েই হাসা শুরু করে দিলো। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে বেচারার।ইরিন আকস্মিকতায় চোখ বড় করে হা হয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিন আজ যেই ইনভার্শন শিখলো জীবনেও ভুলবে না, নিজের নাম ভুলে গেলেও ভুলবে না। গতকাল আর গতকালও এবং তোমাকেই আর তোমাকেতে যে পার্থক্য আছে তা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সে। কলরবের বেডরুম আর ইরিনের বেডরুম পাশাপাশি। কলরবের হাসির আওয়াজ কুহু আর ইরিনও শুনতে পাচ্ছে। কুহু এতোক্ষণ হাসির আওয়াজ শুনতে পেলেও ধীরে ধীরে কুহুর মনে হচ্ছে হাসির শব্দটা কমে আসছে। কুহু তরতর করে ঘেমে যাচ্ছে, হাত পাও ঠান্ডা হয়ে আসছে। কুহু আস্তে করে ইরিনকে বললো,
– একটু পানি দাও তো।
ইরিন ধীরে ধীরে অসুস্হ পা নিয়েই ডাইনিংরুম থেকে এক গ্লাস পানি এনে দিতেই কুহু একটানে সবটা পানি শেষ করে ভেনিটি ব্যাগ নিয়েই বের হয়ে যায়। কুহু চলে যেতেই ইরিন গেলো কলরবের ঘরে। দরজায় টোকা দিতেই কলরব দরজা খুলে ইরিনকে জড়িয়ে ধরে আবার হাসতে লাগলো। এবার ইরিনও ভাইয়ের সাথে যোগ দিল। হাসতে হাসতে বললো,
– ভাইয়া আমি আগে ভাবতাম তুমি পৃথিবীর বেস্ট ভাই কিন্তু আজ থেকে তুমি আমার কাছে পৃথিবীর বেস্ট টিচার।
– টিচার নারে চিটার।
কলরব আবারো হাসতে লাগলো।
– আচ্ছা ভাবি যেভাবে চলে গেল আসবে তো?
– অবশ্যই আসবে।
– উহু আমার তা মনে হয় না।
– দেখিস আসবে।
– আসলেই ভালো।
– এই তুই হেঁটে এলি যে?
– লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছি। হাঁটতে কোথায় দেখছো?
– আহারে আমার বোনটা।
– আরে একদম ঠিক আছি।
..
কুহু বাসায় যেয়েই দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বসে রইলো। নিজের গালে কষে কয়েকটা থাপ্পর মারতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর। পিহু যে বলে সে বোকা একদম ঠিক বলে, মাও কুহুকে নিয়ে শুধু শুধুই এতো চিন্তা করে না, বুঝেসুঝেই করে। কুহু এত হাবলি কেনো? সে কিভাবে ঐ আজব প্রাণীটাকে আই ডু লাভ ইউ বলতে পারলো? লাভ ইউ ও না একেবারে আই ডু লাভ ইউ। পিহু এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে।
– এই কিরে ঘুমিয়ে গেলি নাকি?
– না আসছি।
দরজা খুলতেই পিহু শরবত খেতে খেতে রুমে ঢুকলো। পিহু রুমে ঢুকার সাথে সাথেই কুহু আবার দরজা আটকে দিলো। তারপর বললো,
– পিহু সর্বনাশ হয়েছে?
– কে তোর সর্বনাশ করলো?
– কলরব।
কুহুর কথা শুনেই পিহুর মুখ থেকে শরবত বেরিয়ে এলো তাও আবার কুহুর উপরেই পড়লো। পিহু এখন নিজেই ভয়ে শেষ। পিহু জানে এখনই কুহুর হাতে দুই গালে দুইটা কষে থাপ্পর খাবে। পিহু ঢোক গিলে বললো,
– আপুণি সরি।
– আরে রাখ তোর সরি। জানিস আমি কি করেছি?
– কি কি করেছিস?
– কলরবকে আই লাভ ইউ বলেছি না আই ডু লাভ ইউ বলেছি।
পিহু এবার হাতে থাকা গ্লাসটা ছেড়ে দিল।
– আপুণি আয় বস।
– পিহু কেনো গেলাম ঐ বাসায়? আসলেই ইরিনের জন্য কেনো এতো দরদ দেখাতে গেলাম?
– কিছুই বুঝতে পারছি না একটু খুলে বল।
পিহু কুহুর কাছে সবটা শুনে থ হয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করলো। পিহু সাধারণত খুব বেশি মজা না পেলে এতো হাসে না। বালিশ মুখে চেপে তারপর হাসছে পিহু। কুহুর যে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে তা বুঝে পিহু হাসি থামিয়ে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,
– আরে এতো টেনশন নিস না। তুই তো ট্রান্সলেট করেছিস আর কিছু তো না।
– কিন্তু পিহু ঐ কলরব যেভাবে হাসছিলো না..
– আরে বাদ দে তো।
– সত্যি বলছিস সিরিয়াস কিছু হয়ে যাবে না তো?
– আরে বাবা এইটুকুতে আর কি হয়?
– আচ্ছা তুই যেহেতু বলেছিস বুঝেই বলেছিস।
– আচ্ছা এখন পড়তে বসবো আর কোনো কথা না।
– হ্যা বস আমারো অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে হবে।
কুহু আর পিহু দুইজনই নিজেদের পড়ায় লেগে গেল।
পিহু পড়তে যেয়ে বায়োলজির এক টপিকে আটকে যাওয়ায় কুহুর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
– আপুণি সালোকসংশ্লেষণের আলোক পর্যায় আমার কাছে ক্লিয়ার না। একটু বুঝিয়ে দে তো।
কুহু বেশ বিরক্ত হয়ে জবাব দিল,
– দেখছিস না কাজ করছি?
– একটু বুঝিয়ে দে তারপর আবার করিস।
– ভাগ এখান থেকে।
– এতো ভাব মারিস কেনো সবসময়? স্টুডেন্টদের জন্য তো কতো দরদ আর নিজের বোনের জন্য..
– বায়োলজি কাওকে আবার বুঝিয়ে দিতে হয় নাকি?
– তুই বায়োলজিতে ভালো ছিলি তাই তুই নিজে নিজে পড়েই পেরেছিস।
– এখন যা বলছি মন মেজাজ একদম ভালো না।
– তোর এই এক সমস্যা রেগে যাস।
– আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে পিহু।
– কলরব ঠিকই বলেছে তুই জীবনেও ভালো টিচার হতে পারবি না।
পিহু কথাটা বলেই নিজের স্টাডি টেবিলে যেয়ে অন্য সাবজেক্টে মন দিল।
কুহু নিজের টেবিল থেকে উঠে যেয়ে পিহুর বায়োলজি বইটা নিয়ে বেডে বসতে বসতে বললো,
– আয় বুঝিয়ে দিচ্ছি।
– হুম ধমক খাওয়ার জন্য রেডি হয়েই আসছি।
কুহু মন খারাপ করে বললো,
– আমি কি আসলেই বেশি বকা দেই পড়ানোর সময়?
– হুম।
আজ কুহু পিহুকে পড়া বোঝানের সময় একটাবারে ধমক দেয়নি বরং নরম সুরে এক পড়া দুইবার করে বুঝিয়ে দিয়েছে। পিহু মনে মনে কলরবের উপর বেশ খুশিই হলো।
কুহু আর পিহু রাতের খাবার খাওয়া শেষে শুয়ে পড়লো। কুহুর কিছুতে ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই শুধু কলরবের হাসির আওয়াজ কানে বাজে। কুহু পিহুর দিকে ফিরে পিহুকে জড়িয়ে ধরতেই পিহু উফ্ফো আপুণি সরতো বলে কুহুকে ধমকে উঠলো।
– এই শুন না আমার না ঘুম আসছে না।
– কেনো কি হয়েছে?
– চোখ বন্ধ করলেই শুধু কলরবের হাসির আওয়াজ শুনতে পাই।
– আহা শোন শশী কাপুরের কথা মনে কর দেখবি তোর ঘুম চলে আসবে আর স্বপ্নে শশী কাপুরও চলে আসবে।
– ঐ মোবাইলটা দে তো।
– হাত বাড়িয়ে নিজে নিয়ে নে।
– তোর পাশেই তো দে না।
– পারবো না।
কুহু আর কথা না বাড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে মোবাইল আর হেডফোন নিল। তারপর কুহুর পছন্দের নায়ক শশী কাপুরের গান শুনতে লাগলো।
” নেনোমে নিন্দিয়া
নিন্দিয়া মে সাপনে
সাপনো মে সাজান
জাপসে বাসা
বাহারে আয়ী জীবানমে
নেয়ি হালচাল হে তান মানমে
এক নেয়ি রূপ বাসা হে আখিয়ুমে..”
গানটা শুনতে শুনতে কুহুর মন ভালো হয়ে গেল। গানটা শেষ হতেই কুহু মোবাইল অফ করে চোখ বন্ধ করলো।
চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে এবার কলরবের চেহারাটা ভেসে উঠলো সাথে কলরবের বলা আমি তোমাকেই ভালোবাসি কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগলো। কুহু আবার পিহুকে জড়িয়ে ধরে একথা টা বললো।
পিহু কিছুটা বিরক্তির সুরে বললো,
– তোর না কালকে বান্ধবীদের সাথে শালবন বিহার ঘুরতে যাওয়ার কথা
এখন ঘুমিয়ে পর নয়তো যেতে পারবি না।
– হ্যা ঠিকই তো।
কুহু বহু কষ্টে দুচোখের পাতা এক করলো।
সকালে উঠেই মাকে বলে বান্ধবীদের সাথে কোটবাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল কুহু।কোটবাড়ির শালবন বিহার দেখা শেষ হতেই জাদুঘরে যাওয়ার জন্য মাত্র টিকিট কাটলো আর পিহুর ফোন এলো।
– হ্যালো পিহু বল।
– আপুণি তুই এক্ষণই আয় মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে।
কুহু এ কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে কোনোরকম বান্ধবীদের বলেই জাদুঘরের বাইরে চলে এলো। কুহুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে কোনোভাবেই থামাতে পারছে না। কুহুর মাথাও কাজ করছে না কি করবে। আসলে একা আসা উচিত হয়নি মিতা বা টিনাকে সাথে নিয়ে আসা উচিত ছিল।
কুহু চোখ মুছতে মুছতে একটা সিএনজি ডাকলো।
সিএনজি তে উঠতে যাবে এমন সময় কুহু কারো কণ্ঠে নিজের নাম শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো।
– কুহু কেমন আছেন?
কুহুর কি বলা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না।
– চিনতে পেরেছেন? আমি কূজন।
কুহু কোনোরকম মাথা নাড়িয়ে হা সূচক উত্তর দিল।
কূজন আবার বললো,
– প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড আপনি কি কোনো সমস্যায় পড়েছেন? দেখুন আমাকে বলুন হেল্প করার চেষ্টা করবো।
– না তেমন কিছুই না। আমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে আমার মা অসুস্হ হয়ে পড়েছেন।
– আপনার বাসা ফেণী না?
– জ্বি আমি এখন আসছি।
– কুহু শুনোন আমি আপনাকে ড্রপ করে দেই। সিএনজি দিয়ে তো ভেঙে ভেঙে যেতে হবে অনেক বেশি সময় লাগবে। আমার সাথে গাড়ি আছে আমি বরং গাড়িতে করে আপনাকে পৌঁছে দেই।
– না ধন্যবাদ।
– শুনুন এখন আপনাকে আপনার পরিবারের অনেক দরকার তাই বলছি যত তাড়াতাড়ি পৌঁছুবেন ততোই ভালো।
– ধন্যবাদ কিন্তু আমি যেতে পারবো। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।
– প্লিজ কুহু চলুন ড্রপ করে দিচ্ছি। কোনো কষ্ট হবে না। আর আপনার জন্য তো এটুকু করতেই পারি। আপনিও তো আমাকে হেল্প করেছিলেন।
কুহু আর কিছু না বলেই রাজি হয়ে গেল। কুহুর কাছে পৃথিবীর সব কিছুর উর্ধ্বে তার পরিবার।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here