একটুখানি
#লামিয়া_চৌ
পর্ব:১২
কূজন গাড়ির দরজা খুলে দিতেই কুহু গাড়িতে বসলো। কূজন দরজা লাগিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। কুহু অনবরত কেঁদেই চলছে। ফুপিয়ে কান্না চলে আসছে কিন্তু কান্নাটা নিবারণ করলো। এভাবে রাস্তাঘাটে ফুপিয়ে কাঁদার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু কুহু হাজার চেষ্টা করেও চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ করতে পারছে না।
কূজন গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে কুহুকে দেখছে। কূজন কখনোই কারো কান্নাকাটি সহ্য করতে পারে না। সে চায় তার আশেপাশের সব মানুষ হাসি খুশি থাকুক আর সে তা করতে আপ্রাণ চেষ্টাও করে। কিন্তু কুহুকে কি বলা উচিত সে বুঝতেই পারছে না। কুহুকে অনবরত চোখ মোছতে দেখে কূজন লুকিং গ্লাস থেকে চোখ সরিয়ে নিল। কূজনের খুব খারাপ লাগছে কারণ সে কুহুর জন্য কিছুই করতে পারছে না। গাড়ি ফেণী পৌঁছুতেই ড্রাইভার কুহুর কাছ থেকে বাসার ঠিকানা জানতে চাইলো। কূজন বললো,
– বাসায় না যেয়ে যে হসপিটালে ভর্তি সেখানে যাওয়া উচিত। কুহু পিহুর কাছ থেকে হসপিটালের নাম জেনে ড্রাইভারকে বললো। গাড়ি হসপিটালের সামনে যেতেই কুহু গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে হসপিটালের ভিতর ঢুকলো। কূজন কতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকার পর গাড়ি থেকে বের হলো। হাসপাতালের ভিতর যেয়ে মনে হলো কোন ফ্লোরে ভর্তি বা কোন কেবিনে আছে সে তো কিছুই জানে না। কূজন আবার যেয়ে গাড়িতে বসলো কিন্তু খেয়াল রাখলো হাসপাতালের মেইন এনট্রেন্সে। বেশ কিছু সময় পর দেখলো কুহু একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে বের যাচ্ছে। কূজন একবার ভাবলো যেয়ে কুহুর সাথে কথা বলা দরকার। ওর মা কেমন আছে জানা দরকার। পরক্ষণেই সে এই চিন্তা দূর করে ড্রাইভারকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হতে বললো।
কূজন মোটেও চাইছে না কুহুকে এখন বিপদে ফেলতে এমনিতেই ওর মা অসুস্হ। এখন যদি কূজন যেয়ে কুহুর সাথে কথা বলতো কুহুর পরিবারের লোক অন্যভাবেও ব্যাপারটা দেখতে পারতো। আফটার অল কূজন জানে না কুহুর পরিবার কেমন। কনজারভেটিভও হতে পারে আবার নাও হতে পারে তবে কুহু বেশ কনজারভেটিভ।
তাছাড়া কুহু কোটবাড়ি গিয়েছিলো বেড়াতে এখন তার সাথে ফিরতে দেখলে কুহুর পরিবার কুহুকে ভুলও বুঝতে পারে।
..
কলরব বাসায় ফিরলো রাত দশটার দিকে। কলরবের মা জিজ্ঞাসা করতেই বললো, অফিসে কাজের খুব চাপ ছিল তাই দেরি হয়েছে।
কলরবের মা মুখ বাকিয়ে বললেন,
– তুই যে কতো বড় গাধা আল্লাহই জানেন। ভার্সিটিতেই তো সুযোগ পেয়েছিলি না উনি বিসিএস হবেন পররাষ্ট্র কেডারে যাবেন।
– মা এটাই আমার এইম।
– এখন দেখ রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।
– আরে কয়েকদিনই তো। আমার কনফিডেন্স আছে আমার বিসিএস হয়ে যাবে।
– আচ্ছা বিসিএস হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষকতা করতে পারতি ভার্সিটিতে।
– আরে একবার পড়ানো শুরু করলে আর ছাড়তে পারতাম না।
ইরিন এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো কিন্তু কলরবের এ কথা শুনে ইরিন চোখ মেরে বললো,
– ভাইয়া তুমি যদি ভার্সিটিতে থেকে যেতে তাহলে তোমার ছাত্রীরা তোমাকে লাভ ইউ লাভ ইউ বলতে বলতে শেষ হয়ে যেত।
– এই থাম তো।
– না মাকে বলি??
– একদম না।
– এই কি লুকাচ্ছিস তোরা? আমাকেও বল নাহলে আমি শান্তি পাব না।
– উফ্ ইরিন যদি কিছু বলিস মাকে তাহলে তোর বিয়ে দিয়ে দিব।
– আচ্ছা দিয়ে দিও। ভালোই হবে পড়াশুনা করতে হবে না। পড়াশুনা করে কি হয় বলো তো? শেষ পর্যন্ত বিয়েই তো করতে হয়। মা মা শুনো না কাল ভাইয়া কি করেছে..
ইরিন এতটুকু বলার পরই কলরব উঠে ইরিনের মুখ চেপে ধরলো। কলরবের মা বললো,
– আচ্ছা থাক আমাকে বলা লাগবে না।
কলরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার খাবার শুরু করলো। কলরব খেয়ে উঠে যেতেই ইরিন মাকে সবটা বললো। কলরবের মা সবটা শুনে কতক্ষণ কি যেন ভাবলো তারপর বললেন,
– ওরে বাবা ছেলে আমার এতো ব্রিলিয়ান্ট । আমি তো ভাবতাম এই ছেলে শুধু পড়া আর খেলা ছাড়া কিছুই পারে না।
তারপর মা মেয়ে আবার হাসা শুরু করলো।
..
কূজন এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু ঘুম আসছে না তার। বারবার কুহুর মা কেমন আছে তা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইশ সাথে সাথে কেনো দৌড়ে কুহুর পিছন গেল না তাহলেই তো জানতে পারতো। কুহু কি এখন কাঁদছে? কুহুর কান্নার কথা মনে হতেই কূজনের মন খারাপ হয়ে গেল। কূজন বেড ছেড়ে উঠে গিটার নিয়ে বসলো। গিটারে টুংটাং বাজাচ্ছে। গিটার বাজাতেও ভালো লাগছে না। কূজন যতক্ষণ না কুহুর হাসিমাখা মুখ দেখতে পাবে ততক্ষণ তার শান্তি হবে না। কেনো যে কূজন এমন কূজন নিজেই জানে না। কূজন বেডরুম ছেড়ে বের হয়ে এগুলো বাবার ঘরের দিকে। লিভিংরুম পার হয়ে বাবা মার বেডরুমের কাছে যেয়েই আবার কূজন নিজের ঘরের দিকে ব্যাক করলো। কূজনের বাবার শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। তাই কূজন বাবার সাথে গল্প করার ইচ্ছাটা বাদ দিল।
বেডরুমে এসেই কূজন লাইটা অফ করে দিয়ে গিটার নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসলো। তারপর গান ধরলো,
“এখন তো সময় ভালোবাসার
এ দুটি হৃদয় কাছে আসার
তুমিও যে একা
আমিও যে একা
লাগে যে ভালো
ও প্রিয় ও প্রিয়..”
..
কুহু বাসায় ফিরলো রাত দশটার দিকে। পিহুও সাথে এলো। কুহুর বাবা হসপিটালেই আছেন স্ত্রীর সাথে। কুহুর মায়ের পায়ের আঙ্গুলে সেলাই দিতে হয়েছে কয়েকটা। কুহু সারাদিনের ধকল শেষে বাসায় ফিরে সোজা বিছানায় শুয়েই ঘুম দিল। ফজরের নামাজ পড়তে ঘুম থেকে উঠতেই বুঝতে পারলো যে তার বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে। নামাজ শেষে কুহু রান্না ঘরে যেয়ে পরোটা বেললো। পরোটা হয়ে যেতেই ডিম ভাজি করে সোজা রুমে চলে এলো। তারপর পিহুকে ডাকলো উঠার জন্য কিন্তু পিহু কিছুতেই উঠলো না। কুহুর হঠাৎ খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেলো। প্লেটটা ডাইনিং টেবিলে রেখে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। এসময় পাশের বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়াবে না তাই গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ কুহুর মনে হলো সে কূজনকে কৃতজ্ঞতাটুকু জানায়নি। টেনশনে কূজনের কথা খেয়ালই ছিল না। একটুখানি ধন্যবাদ পাওয়ার প্রাপ্য তো কূজন ছিলই। কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ফিরে এসে মোবাইল হাতে নিল। তারপর কূজনের আইডিতে নক করলো।
চলবে…