একটুখানি পর্ব :১

0
4409

একটুখানি
#লামিয়া চৌঃ
পর্ব :১

– কাইন্ডলি যদি আমাকে একটু জানালার পাশের সিটে বসতে দিন কৃতজ্ঞ থাকবো।
কুহু এতক্ষণ জানালার বাইরে স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা কেউ বলেছে বুঝতে পেরে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। কুহু ছেলেটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকায়। হবে পাঁচ ফুট পাঁচের মতো, চোখে চশমা, বেশ ফর্সা,চুলগুলো সাইড সিঁথি করে আঁচড়ানো তবে চুলগুলো কিছুটা খাঁড়া খাঁড়া।
– কাইন্ডলি কি দেওয়া যাবে?
ছেলেটা খুব কিউট করে একটা হাসি দিয়ে কুহুর জবাবের অপেক্ষা করছে। কুহু ভাবছে তার কি বলা সমীচীন হবে। প্রশ্নটা তাঁর কাছে পদার্থবিজ্ঞানের চৌম্বক সম্পর্কিত অঙ্ক থেকেও বেশি দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। অন্য কোনো মেয়ের জন্য হয়তো খুব সহজ ছিল প্রশ্নটা কিন্তু তার মতো মেয়ে যে একে তো ছেলেদের সাথে তেমন একটা কথা বলতে পারে না, আবার এতোটা কোমল হৃদয়ের মেয়ে। তবে সে বেশ আভিজাত্য নিয়ে চলতে পছন্দ করে। কুহুর নিজের কাছেই শব্দটা বেশ ভারী ভারী মনে হচ্ছে। আভিজাত্য আহা! এসকল শব্দ মাথায় ঘুরে রাজ- রাজাদের কাহিনী পড়ে পড়ে আর দেখে দেখে। সহজে ভাবতে গেলে কীভাবে ভাবা যায় কথাগুলো তা একবার ভাবছে। সহজে বললে এমন হয় যে সে চায় না তার কোমল হৃ ধুর নরম মনের জন্য কেউ তাকে নির্বোধ বা বোকা মনে করুক। এইতো হয়েছে। কুহু একমনে কথাগুলো ভেবেই চলেছে।
ছেলেটা কুহুর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একটু কেশে বললো,
– মিস সিটটা কি দেওয়া যায় না?
কুহু এই পর্যায়ে উত্তর দেয়,
– জানালার পাশের সিটটা তো আমার।
– তাইতো আপনাকে রিকুয়েস্ট করছি।
কুহু বুঝতে পারছে না ছেলেটাকে কি বলবে আবার মুখ ফিরিয়ে নিতেও পারছে না এটা যথেষ্ট অভদ্রতা হবে।
তাই আবার মুখ খুলে বললো,
– আসলে আমিও জানালার পাশের সিট ছাড়া কখনো বসি না সরি!
কুহু কথাটা বলেই জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তবে আড়চোখে ছেলেটার রিয়েকশন দেখছে।
ছেলেটা বেশ বিরক্ত হয়েই স্টাইল করে ঝুলানো কলেজ ব্যাগটা খুলে উপরে রেখে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কুহুর পাশের সিটটায় বসে পড়ে।
কুহুর কেনো যেন এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা এতো করে যেহেতু বলছিলো তাকে সিটটা দেওয়া উচিত ছিলো। ছেলেটাকে তো বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে তার। বেশ স্টাইলিশ তবে ভদ্রতার একটা ছোঁয়া আছে। সাদা প্যান্ট, হালকা নীল শার্ট আর সাদা স্নিকারস্ পড়ে আছে। চোখে নেভী ব্লু ফ্রেমের চশমা। কুহু একটু খেয়াল করে দেখলো ছেলেটা পায়ের গোড়ালির উপর প্যান্ট ফোল্ড করে রেখেছে। কুহুর এই ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগছে। ছেলেটা ইসলামিক মাইন্ডের পরক্ষণেই আবার নিজের মাথা নিজেরই ট্রেনে ঠুকতে ইচ্ছে হচ্ছে। সবসময় অকারণেই সে সবাইকে ভালো মনে করে ফেলে, মোটেও সে মানুষ চেনে না। ছেলেটা নিশ্চয় স্টাইল করে এভাবে প্যান্ট ফোল্ড করে রেখেছে আর সে কিনা তাকে মহান বানিয়ে ফেলছে। কুহুর এই এক সমস্যা সে সবাইকে বিশ্বাস করবে না করবে ন। করেও হুটাহাট বিশ্বাস করে বসে। যেখানে তার ছোট বোন পিহু একনজর কাউকে দেখেই বলে দিতে পারে মানুষটা কেমন। যেমন ধরা যায় কুহুর ক্লাসমেট নীরাকে দেখেই পিহু বলে দিয়েছিলো আপুণি এই মেয়ের নির্ঘাত বয়ফ্র্যান্ড আছে। কুহু বেশ কনফিডেন্টলি বলেছিলো,
নারে পিহু নেই। হয়তো নীরা একটু টম বয় মার্কা কিন্তু বয়ফ্র্যান্ড নেই। একমাস পড়েই যখন নীরার সাথে কুহুর বন্ধুত্বটা ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো তখনই কুহু জানতে পারে নীরার বয়ফ্র্যান্ড আছে। এখন কুহুর আবার মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে সে সিট ছেড়ে উঠেনি নয়তো ছেলেটা তাকে ছেঁচরি টাইপের ভাবতো। কুহু সবসময় জানতো মেয়েরা এভাবে ছেলেদের কাছে জানালার পাশে বসার জন্য রিকুয়েস্ট করে আর ছেলেরাও বেশ মহা আনন্দে নেচে নেচে মেয়েদের সে সুযোগ করে দেয়। কিন্তু কোনো ছেলেও যে কোনো মেয়েকে এমন কথা বলতে পারে তা কুহুর জানা ছিল না। হঠাৎ কুহু শুনতে পায় চানাচুর! চানাচুর!
কুহুর ভাবনায় এতক্ষণে ছেদ পড়ে। কুহু খেয়ালই করেনি কখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
– ভাইয়া দশ টাকার চানাচুর দিন তো।
কুহু একহাতে চানাচুর নিয়ে অন্যহতে টাকা দিতে যেতেই চোখ যায় ছেলেটার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। এফবি থেকে লগ আউট হচ্ছে। ছেলেটার আইডিটার নামও কুহুর চোখে পড়েছে।
আইডির নাম ” জানালার পাশে”। ছেলেটা লগ আউট করেই মেবাইলটা পকেটে রেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আছে। কুহু বুঝতে পারছে ছেলেটার আইডিটা ফেইক ছিল তারপরো মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করছে। মানুষ সাধারণত ফেইক আইডি খুলে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছুর নামে। ছেলেটারও জন্য হয়তো জানালার পাশের সিটটা বেশ আবেগময়ী কিছু তাই সে এই নামেই ফেইক আইডি খুলেছে। সে নিজেও তো একবার খুলেছিল স্বপ্নবিলাসী নামের একটা আইডি। নাহ্ কুহুর আবার মনে হচ্ছে ছেলেটা নিশ্চয় এখনই ট্রেনে বসে আইডিটা খুলেছে তাও আবার কুহুকে দেখানোর জন্য। এসব উথালপাথাল ভাবতে ভাবতেই কুহু হাতের চানাচুরটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ছেলেটা একটা পা সামনের সীটের নীচে রেখে আরেকটা পা পিছনের দিকে ভাঁজ করে বসে আছে। কুহু তার বোরকাটা ধরে সামান্য উপরে তুলে ছেলেটার পা ডিঙিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সামনে থেকে একটা আইসক্রিম হাতে করে নিয়ে এসে ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– এই যে শুনছেন?
ছেলেটা চোখ খুলে কুহুর দিকে তাকিয়ে বলে,
– কিছু বলবেন?
– জ্বি একটু চেপে বসুন তো।
– কোথায় চেপে বসবো?
– ঐপাশে চেপে বসুন।
– দেখুন ঐপাশে কীভাবে আমি চেপে বসবো? আমার পাশে একজন অচেনা মেয়ে বসে আছেন।
– আমি তো আপনার পাশে কোনো মেয়ে দেখছি না।।
ছেলেটা তার ডান পাশে একবার তাকিয়েই কুহুর দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার সেই কিউট হাসিটা দিয়ে বলে,
– সরি আসলে আমি খেয়াল করিনি। আমি সাইড দিচ্ছি আপনি যান।
– না আপনি ঐ সিটটায় বসুন।
– সত্যি?
ছেলেটার এমন কান্ড দেখে কুহু আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারেনি। যদিও সে ছেলেদের সাথে হাসাহাসি করে না তাও কিছুটা শব্দ করেই হেসে উঠলো। একটা বাচ্চা যখন ফ্যান্টাসী কিংডমে যাওয়ার কথা শুনে তখন যেমন বলে উঠে সত্যি ঠিক তেমনি ছেলেটা কুহুকে বলেছে সত্যি। ছেলেটা জানালার পাশের সীটটায় বসে বেশ কৌতুহলী দৃষ্টিতে জানালার বাইরের দৃশ্য দেখছে। ছেলেটা জানালার দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলে,
– ধন্যবাদ!
– কিছু বলছেন? শোনা যাচ্ছে না।
ছেলেটা কুহুর দিকে তাকিয়ে বলে,
– ধন্যবাদ! কোনোদিন ট্রেনে উঠিনি এই প্রথম। আসলে আমার বাসা কুমিল্লায়। থাকি ঢাকায়,পড়াশুনার খাতিরে আরকি। সবসময় বাসে বা প্রাইভেট কারে যাওয়া আসা করেছি। এই যে এখন কুমিল্লায় যাচ্ছি বাসায় কেউ জানে না জানলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতো তাই বলিনি। বাসে যদিও যাওয়া আসা হয়েছে কিন্তু ট্রেনে কেনো যেন কোনোদিন চড়া হয়নি। তাই প্রথম। আর বাসে সবসময় জানালার পাশে বসেছি। জানালার পাশে বসার জন্য আমি দুটো টিকিটই কেটে ফেলি কিন্তু এখানে ট্রেনের টিকিট দুটো পাইনি। হুট করে আসা তো ব্ল্যাকে টিকিট পেয়েছি একটা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
– ঠিক আছে।
– আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
– এই তো ফেণী।
– ওহ্ সেখানে কি আপনার বাসা?
– জ্বি।
ছেলেটা আর কোনো কথা না বলে বাইরের দৃশ্য দেখছে। কুহুও খুশিই হলো ছেলেটা তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করছে না দেখে। কুহুর আবার ট্রেনে বাসে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস কিন্তু সে ইচ্ছে করে ঘুমোচ্ছে না কারণ ঘুমের ঘোরে যদি ছেলেটার কাঁধে মাথা রাখে তাহলে সেটা খুবই বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে। কুমিল্লা স্টেশনে পৌঁছুতেই ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়। তারপর ব্যাগটা আবার বেশ স্টাইল করে কাঁধে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে আর কুহু তার জানলার পাশের সিটটায় বসে পড়ে। কুহু সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পায়,
– এই যে শুনছেন?
কুহু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সেই ছেলেটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।
– জ্বি বলুন।
– আমি কূজন। ধন্যবাদ না জানিয়েই ট্রেন থেকে নেমে পড়েছি তাই সরি।
– না ঠিক আছে।
– আপনার নাম?
– কুহু।
– সুন্দর নাম। একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনই আসছি।
কুহুর কাছে কূজনকে পুরোই উদ্ভট লাগছে। কুহু ভাবছে সে কীভাবে অপেক্ষা করবে। ট্রেন ছেড়ে দিলে তো কিছুই করার নেই তবে কেনো অপেক্ষা করবে তাও বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর কূজন আবার জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা কলম বের করে হাতে থাকা বইটায় কি যেন লিখে। লিখা শেষে আবার সেই কিউট মার্কা হাসিটা দিয়ে কুহুর দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– ধরুন।
কুহুকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে জানালা দিয়েই বইটা কুহুর কোলে রেখে কূজন বলে,
– ছোট একটা উপহার।
– এই না না লাগবে না থেঙ্কস্।
– আরে রাখুন! আমি আসছি বাই।
কুহু বইটা হাতে নিয়ে কূজনের দিকে বাড়িয়ে দিতেই কূজন একটুখানি হাসি দিয়ে পিছন ফিরে চলে যায়। আর কুহু অবাক হয়ে কূজনের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। ট্রেন ছাড়ার আওয়াজে কুহু বাস্তবে ফিরে আসে। হাতে থাকা বইটার দিকে তাকিয়ে দেখে ডেল কার্নেগী সমগ্র। বইটা সীটের পাশে রেখেই কুহু মোবাইলটা বের করে ফেইসবুকে লগ ইন করে জানালার পাশে লিখে সার্চ করে। সার্চ দিতেই অনেকগুলো আইডি আসে। সবগুলোই যে ফেইক বুঝাই যাচ্ছে তবে একটা আইডিতে একটা ছেলের ছবি দেয়া। সেই আইডিতে যেয়েই দেখলো নিক নেইম দেয়া কূজন। ছবিটা এবার খেয়াল করে দেখলো এটা কুহুর পাশে বসা ছেলেটারই। কূজনের বেশকিছু ইনফর্মেশনও দেয়া আছে।
সেখান থেকে কুহু জানতে পারলো কূজন আহসানউল্লাহ তে পড়ে ট্রিপল ই তে। বাড়ি কুমিল্লাতেই। কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে পাশ করেছে সে। এখন আহসানউল্লাহ্তে পড়ে।
কুহু মোবাইলটা তার হ্যান্ড ব্যাগে রেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে বইটা আবার হাতে নেয়। বইটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে বইটা উপহার হিসেবে যদি তার কোনো শিক্ষক বা বাবা- মা টাইপের কেউ দিত তাহলে মানানসই হতো। কিন্তু অন্য যে কারো কাছ থেকে উপন্যাস টাইপের বই পেলে কুহু খুশি হয়। কুহু ভাবছে এই বইটা কেনো দিল? আর বই পায়নি দিতে? বইটা বেশ ভালোই আর কুহুরও এধরনের পড়তে ভালোই লাগে তবে গিফ্ট হিসেবে উপন্যাস পাওয়ার আনন্দই আলাদা। চট করে কুহুর মনে হলো রেল স্টেশনের স্টলগুলোতে এ ধরনের বইগুলোই বেশি পাওয়া যায় তাই হয়তো এটা দিয়েছে। কুহুর ভাবতেই হাসি পাচ্ছে যদি “আমি হিটলার বলছি” বইটা কিনে দিতো তাহলে কেমন হতো? হাসতে হাসতেই কুহু বইটা খুলে। প্রথম পৃষ্ঠায় নজর দিতেই দেখে,
“একটুখানি পথচলাতেই
বিশাল অবদান
একটুকরো হাসিতে
স্মৃতিটুকু অম্লান।”
ধন্যবাদ কুহু।
কূজন!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here