একটুখানি পর্ব : ২০

0
554

একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব:২০
কলরব মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে যে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে বাসায় আর ফিরে যায়নি।
এক দৃষ্টিতে কুহুদের ছাদে তাকিয়ে আছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মাগরিবের নামজ পড়তে হবে মনে হতেই মসজিদে চলে গেল। নামজ শেষ হতেই কলরব আবার ছাদে চলে এসেছে। জোছনা রাত, আকাশে মেঘও ভাসছে। মেঘ বারবার চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। কলরবের চাঁদটাকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। শুধু চাঁদ আর মেঘে ঢাকা চাঁদ দুইটার মাঝে কলরব আজ পার্থক্য খুঁজে পেয়েছে। কলরব কখনো প্রকৃতি নিয়ে ভাবেনি, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণও করেনি সে। ছোট থেকেই পড়াশুনা আর খেলাধূলা, হই হুল্লোড়, মজা করা এসবই করে এসেছে। প্রকৃতি খুব একটা টানেনি তাকে। কিন্তু আজ খুব ভালো লাগছে চাঁদ দেখতে। হালকা শীত লাগছে কিন্তু বাসায় যেয়ে গরম কাপড় আনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কুহুকে তো দেখতে পেল না কিন্তু চাঁদকে দেখে তা পুষিয়ে নিচ্ছে। মেঘে ঢাকা চাঁদ যেন কুহুর অন্য এক রূপ। কুহুর চুলগুলো দেখার কলরবের অনেক শখ। ইরিনের কাছে শুনেছে কুহুর চুলগুলো অনেক সুন্দর। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে কলরবের। কলরব আপন মনেই হাসলো, দেখাই হলো না আর ছুঁয়ে দেখা। ইরিন বলেছিলো সাজলে নাকি কুহুকে অন্যরকম লাগে, অনেক সুন্দর লাগে। কলরব চোখ বন্ধ করে কুহুকে বউ সাজে একবার ভাবতে যেয়েও ভাবলো না। কলরব সরাসরি দেখতে চায় কুহুকে কেমন লাগে, কল্পনার সাথে গুলিয়ে ফেলতে চায় না। কলরবের একটা গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। মোবাইল বের করে গান ছাড়লো। কলরব আবার ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনে না। কলরব সবসময় জোরেই গান শুনে। নিজের চারপাশটা মাতিয়ে রাখতেই পছন্দ তার।
”মনের অবুঝ পাখি
স্বপ্ন দুটি নয়নে
অভিসারে যাবে মধু লগনে
আকাশ নদী পাহাড় আজই
শূণ্য তোরই কারণে
অভিানে পুড়ে ভরা ফাগুণে
তুই হয়ে যারে রাধা
পিরিতে নাইরে বাধা
ভালোবাসা রাখিসনে আর গোপনে গোপনে
লোকে ভালেবাসা হলো এমনি
দিনে দিনে বেড়ে চলে
প্রেমের কাহিনী
তোরই কারণে তোরই স্মরণে
ভালো লাগা তুলে দিব চরণে চরণে
মাঝে মাঝে দিশেহারা লাগে জীবনে
ছায়া যদি সরে পরে মিছে স্বপনে
তোরই কারণে তোরই বাঁধনে
তোরই কারণে তোরই বাঁধনে
রয়ে যাব চিরদিন তোর ভুবনে ভুবনে
মনের অবুঝ পাখি
স্বপ্ন দুটি নয়নে
অভিসারে যাবে মধু লগনে
আকাশ নদী পাহাড় আজই
শূণ্য তোরই কারণে
অভিমানে পুড়ি ভরা ফাগুণে”
গানটা শেষ হতেই ইরিন বলে
উঠলো,
– ভাইয়া এখন আসল গান শুনবে, এতক্ষন তো নকল টা শুনেছো।
কলরব পিছন ফিরে দেখলো ইরিন কূজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
– নকল হবে কেনো?
ইরিন মাদুরে বসতে বসতে বললো,
– বুঝোনি নকল কেনো? প্রথমে একজন গান গাইলো সেটা রেকর্ড হলো তার সেখান থেকে রেডিওতে বা টিভিতে, তারপর তোমার আমার কানে এলো। তিনটায় মিলে নকলই তো।
কূজন ইরিনের পাশে বসতে বসতে বললো,
– শাপমোচন কি বলো সোনার হরিণ?
ইরিন কূজনের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– এই ভাইয়াকে আবার বলো না যেন আমি ডায়ালগটা শাপমোচন থেকে নিয়েছি। বই টই পড়ে না বুঝবে না। মনে করবে আমার মাথা থেকে কথাটা বেরিয়েছে।
কূজন আস্তে করে বললো,
– ওকে সোনার হরিণ।
কলরব ওদের সামনে মুখোমুখি বসতে বসতে বললো,
– কানে কানে কথা বলে কানু মিয়ার বউ।
ইরিন ক্ষেপে গিয়ে বললো,
– ভাইয়া!
– ডায়ালগ খালি আপনিই মারতে পারেন তাই না???
কলরবের কথা শুনে কূজন আর ইরিন হাসতে শুরু করলো।
– এই হাসছিস কেনো তোরা?
কূজন হাসি থামিয়ে বললো,
– ভাই তুমি কি মুভি দেখো না?
– কি বলিস প্রচুর দেখি, আমার ড্রেস আপ দেখে বুঝিস না??
– পুরাতন, উত্তম সূচিত্রার??
– নাহ দেখা হয় না। তুই দেখিস?
– না আমি মুভি তেমন একটা দেখি না তবে মা উত্তম সূচিত্রার মুভি দেখে তো তাই সেগুলো আমারো দেখা হয়।
– হঠাৎ এ কথা বললি যে??
ইরিন আর কূজন আবার হাসলো।
কলরব বিরক্ত হয়ে বললো,
– তোরা থাক আমি যেয়ে স্নেকস নিয়ে আসি।
কলরব উঠে বাসায় এলো। কলরব আসতে দেখলো তার বাবা পত্রিকা হাতে কোথায় যেন যাচ্ছেন।
– বাবা কোথায় যাচ্ছো?
– ছাদে গান শুনবো।
– ওহ্ বাট এখানেও পত্রিকা?
– হা হা হা।
কলরব রান্না ঘরে যেয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ালো তারপর বললো,
– ট্রে কোথায় রেখেছো মা?
– ওই যে ওই পাশটায় দেখ।
কলরব ট্রেতে একে একে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, সমুচা, বিস্কিট, চানাচুর, চা সব উঠিয়ে নিয়ে বললো,
– মা আমি এগুলো নিয়ে ছাদে যাচ্ছি তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
– হুম এখনই আসছি।
..
কুহু ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে বেণী করছিল। পিহু সেসময় কুহুকে যেয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কুহু একটু ঢং করে বললো,
– মতলবটা কি আপনার???
– এখন আমার সাথে তোকে এক জায়গায় যেতে হবে।
– এই রাতে কোথায়?
পিহু কুহুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আপুণি প্লিজ না করিস না ছাদে যাব।
কুহু পিহুর হাত সরিয়ে বললো,
– এই রাতে? পাগল নাকি?
– আপুণি এমন করিস কেনো? আমি ভয় পাই তাইতো বলছি। তুই তো আর আমার মতো ভয় পাসনা তাহলে সমস্যা কি তোর?
– ভূতের এতো মুভি দেখলে ভয় তো পাবিই।
– আরে প্লিজ চল না, তুই তো ভূতের মুভি দেখেও ভয় পাস না।
– ভূত বলতে কিছু আছে নাকি? ভূতের মুভি দেখলে আমার আরো হাসি পায়।
– আর তোর সেই হাসি শুনে আমার তখন আরো বেশি ভয় লাগে।
– তাহলে আমাকে নিয়ে দেখিস কেনো?
– একা দেখতে সাহস পাইনা।
– আচ্ছা হঠাৎ ছাদে যাওয়ার মতলব কেনো হলো? তুই তো বছরে একবারো যাস না, চাঁদ দেখারও শখ নেই তাহলে?
– হি হি হি বাস্কেটবল আনতে যাব।
– মানে?
– হাবলি কলরবের বাস্কেটবল আমাদের ছাদে।
বেচারা না নিয়েই চলে গিয়েছে।
– তো??
– এখন এটা রেখে দিয়ে মজা নিব।
– তোর সব ব্যপারে এতো মজা নেওয়া লাগে কেনো?
– প্লিজ একবার ঐ কূজনের আইডিতে নক দিতে দিলি না এখন আবার এটা করতে না করিস না যেন।
– ওর বাস্কেটবল যা ইচ্ছা হোক।
– না না আমি ওটা আনবো। বিকেলে ভুলে গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়েছে।
– ভাগ ফাজিল মেয়ে।
– আপুণি প্লিজ প্লিজ।
– কখনো না।
পিহু জানে কুহুর পিছনে পড়ে থাকলে খুব সহজেই কুহুকে সে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে। বোনকে খুব ভালোবাসে কুহু। আর কুহু যেই নরম মনের মানুষ পিহু তো জানেই। ঠিক ঠিক রাজিও করিয়ে ফেললো সে কুহুকে। টর্চ নিয়ে ছাদে উঠার সময় কুহুর হাত শক্ত করে ধরে রাখলো পিহু। কুহু বিরক্ত হয়ে বললো,
– এমন ভাব করছিস মনে হয় সত্যি ভূত এসে যাবে।
– আপুণি নাগরদোলায় তোরও কিন্তু এমন হয়।
– আমি ভয় পাই তাই উঠিও না, তুই জোর করে আমাকে উঠাস।
– ভয়কে জয় করতে হয় মিস কুহু আরিজা।
– মিস পিহু আলিশা দেখো তো তোমার পিছনে কি?
পিহু চিৎকার দিয়ে কুহুকে জড়িয়ে ধরলো। কুহু হাসতে শুরু করলো। পিহু বললো,
– এটা ঠিক না আপুণি।
– আচ্ছা সরি! কিন্তু আমি বলতে চেয়েছিলাম তোর পিছনে রড রাখা সাবধানে দাঁড়া।
– ওহ্।
কুহু আর পিহু দুজনই টর্চ জ্বেলে পা টিপে টিপে বাস্কেটবলটা খুঁজতে লাগলো হঠাৎ গানের আওয়াজ শুনতে পেল। মনে হচ্ছে পাশের ছাদে। কুহু পিহু ওদের ছাদের পিছন দিকটায়
বাস্কেটবল খুঁজছিল সেখান থেকে ছাদের সামনে এগিয়ে এলো। জোছনা রাত টর্চের প্রয়োজন নেই তবুও পিহু টর্চ জ্বালিয়ে রেখেছে। পিহুর মনে হচ্ছে টর্চের আলো নিভালেই পিহুকে আজ কবরে যেতে হবে। সামনের দিকটায় যেতেই গানের সুর স্পষ্ট পিহু কুহুর কানে ভেসে এলো । দুইবোনই থমকে দাঁড়ালো।
কলরবদের ছাদে কয়েকজন বসে আছে। কুহু দেখলো কলরবের মা, ইরিন আর আরেকজন ছেলে একসাথে গান গাইছে।
”বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দিব তার সুরভী
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো নাকো আমারই ছবি
আমি মিনতি করে গেলাম
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম
ভালোবেসে আমি বারে বার
তোমারি ও মনে হারাবো
এ জীবনে আমি যে তোমার
মরণেও তোমারি রবো
তুমি ভুলো না আমারই নাম
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম”
কুহু খেয়াল করলো ছেলেটা কূজন। কুহু পিহুকে ফিসফিস করে বললো,
– গিটার হাতের ছেলেটা কূজন।
– ওহ্ চশমিশটা।
কুহু বললো,
– তুই কি বাস্কেটবল খুঁজে পেয়েছিস?
– না।
– আমার ডান পাশেই, পায়ের কাছে।
– ভালো চুপচাপ এটা আমাদের সিঁড়ির ওখানে রেখে আয়।
– তুই ভয় পাবি না?
– না এখানে তো ওরা আছে তাই ভয় পাব না।
কুহু বাস্কেটবল সিঁড়িতে রেখে এসে পিহুর পাশে দাঁড়ালো আর সাথে সাথে কলরব কুহুদের ছাদে টর্চ মারলো।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here