একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব:২৩
কুহু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই মনে পড়লো কূজনের মেসেজের রিপ্লাই না দিয়েই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ইশ কূজন ওর সম্পর্কে না জানি কি ভাবছে ভেবেই কুহু মেসেজ পাঠিয়েই রেডি হয়ে কলেজে চলে গেল। কলেজে আজ এসাইনমেন্ট জমা দিবে। এমনিতে তেমন একটা যাওয়া লাগে না। কিন্তু যে কারণে কলেজে গেল সে কাজের কিছুই হলো না। এসাইনমেন্ট যে ফাইলে রেখেছিল সে ফাইল নিতেই ভুলে গেল কুহু। এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট আগামীকাল। কুহুর এসাইনমেন্ট আগেই কমপ্লিট তাই ভেবেছিল আজই দিবে কিন্তু দেওয়া হলো না। কাল ঠিকই আবার কুহুকে আসতে হবে। কুহুর কলেজে ক্লাস করতে ভালো লাগে না তাই ভাবলো বাসায় চলে যাবে। কিন্তু গেইট থেকে তো আর বের হতে দিবে না। দারোয়ানগুলো প্রিন্সিপালেরও আব্বা। কুহু তাই কলেজের অ্যাপ্রোনটা খুলে ব্যাগে নিয়ে নিলো। এখন আর দারোয়ান কুহুকে আটকাবে না। ভাববে হোস্টেলের মেয়ে। কুহুকে বোরকা পড়া দেখে ঠিক ঠিক দারোয়ান ওকে আর বাধা দেয়নি। কুহু গেইট থেকে বের হয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যখন রিকশা পেল না তখন সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। একটুখানি এগিয়ে যেতেই একটা রিকশা পেল। রিকশাওয়ালা ডাবল দাম চাইলো তাই কুহু রিকশাটা না নিয়েই সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। আজকালকার রিকশাওয়ালারা নিজেদের পাইলট মনে করে। কুহুর ইচ্ছে করছিল দুই একটা কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু এনার্জি নষ্ট করতে চাইলো না। আরো একটুখানি এগুতেই সেই রিকশাওয়ালাটাই বললো,
– আফা উডেন।
– আপনার উড়োজাহাজের ডাবল ভাড়া আমি দিতে পারবো না।
– যা ভাড়া তাই দিয়েন।
কুহু রিকশায় উঠলো। রিকশা চলতে শুরু করতেই হঠাৎ কুহুর মনে হলো কলরবকে বাইকে করে কোথাও যেতে দেখলো। কুহু পিছন দিকে ফিরে আবার দেখলো। ছেলেটা কলরবই ছিল । কুহুর কেনো যেন মনে হলো কলরবই রিকশাটা ঠিক করে দিয়েছে। কুহুর হঠাৎ বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক শুরু হলো। কলরবকে ফিল করে না ভয় পেয়ে। কুহুর এমনিতেই খুব পিপাসা পেয়েছিল কলরবকে কলেজের সামনে দেখে এখন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পানি না পেলে প্রাণটাই বোধহয় যাবে। কুহু আবার সাথে পানি রাখে না তাই পিপাসা বাড়তেই লাগলো। কলরব কি কুহুকে এখন ফলো করে? কুহু যেখানে যায় সেখানেই কি কলরব যায়? কলরব কুহুকে পাহাড়া দেয়? কথাগুলো ভাবতেই কুহু ঢোক গিলতে লাগলো। রিকশা বাসার সামনে আসতেই কুহু তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে রিকশাচালককে টাকা দিল। কুহু ভেবেছিল টাকাটা রিকশাওয়ালা নিবে না কিন্তু ঠিকই নিলো। কুহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক কলরব তাহলে রিকশা ঠিক করে দেয়নি। রিকশা ঠিক করে দিলে নিশ্চয় ভাড়াটাও মিটিয়ে দিতো।
কুহু বাসায় যেয়ে পিহুকে পেলো।
– কিরে তুই বাসায় যে?
– শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই যাইনি।
– জ্বর নাকি?
– আরে না মাথা ব্যাথা করছিলো।
– এখন করছে না?
– না এখন আর নেই।
– আচ্ছা তুই এতো তাড়াতাড়ি
চলে এলি যে?
– আরে বলিস না এসাইনমেন্ট নিতে ভুলে গিয়েছি।
– ওহ্।
কুহু পিহুর পাশে বসে কলেজ থেকে ফেরার কাহিনী বলতে লাগলো। পিহু সব শুনে বললো,
– রিকশাটা কলরবই ঠিক করে দিয়েছে।
– না কলরব তাহলে ভাড়া মিটিয়ে দিতো।
– জ্বি না এই পোলা আগুনের গোলা। সে এতো কাঁচা কাজ করে না।
– মানে?
– সে জানে ভাড়া মিটিয়ে দিলে তুই কাজটা পছন্দ করবি না তাই ভাড়া দেয়নি।
– এটা কোনো যুক্তি হলো?
– দেখ রিকশাওয়ালা হঠাৎ কেনো তোকে তোর বলা দামে রিকশায় উঠালো?
– কেনো?
– হাবলি কলরব অর্ধেক ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে।
– কি বলিস এইটুকু রাস্তা পঞ্চাশ টাকা? বেশি হলে ত্রিশ টাকা দেওয়া যায়।
– তোর যাতে হাঁটতে না হয় তাই দিয়ে দিলো আরকি।
কুহু কতক্ষণ ভেবে বললো,
– আমি এতো বোকা কেনোরে পিহু?
– আরে এতোটাও বোকা না।
– আরে না অনেক বোকা।
আর শুন কলরব কি আমাকে ফলো করে? আমার অনেক ভয় করছে। এই ছেলে তো সুবিধার না।
– ফলো করতেও পারে নাও করতে পারে।
– যদি করে তাহলে ব্যাপারটা কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে বল তো।
– হুম তা ঠিক এসব মোটেও ভালো লাগে না।
..
কুহু ইরিনকে পড়া দিয়ে বসে বসে চা খাচ্ছে। ইরিন পড়াটা শেষ করেই লিখে ফেললো। কুহু খাতা দেখতে দেখতে বললো,
– ইরিন তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
– জ্বি আপু।
– তুমি তো অনেক ভালো আর্ট পারো। আমার একটা ছবি এঁকে দিতে পারবে?
– আপু আপনার ছবি আমি অলরেডি এঁকে রেখেছি চাইলে দেখাতে পারি কিন্তু একেবারে দিয়ে দিতে পারবো না।
– আচ্ছা ঠিক আছে আরেকদিন দেখবো আজ একটু তাড়া আছে।
– আচ্ছা আপু।
কুহু ইরিনের রুম থেকে বের হয়েই দেখলো কূজন ড্রয়িং রুমে বসে আছে। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা পেপারওয়েটটা ঘুরাচ্ছে আর খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। পেপারওয়েট থামতেই আবার ঘুরিয়ে দিচ্ছে। কুহু কিছুক্ষণ এটা দেখে চলে এলো।
কুহু চলে যেতেই কূজন পেপারওয়েটটা চেপে ধরে থামিয়ে দিল। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কুহু থাকাকালীন অবস্হায় ইচ্ছে করে কূজন এই কাজটা করেছে। কুহুর দিকে একবার তাকালে কূজন আর চোখ সরাতে পারবে না, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই থাকবে তাই কুহুর থেকে মনোযোগ সরাতে পেপারওয়েট নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলতে শুরু করলো। আল্লাহ জানে কুহু ওকে কি রকম পাগল ভাবছে। না পাগল ভাবছে না কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত ভাবছে নিশ্চয়। কূজন আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ইরিনের রুমের সামনে যেয়ে নক করলো।
ইরিন বললো,
– কূজন ভাইয়া এসো।
– কি করছিলে?
– রেস্ট নিচ্ছিলাম মাত্র ছুটি পেয়েছি তো তাই।
– এই এক ঘণ্টার পড়ায় তোমার ব্রেক নিতে হয়?
– কুহু আপু যতক্ষণ থাকে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি তাই আমার স্নায়ুকোষগুলোর রেস্টের খুব প্রয়োজন হয়। হা হা হা।
– তোমার টিচার কি এতোই স্ট্রিক্ট?
– হ্যা আগে তো বকাও দিতো।
– এখন দেয় না?
– না ভাইয়ার ধুলাই শুনে আর দেয় না।
– ধুলাই মানে?
ইরিন কূজনকে সেদিনের ঘটনাটা পুরোটা বললো।কূজন ইরিনের কাছে সবটা শুনে হাসতে হাসতে বললো,
– আরে আমি যেই ফাঁকিবাজ ছিলাম এমন টিচার থাকলে ভালোই হতো। তাহলে আর এতো টাকা খরচ করে প্রাইভেটে পড়তে হতো না।
– আরে তোমাদের কি টাকার অভাব আছে নাকি?
– তারপরো সরকারিতে চান্স পাওয়াটা ক্রেডিট নেওয়ার বিষয়। চান্স পাবো কীভাবে পড়ার টেবিলে বসে হাবিজাবি চিন্তা করে কাটিয়ে দিতাম। একবার হোম টিউটর অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন আমি অঙ্ক খাতায় কবিতার লাইন লিখে ভরিয়ে রেখেছিলাম। টিউটর তো এটা দেখে আমাকে কি বকাটাই না দিলেন। তারপর স্কেল নিলেন মারার জন্যে। বাবা সেদিন বাসায় ছিলেন। বাবা এটা দেখে টিউটরকে সেদিনই বিদেয় করে দিয়েছিলেন।
– তোমাকে কি টিচার মেরেছিলেন?
– আরে না জাস্ট স্কেল হাতে নিয়েছিলেন।
– আঙ্কেল তো তাহলে অনেক আদর করেন তোমায়।
– হুম অনেক। এরপর থেকে বাবা সব টিচারকে শর্ত দিয়ে রাখতেন যে আমাকে মারা যাবে না এমনকি বকাও যাবে না। আর এজন্যেই পড়াশুনা লাটে উঠেছিলো আমার।
– আঙ্কেল অনেক ভালোবাসে তোমাকে।
– হুম কিন্তু তাই তো বাবাকে কোনোদিন কষ্ট দিতে চাই না। বাবা যদি জানে আমি তোমাদের এখানে তাহলে অনেক কষ্ট পাবে।
চলবে…