একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব:২৬
কুহুর হাত পা কাঁপছে। অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত নেমেই শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। সিঁড়িতেই বসে পড়েছে, বিশ মিনিট হয়েছে এখনো বসেই আছে। কলরবের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেলেও হৃদয়ে কিছু একটার আবাশ পাচ্ছে কুহু। চোখ বন্ধ করে সিঁড়ির পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো সে। চোখ বন্ধ করতেই কলরবকে দেখতে পেলো। তবে অবাক হয়নি কুহু কারণ এটা ওর নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুহু চোখ বন্ধ করলেই কলরবকে দেখতে পায় এমনকি ঘুমোতে গেলেও একই অবস্হা হয়। কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুললো আর তখনই দেখতে পেলো কূজন ওর সামনে দাঁড়িয়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু কূজন থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো ঠিক তখনই কুহু শুনতে পেলো কূজন বলছে,
– কুহু আপনাকে একটা গান শুনাবো?
কুহু কূজনের কথায় পাত্তা না দিয়ে নীচে নেমে গেল। কি উত্তর দিবে সে কূজনকে? এটা তো কূজন নয় কূজনের অবয়ব যেটা কুহু প্রায়শই কল্পনা করে। বাসার দরজা খুলাই ছিল। কুহু বাসায় এসেই নিজের রুমে চলে এলো। তারপর দরজা লাগিয়ে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। একটু আগেই গোসল সেরে ঘুম দিয়েছিলো। ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে ছাদে গিয়েছিলো কাপড় আনতে। কিন্তু ছাদ থেকে আসার পর পুরো মাথা হ্যাং হয়ে আছে। কুহু শাওয়ার হেডের দিকে একদৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তারপর শাওয়ারের নীচে বসে পড়লো। কুহুর মনে হচ্ছে কয়দিন ধরে সে পুরো পাগল হয়ে গেছে। সব কেমন যেন ঘোলাটে। চোখ বন্ধ করলেই কলরব আর পথে ঘাটে যেখানে সেখানে কূজন। নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর।পিহুও জানে ব্যাপারটা। পিহুর ভাষ্যমতে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কূজনের গান শুনে শুনে কুহু কূজনের ভক্ত হয়ে গিয়েছে। আর কলরবকে নিয়ে এতোভাবে তাই চোখ বন্ধ করলে কলরব কলরব আর কলরব। কুহুর কাছে পিহুর কথাগুলো যুক্তিসংগত মনে হয়েছে কিন্তু তারপরো কুহুর যেন কেমন কেমন লাগে। এই কেমন কেমন কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আচ্ছা সে কি প্রেমে পড়েছে? হয়তো পড়েছে কিন্তু কার? কার প্রেমে পড়েছে কুহু? কলরবের না কূজনের? কুহু কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তার খুব কান্না পেলো, কেঁদেও দিল। কুহু অঝরে কাঁদছে কিন্তু কেনো কাঁদছে নিজেও জানে না। অনেকক্ষণ কেঁদে কেটে উঠে দাঁড়ালো। শাওয়ার বন্ধ করে কাপড় পাল্টে মায়ের রুমে চলে গেলো। কুহুর মা তখন টিভি দেখছিলো। কুহু মায়ের পাশে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আম্মু তোমার কোলে একটু মাথা রাখি?
– মানা করেছে কে? আয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
কুহুর মা পা মেলতেই কুহু মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বললেন,
– শরীর খারাপ?
– না।
– তাহলে মন খারাপ?
– জানি না।
– একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক তাহলে হয়তো ভালো লাগবে।
কুহু চোখ বন্ধ করলো না কারণ সে জানে চোখ বন্ধ করতেই আবার কলরবকে দেখতে পাবে। আচ্ছা একজন মানুষ কি একই সময়ে দুইজনের প্রেমে পড়তে পারে? কুহু অনেক ভেবে বের করলো, এটা সম্ভব না। একই মানুষ দুইটা মানুষের প্রেমে পড়তেই পারে না, তাও আবার একই সময়ে। কুহুর মা কুহুকে বললো,
– আম্মাজান আমাকে বলা যায় না?
– নাহ্ তেমন কিছু না।
– আচ্ছা যখন ইচ্ছে হবে তখন বলবি সমস্যা নেই।
কুহু আর কিছু বললো না তবে চোখ বন্ধ করলো। কলরবকে দেখতে দেখতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে যখন উঠলো তখন দেখলো কুহুর বাবা কুহুর পাশে বসে আছে।
– কি ব্যাপার তুই তো দেখি জ্বর বাধিয়ে ফেলেছিস। আজ কি এতোই গরম পড়েছিলো যে দুইবার গোসল করেছিস?
– আরে বাবা তেমন কিছু না। হালকা টেম্পারেচার বেড়েছে হয়তো।
– হুম কিন্তু তোর কি কিছু হয়েছে? হলে বলে দে, শেয়ার না করলে হবে নাকি?
– নাহ্ তেমন কিছু না তো।
কুহু মা বাবার রুম থেকে বের হতেই দেখলো ডাইনিং টেবিলে বসে পিহু স্যারের কাছে পড়ছে। কুহু ইশারায় পিহুকে বললো তাড়তাড়ি যেন ছুটি নিয়ে নেয় দরকারি কথা আছে। পিহু একটু পরেই স্যারকে বিদায় করে কুহুর কাছে গিয়ে বসলো। তারপর বললো,
– তুই কি আম্মু আব্বুকে কিছু বলেছিস?
– নাহ্।
– ভালো করেছিস এই পাগলামির কথা শুনলে তোকে পাবনা পাঠাবে নয়তো বিয়ে দিয়ে দিবে।
কুহু কাঁদো কাঁদো হয়ে পিহুকে বললো,
– পিহুন শুনবি কলরব আজকে কি বলেছে?
– কলরবের সাথে তোর দেখা হয়েছে?
– হুম বিকেলে আজ ছাদে এসেছিলো।
– আচ্ছা বল কি বলেছে?
– জিজ্ঞাসা করেছে আব্বুর কাছে বায়োডাটা পাঠাবে কি না?
পিহু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বললো,
– মানে বিয়ের প্রস্তাবের কথা বলছে?
– হুম।
– আগুনের গোলা তো জাতে মাতাল তালে ঠিক। আচ্ছা তুই কি বলেছিস?
– আমি কিছু বলিনি, কি বলবো ভেবে পাইনি।
– ভালোই করেছিস।
– আচ্ছা আমি এখন কি করবো?
– তুই কি চাইছিস মানে কাকে চাইছিস?
– আমি জানি না! জানি না!
কথা বলতে বলতে কুহু বিছানায় থাকা বালিশটা ছুঁড়ে ফেললো। পিহু কুহুর হাত চেপে ধরে শান্ত স্বরে বললো,
– আপুণি রাগিস না। মনে রাখবি রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
– পিহুন আমি কি করবো বোন? কলরব যদি এখন সত্যি বাসায় আসে তাহলে?
– মনে হয়না তুই না বলা পর্যন্ত আসবে কারণ সে তোর কাছ থেকে জানতে চেয়েছে আসবে কিনা, অনুমতি চেয়েছে।
– তারপরো যদি আসে?
– আব্বু কি তোর মতের বাইরে কিছু করবে নাকি? তুই চাইলে কলরবকে বিয়ে করবি আর না চাইলে না করবি।
– এটাই তো বুঝতে পারছি না আমি কি চাচ্ছি। তুই বল তুই আমার জায়গায় হলে কি করতিস?
– কলরবকে বিয়ে করতাম।
কুহু চোখ মুছে বললো,
– একটু বুঝিয়ে বল কেনো কলরবকে করতিস?
– দেখ তুই দুটানায় ভোগছিস। তুই বুঝতেই পারছিস না তুই কাকে পছন্দ করিস। কূজনকে নাকি কলরবকে? কিন্তু একটা বিষয় আমি এখানে পরিস্কার যে কলরব তোকে চাচ্ছে, মনে প্রাণে চাচ্ছে কিন্তু কূজন তো আর তোকে ভালোবাসে না, তাইনা?
– হুম।
– যদি বাসতো তোকে কিছু একটা বলতো। যেমন ধর কূজন তো ছাদেই থাকে তোর দিকে তো ভালোভাবে তাকায়ও না, কথাও বলে না। দেখ যদি তোর কথা মেনে নেই তাহলে দেখা যাচ্ছে তুই দুইজনকেই পছন্দ করিস কিন্তু বুঝতে পারছিস না কাকে চুজ করবি, তাইতো?
– হুম।
– এখানে চুজ করার মতো কিছুই নেই আপুণি কারণ যদি এমন হতো কূজনও তোকে পছন্দ করে তাহলে তুই দুইজনের একজনকে চুজ করতি। কিন্তু কূজনের দিক থেকে সেরকম কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এখন বুদ্ধিমতির কাজ করতে হবে ।
– কি করতে হবে?
– দেখ যেহেতু দুইজনকেই পছন্দ করিস তাহলে যে তোকে পছন্দ করবে তোকে ভালোবাসবে তাকেই তোর প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আমি কি তোকে বোঝাতে পেরেছি?
– হুম।
– আরেকটা বিষয় আমি তোকে ক্লিয়ার করে বলি সেটা হলো এই যে কলরব আমাকে ছাদে দেখতো কোনোদিন অন্য চোখে তাকায়নি। বরং তোকে দেখতে না পেয়ে আমার উপর বিরক্ত হতো। আমি কি বোঝাতে চেয়েছি বলতো?
– কলরব শুধু আমাকেই পছন্দ করে।
– নাহ্ এটা বুঝায়নি।
– তাহলে কি বুঝাতে চেয়েছিস?
– কলরব শুধু তোকেই ভালোবাসে।
চলবে..