একটুখানি
—লামিয়া চৌঃ
পর্বঃ৩৭
তৈয়ব সাহেব পিহুকে ডাকলেন।
– আব্বু ডেকেছো?
– হুম ডেকেছি। বায়োডাটা নাকি তোর কাছে?
– হ্যাঁ।
– দে তো দেখি।
পিহু বাবাকে বায়োডাটা এনে দিল।
কুহুর মা আবারো শুরু থেকে পড়ছেন। তার আগে
আরো একবার কূজনের ছবি দেখে নিলেন।
কূজনকে দেখলেই উনার বড্ড মায়া মায়া লাগে।
কেন জানেন না তবে ছেলেটার হাসিটায় হয়তো
কিছু একটা আছে। বেশ ভদ্র ভদ্র চেহারা আর
দেখতেও রাজপুত্র। কুহু থেকেও ফর্সা ছেলেটা।
উনি খুশি মনে বায়োডাটা পড়ছেন। তৈয়ব সাহেব চিন্তিত
ভঙ্গিতে বসে আছেন। পিহু দাঁড়িয়ে আছে বাবার
পাশে। তৈয়ব সাহেব পিহুকে পাশে বসতে বললেন।
তারপর বললেন,
– কুহুর মা! কুহুর বিয়ে নিয়ে তো আমি প্রায় অন্য
কাউকে আশ্বাস দিয়ে ফেলেছি।
করবী বিরক্ত হয়ে বললেন,
– তুমি না পারো বটে। এমন ভাবে বললে মনে
হলো কথা দিয়ে ফেলেছ। কথা দেওয়া আর
আশ্বাস দেওয়া ভিন্ন!
– তারপরো..
– শুনো মেয়ে বড় হলে সবাই প্রস্তাব নিয়ে আসে
আর তিন কবুলের আগ পর্যন্ত কিছুই শিউর ভাবে বলা
যায় না। আমার মেয়ে যেখানে সুখী হবে
সেখানে আমি মেয়ে দিব। ছেলেটাকে
দেখেই আমার কত ভালো লাগছে। কি যেন নাম
রবিন। আর তাছাড়া এত ভালো প্রস্তাব। আমার মেয়ের
মন আয়নার মত পরিষ্কার তাই আল্লাহ নিজ হাতে ভাগ্য
খুলে দিয়েছেন।
– শুনো এই ছেলে অনেক বড় লোকের
ছেলে। বড় লোকের ছেলেমেয়েরা বিগড়ে
থাকে। নেশাখোর হয়! দুই দিন পর পর বিয়ে করে
ঘরে বউ তুলে।
– তুমি একবার ছেলেটাকে দেখো দেখলেই
বোঝা যায় কত ভালো।
তৈয়ব সাহেব কূজনের ছবিটা দেখলেন।
– চেহারা দেখে ভালো মনে হলেও তুমি কি মনে
কি আছে জানো? আর কোথাকার কোন ছেলে
চিনিও না, জানিও না। টাকা দেখে বিয়ে দিয়ে আমার
মেয়ের জীবন নষ্ট করবো নাকি? ছেলে
দেখে মেয়ে বিয়ে দিব। ছেলের বাবার টাকা
দিয়ে কি হবে?? আমার মেয়ে এক টাকা কম
খেয়ে হলেও যেন শান্তিতে থাকে সেটা
দেখবো।
– তুমি হেডমাষ্টারের ছেলের কথা বলছো তো?
– হুম।
– আরে কলরব যে ভালো হবে তা তুমি শিউর হয়ে
বলছো কীভাবে?
কলরবের কথা শোনে পিহুর মাথা ঘোরাতে
লাগলো। কলরব, কূজন দুইভাই একই সাথে বিয়ের
প্রপোজাল পাঠিয়েছে??? দুইটাই রাম ছাগল। কিন্তু
ফ্যামিলিও তো পাগল। এখন আপুণির অবস্হা আরো
খারাপ হবে। এই হলো আরেক গাধী। কাকে পছন্দ
করে জানে না। পিহু সবদিক দিয়ে অন্ধকার দেখছে।
মাথা ঘুরছে। কি হবে তা ভাবতেই বিরক্তি ছেয়ে
গেল মনে। আর বেশি কিছু ভাবতে পারলাম না পিহু। বাবা
– মায়ের কথপোকথনে ভাবনায় ছেদ পড়লো।
– ছেলেটাকে আমি প্রতিদিন ফজরের সময়
মসজিদে দেখি নামাজ পড়তে আসে। একদিনও মিস
দেয় না। আর তোমার বড় আপার ছেলে সঞ্জু
কলরবের কলিগ। সঞ্জুকে বলায় বললো, “খালু এক
কথায় রাজি হয়ে যান। ফিউচার খুব ব্রাইট কলরবের। দাই
দাই করে উপরে উঠবে জীবনে। খুবই
ইন্টিলিজেন্ট। আর আচার ব্যবহারও ভালো।”
করবী বললেন,
– বাড়ির পাশের ঘাস গরুতেও খায় না।
– কুহুর মা! আমরা মধ্যবিত্ত তাই বামুন হয়ে চাঁদে হাত
বাড়ানোটা ঠিক হবে না।
– চাঁদ যখন বামুনকন্যা চায় তাহলে ফিরিয়ে দেয়ার
কোনো মানেই হয় না।
– শুনো হাসনাদ সাহেব অনেক বড়লোক। ওদের
স্ট্যাটাস আর আমাদের স্ট্যাটাস কখনোই এক হবে
না। সবচেয়ে বড় কথা এত বড়লোকের
ছেলেমেয়েরা বখে যাওয়া হয়। তারপর ছেলে
স্ট্যাবলিশ না। আজকেই রেজাল্ট বেরিয়েছে।
– ছেলের বাবার যা টাকা আছে না সেগুলো এই
ছেলের নাতি নাতনী পর্যন্ত বখে যাওয়ার জন্য
যথেষ্ট।
আর সে তো ফ্যামিলি বিজনেসই করবে। বাবা মায়ের
এক ছেলে। সবই তো ওর।
– বিজনেস করে লস খাবে না কোনো শিউরিটি
আছে?
– লস খেলেও সমস্যা হবে না। বাবার ছায়া আছে মাথার
উপর।
– কলরব খুব মেধাবী একটা ছেলে। স্কুল
কলেজের ফার্স্ট বয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে ফরেস্ট্রি থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট
হয়েছে। আর এই ছেলে বাবার টাকায় প্রাইভেটে
পড়েছে। কলরবদের খুব ভালো করে চিনি। ওর বাবা
মা বেশ ভালো মানুষ। হাসনাদ সাহেবের মত অপরিচিত
নয়।
– কলরবের ছোট একটা বোন আছে। ঘরে
অবিবাহিত ননদ থাকা মানে কালসাপ থাকা। একলা ঘর দেখে
বিয়ে দেয়া ভালো। কলরবকে কত দায়িত্ব পালন
করতে হবে আর এই ছেলে সম্পূর্ণ রাজা।
– তাও ঠিক। তবে হাতে দুইটাই থাক। দেখাশোনা করি
তারপর কুহু যেটা চাবে সেটা হবে। আচ্ছা বাকিটুকু
পড়ো তো।
তৈয়ব সাহেব আর করবী দুজন মিলে বায়োডাটা
দেখলো। মেটারনাল ব্যাকগ্রাউন্ডে যেয়ে
একে অপরের দিকে বিস্ময়ভরা চাহনী নিয়ে
তাকালো। তৈয়ব সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
– কূজন আর কলরব তো রিলেটিভ।
করবী অবাক হয়ে বললেন,
– শুধু রিলেটিভ না আপন খালাতো ভাই।
– এটা কি করে সম্ভব?? ইফতেখার সাহেব যেখানে
আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন সেখানে হাসনাদ
সাহেব কীভাবে আমাদের কাছে আসতে
পারেন?? বড়লোক হলেই যে মানুষ অমানুষ হয়ে
যায় তার প্রমাণ পেলাম।
করবী আস্তে করে বললেন,
– এমনো তো হতে পারে উনি জানেন না যে
কলরব আর কুহুর বিয়ের কথা চলছে।
– কি জানি বাবা। ওদের ব্যাপারস্যাপার কিছুই বুঝলাম না।
পিহু যা শোনার শোনে নিয়েছে। বাবা মার আজাইরা
প্যাঁচাল আর শুনলো না সে। নিজের রুমে এসে
সঞ্জু ভাইয়ের বউ শিপ্রা ভাবীকে কল করলো
সে। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে শিপ্রা ফোন
ধরে বললো,
– হ্যালো পিহু কেমন আছো?
– জ্বি ভাবি ভালো। আপনি কেমন আছেন?
– ভালো থাকি কীভাবে বলো। ননদিনী আমার
কোনো খবরই রাখে না। কুহু তো মাঝে মাঝে
আসে তুমি খুব কম আসো।
– আমি আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরীক্ষা তাই মা
দেয়নি।
– থাক এই কয়টা বছর কষ্ট করো তারপর তো আরাম
আর আরাম।
– হুম। ভাবী আপুণি আছে?
– আছে তো। দিব??
– জ্বি ভাবী আর্জেন্ট।
– আচ্ছা দিচ্ছি।
শিপ্রা কুহুর হাতে মোবাইল দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা
বাড়ালো। কুহু ফোন কানে নিয়ে আহ্লাদ করে
বললো,
– পিহু সোনা তুমি পড়ো! বেশি করে পড়ো আর
আমি এখানে মজা করি।
– আজাইরা কথা বাদ দিয়ে আসল কথা শোন।তাড়াতাড়ি বাসায়
আয়।
– জীবনেও না। নিজে মজা করতে পারবে না বলে
আমাকেও বেড়াতে দেয় না।
– উফ্ ঢং রাখ তো। আর্জেন্ট!
– ঠিক আছে ম্যাডাম আসছি।
.
কূজন ঘুম থেকে দেরি করে উঠলো। রাতে
মাথাব্যাথায় ভালোভাবে ঘুম হয়নি। বিছানা ছেড়ে
ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে মোবাইল চার্জে
দিতেই মোবাইলের স্ক্রিনে ডেইট দেখে
মনে পড়লো আজ রেজাল্ট দেয়ার কথা। রেজাল্ট
জানার জন্য কোনো আগ্রহবোধ করলো না। মনটা
বেশ খারাপ হয়ে আছে তার। রাতের শোনা
কথাগুলো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে
না। বুকের ভিতর সবকিছু কেমন যেন শূণ্য শূণ্য
লাগছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বের
হলো সে। রুম থেকে বেরিয়েই দেখলো বাবা
আর ইরিন বেশ গল্প করছে। ইরিনের হাতে একটা
মাঝারী সাইজের হরিণের শো-পিজ। সোনালী
রঙের। এন্টিকের বেশ সুন্দর। কূজন যথাসম্ভব
প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বাবার পাশে বসলো। ইরিন
শাসন করার মতো করে বললো,
– ভাইয়া এত দেরি করে কেউ ঘুম থেকে উঠে?
আরেকদিন দেখলে মাইর দিব।
অন্য সময় হলে কূজন ইরিনের কথায় হেসে দিত
কিন্তু আজ হাসলো না। ইরিন কূজনের জন্য
ব্রেকফাস্ট আনতে চলে গেল। ইরিন চলে
যেতেই হাসনাদ সাহেব কূজনকে তার রেজাল্টের
খবর জানালো। বাবাকে এত খুশি দেখে কূজনের
প্লাস্টিক হাসিটা সত্যিকারের হাসিতে বদলে গেল।
হাসনাদ সাহেব কূজনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– প্রিন্স তোমার জন্য অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ
আছে।
কূজন হেসে জিজ্ঞাসা করলো,
– কি সারপ্রাইজ বাবা?
হাসনাদ সাহেব কণ্ঠে আনন্দ ঝরিয়ে বললেন,
– আমি কুহুর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে এসেছি।
রেজাল্ট প্রায় পজিটিভ ধরে নিতে পারো।
হাসনাদ সাহেবের কথা কূজনের মাথার উপর দিয়ে
গেল। কি বলছে বাবা? কুহুর সাথে তার বিয়ে???
তাহলে গতকালের ঘটনা, কুহু আর কলরব ভাই…. ঐটা কি
স্বপ্ন ছিল?? নাহ্ দুঃস্বপ্ন ছিল? নাকি এখন সে স্বপ্ন
দেখছে।
চলবে…