একটুখানি পর্ব : ৩৯

0
620

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী
পর্বঃ ৩৯
কুহু মা কুহুর মাথায় নারিকেল তেল দিয়ে দিচ্ছেন। কুহুর
মা এত সুন্দর করে তেল দেন যে কুহুর মাথায় তেল
দেওয়ার সময় তন্দ্রা লেগে যায়। আজো ব্যতিক্রম
হয়নি। আরামে কুহু চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
কুহুর তন্দ্রা লাগবে লাগবে এমন সময় কুহুর মা
বললেন,
– কুহু একটা কবিতা শোনা তো। অনেকদিন ধরে
তোর আবৃতি শুনি না।
কুহু মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করেই আবৃতি করতে
লাগলো,
“অন্তরবাসিনি, প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তোমায়
অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃত রুপ পাশের জানালায়।
খোলা চুল উড়ছিল বাতাসে।
উড়ছে এলো চুল ,নাকি উড়ছে আমার মন?
বুঝিনি সেদিন হৃদয়ের আয়নাখানি
এঁকেছে তোমার ছবি মায়াবী ও চোখ খানি,
জোড়া ভ্রু জুগোল, কাজল চোখ হরিণী।
ওহে অন্তরবাসিনি সেই তো প্রথম দর্শন।….
পিহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে নখ কাটছিল। কুহুর কবিতা আবৃতি
বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেল সে। প্রথমে
পাত্তা দেয়নি কারণ কুহু প্রায় কবিতা নিজে নিজে
আওড়াতে থাকে যদিও এটাকে সবাই আবৃতি বলে
কিন্তু পিহু বলে আওড়ানো। হঠাৎ তার কাছে কবিতাটা
পরিচিত মনে হলো। পিহু শিউর হওয়ার জন্য রুমের
ভিতর পা বাড়ালো। রুমে যেয়ে দেখলো কুহু
ফ্লোরে বসে আছে আর মা একটা মোড়ায়
বসে কুহুর দীঘল চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। কুহু
চোখ বন্ধ করে একমনে কূজনের লিখা কবিতা
আবৃতি করে চলেছে।
পিহু এবার দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে লাগলো। কুহু পুরো
কবিতা শেষ করে চোখ মেলতেই দেখতে
পেল পিহু হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছে আর
কুহুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কুহু
চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো,
– কি??
পিহুও ইশারায় বললো,
– এই কবিতা কেনো?
পিহুর প্রশ্ন শুনে কুহু নিজেই থতমত খেয়ে গেল।
আস্তে করে বললো,
– উফ্!
কুহুর মা কুহুর উফ্ কথাটা শুনলেন না। কুহুর চুলে তেল
দেওয়া শেষ করে তিনি চুল আঁচড়ে দিতে
লাগলেন। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই বললেন,
– কার লিখা কবিতারে??
মায়ের প্রশ্ন শোনে দুই বোন একবার
চেখাচোখি করলো। তারপর কুহু বললো,
– কেনো?
– অনেক সুন্দর তো তাই বলছি। মনে হল কেউ
যেন আমার কুহুকে নিয়েই লিখেছে।
মায়ের এই কথা শুনে ভয়ে কুহুর বুক দুরুদুরু কাঁপতে
লাগলো। মার কাছে কি ধরা পড়ে গেল? মা এখন কি
করবে? যদিও পিহুর কাছে শুনেছে মা কূজনকে
অনেক পছন্দ করেছে। তারপরো ছি!
কেমন মেয়ে ভাববে মা ওকে? নিশ্চয় ভাববে কুহু
প্রেমটেম শুরু করেছে। অথচ সে এগুলোর
ধারে কাছেও নেই। মায়ের ডাকে কুহুর ভাবনায়
ছেদ পড়লো।
– কিরে বললি না যে?
কুহু ভয়ে কাঁচুমুচু হয়ে বললো,
– কি বলবো?
– তুই লিখেছিস কিনা?
কুহু মায়ের কথা শেষ না হতেই বলে উঠলো,
– হুম আমি লিখেছি।
– হা হা হা।
– হাসছো কেনো মা?
– পৃথিবীতে তুই বোধহয় প্রথম মেয়ে যে কিনা
নিজেকে নিয়ে কবিতা লিখেছিস।
– নাহ্ মানে আমাকে নিয়ে লিখিনি। আমার এক বান্ধবী
আছে ওকে নিয়ে লিখেছি।
– ওহ্ তাই বল। তবে তোর সাথে হুবুহু মিলে
গেছে।
কুহু তাড়তাড়ি করে বললো,
– অন্য ফ্রেন্ডরাও তাই বলে।
– ওহ্ আচ্ছা শোন এটা দেখ।
– কি এটা?
– খুলে দেখ।
কুহু খাম খুলে কূজনের ছবি পেল। ছবিটা একনজর
দেখেই খামে পুরে রাখলো। কুহুর মা বললো,
– ছেলেটাকে কেমন লাগলো?
কুহু কিছু বললো না চুপ করে রইলো। মেয়েকে
চুপ থাকতে দেখে তিনি আবার বললেন,
– আমার বেশ ভালো লেগেছে কতো মায়া
চেহারায়।
কুহু এবারো কিছু বললো না।
কুহুর মা কুহুর চুল বেণী করছিলেন। বেণী করা
শেষে রাবার দিয়ে চুল বেঁধে দিয়ে বললেন,
– আচ্ছা ইরিনের ভাই কলরবকে কেমন লাগে
তোর?
কলরবের কথা শোনা মাত্রই কুহুর মনে হলো শ্বাস
নিতেই কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর দড়াম দড়াম শব্দ
হতে লাগলো। কুহুর মনে হচ্ছে কুহুর মা এমনকি
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিহুও বুঝি এই শব্দ শুনতে পাবে।
নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললে,
– আম্মু আমার ইরিনের ভাইকেও ভালো লাগে না আর
এই ছেলেকেও ভালো লাগে না।
কুহুর মা বিস্ফোরিত চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে
বললো,
– তোকে না তোর বাবা সেদিন জিজ্ঞাসা করলো
তখন বললি না কেনো তোর অন্য কাউকে পছন্দ?
ছেলের নাম কি? কোথায় থাকে? কি করে…
মায়ের কথা শুনে কুহুর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো।
দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– আশ্চর্য তো আম্মু। আমি কখন বললাম আমার অন্য
কাউকে পছন্দ?
– এই না বললি..
কুহু রাগে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– বলেছি এই দুই ছেলে ছাড়া তুমি যার সাথে ইচ্ছা
আমার বিয়ে দাও। আমার কোনো আপত্তি নেই।
এমনকি আমি একবার ছেলেকে দেখতেও চাইবো
না।
কুহু নিজের কথা শেষে রাগে গজগজ করতে
করতে হেঁটে চলে গেল। আর একমুহুর্তও
দাঁড়ালো না। কুহুর মা মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে থেকে নিজেও উঠে পড়লেন। এখন আর
কুহুকে কিছু বলবেন না। এখন ভালো কথা বললেও
হিতে বিপরীত হবে। একটু পর যেয়ে মেয়ের
সাথে কথা বলবেন। কুহুর রাগ পড়ে গেলে কুহুকে
তিনি যা বোঝাবেন তাই বুঝবে। এদিক থেকে পিহু
আবার অন্যরকম। একবার যা ঠিক করবে তাই। নিজের
কথার বাইরে একচুলও নড়বে না। আজকালকার
মেয়েরা কতো কি করে…। কুহুর সেরকম
মেজাজ খারাপ হচ্ছে মায়ের উপর। রাগে
ইচ্ছে করছে কলরব, কূজন দুইজনকেই বিয়ে
করে মাকে শান্তি করে দিতে। বিরক্তিকর তো এই
চিনে মা তাকে? এমন করে বললো কেনো মা
ওকে?? ডাইনিং থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে
নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। সাথে
সাথেই আবার সিদ্ধান্ত নিল এখন রুমে যাবে না। এখন
রুমে গেলেই পিহু তাকে প্রশ্ন করবে কেনো
সে এই কবিতা আবৃতি করে শোনালো। সে না
বললো কাউকেই বিয়ে করবে না। কুহুর নিজের
উপরও রাগ হচ্ছে বেশ। দুনিয়াতে কি কবিতার অভাব
আছে নাকি? সে তো কতোশতো কবিতা পড়ে
ঐগুলো মাকে শোনালেই হতো। তবে তার কি
দোষ? কবিতাটা পছন্দ হয়েছে তার। কুহু মাথা কিছুটা
ঠান্ডা করার জন্য ছাদে গেল। রেলিং এর দিকে
এগিয়ে যেতেই দেখলো মধ্যবয়স্ক একজন
লোক তাদের ছাদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে একটা
ছেলের সাথে কথা বলছেন। ছেলেটা পিছন
ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে সে বুঝলো না
ছেলেটা কে। তবে পিছন দিক থেকে দেখে
কূজন মনে হলো। কুহুর মেজাজ ঠান্ডা হওয়ার বদলে
আরো চড়ে গেল। কুহু দেখতে পেল মধ্যবয়স্ক
লোকটিও বেশ রেগে কথা বলছে। যদিও কি কথা
হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু উনার চেহারা
দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি বেশ রেগে
আছেন। ছেলেটা কথা বলতে বলতে একটু ঘুরে
দাঁড়ালো আর তখনই দেখলো ছেলেটা কূজন, তার
ধারনাই ঠিক। এখানে এসেছিল মাথা ঠান্ডা করতে আর
যেই ছাগলদের কারণে আজ ওর এই অবস্হা সে
ছাগলদের একজন আবার এখানে হাজির। রাগে চোখ
বন্ধ করে পায়ের কাছে থাকা টবে লাথি দিল কুহু। টবটা
কাত হয়ে পড়ে গেল। কুহু পায়ে একটুখানি ব্যাথাও
পেল। জোরে আউ বলে উঠলো সে। হাসনাদ
সাহেব আর কূজন কথা থামিয়ে পাশের ছাদে
তাকালেন। কুহুও ওদের দিকে তাকালো। দুইজনকেই
ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহু তাড়াতাড়ি করে
সিঁড়িঘরের দিকে পা বাড়ায়। কুহু চলে যেতেই হাসনাদ
সাহেব কুজনকে বললেন,
– এই মেয়েই কি কুহু?
কূজন অবাক হয়ে বললো,
– তুমি জানো কি করে?
– কুহুর ছোট বোনকে দেখেছি। দুই বোনের
ফেসকাটিং একইরকম। নাকটা তো পুরাই একরকম।
– ওহ্।
হাসনাদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,
– মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি আর তুমি কিনা…
– বাবা উফ্ফো প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করো কলরব
ভাইয়ের সাথে কুহুর বিয়ে…
হাসনাদ সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন,
– তুমি থাকো তোমার কলরব ভাইকে নিয়ে। আমিও
দেখে নিব কুহু কীভাবে আমার ছেলের বউ না
হয়ে থাকতে পারে?
হাসনাদ সাহেব কূজনের কথা না শোনেই চলে
যেতে নিলে কূজন পিছন থেকে বলে,
– বাবা তোমার ছেলেই যদি বিয়ে না করে?
হাসনাদ সাহেবের হাঁটার গতি কিছুটা শ্লথ হলেও তিনি পিছন
ফিরে তাকালেন না। যেতে যেতেই বললেন,
– তুমি আমাকে জন্ম দাওনি, আমি তোমাকে জন্ম
দিয়েছি। কথাটা মাথায় রেখো।
বাবা চলে যেতেই কূজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে
নিজের চুল দুই হাতে খামচে ধরে বললো,
– উফ্ বাবা তুমি বুঝো না কেনো?
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here