একটুখানি পর্ব : ৪০

0
481

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪০
কুহু দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলো আর
বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– ওরা কি আমার পিছু ছাড়বে না?? পাগল করে আমাকে
পাবনা পাঠিয়ে দেখা যাবে দুই ভাই অন্য দুই
মেয়েকে নিয়ে সংসার করা শুরু করবে। মাঝখানে
থেকে আমিই বৈরাগী হবো।
নিজে নিজে কথা বলতে বলতে আর দৌড়ে নামতে
গিয়ে পড়ে যেতে নিল সে। তাড়াতাড়ি করে
দেয়াল ধরে ব্যালেন্স ঠিক রাখলো। তবে পায়ে
আবারো ব্যাথা পেল। এবার একটুখানি বেশিই ব্যাথা
পেয়েছে। পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে
দেখলো রক্ত পড়ছে হালকা। এবার ধীরে
ধীরে দেখেশুনে সিঁড়ি বেয়ে নামতে
লাগলো সে। কুহুদের বাসা যে তলায় সে তলায় পা
রাখতেই কলরবের মুখোমুখি হলো কুহু।
কলরবকে সে যেখানে সেখানে দেখে না শুধু
ঘুমানোর সময় ওর কথা মনে হয় আর চোখ বন্ধ
করলে তাই কলরব যে বাস্তবে হাজির তা বুঝতে
পারলো। এবার কুহুর আর রাগ হলো না বরং প্রচণ্ড
বিরক্ত লাগলো। যাদের চিন্তা মাথা থেকে সরাতে বাসা
থেকে বের হয়েছিল তাদেরকেই কেনো ওর
সামনে পড়তে হয়। কলরব কুহুকে দেখে কতক্ষণ
তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে। তারপর হেসে জিজ্ঞাসা
করলো,
– কেমন আছো ফুলটুশী?
কুহু তখন সেখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে দুই ভাইকে
ওয়াশিং মেশিনে ফেলে ইচ্ছে মতো ধুলাই করছিল।
কলরবের কথা শোনে সে কলরবের দিকে
সরাসরি তাকালো। তারপর ধীর পায়ে কলরবের একটু
কাছে যেয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে
বললো,
– আপনার সাহস তো কম না আপনি আমার বাসা অব্দি
চলে এলেন। এত অভদ্র কেনো আপনি? আমার
সাথে ফাজলামি করার জায়গা পান না। যত্তসব ফালতু!
কলরব হালকা হেসে বললো,
– কে বলেছে জায়গা পাই না? ছাদে দাঁড়িয়েই তো
তোমার সাথে ফাজলামি করতে পারি কিন্তু তুমি তো
আমার ভয়ে ছাদেই যাও না।
কুহু চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
– আমি আপনাকে ভয় পাই না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমি
কাউকে ভয় পাই না।
কলরব এবার জোরে হেসে ফেললো। তারপর
বললো,
– ভয় পাও অবশ্যই আমাকে তুমি ভয় পাও। কিন্তু যখন
রেগে যাও তখন পাও না আরকি। কিন্তু ফুলটুশী হঠাৎ
রেগে আছো কেনো?
কুহু এবার গলা চড়িয়ে আঙুল তুলে বললো,
– একদম চুপ! এসব ফুলটুশী টুলটুশী বলে আমাকে
ডাকবেন না। আর আপনার সমস্যা কি? ঘরে মা, বোন
নেই? মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে
হয় জানেন না? আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করার
জন্য আমি আপনাকে পারমিশন দিয়েছি কি?
– তুমি এত ভারি ভারি শব্দ ইউজ করো কেনো?
সম্বোধন না বলে তুমি করে কেনো বলি এটা
বললেই হতো।
– আপনি এরকম ফাজলামি শুরু করেছেন কেনো?
– শুনো ফুলটুশী আমার ঘরে মা আর বোন
দুটোই আছে সাথে আছে বোনের একটা রাগী
টিচার। অবশ্য ঘরে বউ নেই। তাই তোমাকেই
যেতে হবে আমার বউ হয়ে।
কুহু কথা বলছে ঠিকই কিন্তু পায়ের ব্যাথায় সে কাহিল
হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে ঝগড়া করার মতো শক্তি তার
নেই। তার উপর কলরব যেভাবে তাকে বউ করার কথা
বললো লজ্জা লাগছে তার। তাই আর দাঁড়ালো না সে।
নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে
ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। তবে পিছন থেকে
কলরবের বলা কথাগুলো সে ঠিকই শুনেছে।
কলরব উঁচু গলায় বলেছিল,
” বাই দ্যা ওয়ে ফুলটুশী আমি তোমার বাসায় আসিনি।
বন্ধুর জন্য বাসা ভাড়া নিতে এসেছিলাম। আর আজ
থেকে আপনি বলেই সম্বোধন করবো তোমায়
তবে ফুলটুশী বলা বাদ দিব না।”
কুহু নিজের রুমে যেয়ে প্রথমেই পায়ে ঔষধ
দিল। তারপর চুপচাপ শুয়ে রইলো। অসুস্হ হলেই কুহু
শুধু পড়ে পড়ে ঘুমায়। এতে করে ব্যাথা টের পাওয়া
যায় না। কুহুর ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। কুহু কথা
বললো না, ইশারায় মাকে পাশে বসতে বললো। মা
পাশে বসতেই কুহু মায়ের কোলে মাথা রেখে
মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– সরি আম্মু ঐসময় মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
কুহুর মা হেসে বললো,
– এই জন্যই তো আপনার জন্য একটা ঠান্ডা স্বভাবের
বাবাজি আনতে চাই। যাতে আপনি এভাবে হুটহাট
রেগে গেলে বাবাজী চুপচাপ বসে থাকে।
কুহু মায়ের কথায় লজ্জা পেয়ে বললো,
– উফ্ আম্মু তুমি সবসময় খালি এসব নিয়ে পড়ে
থাকো।
কুহুর মা কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বললো,
– শোন না আমার কাছে কূজনকে বেশ ভালো
লেগেছে। ছেলের বাবাটাও ঠান্ডা মেজাজের
ছেলেকেও আমার তেমনই মনে হলো। যদিও
কলরব ভালো। তোর বাবা তো কলরবকেই
সাপোর্ট করছে….
– আম্মু তুমি আবার শুরু করলে কেনো?
– আহা আগে শোন তারপর বলিস। আমারো
কলরবকে ভালো লাগে কিন্তু তোর যা রাগ ওদের
ফ্যামিলিতে চলতে কষ্ট হবে। আমি বলছি না ইরিন খারাপ
মেয়ে আবার ইরিন এখন ছোট তাই হয়তো ভালো।
বড় হতে হতে অনেক কিছু বুঝবে, মায়ের আগে
আগ বাড়িয়ে কথা বলবে, মাকে শিখিয়ে পড়িয়ে
দিবে। শোন ননদরা খারাপ তা না। তবে দুনিয়ার
সবচেয়ে ভালো ননদটার সাথে চলতে গেলেও
অনেক বুঝে শোনে বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হয়।
একে তো তুই বোকাদের দলনেত্রী তারউপর
যা রাগ। এভাবে যেয়ে চলতে পারবি না সেখানে।
দুইদিন পর পর ভেজাল হবে। সাহরা ভাবিও কিন্তু প্রচন্ড
চালাক। এত চালাক শ্বাশুড়ী ভালো না আবার বোকা
শ্বাশুড়ীও ভালো না। মোটামুটি টাইপের হলে
ভালো হয়। যদিও আমি জানি না কূজনের মা কেমন।
হয়তো সাহরা ভাবীর মতোই হবে। আপন বোন
বলে কথা আবার নাও হতে পারে। যেমন ধর পিহু
কতো চালাক আর তুই একদম সহজ সরল। বাবারা এতো
কিছু বুঝে না। মনে করে ছেলে ভালো হলেই
হয়। কিন্তু সংসারের কতো প্যাঁচ আছে তা মায়েরা
জানে….
কুহুর মা আরো অনেক কথাই বলছে কিন্তু কুহু কিছুই
শোনছে না। সে আনমনেই বললো,
– মা ওদের দুইজনকে বাদ দেওয়া যায় না?
– কেনো আমি তো বলি ওদের দুইজন থেকে
একজনের কাছেই তোকে বিয়ে দিব।
– কেনো মা?
– কারণ ওরা দুইজনই সুপাত্র।
– মা ওদের ফ্যামিলিতে বড় ধরনের ঝামেলা হবে।
– হোক তাতে আমাদের সমস্যা কি? কলরব, কূজন
তো আপন ভাই না। আপন ভাই হলে সমস্যা হতো
এমনকি চাচাতো ভাইও না। খালাতো ভাইদের
ক্ষেত্রে এতে তেমন কোনো সমস্যা হবে
না।
– মা তারপরো..
– তোর তো অন্য কোথাও পছন্দ নেই তাই না?
– না নেই।
– তাহলে আমার উপর ভরসা আছে?
– আছে।
– তাহলে তুই কিছু বলিস না আমি তোর ভালোটাই
করবো বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা আর তোর তকদির।
কুহু আর কিছু বললো না। আসলেই তার মা সবসময় তার
জন্য বেস্ট জিনিসটাই করেন। পিহু বেশি চালাক আর
চটপটে বলে তিনি কুহুকে বেশি আদর করেন।
কুহু আর কিছু ভাববে না কারণ মায়ের মনে
কোনোদিনো সে কষ্ট দেয় না। পিকনিকে বা
ঘুরতে গেলে মেয়েরা সমসময় নিজেদের জন
কেনাকাটা করে কিন্তু কুহু সবসময় মা আর পিহুর জন্য
গিফ্ট কিনে। ইলাভেনে পড়ার সময় রাঙামাটি গিয়েছিল
ঘুরতে। বাসে টাকা হারিয়ে ফেলেছিল। কাঁধে
ঝুলানো ব্যাগে শুধু পাঁচশো টাকার নোট ছিল বাকি সব
টাকা কেউ চুরি করে নিয়েছিল। সেবার সে পিহুর
জন্যও কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। শুধু মায়ের জন্য
পাহাড়ীদের হাতে বুণা কামিজের কাপড় নিয়ে
এসেছিল। মা এমন পোষাক খুব পছন্দ করে দেখে
নিজের জন্য কিছু না কিনেও সে মায়ের জন্য
কিনেছিল। বাসায় এসে অবশ্য কামিজের সাথের
ওড়নাটা পিহুকে দিয়ে দিয়েছিল। ছোট বোনকে
কিছু না দিতে পেরে খুব খারাপ লাগছিল তার। যদিও পিহু
জানে টাকা হারিয়ে না ফেললে পিহুর জন্যও কিছু
নিয়ে আসতো। আর সেই মাকে কষ্ট দিতে
পারবে না সে। আর তাছাড়া ভালোই হবে কূজন –
কলরব নামক পাজেল থেকে মা তাকে মুক্তি দিবে।
মা যাকে চুজ করবে সে তাকেই বিয়ে করবে।
ছোটবেলায় পরীক্ষার সময় মা যদি বলতো পাট
রচনাটা পড়ে যা তাহলে সেটাই পরীক্ষার প্রশ্নে
থাকতো আবার যদি বলতো পরিবেশ দূ্ষণ পড় এবার
তাহলে সেবার কেমন করে যেন সেটাই
আসতো। কুহু মায়ের কথা মতো পড়তো আর
সেটাই কমন পেতো সে। আজো সে মায়ের
কথা মতো চলবে। মায়ের সাথে রাগ দেখিয়েই
পায়ে ব্যাথা পেল সে। মাকে কষ্ট দিলেই তার
কপালে শনি লাগে।
..
রাতে খাওয়ার টেবিলে কুহুর মা আবার কথা তুললেন।
এবং সব শুনে বুঝেই তৈয়ব সাহেবও স্ত্রীর সাথে
একমত হলেন। ঘরোয়াভাবে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল
আগামীকাল হাসনাদ সাহেবের সাথে কথা বলবেন।
কূজনই যে কুহুর জন্য পারফেক্ট তৈয়ব সাহেবকে
খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন কবরী। পিহু কিছু
বললো না শুধু ইশারায় বোনকে জিজ্ঞাসা করলো
বোন রাজি আছে কিনা?
কুহু ইশারায় বলে ফেললো মা – বাবা যা করবে তাতে
সে দ্বিমত করবে না। ওদের এই একটা বিষয় আছে
দুই বোনের মাঝে। হাজার মানুষের চোখ
এড়িয়েও দুইবোন দিব্যি ইশারায় নিজেদের
কথাগুলো বলে ফেলে। কেউ দেখলেও এই
ইশারা বোঝে না। পিহু বোনের কথা শোনে
নিশ্চিন্ত হয়েছে। যাক অবশেষে তার বোন থিতু
হয়েছে। পিহুর মনটা আনন্দে ছেয়ে গেল।
আপুণির বিয়ে অনেক মজা করবে সে। তারও একটা
দুলাভাই থাকবে। দুলাভাই মানেই হলো সব আবদার পূরণ
করার ছোট খাটো মেশিন। অবশ্য এই আবদারগুলো
সবই হলো শয়তানী আবদার। কূজন দুলাভাই হিসেবে
কেমন হবে ভাবতে লাগলো সে। বেশ
ভোলাভালা দুলাভাই হবে। বড়লোক বাপের টাকা
পকেটে নিয়ে ঘুরে তাই পকেট খালি করতে
সমস্যা হবে না, নিজের রোজগার উড়াতে কষ্ট হয়
কিন্তু বাপের টাকা উড়াতে মজা লাগে সবার। আর কূজন
বেশ ভদ্র টাইপের মানুষ। অনেক দুলাভাই আছে
যাদের খেচর মনে করে শ্যালিকারা। কিন্তু কূজন
হবে কিউট দুলাভাই। বাহ্ বেশ সুন্দর গান শোনাবে।
কূজনের গান অসাধারণ তবে কবিতাগুলো খুবই বোরিং।
ঐগুলো না আবার জোর করে পড়ানো শুরু করে।
মনে মনে হিসাব নিকাষ কষে ফেললো সে। নাহ্
মোটামুটি ভালোই দুলাভাই হবে।
..
কুহুর সারারাত ঘুম হয়নি। মাঝরাতের দিকে চোখে
একটুখানি ঘুম এসেছিল। কিন্তু ভোররাতে ঘুম
ভেঙে গেল তার। পিহু তখন বিভোর হয়ে
ঘুমোচ্ছে। কুহু এপাশ ওপাশ করছে। ঘড়ি দেখলো
সে আজান পড়তে আরো সময় লাগবে। তাই বিছানা
ছেড়ে উঠলো না। পিহুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে
রইলো। পিহু ঘুমের ঘোরেই কুহুর হাতে চড় দিল।
কুহু হেসে হাত সরিয়ে ফেললো। পিহুকে কেউ
জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেই পারে না। পিহু ঘুমের
মাঝেও বিরক্ত হয়। কুহু উল্টো ফিরে চোখ বন্ধ
করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। চোখ বন্ধ
করতেই কলরবকে মনে পড়লো। আজ
কলরবকে কতোগুলো কথা শুনিয়েছে সে কিন্তু
কলরব কিছু বলেনি। কলরবকে মনে পড়তেই মনে
হলো কয়দিন বাদেই কূজনের সাথে বিয়ে হয়ে
যাবে। তখন কূজনকে নিয়ে সংসার করতে হবে তার।
ভাবতেই কান্না পেল কুহুর। প্রচন্ড জোর করেও
কান্না আটকে রাখতে পারলো না। চোখ থেকে
বারিধারা ঝরতে লাগলো। কুহু কাঁদতে কাঁদতেই উঠে
পড়লো বিছনা ছেড়ে। তারপর চোখ বন্ধ করে
সবকটা ঘটনা ভাবলো সে। তারপর লাইট জ্বালিয়ে
আস্তে করে টেবিলের দিকে এগুলো। রিডিং
টেবিলে রাখা খাতাগুলোর একটা থেকে একটা কাগজ
ছিঁড়ে খাতাটা জায়গায় রেখে বসে পড়লো চেয়ার
টেনে। কলম দিয়ে পৃষ্ঠার মাঝামাঝি দাগ কাটলো।
তারপর একপাশে লম্বা করে কূজনের নাম অনেকবার
লিখলো। তারপর অন্য পাশে একইভাবে কলরবের
নাম লিখলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লিখাগুলোর
দিকে। তারপর কিছু আঁকিবুকি করলো সাথে কিছু লিখাও
লিখলো। পৃষ্ঠাটা হাতে নিয়ে বিছানার কাছে যেয়ে
পিহুকে ডেকে তুললো। পিহু বিরক্ত হয়ে
বললো,
– পাগল হয়ে গেলি নাকি? ঘুম থেকে ডেকে তুললি
কেনো? পাগল মেয়ে কোথাকার!
কুহু পিহুর দিকে পৃষ্ঠাটা এগিয়ে দিল। পিহু ঘুম ঘুম
চোখেই দেখতে শুরু করলো। পিহুর চোখ
ছানাবড়া হয়ে গেল। অবাক চাহনী নিয়ে পিহু কুহুর
দিকে তাকিয়ে বললো,
– এর মানে কি?
কুহু সামান্য হেসে বললো,
– এর মানে হলো আমি কূজনের কবিতা, গান, আচার,
ব্যাবহার সব ভালোবাসি কিন্তু ভালোবাসি কলরবকে।
পিহু ঝাঁঝালো কণ্ঠে কুহুকে বললো,
– তোকে আমি কালকেই আব্বুর কাছে বলে পাবনা
পাঠাবো।
কুহু শান্ত স্বরে পিহুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পিহুর
পাশে বসে পড়লো। তারপর কাগজটায় আঙুল দিয়ে
পিহুকে দেখিয়ে বললো,
– এই যে দেখ কূজনের নামের উপর আমি লাভ চিহ্ন
দিয়েছে কিন্তু ওর নামের পাশে ভালোবাসি কথাটা
লিখতে পারিনি। কলরবের নামের পাশে বারংবার লিখেছি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। লাভ চিহ্ন আঁকা আর
ভালোবাসির মধ্যে বহু তফাৎ পিহুন।
– এই লিখা দিয়ে তুই কীভাবে বুঝলি?
– ভালোবাসা আর মুগ্ধ হওয়া এক নয়। কূজনকে আমি
কখনোই ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি কলরবকে।
কূজনের কবিতা গান এসব আমাকে মুগ্ধ করেছে
এমনকি আমি কখনো কলরবকে নিয়ে তেমন একটা
ভাবিনি। সবসময়ই কূজনকে নিয়ে ভেবেছি। কূজনের
গান নিয়ে ভেবেছি। কূজনের কবিতা পড়ে কবিতায়
মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু যতবার আমি কূজনের গান শুনেছি
ততোবারই কলরবকে মনে পড়েছে। কূজনের
লিখা কবিতায় আমি কলরবের চোখে নিজেকে
দেখেছি।
পিহু হা হয়ে আছে। মুখ কিছুতেই বন্ধ করতে
পারছে না। কুহু একমনে বলেই চলেছে,
– কলরবকে নিয়ে আমার কখনো ভাবতে হয়নি সে
নিজেই আমার হৃদয়ের মাঝে ঝেঁকে বসেছিল তাই
ওকে নিয়ে ভাবা লাগতো না সে এমনিতেও মনে
পড়তো। তার উপর কূজন আর আমি সবদিক থেকেই
সেইম। দুজনের পছন্দের জগৎটা একই। অপরদিকে
কলরবের কিছুই আমার ভালো লাগে না। কলরব গায়ে
পড়া স্বভাবের ছেলে, তারউপর বেশি পটপট করে,
খেলাধূলায় মেতে থাকে। এসব কিছুই আমার ভালো
লাগে না। তারপরো কেনো আমার তাকে ভালো
লাগে জানিস? আসলে আমি কলরবকে ভালোবাসি।
কূজনের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে আর কলরবের
প্রতি ভালোবাসা। তুই যাকে ভালোবাসবি তাকে কারণ
ছাড়া ভালো লাগবে তোর। যেমনটা কলরবের
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই ছেলের মাথার চুল
থেকে পায়ের নখ অব্দি আমার কিছুই ভালো লাগে
না। মানে ওর আচরণের কথা বলছি আরকি তারপরো
কেনো আমার তাকে ভালো লাগে?? কারণ আমি
কলরবকে ভালোবাসি।
এতটুকু বলেই কুহু কাগজটা মাঝ বরাবর ছিঁড়ে
ফেললো। কূজনের নামগুলো লিখা যে পাশটায়
সে অংশটুকু বটে ফেললো আর কলরবের নাম
লিখা কাগজটায় চুমু খেয়ে উঠে পড়লো বিছানা
ছেড়ে। মোবাইল আর ইয়ারফোন নিয়ে বারান্দার
দিকে এগুলো সে। বারান্দায় যাওয়ার আগে রুমের
কোণায় রাখা ময়লার ঝুড়িতে কূজন লিখা কাগজটা
ফেলে দিলো। বারান্দায় যেয়ে চুলের বেণুণী
খুলে চুল ছেড়ে দিলো সে। তখন চারিদিকে
অন্ধকার, সবাই ঘুমিয়ে শুধু কুহুর মন জুড়ে কলরব নামক
বহ্নিশিখা জ্বলছে আর কুহুর হৃদয় জেগে কলরব
ধ্বনিতে মুখোরিত হচ্ছে। হালকা বাতাসে কুহুর
দীঘল কালো চুলগুলো উড়ছে। কুহুর এই
কেশের নেশায় যেকোনো ছেলেই কুহুর
গ্রীবায় গহীনে মত্য হবে, ডুবে যেতে
চাইবে তার চুলের নেশায়। কিন্তু কুহু ডুবছে কলরব
নামক সমুদ্দুরে। কুহু কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ
বন্ধ করে গান শুনছে আর কলরবের বলা একেকটা
কথা, তার গগণবিহারী হাসি, হৃদয় ছিদ্র করে ফেলার
মতো ডাক ফুলটুশী সব মনে করছে সে। গানের
প্রতিটি লাইনেই সে কলরবের নামে উত্তর দিচ্ছে।
” সুজন তুমি আমায় যে গো ভুল বুঝো না।
আমি ছিলাম তোমার, থাকবো তোমার হয়েই ঠিকানা।
হৃদয় জুড়ে এখনো তো তোমায় আঁকে মন।
আমার কাজল কালো আখিতে রয় তোমারি স্বপন।
আজ ভুলের পাহাড় গইড়া তুমি ডুবলে যে নেশায়।”
কুহু গানের লাইনের বিপরীতে বললো,
– উঁহু কলরব আমি ভালোলাগার নেশায় তোমার
ভালোবাসা বুঝিনি।ভুল করেছি আমি তুমি না কলরব।
“সেই নেশাই যেন দূরে ঢেইলা দিল যে আমায়।”
কুহু ঘোর লাগা কণ্ঠে আবার বললো,
– আমি দূরে ঢেলে দিতে চেয়েছিলাম তোমায়
কিন্তু তুমি প্লিজ এই গাধীটাকে দূরে ঢেলে দিও না।
“হায় কেমন কইরা ভাবলা তোমার খবর নিব না?
হায় কেমন কইরা ভাবলা এই মন তোমায় দিব না?
দূরে কোথাও যাইনি আমি
কাছে যে আছি।
শুধু চোখটা মেলে দেখো আমি যে এক
উদাসী।
আমার পায়ের নূপুর শুধু তোমার আঙিনায়।
বাজবে যখন ডাকবে তুমি আমায় একটিবার।
রোজ বিকালে আমি একা থাকি দাঁড়িয়ে।
তুমি কখন আইসা দেবে তোমার হাতটা বাড়িয়ে?
এই হৃদপিন্ডের ধুঁকপুৃঁকানি শুধুই যে তোমার।
বন্ধু কেনো বুঝো নাগো বলি বারেবার।”
কুহু কান থেকে ইয়ারফোন খুলে কাগজটা বুকের
সাথে চেপে ধরে বললো,
– আই ডু মাভ ইউ কলরব! আই ডু লাভ ইউ!
কুহুর চোখ থেকে এক ফোঁটা ভালোবাসার জল
গড়িয়ে পড়লো। চিবুক পেরিয়ে বুকের মাঝে
চেপে ধরা কাগজটায় মিলিয়ে গেল এই ভালোবাসার
জল।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here