একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৭
– মামা! আমার ভাইকে দেখেছো?
মুদি দোকানদার তিতাস পানের ফিঁক ফেলে বললো,
– ঐ সুন্দর কইরা পোলাডা? চশমা পড়ে যে?
কলরব হেসে বলল,
– হুম মামা সুন্দর ছেলেটাই।
– হো দেখছি তো কিছুক্ষণ আগেই গলির ভিতর
ঢুকলো।
– শুকরিয়া মামা!
– আরে হিরো যাও কই? শুনলাম তোমার নাকি বিয়া?
– ভুল শোনোনি মামা।
– তা হিরোইন নাকি আমগো তৈয়ব সাহেবের বড়
মাইয়া?
কলরব ম্লান হাসলো। তারপর বলল,
– কেন হিরোর সাথে যাবে না?
দোকানদার তিতাস মিয়া ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
– কি যে কও হিরো। তৈয়ব সাহেবের মাইয়াগুলা তো
সেনালক্ষী মাইয়া। জীবনে বারান্দায় ও দাঁড়াইতে
দেখে না কেউ। মেলা ভালো বউ খুঁইজা বাইর
করছো। তয় দাওয়াতি হইতে পারমু তো?
– কি যে বলো মামা অবশ্যই। আমি এখন যাই পরে কথা
বলব।
– ঠিক আছে হিরো যাও।
তিতাস মিয়ার সাথে কথা শেষ করেই কলরব আবার গলির
রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। চারিদিক তীক্ষ্ণ নজরে
দেখছে কলরব। গলির ভিতরও দুই একজনকে
জিজ্ঞাসা করলো। বাড়িওয়ালার ছেলেকে দেখে
ওকেও কূজনের কথা বলল।
– কিরে মন্টু কূজনকে দেখেছিস?
– কলরব ভাই! কূজন ভাইয়া তো ছাদে গেল। আমার কাছ
থেকেই চাবি নিয়েছে ছাদের।
– এত রাতে ছাদে? অবশ্য যেতেই পারে আমিও যাই।
– আমিও তো ভাবলাম তুমি বোধহয় ছাদে যাবে তাই
চাবি নিতে কূজন ভাইয়াকে পাঠিয়েছ।
– উমাহ্ ভুললি কি করে? আমার কাছে তো ছাদের
একস্ট্রা চাবি আছে।
– ও হ্যাঁ আমিই তো বানিয়ে দিয়েছিলাম তোমায়।
কলরব মন্টুর পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
– ব্যাটা প্রেমটেম করছিস নাকি? এত ভুলাভুলি কিসের?
– প্রেম করলে তুমি, বিয়েও করছো তুমি আর এখন
আমার উপর দোষ চাপাচ্ছো।
– কবে প্রেম করলাম?
– আমি তোমার খেলা দেখেছি তো..
কলরবের কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর অবাক হয়ে
বলল,
– কি খেলা?
– বাস্কেটবল ছুঁড়াছুঁড়ি।
কলরব গগনবিহারী হাসি দিয়ে বলল,
– কখন দেখলি?
– একদিনই দেখেছিলাম। তুমি তো ভাবীকে পুরাই
ইভ্টিজিং করো।
কলরব আরো জোরে হেসে মন্টুর চিবুকে হাত
রেখে বলল,
– মন্টু সোনা ইভটিজিং এর শাস্তিসরূপ এখন জেলখানার
কয়েদী হতে যাচ্ছি।
– বাহ্ ভালো তো! আমিও এমন কয়েদী হতে চাই।
– এই ছেলে এইটে পড়িস না? সামনে না তোর
পরীক্ষা? পড়তে বসেন পড়ে মজনু হলেও
চলবে।
– নাহ্ আমি তো মজনু হব না। আমি হবো তোমার
মতন। তোমার কাছ থেকে অবশ্যই বাস্কেটবল
খেলা শিখব। তারপর মেয়েদের সেটা শিখানোর
নামে বল থেকে শুরু করে মন ছুঁড়াছুঁড়ি সব করব।
– আরে বাবা কতসব দেখেছে। কখন দেখলি?
মন্টু লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলল,
– ঐ একদিনই দেখেছি। আন্টি আর আমি দুজন
একসাথে টাঙ্কির চিপায় দাঁড়িয়ে দেখেছি।
– মা তো পারেও বটে। আর শোন আমি এতদিন
মোটেও প্রেম করিনি কিন্তু এখন করব। কিন্তু তুই
এত রাতে পড়ার টেবিলে না বসে থেকে টইটই
করছিস কেনো?
– আম্মু কয়েল কিনতে পাঠিয়েছে।
– ওহ্ তাড়াতাড়ি বাসায় যা।
কলরব পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। সোজা ছাদে চলে
এল সে। টর্চ আনেনি কিন্তু চাঁদের আলোয় স্পষ্ট
সব দেখা যায়। জোছনা চুইয়ে পড়ছে চারিদিকে।
কূজন পকেটে হাত রেখে আকাশের দিকে মুখ
করে দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে পিছন থেকে
দেখে কলরবের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটলো।
কলরব পিছন থেকে কূজন বলে ডাক দিল। কূজন
কলরবের ডাকে পিছন ফিরে চাইলো। তারপর ম্লান
হেসে বলল,
– ভাই এখানে এসে দাঁড়াও।
কলরব কূজনের পাশে দাঁড়িয়ে কূজনের কাঁধে হাত
রাখতেই কূজনের চোখগুলো সাথে সাথে ভিজে
উঠলো। কলরব দেখে ফেলবে ভয়ে কূজন মুখ
তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর
ধাতস্হ হয়ে বলল,
“জোছনা কুড়াইয়ো না বন্ধু!
চোক্ষে ধইরা রাখো।
স্বপন দেইখো মোরে লইয়া!
ছুঁইতে নাহি চাইয়ো।”
কলরবও কথাটা মনে মনে রিপিড করলো। তারপর
হেসে বলল,
– তুই অনেক সুন্দর কবিতা লিখিস। ইশ্ আমি যদি কবি হতাম
তাহলে তোদের ভাবীর জন্য কিছু লিখতাম।
কলরবের কথায় কূজন কলরবের দিকে তাকালো।
তারপর কাঁপা গলায় বলল,
– ভাই একটা গান গাইবো?
– উমাহ্ না করেছে কে? গান তো বেশ লাগে
আমার। দাঁড়া আমি তোর গিটারটা এক দৌঁড়ে নিয়ে আসছি।
– নাহ্ ভাই খালি গলায় শুনাই? গিটার বাজাতে ইচ্ছে করছে
না।
– কি ভালো লাগছে না? এখনি নিয়ে আসছি আমি।
কলরব সত্যি সত্যি গিটার নিয়ে আসতে চলে গেল।
কলরবের চলে যাওয়ার দিকে কূজন তাকিয়ে রইল
কতক্ষণ তারপর বলল,
– ভাই তোমাকে কুহু অনেক ভালোবাসে।
চোখ থেকে চশমাটা খুলে শার্টের কোণা দিয়ে
মুছলো কূজন। তারপর চোখে দিয়ে অপেক্ষা
করতে লাগলো কলরবের জন্য। কলরব পাঁচ
মিনিটের মধ্যেই গিটার নিয়ে চলে এল।
কূজন গিটার হাতে গান ধরলো,
“তেরে নাম সে জি লু
তেরে নাম সে মার জায়ু
তেরে জানকে সাদকে মে
কোচ এসা কার জা য়ু
তুনে কিয়া কারডালা
মার গায়ি মে মিট গায়ি মে
ওহো জি আহা জি
হোগায়ি মে তেরি দিওয়ানী
দিওয়ানী তেরি দিওয়ানী দিওয়ানী
ইশক জুনু যাব
হাদসে বার যায়ে
হাসতে হাসতে আশিক
সুলি চার যায়ে”
কূজন এতটুকু গেয়েই আর টাল সামলাতে পারলো না।
গিটার হাত থেকে পড়ে গেল। সেও দাঁড়িয়ে
থাকতে পারছে না। হাত পা কাঁপছে, শরীর ম্যাজম্যাজ
করছে। কলরব হঠাৎ ঘটে যাওয়া কান্ডে হতবাক হয়ে
গেল। এগিয়ে যেয়ে কূজনের কাঁধে হাত
রাখলো। সাথে সাথে কূজন ঢলে পড়লো। কলরব
তাড়াতাড়ি করে কূজনকে ধরলো। কূজন কলরবের
হাত ধরে বলল,
– ভাই আমার শরীরটা ভালো না। আমাকে একটু ধরে
বাসায় নিয়ে যাও তো।
কূজনের হাত এত গরম দেখে কলরব কূজনের
কপালে হাত রেখে দেখলো। তারপর
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
– আল্লাহ জ্বরে তো কপাল পুড়ে যাচ্ছে তোর।
শীত পড়েছে গায়ে শীতের কাপড় না জড়িয়ে
ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলে তো এমন হবেই।
কূজন কিছু বলল না। কূজনের হাত ধরে রেখেই
আরেক হাতে কলরব কূজনের গিটারটা তুলে নিল।
তারপর ছাদ থেকে নেমে বাসায় এসে সোজা
নিজের রুমে নিয়ে গেল কূজনকে। কূজন রুমে
ঢুকেই বিছানায় বসে পড়লো। চশমা খুলে কলরবের
হাতে দিয়ে বলল,
– ভাই আমি এখন ঘুমাবো।
কলরব দেখলো কূজনের চোখ লাল টকটকে
হয়ে আছে। কলরব ধমকে বলল,
– আগে জ্বর মেপে নিই তারপর। আর না খেয়ে
আবার ঘুম কিসের? ঔষধ খেতে হবে না?
কূজন লাল টকটকে চোখগুলো দিয়ে কলরবের
দিকে তাকালো। তারপর বিড়বিড় করে বলল,
– ভাই আমার ঔষধ অন্য কারো ভালোবাসার টনিক।
কূজনের কথাগুলো কেমন যেন জড়ানো মনে
হচ্ছে। কলরব সবটুকু না বুঝলেও ভালোবাসার টনিক
শব্দটা বুঝলো।
– কি বলছিস কূজন বুঝতে পারছি না স্পষ্ট করে বল।
কূজন কিছু বলল না চুপচাপ শরীর ছেড়ে দিল বিছানায়।
কলরব আর কূজনকে ঘাঁটলো না। কাবার্ড এর ড্রয়ার
থেকে থার্মোমিটার নিয়ে এল। কূজনের পাশে
বসে কূজনের মাথায় হাত রাখতেই কূজন চোখ খুলে
আকুতির স্বরে বলল,
– ভাই কুহুকে বলবে একবার আমাকে ভালোবাসি কথাটা
বলতে? একটুখানি বলবে কি?
কূজনের জড়ানো কণ্ঠের প্রতিটা শব্দ কলরবের
কানে বজ্রপাত মনে হলো। সে অবাক হয়ে
কূজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কূজন অসহায়
দৃষ্টিতে কলরবের দিকে তাকিয়ে আছে। কলরব
খেয়াল করলো কূজন ওর হাত জুড়ে চেপে ধরে
রেখেছে। কলরবের মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। কিছুই
ভাবতে পারছে না সে। কূজন কলরবের হাত ছেড়ে
দিয়ে হতাশ গলায় বলল,
– থাক বলা লাগবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো কুহু যদি একবার
আমাকে বলে কূজন তোমাকে আমি ভালোবাসি
তাহলে আমি চলে যাব এখান থেকে। আর
কোনোদিন আসব না তোমাদের মাঝে।
কলরব আর শুনতে পারলো না। ওর কান ঝাঁঝা করতে
লাগলো। কি বলছে কি এসব? কোন কুহুর কথা
বলছে কূজন? সে কি ফুলটুশীর কথা বলছে? তার
ফুলটুশীর কথা বলছে কি? কলরব কি করবে কি
ভাববে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কলরব যখন
খুব বেশি টেনসড থাকে তখন কফি খায়। কলরব
কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। এক মগ স্ট্রং কফি
দরকার ওর, খুব বেশি দরকার।
চলবে…