একটুখানি পর্ব : ৪৬

0
462

একটুখানি
— লামইয়া চৌঃ
পর্বঃ৪৬
“আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ। আপনার সবটা
জুড়েই ভালো লাগা কাজ করে। আপনার মতন
পার্ফেক্ট মানুষ আমার কাছে দ্বিতীয় আর নেই।
সবার কাছে মুভির হিরোরা যেমন পার্ফেক্ট হয়
আমারো আপনাকে তেমন পারফেক্টই মনে হয়।
আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু কথাটা সত্য আমি
আপনাকে ভালোবাসি না। দয়া করে আমার জন্য মনে
দুঃখ কিংবা রাগ পুষে রাখবেন না। আমাকে নিজের পক্ষ
নিয়ে কিছু বলতে দেওয়া হলে আমি বলব আমি
কোনোদিন আপনাকে সেরকম কোনো ইশারা
ইঙ্গিত করিনি। তাই আশা করি আমার উপর রাগ পোষণ
করে থাকবেন না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আপনি
খুব খুব ভালো কাউকে যেন জীবনসঙ্গী
হিসেবে পেয়ে যান। আপনাকে একটা কথাই বলব
আপনি একজন মনোমুগ্ধকর মানুষ। আল্লাহ নিশ্চয়
আপনাকে ঠকাবেন না। আমার মতো অতি সাধারণ
একজন মেয়ে আপনার জীবনে না এলেও আপনার
জীবনে সুখের অভাব হবে না। আপনি যেন এক
অনিন্দ্য সুন্দরীকে জীবনসাথী রূপে পান। দয়া
করে এটাকে আমার সিমপ্যাথি মনে করবেন না। আমি
শুধু আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে চেয়েছি। তবে
আরেকটা কথা আমি কলরবকে ভালোবাসি অনেক
আগে থেকেই ভালোবাসি। ভালো থাকুন আর
আমাকে প্লিজ ক্ষমা করুন।”
কুহু চিঠিটা লিখে ডায়েরীর মাঝে রেখে পিহুকে
দিয়ে বলল,
– তুই যে করে হোক কূজনের কাছে এটা পৌঁছে
দিবি।
– ঠিক আছে। তবে তুই সরাসরি দিলেই ভালো
হতো।আর এখানে ক্ষমার কথা বলছিস কেনো তুই?
ভালোবাসিস না এইটুকুই যথেষ্ট।
– নারে তুই দিয়ে দিস। কূজন ছেলেটা সত্যি অনেক
ভালো। আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে
ভেবে যে দুইদিন পর আমি ওর সামনেই ওর
ভাইয়ের বউ হব। বিষয়টা কূজনের জন্য খুবই
বেদনাদায়ক।
পিহু বিরক্ত হয়ে বলল,
– নিজের চিন্তা কর তুই। তোর এসব ভালেমানুষী
দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।
– এমনভাবে বলছিস কেনো? কূজনের মনে কষ্ট
দিয়ে আমি কখনোই ভালো থাকতে পারব না। কূজন
ছেলেটা অনেক বেশি ভদ্র। দেখিসনি কেমন
চুপচাপ সব সয়ে যাচ্ছে।
– এত খারাপ লাগলে বিয়ে করে নে ওকে।
– পিহু! আমি কি সেটা বলেছি নাকি? আমি শুধুই কলরবকে
চাই। কূজনের জন্য খারাপ লাগছে এতটুকুই..
– ঠিক আছে আপুণি রাগিস না। সরি! সরি!
– এখন সামনে থেকে যা তুই। তোকে দেখলেই
মেজাজ খারাপ হতে থাকবে। যা বলেছি তা কর।
পিহু চুপচাপ রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।
..
কূজন ছাদের রেলিং ঘেঁষে বসে আছে।
ডায়েরীর প্রত্যেকটা পাতা বসে বসে ছিঁড়ছে
সে। একটা একটা করে পেইজ টেনে খুলে
ফেলছে সে। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসছে। চারিদিকের
আকাশটাও লালচে আভায় ছেয়ে আছে। কূজন মুখ
তুলে আকাশের দিকে তাকালো। একসময় এই
আকাশের এই লালরঙা রূপ দেখে কূজন ভাবতো এই
বুঝি কুহুর কপালের লাল টিপ। আজ মনে হচ্ছে এ
হলো ওর নিজের বুকের রক্তক্ষরণ। পিহুর হাত
থেকে ডায়েরী পেয়েছে বহু আগেই।
এতোটা সময় নিয়ে সে কুহুর লিখা চিঠিটা পড়েছে
সে। একবার নয় বহুবার। চিঠিটা পড়তে পড়তেই
বিকেলের মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে এখন লাল আকাশপটে
তাকিয়ে আছে কূজন। কূজন এখনো ডায়েরীর সব
পাতা ছিঁড়েনি। যেগুলো ছিঁড়েছে সেগুলো ভাঁজ
করে পকেটে পুরে নিয়েছে সে। তারপর
ডায়েরীটা হাতে নিয়ে কুহু চিঠিটা রেখেছে
শার্টের বুক পকেটে। দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে
নেমে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো সে। গলির রাস্তা
ধরে এলোপাথাড়ি পা ফেলতে লাগলো সে। কুহু
তাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে কলরবকে।
সে তাহলে কিসের স্যাক্রিফাইজ করছে? সে
তো ওদের দুজনের মাঝে এসে যাচ্ছিল। কূজন
তো ভেবেছে কুহু কাউকেই ভালোবাসে না, শুধু
পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। নাহ্ কুহু কুহুর
নিজের ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছে। হাঁটতে
হাঁটতে গলির শেষ প্রান্তের টং দোকানটার সামনে
এসে দাঁড়ালো সে। কাঁপা স্বরে দোকানদারকে
বলল,
– একটা ডলফিন দিয়াশলাই দিন তো।
দিয়াশলাই এর প্যাকেট নিয়ে আবারো হাঁটতে
লাগলো উদ্দেশ্যহীনভাবে। গলি পেরিয়ে
মেইনরাস্তায় চলে এল কূজন। কিছুক্ষণ থমকে
দাঁড়িয়ে রইলো আর রাস্তার গাড়িগুলো গুনতে
লাগলো। সময়টা বেশ গড়িয়েছে কিন্তু কূজনের
সেদিকে খেয়াল নেই। সে ফুটপাতের উপর
দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে
আছে। ফুটপাতে মানুষ চলাচল করছে। মাঝে মাঝে
ধাক্কা লাগছে কূজনের সাথে। কেউ কেউ বিরক্ত
হয়ে কূজনের দিকে তাকাচ্ছে কেউবা বলেও
ফেলছে,
– এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? এটা কি দাঁড়িয়ে
থাকার রাস্তা?
কূজনের সে কথাগুলো কানে যাচ্ছে না। সে
চুপচাপ নিজেতে মগ্ন। হঠাৎ মোবাইল
বেজে উঠায় কূজনের হুঁশ ফিরে। পকেট থেকে
মোবাইল বের করতেই দেখে স্ক্রিনে
কলরবের নাম। সাথে সাথে মোবাইলটা ছুঁড়ে
ফেলে দেয় রাস্তায়। চোখের নিমিষেই একটা
ট্রাক চলে যায় মোবাইলটার উপর দিয়ে।
দুমড়েমুচড়ে পড়ে থাকে ভাঙা মোবাইলটা। গুড়ো
হয়ে গেছে প্রায়। মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে
কূজন হালকা হেসে বললো,
– কূজন তোমার অবস্হাও এমন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কূজন গলির রাস্তায় পা বাড়ালো।
গলির মোড়ে ঢুকতেই একটা পরিত্যক্ত বাড়ির দেখা
পাওয়া যায়। ভিত গড়ার পর আর করেননি বাড়ির মালিক।
বোধহয় কোনো সমস্যা আছে। কূজন বাড়িটার
দিকে গেল। নিতান্তই কাঁচা বাড়ি। একপাশে রড সিমেন্ট
রাখা,অল্প কিছু,।পাহাড়াদারও নেই তাহলে চুরি হয়নি
কেনো? এগুলো ভাবতে লাগলো কূজন। হঠাৎ তার
মনে হল সে আর তার বাবা মিলেও তো কুহুর
ভালোবাসা আর স্বপ্ন চুরি করে নিচ্ছিল। হাতের
ডায়েরিটা ছুঁড়ে ফেললো পরিত্যক্ত বাড়ির মাঝ
বরাবর। তারপর পকেট থেকে ডায়েরীর ছিঁড়া
কাগজগুলো বের করে দিয়াশলাই দিয়ে
সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল কূজন। কাগজ
গুলো চোখের সামনে ধরে তীক্ষ্ণ গলায়
বলল,
– কুহু! আমি তো অনিন্দ্য সুন্দরী কাউকে
চাইনি,চেয়েছি তোমাকে। আমার কাছে অনিন্দ্য
সুন্দরীর সংজ্ঞা তুমি। তোমার চোখের জলকে
ভালোবেসেছিলাম তাই আজ আমার বুকে কান্নার
জোয়ার আসে। ভালো থেকো কুহু! ভালো
থেকো।
ঝড়ের মতো আগুনসহ কাগজগুলো ছুঁড়ে
ফেললো ডায়েরীর উপর। বুক পকেটে থাকা
কুহুর চিঠিটা আবার পড়লো কূজন। তারপর ছুঁড়ে
ফেলে দিতে নিয়েও ফেললো না। ভাঁজ করে
সযত্নে বুকপকেটে রেখে দিল সে। বিড়বিড়
করে বলল,
– “তোমার সুখটুকু দেখেই যাব।”

কলরব একের পর এক কল করেই যাচ্ছে
কূজনকে। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে।
কেনো বন্ধ করে রেখেছে কলরব কিছুতেই
বুঝতে পারছে না। এদিকে রাতের এগারোটা বাজতে
চললো। কূজন তো তেমন কোথাও যায় না। যখনই
ঘুরতে যায় দুইভাই মিলে একসাথে যায়।
তারউপর ফোনেও পাচ্ছে না। মাকে কিছু বলাও
যাবে না, কেঁদে কেটে বাসা অস্হির বানিয়ে
ফেলবে। কলরব নিরুপায় হয়ে গেল ইরিনের
কাছে। ইরিনও বলল সে জানে না। ইরিনকে কলরব
বলে দিয়েছে যেন “কূজন কোথায় কেউ
জানতে চাইলে বলে দেয় কি কাজ যেন আছে
বলেছে আসতে দেরি হবে।” কলরব আবারো
ট্রাই করেই চলেছে। আশা করছে একবার না একবার
লাইনে পাবে কূজনকে। কিন্তু সব আশায় গুঁড়ে বালি
তারপরো কলরব একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে।
এর মাঝেই কলরবের মোবাইলে কল এল। কলরব
রিসিভ করে বলল,
– হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম!
কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করে যখন উত্তর
পেল না আবারো জিজ্ঞাসা করলো,
– কে বলছেন?
কিছুক্ষণ আবারো অপেক্ষা করলো জবাবের
আশায়। ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়া
শব্দ না পেয়ে কলরব হালকা গলায় বলল,
– ফুলটুশী! আপনার সাথে পরে কথা বলছি এখন
একটুখানি ব্যস্ত আছি।
সাথে সাথে ওপাশ থেকে ফোন রেখে
দেওয়ার শব্দ হল। কলরব মোবাইল পকেটে
রেখে শার্টের উপর একটা পাতলা সুয়েটার
পড়লো। তারপর বেড়িয়ে পড়লো কূজনকে
খোঁজার উদ্দেশ্য।
..
কুহুর রাগে কান্না এসে যাচ্ছে। চোখগুলো টলমল
করছে, যেন পলক পড়লেই চোখ থেকে পানি
টুপ করে পড়ে যাবে। সামনে পিহু বসে আছে তাই
কুহু কোনোভাবেই কাঁদতে চাইছে না। কিন্তু
চোখের কোণায় অলরেডি পানি চিকচিক করতে
লাগলো। কোনোরকমে পিহুকে বলল,
– পিহু যা তো এখন পড়তে বস। আর এর আগে
আম্মুকে বল আমার জন্য একটু চা করে দিতে।
– এত রাতে চা খাবি?? কেনো রে তোর কলরব কি
রাত জেগে কথা বলবে বলেছে?
– যা বলেছি তা কর।
– ঠিক আছে ফুলটুশী মেডাম।
কুহু সাথে সাথে বেডসাইড টেবিলে থাকা টেবিলঘড়ি
হাত দিয়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
– একবার বলিনি আমাকে এসব ডাকবি না?
পিহু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
– কি হল কথার জবাব দিচ্ছিস না কেনো?
– হুম না করেছিস।
– তাহলে বারবার না করা স্বত্তেও কেনো একি কাজ
করিস?
– আর করবো না।
– এখন সামনে থেকে সর আমার।
পিহুও মেজাজ দেখিয়ে বলল,
– তুই শুধু শুধু আমার সাথে রাগছিস কেনো?
– পিহু মার খেতে না চাইলে সামনে থেকে ফুট।
পিহু আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ উঠে চলে গেল।
কুহু পিহুকে ডেকে বলল,
– লাইটটা অফ করে যা, তুই অন্যরুমে পড়।
পিহু লাইট অফ করতেই কুহু গুটিসুটি মেরে বিছানায়
শুয়ে পড়লো, কেঁদে বালিশ ভিজাতে লাগলো।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here