একটুখানি পর্ব : ৪৫

0
550

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী
পর্বঃ৪৫
কূজন এর সাধারণত রাগ হয় না,খুব কম। আজ রাগে সব
ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। চোখ ঝাঁঝাঁ
করতে লাগলো। হাতগুলো নিশপিশ করছে, ইচ্ছে
হচ্ছে সব ভেঙ্গে গুঁড়ো করে ফেলতে।
কলরবকে কুহুর কথা ভাবতে দেখে কূজনের
প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল। কূজনের মন ভালো করার
টনিক হলো ইরিন। তাই সে গিয়েছিল ইরিনের রুমে।
ইরিনকে পড়ার টেবিলে দেখে সে ফিরে চলে
আসছিল। ইরিন কূজনকে দেখে ডেকে ভিতরে
যেতে বললো। কূজনও ভিতরে যেয়ে ইরিনের
সাথে বেশ গল্প করছিল। মনটা হালকা হালকা লাগছিল।
ইরিন কি মনে করে যেন কূজনকে বসতে বলে
কলরবকে ডেকে নিয়ে এলো। তারপর জানতে
চাইলো কলরব আর কুহুর মাঝে কি কথা হয়েছে।
কলরব প্রথমে খুব ভাব নিয়ে বলেছিল,
” ভাইয়া ভাবীর কথা শুনতে নেই বাবুরা!”
তারপর নিজে নিজেই হেসেছে সে, সেই
গগণবিহারী হাসি। ইরিনও যোগ দিয়েছিল কলরবের
সাথে। শুধু কূজনেরই হাসি আসছে না। প্লাস্টিক হাসিটাও
খুঁজে পাচ্ছে না সে। চুপচাপ কলরবের দিকে
তাকিয়ে কলরবের হাসি দেখছে। কলরব হাসি থামিয়ে
কুহুর সাথে কি কি কথা হলো সব বললো। আয়নায়
ভালোবাসার কথা লিখেছে সেটাও বললো। ছবি
নিয়ে আসা আর আয়নায় কুহুর প্রতিফলনে হাত রাখার
কথাটা চেপে গেল সে। ইরিন খুশিতে গদগদ হয়ে
কলরবের কথা শুনছে। আর কূজনের রাগ হচ্ছে।
কুহুকে নিয়ে কলরব এত কথা বলছে তাই কূজনের
সহ্য হচ্ছে না। একদম অসহ্য লাগছে। ইচ্ছে
করছে সব ছেড়ে কুহুকে নিয়ে বহুদূর চলে
যেতে। যেখানে কুহু শুধুই ওর। একথা ভাবতেই
কূজন ভিতরে ভিতরে ঘেমে গেল। কি ভাবছে
এসব? দুইদিন পর কুহুর বিয়ে হয়ে যাবে। আর সে তার
ভাইয়ের বাগদত্তাকে নিয়ে এসব কি চিন্তা করছে?
কূজন কল দেবার ছুঁতোয় ওদের মাঝ থেকে
উঠে চলে এলো।
কূজন চলে যেতেই কলরব ইরিনকে বলল,
– ইরিন দেখি তোর চুলের খোঁপা করে দিই।
ইরিন মুখ হা করে ফ্যালফ্যাল করে কলরবের দিকে
তাকিয়ে রইলো।
কলরব ইরিনের চাহনী দেখে একটুখানি ইতঃস্ত করে
বলল,
– আসলে আমি শিখতে চাইছি খোঁপা কীভাবে
করে..
ইরিন হুহু করে হাসতে হাসতে ভাইয়ের উপর গড়িয়ে
পড়লো। কোমরে হাত রেখে অট্টহাসিতে
ফেঁটে পড়ছে ইরিন। কলরব বিরক্ত হয়ে ইরিনের
দিকে তাকিয়ে রইলো। ইরিনের হাসি থামার কোনো
নাম গন্ধ নেই। কলরব বিরক্ত হয়ে ইরিনের বেণী
ধরে টানলো। ইরিন বলল,
– ভাইয়া এখন কি বেণী ধরে টেনেও তুমি প্র্যাকটিস
করছো নাকি? আর যাই করো ভাবীর চুল টেনো না।
বাপের বাড়ি একটুখানি বেশি কাছে তাই নারী নির্যাতন
একদমই চলবে না।
তোমার জন্য আমরা গোষ্ঠী শুদ্ধ জেলে
যেতে পারব না।
কলরব অসহায় ভঙ্গীতে ইরিনের দিকে তাকিয়ে
রইলো। ইরিন কলরবের এই অবস্হা দেখে হাসি
থামিয়ে বলল,
– চলো তোমাকে খোঁপা বাঁধা শিখিয়ে দিই তবে
আমি কিন্তু আমার ভাবীর মতন রাগী টিচার না, আমি হলাম
আমার হবু ভাবীর বরের মতন ঝাক্কাস টিচার। একদম বকা
দিব না তোমায়।
কলরব হাসতে হাসতে বোনকে জড়িয়ে ধরে
কপালে চুমু দিল। ইরিনও ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– তুমি নিশ্চই ভাবীর খোঁপা দেখেছো,তাইনা?
– হুম! তোর হবু ভাবী তার বরকে দেখে ভয়
পেয়ে গিয়েছিল। কবে যে এই ফাঁকে মহারানীর
খোঁপা দেখেছি তা উনি জানেনই না।
ইরিন ভাইয়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর
বললো,
– ভাইয়া তুমি ভাবীকে অনেক ভালোবাসো তাইনা?
কলরব ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,
– উঁহু একটুখানি!
..
কূজন খুব করে চাইছে নিজেকে কন্ট্রোল
করতে। কিন্তু স্নায়ুকোষগুলো বোধহয় আর
কূজনের নেই। কুহু বোধহয় দেবী চৌধুরাণী
হয়ে সেগুলো ডাকাতি করে নিজের আয়ত্তাধীন
করে নিয়েছে। কূজন গিটার নিয়ে বসে টুংটাং করে
যাচ্ছে। চোখ দুটোও কেমন ঝাপসা হয়ে
আসছে। কুহুকে আজ নিজ চোখে সে
দেখেছে কলরবের জন্য হাত ভর্তি চুড়ি পরতে।
কলরবের জন্যই তো সেজে বসেছিল সে। শাড়ি
পরে নিজেকে কলরবের আকাশ বানিয়ে নীল
পরী হয়ে উড়ছিল কুহু। আর এক এক করে
কূজনের আকাশের তারাগুলো নিভে যাচ্ছিল। কূজন
আনমনা হয়ে গান গাইতে লাগলো।
” ইয়ে জিসমে হ্যায় তো কিয়া
রুহুকা লিবাস হ্যায়
ইয়ে দারদ হ্যায় তো কিয়া
ইয়ে ইশকেকি তালাশ হ্যায়
ফানা কিয়া মুঝে
ইয়ে চাহনেকি আস নে
তারাহ তারাহ শিকাসত হি হুয়া
রেজা হ্যায় কিয়া তেরি
দিলো যাহা তাবাহ কিয়া
জাজাবি কিয়া তেরি
বাফা কো বেবাফা কিয়া
হুয়ারে জিন্দেগী সে ইয়ু মুঝে জুদা কিয়া…”
..
কুহুর মা একদম কুহুকে এখন কলরবদের বাসায় আসতে
দিতে চায়নি। দুদিন পর বিয়ে তাই এসময় কলরবদের
বাসায় না যাওয়াই ভালো। কিন্তু কলরবের মা মানলেন না।
তিনি এক কথায় অটল। যেমন চলছিল সব ঠিক তেমনি
চলবে। এসব ছাইপাশ মানেন না উনি। কবরী
বলেছিলেন ইরিন যেন বাসায় এসে পড়ে। সাহরা
বলেছেন,
– “আরে নাহ্ কুহু আমাদের বাসায় আসবে যাবে,
আমাদের সাথে মিশবে। সমস্যা কোথায়?”
কবরীকে সাহরার কথা মানতেই হলো। সাহরা একদম
রাজি করিয়ে ছাড়লেন। তাই কুহু ইরিনকে পড়াতে এল।
ইরিনকে ন্যারেশন করতে দিয়ে কুহু বসে বসে
একটা বই পড়ছে। ইরিনের রুমে বেশ ভালো
গল্পের বইয়ের কালেকশন। কুহু বই পড়তে
পড়তেই হঠাৎ চোখ গেল আয়নার দিকে। ইরিনের
টেবিলের সাথেই ড্রেসিংটেবিল রাখা। কলরব দরজার
কাছে দাঁড়িয়ে আয়নায় কুহুকে দেখছে। কলরবকে
এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহু একটু
নড়েচড়ে বসলো। কুহুর বেশ অড লাগছে।
এভাবে মানুষ তাকিয়ে থাকে নাকি? আর ইরিন
দেখলেই বা কি ভাববে? কলরব কুহুর এ অবস্হা
দেখে মজা পেল। এর আগেও বহুবার ইচ্ছে
হয়েছিল কুহুকে এভাবে একদৃষ্টিতে দেখার। কিন্তু
কুহুর কাছে খারাপ লাগবে তাই সে দেখেনি। কিন্তু
এখন আর কলরবকে পায় কে? কুহু তো তারই।
কলরব হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালো কুহু কল দেয় না
কেনো? কুহু দেখেও না দেখার ভাণ করলো।
কলরব বারকয়েক আরো দেখালো কিন্তু কুহু
কলরবকে বুঝতে দিচ্ছে না। কলরব হতাশ হয়ে
দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর চলে গেল সে।
কলরব চলে যেতেই কুহু মনে মনে বলল,
– ” এই আজবটা গেল কোথায়?”
অনেকক্ষণ কলরবকে না দেখতে পেয়ে কুহুর
মন উশখুশ করছে। ইরিনের কাজ শেষ হতেই কুহু
ইরিনের খাতা দেখতে লাগলো। কি মনে করে
যেন চোখ বারবার খাতা থেকে সরে আয়নায় চলে
যাচ্ছে। কিছুতেই মন ধরে রাখতে পারছে না সে।
হঠাৎ দেখলো কলরব দরজার ওপাশ থেকে সরে
আয়না বরাবর দাঁড়ালো। কলরবকে দেখে কুহুর
ঠোঁটে অজান্তেই হাসি ফুটলো। কলরব এটা
দেখে কুহুকে চোখ মারলো। সাথে সাথে কুহু হা
হয়ে গেল। লজ্জায় আয়না থেকে চোখ সরিয়ে
খাতা দেখতে লাগলো। খাতা দেখা শেষে ইরিনের
দিকে খাতা বাড়িয়ে দিতেই ইরিনও কুহুকে চোখ
মারলো। এবার কুহু সত্যি বেশ লজ্জা পেয়েছে।
ইরিন এভাবে দেখে ফেললো ভেবেই মরে
যেতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর। সাথে কলরবকেও গলা
টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই পাগল
জায়গাও বুঝে না। কোথায় কি করতে হয়, আর
কোথায় কি না করতে হয় কিছুই মাথায় নেই। কুহু
কোনোরকমে ইরিনকে ছুটি দিয়ে উঠে
পড়লো। ইরিনের রুম থেকে বের হতেই কলরব
কুহুর সামনাসামনি দাঁড়ালো। কুহু সাইড দিয়ে চলে
যেতে নিতেই কলরব আবারো পথ আটকায়। কুহু
ডানে গেলে সেও ডানে যায়, আর বামে গেলে
সেও বামে যায়। কুহুর অবস্হা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ডাইনিং এ কেউ এভাবে পথ আটকাতে পারে সে
ভাবতেই পারছে না। ইরিন তো দেখে ফেলবে
কুহু শিউর। কিন্তু বাসায় আর কেউ আছে না নেই
জানেও না। কেউ দেখলে কি ভাববে। কুহু নিরুপায়
হয়ে কলরবের দিকে তাকালো। এতক্ষণ সে
নীচের দিকে তাকিয়েছিল। কলরব কুহুকে আস্তে
করে বললো,
– ফুলটুশী! আজ যদি ফোনে কথা না বলেন তাহলে
আবারো রাস্তা আটকাবো। মিসডকলের অপেক্ষায়
রইলাম।
তারপর নিজেই কুহুর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল।
কলরব সরে দাঁড়াতেই কুহু হন্তদন্ত হয়ে বাসা
থেকে বেরিয়ে পড়লো। কূজন তখন ডাইনিংরুমে
এসেছিল পানির জন্য। ওদেরকে এভাবে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে ওর সব শেষ করে দিতে ইচ্ছে
হচ্ছিল। সব বলতে একদম সব। কিসের কি পরিবার, আর
কিসের কি। ওর শুধু এখন কুহুকে দরকার, আর কিছুই না।
পৃথিবী ভেসে যাক, জনশূন্য হয়ে পড়ুক তাতে
কূজনের একটুও ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে কূজন শুধু
চাচ্ছে কুহুর হাত ধরে জীবন কাটিয়ে দিতে। কূজন
নিজেই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে সে এগুলো একের
পর এক কি ভাবছে? পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।
যতোটা সহজ ভেবেছিল সে তার চেয়ে সবকিছু
আরো বেশি জটিল মনে হচ্ছে। নাহ্ এখানে থাকা
যাবে না। কুহু কলরবকে একসাথে দেখলে তার সব
উলটপালট হয়ে যায়। এমন হতে থাকলে মন কিছুতেই
কুহুকে ভুলতে পারবে না। কূজন তাই সিদ্ধান্ত নিল সে
বাসায় ব্যাক করবে। ফেণী আসাটাই কূজনের
জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, মারাত্মক রকমের
ভুল!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here