একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৩
কুহুকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে পিহু
সবগুলো চুড়ি এনে কুহুর সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
রাখলো। তারপর কুহুকে বলল,
– কিরে মন খারাপ? তুই যে এতো প্রেম জানিস
আমি ভাবতেও পারিনি। এই পঁচিশ দিনে তুই
কলরব ভাইয়ের সাথে যে হারে প্রেম করেছিস
মানুষ পাঁচ বছরেও বোধহয় এতো করে না।
কুহু পিহুর কথা শুনে ম্লান হাসলো। পিহু কুহুর
গালে আস্তে করে চড় কষিয়ে বলল,
– এই বল তো আমি বড় না তুই বড়?
কুহু ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– আপ্পি তুমি বড়।
পিহু কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– আমার ছোট বোনটা বলো তো আপ্পি
তোমার থেকে কত বছরের বড়?
কুহু নাক লাগিয়ে বলল,
– সাত বছরের কিন্তু তাহলে আপি তোমার
আগে আমার বিয়ে কেনো? তোমাকে কেউ
বিয়ে করে না কেনো?
এটুকু বলার পরই দুইবোন একসাথে হেসে
ফেললো। কুহুর যখনই মন খারাপ হয় পিহু এমন
করে। পিহুর ধারণা চুপচাপ বসে থাকা পিহুর
কাজ। কুহু তো সবসময় কথা বলে যাবে।মাঝে
মাঝে রেগে যাবে আবার রাগটাও এক
নিমিষে ভুলে যাবে। পিহু মনে করতো কুহু
পৃথিবীতে একটা কাজেই এসেছে, শুধু পিহুকে
জ্বালাতন করার জন্য। এই কয়দিনে পিহু একটা
জিনিশ খেয়াল করে দেখেছে কুহুকে জুড়েই
পিহুর সব কথা বলা। কুহুর সাথে পিহু এক ঘণ্টায়
যে কথা বলে পিহু তা সারাদিনেও কারো
সাথে বলতে পারে না। পিহু পড়তে বসলে আগে
যখন কুহু কথা বলতো পিহু বিরক্ত হতো। কিন্তু এই
কয়দিনে কুহু একবারো পিহুকে বিরক্ত করেনি।
আর সেটাই পিহু মিস করছে। সারাদিন
কলরবকে নিয়েই পড়েছিল কুহু। রাতে তো
পিহু,কুহু দুজনই পড়া নিয়ে থাকে।সকালে তো
স্কুলে চলে যায় নতুন চাকুরী। দুপুরে বাসায়
এসেও কলরবের সাথে কথায় লেগে যায়। ঐ
সময়ে কলরবের লাঞ্চ টাইম তাই কুহু কথা বলায়
ব্যস্ত থাকে। তিনটা, সাড়ে তিনটায় ইরিনকে
পড়াতে যায়। এসে আবার একা একা ছাদে
দাঁড়িয়ে থাকে তাও বাস্কেটবল হাতে।
যেদিনগুলোতে কলরব বিকেলে ছাদে থাকে
কুহু তখন আবার বাস্কেটবল নিয়ে যায় না। কুহুর
ধারণা কলরব জানে না কলরবের বাস্কেটবলটা
কুহুর কাছে কিন্তু পিহুর ধারণা কলরব অবশ্যই
বুঝতে পেরেছে। কুহু সেটা কোনোভাবেই
মানতে চায় না। কুহুর কথা হলো কলরব জানলে
অবশ্যই তাকে জিজ্ঞাসা করতো। পিহু আর
কথা বাড়ায় না। কুহুর হাতে বাস্কেটবল দেখে
পিহুর সেই হাসি পায়। কুহু নেটে সার্চ দিয়ে
বাস্কেটবল শিখার একটুখানি ট্রাই করেছিল
কিন্তু কিছুই পারেনি। পিহুকে হাসতে দেখলে
কুহু ভাব দেখিয়ে বলে,
– এতো ঢং মারিস কেনো? আমাকে পারতে
হবে না। কলরব বলেছে আমাকে শিখাবে।
বিয়ের পর আমি মাস্ট বি বাস্কেটবল খেলা
শিখবো। আই জাস্ট লাভ বাস্কেটবল। আর সে
এও বলেছে..
পিহু কুহুকে শুধরে দিয়ে বলে,
– ইউ জাস্ট লাভ কলরব! আর কি বলেছে তোর
কলরব?
কুহু তখন লাজুকভাবে হেসে বলে,
– কলরব বলেছে বাস্কেটবল টিম গঠন করবে।
পিহু হাত নেড়ে বলে,
– আমি বাবা তোর টিমে নেই। আমি খেললে
কলরব ভাইয়ের টিমে খেলবো। তোর মতন
ভেবলির টিমে খেললে হেরে যাওয়ার তকমা
নিয়ে ঘুরতে হবে। তুই বরং তোর বকবকুনে
ইরিনকে নিয়ে টিম গঠন করিস। আমি কলরব
ভাইয়ের টিমে থাকবো। অবশ্য বাস্কেটবল তো
আমিও খেলতে জানি না।
কুহু মাথায় হাত দিয়ে পিহুর সব কথা শোনার পর
বলে,
– তোর শেষ হয়েছে?
পিহু মাথা উপর নীচ করে বলে,
– হয়েছে এবার আপনার পালা।
– কলরব বলেছে আমাদের বাস্কেটবল টিম গঠন
করবে।
– তোদের মানে?
– কলরব,আমি,কুহুরব আর কিচির – মিচির।
পাঁচজনের বাস্কেটবল টিম..
পিহু কুহুর কথা শেষ হতেই হাসতে হাসতে বলল,
– কলরব ভাই তোর প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে
গেছে। এই ছেলে সাঁতার জানে তো? নয়তো
ডুবে মরবে তো।
কুহু পিহুর কথায় হাসলো। কুহুর হাসি দেখে পিহু
বলল,
– কিরে মন ভালো হয়েছে?
– হুম।
– তাহলে চল চুড়িগুলো তোকে পরিয়ে দেই।
– তুই পরবি?
– নাহ্ তুই পরর।
– আরে ভাব ধরিস না। আমি আগে সবগুলো ট্রাই
করবো এক এক করে তারপরই তোকে দিব।
– ঢং।
– ভাগ্যিস হাতের মাপ এক।
আর তুইও তো কলরবের মৌটুশী!
– হুম কলরব ভাইতো দুদিন আমার জন্য ফ্রেঞ্চ
ফ্রাই পাঠালো।
– তুই যে রাক্ষসী তোর এটিএম কার্ড বুঝতে
পেরেছে।
– যাক ভাইয়া ঢাকায় যাওয়ায় তুই যে হারে
দুঃখ পেলি একটু হলেও কমলো। কি বলিস?
– হুম কলরব ফুলটুশীর জন্য মৌটুশীকে রেখে
গেছে তাহলে।
– ভাইয়া আসলে কল দিয়েছিল। আমাকে বলল
নিশ্চয় তোর মন খারাপ হবে তাই চুড়ির হাট
নিয়ে বসতে।
– সত্যি পাগল একটা।
– আসলেই।
– কিন্তু আমি একটা কথা ভাবছিলাম পিহুন।
– কি?
– কূজন এখনো এখানে কেনো? ওর নিশ্চয় এসব
চোখে পড়ে। কূজনেরও তো কষ্ট হয়।
পিহু বিরক্ত হয়ে বলল,
– একদম ভালো মানুষী দেখাবি না। কূজনকে
কি তুই কষ্ট দিচ্ছিস নাকি? এমন তো না যে
তুই উনার সাথে প্রেম করে উনার ভাইকে বিয়ে
করে ইচ্ছে করে উনাকে ছ্যাঁকাকুমার
বানিয়েছিস।
– তারপরো পিহু..
– চুপ থাক! আমার তো মনে হয় এই ছেলে
ভেজাল লাগাতে বসে আছে। নয়তো নিজের
পছন্দের মেয়েকে অন্যের সাথে দেখতে
কারোরই মন চায় না। তাহলে কূজন এখানে পড়ে
আছে কেনো? ঘাপলা আছে।
– ধুর কিসব বলিস তুই? কূজন খুবই ভালো একটা
মানুষ।
– তোর কাছে ভালো না কে বল তো?
– হয়তো বিয়ে এটেন্ড করার পর যাবে।
– এটাই মেইন সমস্যা গাধী। সে তো বিলেত
থাকে না যে এটেন্ড করে পরে যাবে। বিয়ের
আগ পর্যন্ত থাকছে দেখিস বড় ধরনের ঝামেলা
লাগবে।
– এই চুপ কর। আল্লাহ না করুন।
– না করলেই ভালো।
– দেখ কূজন মোটেও এমন না।
– তোকে বুঝানো অসম্ভব আপুণি। বাদ দে এই
কথা। চল বরং চুরিগুলে ট্রাই করি। কলরব
ভাইয়ের চয়েজ অসাধারণ। তবে বুঝে পাই না
উনি তোকে কীভাবে চুজ করলো? সিরিয়াসলি
একটা গাধীকে…
– ফাজিল তোর একদিন কি আমার একদিন।
আমারো একদিন দিন আসবে বলে রাখলাম।
তখন আমিও মজা নিব।
– নিতে পারলি নিস।
– দেখা যাবে।
…
ইরিনের পরীক্ষা শেষ তাই সে এখন বিন্দাস
হয়ে ঘুরছে। সারাদিন কূজনের সাথে কথায়
মেতে থাকে। কূজন চুপচাপ বসে থাকে। অর্ধেক
শোনে অর্ধেক শোনে না। শুধু একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকে আর হু হা করে। ইরিনের কথার
যেন ইতি ঘটে না। একথা ওকথা বলেই চলে।
ইরিন থাকলে তাও একটুখানি হাল্কা থাকে
কূজন। ইরিন টিভি দেখতে বা বান্ধবীদের
সাথে গেলে কূজনের আরো বেশি খারাপ
লাগে। কেমন যেন মনে হয় সব খালি খালি।
কুহুর কথা আরে বেশি মনে পড়ে তখন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার
থাকে না কূজনের। এখান থেকে চলে
যাওয়াটাই ভালো ছিল। কিন্তু কূজন যায়নি।
কূজনের ধারণা সে এখান থেকে চলে গেলেই
বাবা কিছু একটা করবে। কুহু সেইফ তা কূজন
জানে। কূজনের বাবা আর যাই করুক কুহুকে কিছু
করবে না। কিন্তু কলরবকে হাতে পেলে
ছাড়বেন না তিনি। এই মুহুর্তে কলরব আবার
ঢাকা গেল। কূজনের তাই এখন টেনশন আরো
বেড়ে গেছে। একবার ভাবলো সেও যেতে
পারতো ঢাকা। কেনো গেল না কলরবের
সাথে? কূজন কোনোভাবেই চায়না কলরবের
কোনো ক্ষতি হোক। কিন্তু তার বাবার প্রতি
তার বিশ্বাস নেই। বাবা এমন চুপচাপ বসে
আছে কেনো? কূজনকে কিছুই বোঝাচ্ছে না
এতেই কূজনের ভয়টা বেড়েছে। এভাবে ঝিম
ধরে বসে থাকার মানে কি? কিছু বড় ধরনের
ঘটনা ঘটাবে কি? কূজন আকাশ পাতাল
ভাবছিল তখনি ইরিন এসে কূজনের পাশে বসে
বলল,
– ভাইয়া কি এতো ভাবো তুমি?
– হুম কিছু বলেছো সোনার হরিণ?
– বললাম কি এতো ভাবো?
কূজন হেসে বলল,
– কিছু না সোনার হরিণ।-কলরব ভাই ঠিকঠাক
ভাবে পৌঁছেছে?
– হুম মাত্র কথা হলো। তবে ভাইয়া অনেক
টায়ার্ড। অনেক আগেই পৌঁছেছে তারপর
সোজা অফিস করে এখন চাচার বাসায় যাচ্ছে।
– ওহ জার্নি করেছে তাই টায়ার্ড হওয়াটাই
স্বাভাবিক।
ইরিন খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল,
– কিন্তু ভাবীর সাথে রাত জেগে কথা বলতে
ভাইয়া আবার জীবনেও টায়ার্ড হয় না। তুমি
তো ঘুমিয়ে থাকো। ভাইয়া গেস্টরুমে বসে
বসে অর্ধেক রাত পর্যন্ত কথা বলতে থাকে।
তুমি ভাইয়ার রুমে থাকো তাই হয়তো নিজের
রুমে বসে কথা বলতে আনইজি ফিল করে।
জানো একদিন কি হয়েছে? আমি পড়ছিলাম
রাত জেগে। উচ্চতর গণিত পরীক্ষা ছিল আমার।
পানির পিপাসায় পানি খেতে রুম থেকে
বেরিয়েছিলাম। দেখি ভাইয়া ফোনে কথা
বলছে আর কফি বানাচ্ছে। আমার যা মজা
লেগেছিল বলার বাইরে। এক্সাম না থাকলে
মাস্ট বি দাঁড়িয়ে শুনতাম। বাট আফসোস!
ইরিনের কথা শোনে কূজনের বুক জোড়ে
দীর্ঘশ্বাস খেলা করতে লাগলো। কিন্তু বের
করতে পারলো না। ইরিন ভাবে কূজন ঘুমায়।
কিন্তু কূজনও কলরবের মতোই রাত জাগে। ঘুম
মোটেও আসে না তার। বরং চোখ বন্ধ করলে
কুহুর চেহারা ভেসে উঠে। বউ সাজা কুহুকে
কতোবার যে কূজন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে
পেয়েছে তা অগণিত। শুধু শুধু চোখগুলো এতো
বিট্রে করে কেনো ওর সাথে? কুহু তো ওর বউ
হবে না তাহলে কেনো সে কুহুকে দেখে?
কেনো সে বারবার কলরবের কুহুকে দেখে?
কলরবও রাত জাগে কিন্তু কলরবের সাথে রাত
জাগে কুহু। আর কূজনের সঙ্গে কেউ রাত জাগে
না। কূজন যেন নিজেই রাতেদের সঙ্গে জেগে
থাকে।
চলবে…