একটুখানি পর্ব : ৫৪

0
558

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৪
কুহুর লাস্ট পিরিয়ডে কোনো ক্লাস ছিল না।
তাই টিচার্স রুমে বসে সমরেশ মজুমদারের
একটা বই পড়ছে। মন দিয়ে পড়ছে না কেমন
যেন ভাসা ভাসা পড়ে যাচ্ছে। চোখ বুলানো
যাকে বলে আরকি। বই পড়তে পড়তে অস্হির
দৃষ্টিতে বারবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে সময় দেখছে কুহু। সময় পৌনে
বারোটা। কলরব ফোন দিবে দুইটার দিকে। তাই
কুহু আবার পড়ায় মনোযোগ দিল। উত্তরাধিকার
পড়ছে সে। বইটা যখন প্রায় শেষের দিকে
তখনই স্কুল ছুটির ঘণ্টা পড়লো। কুহু বইটা বন্ধ
করে ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল। তারপর পা
বাড়ালো স্কুল গেইটের দিকে। স্কুল ছুটি
হয়েছে তাই বাচ্চাদের হুরোহুরি শুরু হয়েছে।
অভিভাবকরাও স্কুল গেইট দিয়ে ভিতরে
ঢুকছে। সবমিলিয়ে দারুণ রকমের জটলা
বেঁধেছে। কুহু ভিড় ঢেলেই গেইট পর্যন্ত
গিয়েছে। এর মাঝেই পিছন থেকে ডাক শুনে
কুহু পিছনে তাকালো। কে ডেকেছে কুহু এতো
ভিড়ের মাঝে বুঝতে পারলো না। তবে
মেয়েলি কণ্ঠের ডাক শুনেছে। কুহু চোখ ঘুরিয়ে
বারবার খুঁজছে তাকে কে ডেকেছে কিন্তু
বুঝে উঠতে পারছে না। এর মাঝেই শাখা সিঁদুর
পরিহিতা একজন মহিলা এসে কুহুর সামনে
দাঁড়িয়ে বলল,
– আরিজা মেডাম নমস্কার !
কুহু হাসি মুখে বলল,
– আপনি ডেকেছিলেন আপু?
– জ্বি মেডাম আমি ডেকেছি।
– ভালো আছেন আপনি?
– জ্বি মেডাম ভালো। আপনার সঙ্গে এমনিতে
একটুখানি পরিচিত হতে এলাম আরকি।
কুহু হেসে বলল,
– ওহ্ তা বাইরে যেয়ে কথা বলি? এখানে
অনেক ধাক্কাধাক্কি তো তাই বলছিলাম
আরকি।
– জ্বি মেডাম চলুন বরং বাইরে দাঁড়িয়েই কথা
বলি। ঐদিকটা কিছুটা নিরিবিলি।
কুহু ভিড় ঢেলে স্কুলের বাইরে যেয়ে পুকুরের
দিকটায় দাঁড়ালো। কুহু তখন খেয়াল করলো
মহিলার শাড়ির আঁচল ঘেঁষে একটা মেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। কুহুকে নিজের দিকে তাকাতে
দেখে মেয়েটা মায়ের পিছনে আড়াল হয়ে
দাঁড়ালো। কুহু বাচ্চা মেয়েটার দিক থেকে
চোখ সরিয়ে মেয়েটার মায়ের দিকে
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর হেসে
বলল,
– জ্বি আপু কি বলতে চান বলুন।
– মেডাম আমার মেয়ে দীপাবলি। আপনি ওর
ক্লাস টিচার?
– আপু দীপাবলি কি কেজিতে পড়ে? শাপলা
শাখায়?
– জ্বি মেডাম।
– তাহলে আমিই দীপাবলির ক্লাস টিচার।
কেনো আপু কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
দীপাবলির মা হেসে বলল,
– নাহ্ মেডাম তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে
আপনার ছাত্রী নিজেই সমস্যাদের ভাণ্ডার।
যাহ্ দুষ্ট বলার বাইরে। এই মেয়েকে
কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারি না। একটা
কথাও শুনে না আমার খুব জ্বালায়।
কুহু হালকা হেসে বলল,
– এই বয়সী বাচ্চারা একটু আধটু দুষ্টামি তো
করবেই।
দীপাবলির মা কুহুকে বাধা দিয়ে বলল,
– আরে মেডাম চিনেননি এখনো। ভগবান
ভাগ্যিস এই মেয়েকে ছেলে করে পাঠায়নি
নয়তো আমার মাথা খেয়ে ফেলতো।
দীপাবলির মায়ের কথা শোনে কুহু হাসতে
লাগলো। প্রচণ্ড রকমের হাসি হেসে কুহু বলল,
– আপু আপনার কথায় হাসতে হাসতে আমার
পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। আর এই যে মিস
দীপাবলি তুমি এতো দুষ্টামি করো কেনো?
দীপাবলি কুহুর কথা শুনে মায়ের পিছনে
দাঁড়িয়ে পুরোপুরি আড়াল হয়ে গেল।
দীপাবলির মা দীপাবলির হাত ধরে টেনে কুহুর
সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে বলল,
– মেডাম আপনার ছাত্রী নাকি পরপর তিনদিন
হোমওয়ার্ক করেনি তাই আপনি বকা
দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এখন সবসময়
আমাকে বলতেও হয় না নিজেই বসে আপনার
হোম ওয়ার্ক সেড়ে ফেলে। শুধু আপনার
সাবজেক্টটাই করে কিন্তু বাকিগুলো একটাও
করতে চায় না। তাই আপনি একটুখানি বকা
দিয়ে দিন তো।
কুহু আবার হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে
দীপাবলির গাল টেনে বলল,
– তুমি কি জানো মেডামের তোমার নামটা যে
অনেক পছন্দ হয়েছে?
দীপাবলি কিছু বলল না লাজুকভাবে হাসলো।
কিন্তু চোখে মুখে ঠিকই ভয় কাজ করছে ওর। কুহু
দীপাবলিকে এতো ভয় পেতে দেখে
অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো আর বলতে লাগলো,
– শুনো দীপাবলি! তোমার নামটা যেমন আমার
পছন্দের তুমি কি চাওনা তুমিও ঠিক আমার
কাছে এমনি পছন্দের হও?
দীপাবলির মা কুহুকে থামিয়ে বলল,
– আরিজা মেডাম এই মেয়েকে এতো সোহাগ
দিবেন না। পরে আপনার মাথায় চড়ে বসবে।
আগে যেমন ধমক দিয়েছিলেন এমনি দিবেন।
কুহু হাসতে হাসতে বলল,
– আরে আপু কি যে বলেন না….
কুহু হেসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কুহুর চোখ
যায় বাচ্চাদের ভীড়ের মাঝে এক সাইড হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকা কূজনের দিকে। সাথে সাথে
কুহুর ঠোঁটের হাসি বিলীন হয়ে গেল। কুহু
তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে
দীপাবলির মায়ের সাথে কথা বলায় লেগে
গেল। কুহু কোনোভাবেই চায় না কুহুর আবার
যেখানে সেখানে কূজনকে দেখার অভ্যাসটা
দেখা দিক। বেশ তো ছিল এই কয়দিন। একবারো
কূজনকে কল্পনা করেনি সে। তাহলে আবার
কেনো শুরু হলো এসব? তীব্র অস্বস্তিতে কুহু
তাড়াতাড়ি দীপাবলির মায়ের সঙ্গে কথা
বলা শেষ করলো। তারপর পা বাড়ালো
সামনের দিকে। অন্যদিন স্কুল গেইটের সামনে
থেকেই রিকশা নেয় কিন্তু আজ দ্রুত গতিতে
হাঁটা শুরু করলো। এখানে দাঁড়িয়ে রিকশার
জন্য অপেক্ষা করতে গেলে বারবার কূজনকে
দেখতে হবে। কথাটা ভাবতেই কুহু ঘামতে শুরু
করলো। যদিও গরম নেই আর শীতটাও
তেমনভাবে পড়েনি। রাত হলে হালকা চাদর
জড়ালেই চলে। খুব আরামের একটা আমেজ
পাওয়া যায়। আর দুপুরেও না গরম থাকে না
শীত থাকে। কিন্তু এই অবস্হায়ও কুহু ঘামতে
লাগলো। কুহু কলরবকে ছেড়ে আবার কূজন নিয়ে
মেতে উঠছে ভাবতেই কুহুর শরীরের সবগুলো
লোম খাঁড়া হয়ে গেল। কুহু ঝড়ের গতিতে
হেঁটে চলছে। খুব দ্রুত পা ফেলছে সে।
পালাতে চাইছে এখানে থেকে। হঠাৎ কুহু
শুনতে পেল,
– কুহু শুনছেন? আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
একটুখানি শুনবেন কি?
কুহু আরো দ্রুত পা চালাতে আরম্ভ করলো।
কোনোভাবেই সে কূজন নামক মায়াজালে
নিজেকে আটকা পড়তে দিবে না। কুহুর দ্রুত
চলা দেখে কূজনও পিছন থেকে দ্রুত পা
চালালো। সে কিছুটা দৌড়ে এসে কুহুর
পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো আর আকুতির স্বরে
বলল,
– কুহু প্লিজ একবার শুনবেন কি?
কুহু অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই দেখে কূজন
কাতর চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুহুর
এবার সত্যি মনে হচ্ছে কূজন কল্পনা নয়
হয়তোবা সে সত্যি কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু
কি বলবে সে? আর কি এমন কথা যে এখানে
এসে পড়েছে সে? কুহু শিউর হওয়ার জন্য
নিজের হাতে চিমটি কাটলো। কুহু বুঝলো সে
স্বপ্ন দেখছে না কিন্তু কূজনকে তো সে আগে
জেগে জেগে প্রায় দেখতো। তাই আবার হাঁটা
শুরু করলো কুহু। কুহুর সাথে সাথে কূজনও হাঁটতে
লাগলো। আবারো আকুল হয়ে বলল,
– কুহু প্লিজ একটাবার তো আমাকে কথা বলার
সুযোগ দিন। প্লিজ! কুহু প্লিজ!
কুহু কিছু বলল না তাকালোও না কূজনের দিকে।
কূজন অস্হির হয়ে বলল,
– প্লিজ কুহু একটাবার আমাকে বলতে সুযোগ
দিন। প্লিজ কুহু আর্নেস্ট রিকুয়েস্ট, কুহু প্লিজ।
কুহু বিরক্ত হয়ে কূজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কথা বলতে চান আমার সঙ্গে?
– জ্বি প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা করুন..
কুহু কূজনকে থামিয়ে বলল,
– তাহলে ঐখানে বেলুন বিক্রি করছে। আপনি
দুইটা বেলুন কিনে এনে যেকোনো দুইটা
বাচ্চাকে দিন।
কুহুর কথা শেষ করতে দেরি হয়নি তার আগেই
কূজন দৌড়ে চলে গেল বেলুন কিনতে। সবগুলো
বেলুন একসাথে কিনে নিল সে তারপর সবগুলো
একটা বাচ্চা মেয়ের হাতে দিয়ে বলল,
– তুমি দুইটা রেখে বাকিগুলো তোমার বন্ধুদের
দিয়ে দাও মামণি।
এরপর কূজন কুহুর দিকে পা বাড়ায়। কি মনে
করে যেন পিছন ফিরে তাকিয়ে মেয়েটাকে
বলে,
– আমি যদি তোমার বন্ধু হই তাহলে তুমি কি
আমাকে একটা বেলুন দিবে?
মেয়েটা কূজনের কথায় হা হয়ে রইলো কিন্তু
হাত বাড়িয়ে ঠিকই একটা বেলুন দিলো। কূজন
সেটা নিল না। কূজন মেয়েটার হাত থেকে অন্য
একটা নীল রঙের হার্ট শেইপ বেলুন নিলো
তারপর হেসে বলল,
– থেঙ্ক ইউ বন্ধু!
– থেঙ্ক ইউ সুইট ভাইয়া।
কূজন মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কুহুর
কাছে চলে এলো। কুহুর দিকে বেলুনটা এগিয়ে
দিয়ে বলল,
– কুহু আমি আপনাকে ভালোবাসি।
কুহু কূজনের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে রইলো।
তারপর রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বেলুন
হাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট
ছেলের কাছে যেয়ে বলল,
– তোমাকে বেলুনটা কে কিনে দিয়েছে?
ছেলেটা হাত দিয়ে কূজনকে দেখিয়ে বলল,
– চশমা পড়া ভাইয়া কিনে দিয়েছে।
কুহুর এবার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। কি
হচ্ছে কি এসব? প্রথমে শিউর হওয়ার জন্য
কূজনকে বেলুন কিনে বাচ্চাদের দিতে বলল
যাতে করে কুহু বুঝতে পারে কূজন বাস্তবেই ওর
সাথে কথা বলতে চাইছে নাকি এটা শুধুমাত্র
কল্পনা। যখন দেখলো কূজন সত্যি সত্যি বেলুন
কিনে বাচ্চাদের দিল তখন শিউর হয়েছিল যে
কূজন সত্যি এখানে এসেছে। কিন্তু
ভালোবাসার কথা বলায় কুহু নিজের উপর বেশ
রেগে গিয়েছিল কারণ ভেবেছিল কূজন সত্যি
সত্যি তো আর ভাইয়ের হবু বউকে ভালোবাসি
বলবে না।
চলবে…

#হেল্পঃ সবাই আইডিতে বেশি করে কমেন্ট করবেন এবং পোক দিবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here