একটুখানি পর্ব : ৫৫

0
434

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ৫৫
কুহুর হাত পা জমে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে
চোখ ছোট ছোট করে কূজনের দিকে তাকিয়ে
আছে সে। অপরদিকে কূজন কুহুকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে
একনাগাড়ে দেখে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যও
চোখ সরাচ্ছে না সে।কূজনের তাকানো দেখে
মনে হচ্ছে জীবনেও সে কোনো মেয়েকে
দেখেনি। শুধু মেয়ে কেনো আদৌ সে কোনো
মানুষ দেখেছি কিনা সন্দেহ আছে। নয়তো সে
কোনো আফসারা দেখছে, হুরপরী জাতীয়
কিছু। কূজনের এমন করে তাকানো দেখে কুহুর
খুব বেশি রাগ উঠছে কিন্তু প্রকাশ করতে
পারছে না। মুঠোবন্দি করে রাগ কমানোর
চেষ্টা করছে। এখন যদি কুহু রাগটা দেখাতে না
পারে তাহলে সে নিশ্চিত কেঁদে দিবে। কুহু
এখন মোটেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে চাচ্ছে
না। এসব কাজ করে ঢঙ্গী মেয়েরা যারা
এটেনশন সিকার। কুহু মোটেও সেরকম নয়। আর
রাগটাও প্রকাশ করতে পারছে না কুহু। কূজন
যেভাবে কিউট মার্কা হাসি দিয়ে রেখেছে
ফেরেশতা ফেরেশতা মনে হচ্ছে কুহুর কাছে।
কূজনকে নিজের কাছে এতোটা ভালো মানুষ
মনে হওয়াতে কুহু মনে মনে নিজেকে হাজারটা
গালি দিল। আশ্চর্য কূজনের মতন এমন একটা
নম্র ভদ্র ছেলে এমন কথা বলতে পারে কুহু
ভাবতে পারছে না। আসলেই কি কূজন এগুলো
বলেছে? কুহুর এখনো নিজের কানকে বিশ্বাস
হচ্ছে না। যদি বলে থাকে তাহলে কুহু শিউর
কূজন মেন্টালি সিক।
কি বলল এসব? কুহুর কথাগুলো মনে হতেই কান
ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো।
“কুহু কি হয়েছে না করেছেন? প্রপোজ করলে
এমন হাজারবার রিজেক্ট হতেই হয়। তারপরো
আমি আপনাকে ভালোবাসি আর আপনাকে
নিজের করে পেতে চাই। বিয়ে ঠিক হয়েছে
নো প্রবলেম। বিয়ে তো আর হয়নি। আপনি যদি
বিবাহিত হতেন, বাচ্চার মা হতেন তাহলেও
আমি আপনাকে ভালোবেসে পেতে চাইতাম।
আর ভাইয়ের ফিওন্সে তাতে আমার কিছুই যায়
আসে না।এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড
ওয়ার। আমি ভাইয়ের কথা, পরিবারের কথা
অনেক বেশি চিন্তা করে দেখেছি। এই বিশ
পঁচিশ দিন নিজের মনের সঙ্গে, নিজের ভাঙা
হৃদয় নিয়ে তুমুল ঝড়ঝাপটা পার করেছি আমি।
কিন্তু আপনার ভালোবাসার কাছে এসব কিছুই
না। ইনহিউমেন যাকে বলে আমি ঠিক ততোটাই
চেষ্টা করেছি আপনাকে ভুলার কিন্তু
পারিনি। রাতের পর রাত জেগেছি আপনাকে
ভেবে। নিজেকে কিরকম অনল দহনে পুড়েছি
তা আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
যতবার আপনাকে আর কলরব ভাইকে একসাথে
দেখেছি নিজেকে শেষ করে দিতে মন
চেয়েছে কিন্তু তারপরো সবার কথা ভেবে
নিজেকে সামলে নিয়েছি। আপনি বলতে
পারেন তাহলে এতোদিন কেনো চুপ করে
ছিলাম? আমি বলব তিন চারদিন হয়েছে কলরব
ভাই ঢাকা গিয়েছে। তাই এখন আর আপনাদের
একসাথে দেখতে হচ্ছে না। কি যে শান্তি
লাগছে বলে বুঝানোর নয়। আমি এতেই বুঝেছি
কুহু যে স্যাক্রিফাইস করা আর করবো ভাবা
এক নয়। আমি আপনাকে হারাতে পারবো না।
পৃথিবী উল্টে যাক আমি শুধু আপনার হাত ধরতে
চাই আর কিছু চাই না। ”
কুহু মনে মনে কথাগুলো পুনরায় আওড়িয়ে নিল।
তারপর কাঁপা স্বরে বলল,
– প্লিজ আপনি বুঝার চেষ্টা করুন। আমি
কলরবকেই বিয়ে করতে চাই।
কূজন নাছোড়বান্দার মতো বলল,
– কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই কুহু।
ট্রাস্ট মি আমাকে একটুও ভালোবাসতে হবে
না আপনার। শুধু পাশে থাকলেই চলবে। আমার
একার ভালেবাসাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
কুহু কূজনের কথা শেষ হবার আগেই হাঁটতে
লাগলো। কূজন কুহুর সাথে চলতে চলতে বলল,
– কুহু আমাকে শুধু একটুখানি সুযোগ দিন আমি
একদম আপনার মনের মতন হয়ে যাব। আপনি
যেমন চাইবেন ঠিক তেমন হয়ে যাব। কলরব
ভাইয়ের কার্বনকপি হয়ে আপনার সামনে
দাঁড়াবো আমি।
কূজনের এমন অস্বাভাবিক কথা শোনে কুহুর
এবার প্রচন্ড মায়া হলো। কুহু থমকে দাঁড়িয়ে
শান্ত স্বরে বলল,
– দেখুন কূজন আপনাকে আমার জন্য নিজেকে
বদলাতে হবে না। আপনি যেমন আছেন ঠিক
তেমনি থাকুন। কলরব একটুও আমার মনের মতন
না। কিন্তু ভালোবাসি কলরবকে, সে আমার হবু
বর কূজন। ভালোবাসা জিনিসটা মনের মতন
কিনা সেসব বিবেচনা করে হয় না। শুধু হয়ে
যায়।
কূজন নিরাশ হয়ে বলল,
– আমাকে ভালোবাসতে হবে না আপনার শুধু…
কুহু এবার রাগে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।
কূজনের এমন আচরণে কূজনকে বাকি কথাটুকুর
বলার সুযোগ দিল না কুহু। খালি রিকশা পেয়ে
উঠে পড়লো সে। কূজনের জায়গায় এখানে
কলরব হলে কুহু হয়তো চড় পর্যন্ত দিয়ে দিত
কিন্তু কূজন দেখে কোনোরকম পাশ কাটিয়ে
চলে এসেছে সে। কুহুর রিকশার সাথে সাথে
কূজনও কিছুদূর হেঁটে চলল তারপর গতি বাড়ায়
রিকশার সাথে আর তাল মিলাতে পারলো না,
পিছনে পড়ে গেল কূজন।

পিহু গোসল সেড়ে টাওয়াল দিয়ে চুল বেঁধে
বের হতেই দেখলো কুহু গ্লাসে পানি ঢালছে।
কুহুর হাত ভীষণভাবে কাঁপছে। জগের পানি
গ্লাসে কিছু পড়ছে বাকিগুলো ফ্লোরে
পড়ে ফ্লোর পানিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
পিহু এগিয়ে এসে কুহুর হাত থেকে জগ আর
গ্লাসটা নিয়ে গ্লাসে পানি ঢাললো। তারপর
কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– নে!
কুহু একটানে সবটুকু পানি শেষ করে বিছানায়
ধপ করে বসে পড়লো। পিহু চিন্তিত সুরে বলল,
– আবার কি হয়েছে?
কুহুর ঠোঁট কাঁপছে কোনোভাবেই কিছু বলতে
পারছে না। চুপচাপ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে
আছে সে। পিহু জবাব না পেয়ে কুহুকে বলল,
– কি হলো এমন করছিস কেনো?
কুহু হাতের ইশারায় পিহুকে কাছে ডাকলো।
পিহু এগিয়ে এসে বোনের পাশে বসে বলল,
– বল কি হয়েছে?
কুহু কাঁপা স্বরে বলল,
– কূজন আমার পিছু নিয়েছে।
পিহু চোখ বড় বড় করে বলল,
– তারপর?
কুহু স্কার্ফের পিন খুলতে খুলতে বলল,
– আমাকে ভালোবাসে বলল।
আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়। এভরিথিং
ইজ ফেয়ার ইন লাভ বলল। আরো কিসব
হাবিজাবি.. মনে হয় কূজন পাগল হয়ে
গিয়েছে। অপ্রকৃতস্হের মতন বারবার
উল্টাপাল্টা কথা বলেছে সে।
পিহু কুহুর কথা শোনে হা হয়ে রইলো। পিহুর বড়
বড় চোখগুলো যেন কোটর ছেড়ে বের হয়ে
আসছে। পিহু ঢোক গিলে বলল,
– বিশ্বাস কর আপুণি আমি চিঠিটা দিয়েছি।
আমাকে আবার শুধু শুধু বকাঝকা করিস না।
কুহু পিহুকে আশ্বস্ত করে বলল,
– ধুর! তোকে বকবো কেনো? তুই যে চিঠি
দিয়েছিস কূজনও বলেছে।
পিহু নিজের দুইগালে হাত রেখে বলল,
– তাহলে?
কুহু বিরক্তির শব্দ করে বলল,
– কূজন বলল এই চিঠি কেনো আমি যদি মুখে
মুখেও হাজারবার ওকে না বলি তবুও সে আমার
পিছু ছাড়বে না।
পিহু মাথায় হাত দিয়ে বলল,
– দেখেছিস আমি বলেছিলাম না অতি ভক্তি
চোরের লক্ষণ। এখন দেখ তোর ভালো মানুষটা
কেমন গিরগিটি। যেই কলরব ভাই চলে গেল
তোর পিছে লাগলো। কলরব ভাই ছিল বলে
সাহস করে উঠতে পারেনি। যেই কলরব ভাই..
কুহু পিহুকে থামিয়ে বলল,
– হয়তো তুই ঠিক তবুও..
পিহু চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা
করলো,
– তবুও কি?
কুহু একটুখানি ভেবে বলল,
– আমার মনে হয় কূজনের অন্য কোনো সমস্যা
আছে। তুই যদি দেখতিস কি নাছোড়বান্দার
মতন আমার পিছে পড়ে ছিল সে। যতবার বলি
কলরবকে ভালোবাসি, কলরবকে বিয়ে করতে
চাই, আমি এঙ্গগেজড্ সে ততেবারি কিসব
প্রলাপ বকেছে।
পিহু কুহুর দিকে হতাশ হয়ে তাকালো। তারপর
নিজের কপালে নিজে চাপড় দিতে দিতে
বলল,
– আল্লাহ তুমি কি এই গাধীটাকে একটুখানি
বুদ্ধিও দাওনি? আর মিস কুহু আপনি কই ছিলেন
যখন আল্লাহ বুদ্ধি বেটেছিলেন? ঘুমিয়ে
ছিলেন নাকি? আর আপনার মধ্যে এতো
ভালোমানুষী আসে কোথা থেকে? এগুলো তো
ভালোমানুষী না। এসব হলো নিজের পায়ে
নিজে কুড়াল মারা। আমার কথা শোন এখনি
কলরব ভাইকে ফোন দিয়ে সবটুকু জানা। পরে
কি হবে না হবে তা দেখা যাবে।
কুহু আৎকে উঠে বলল,
– কি বলিস কি পিহুন? আমি কি ওদের দুই
ভাইয়ের মাঝে ঝগড়া লাগাবো নাকি? আমি
কখনোই এসব…
পিহু কুহুর কথা শেষ হওয়ার আগেই বিছানা
ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– তোর মতন উঁজবুক নিয়ে মহাবিপদ। তুই মর!
আল্লাহ রওয়াস্তে মর!
কুহু পিহুর কথা শোনে হা হয়ে রইলো আর পিহু
হনহন করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here