একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ৫৬
কলরব কুহুদের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। কুহুর
আসার কথা এখনো আসেনি। কলরব কেমন উশখুশ
করছে। বারবার সিঁড়িঘরে উঁকি দিচ্ছে কিন্তু
কুহুর দেখা মিলছে না। কলরব ফোন দেওয়ার
জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করলো কিন্তু
মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে, চার্জ একদমই নেই।
কলরব তাই বাসায় যাওয়ার জন্য রেলিং পার
করে নিজেদের ছাদে ফিরে এলো।
তাড়াতাড়ি মোবাইলে চার্জ দিতে হবে।
কুহুকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে।
কুহুকে এতোদিন পর দেখতে পাবে মনে হতেই
কলরবের চেহারা খুশিতে ঝলমল করতে
লাগলো। কলরব আকাশের দিকে মুখ তুলে
তাকালো। বাঁকা একটা চাঁদ পুরো আকাশ জুরে
খিলখিল করে হাসছে। কলরবের মনে হলো এটা
যেন কুহুর ঠোঁটের হাসি। আর আকাশটা হলো
কলরবের মন। কুহু যেখানে বিজয়িনীর মতন চড়ে
বেড়ায়। কুহুর কথা ভাবতে ভাবতেই কলরব
একবার কুহুদের ছাদে তাকালো। কলরবের মনে
হলো হয়তো কুহু এসেছে। কলরবের মন বলছে কুহু
আসবে। কলরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুহুকে খুঁজতে
লাগলো। কলরবের কেনো যেন মনে হচ্ছে কুহু
আছে। আশেপাশেই কোথাও অন্ধকারে মিশে
আছে। কিন্তু চারিদিকে তো চাঁদের আলো
আছেই। কলরব আনমনে হাসলো। কুহুর সামনে এই
চাঁদের আলো ম্লান। কলরব আবার প্যাণ্টের
পকেট হাঁতড়াতে লাগলো। পকেটে টর্চ লাইট
পেয়েও গেল সে। কলরব টর্চ জ্বেলে ছাদের
দিকে তাক করে ধরলো। আলো ফেলতেই কুহু
সাথে সাথে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো
আর কলরব বিবশ হয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে
রইলো। চোখ ফিরাতে পারছে না সে।
নিঃশ্বাসের কলরবগুলোও যেন কুহুর মাদকতায়
স্পন্দন পাচ্ছে। কলরব শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হায় কুহুর
দিকে তাকিয়ে আছে। কলরব তাড়াতাড়ি করে
টর্চ সরালো। কুহুও এবার চেহারার সামনে
থেকে হাত সরালো। কলরবের কাছে চাঁদের
আলোয় কুহুকে আরো বেশি মোহনীয় লাগছে।
সাদা সিল্কের শাড়ি, হাত ভর্তি লাল চুড়ি
আর কোমড়ের নীচ পর্যন্ত প্রায় হাঁটু ছুঁই ছুঁই
খোলা চুল। সাথে কলরবের মায়ের দেয়া
টিকলিটাও পড়েছে কুহু। অসহ্যরকমের সুন্দর
লাগছে কুহুকে। বাতাসে চুলগুলো উড়ে এসে
চোখে মুখে পড়ছে কুহুর। কলরব একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে।তার ইচ্ছে হচ্ছে
হাত দিয়ে কুহুর চুলগুলো সরিয়ে দিতে।
উত্তেরজনায় কলরবের চেহারায় ইষৎ লাল আভা
ফুটে উঠেছে। সব আবেগ যেন গলায় এসে
আটকে আছে কলরবের। কিছু একটা বলতে
চাইছে কুহুকে কিন্তু কুহুর চোখ ধাঁধানো রূপে
কলরব বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কলরব
মোহগ্রস্তের মতন কুহুর দিকে চেয়ে আছে। কুহু
কলরবের অবস্হা দেখে উচ্চস্বরে হেসে বলল,
– আমাকে কি পরী মনে হচ্ছে নাকি? এভাবে
তাকিয়ে আছেন কেনো?
কলরব কুহুর কথার সাথে তাল মিলিয়ে মাথা
ঝাঁকালো তারপর কাঁপা স্বরে বলল,
– তাই তো পরী মনে হচ্ছে একদম।
কুহু খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হাসতে
হাসতেই হেঁটে চলল। কলরবের কোনো হুঁশ জ্ঞান
নেই। সে যেন একটা বিবশ মন নিয়ে দেহের
সঙ্গে পেরে উঠছে না। কুহু ঘাড় ঘুরিয়ে
কলরবের উদ্দেশ্যে বলল,
– পরীকে একবার ছুঁয়ে দেখবেন না? পরী কিন্তু
উড়াল দিবে।
কলরব ফিসফিসিয়ে বলল,
– “মন ছুঁয়েছি কোটি বার,
প্রতিচ্ছবি একবার
চোখের ছোঁয়া বারংবার
তুমি যে শুধুই আমার”
কুহু মুচকি হেসে বলল,
– আপনি কবি হলেন কবে?
কলরব বুঝলো না কুহু কীভাবে শুনে ফেললো।
তার যতদূর মনে পরে সে তো ফিসফিসিয়ে
বলেছিল কথাটা। তাহলে কুহু শুনলো কি করে??
ঐশী শক্তি?হয়তো ভালোবাসার ক্ষমতা।
নাকি কলরবের হৃদস্পন্দন এতোটাই বেড়ে গেছে
যে আশেপাশের সবকিছু সে নিঃশব্দের
তালিকায় ফেলছে? কলরব ভেবে পেল না।
কলরব আর ভাবলোও না শুধু বলল,
– যবে থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি।
কুহু কলরবের কথায় এবার আর হাসলো না বরং
শান্ত স্বরে বলল,
– তোমাকে অনেক ভালোবাসি কলরব। অনেক
বেশি! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, মরে
যাব। তোমাকে ভালোবেসে মরে যাবে
তোমার কুহু। তারপরো কুহু শুধু কলরবের হয়েই
থাকবে। কুহুরবকে কেউ আলাদা করতে পারবে
না কেউ না।
কলরব অবাক হয়ে কুহুর কথা শুনছে। কলরব
এতোটাই অবাক হয়েছে যে কুহু যে এক
নিমিষেই দৌড়ে ছাদের পিছন দিকটায় চলে
গেছে সেটা কলরব বুঝতেই পারেনি। যখনই হুঁশ
ফিরলো কলরবও রেলিং টপকে এসে কুহুর
পিছনে দৌড়ে এলো।সিঁড়িঘর পেরিয়ে পিছন
দিকটায় আসতেই দেখলো কুহু রেলিং এর উপর
উঠে দাঁড়িয়ে আছে। কলরব আতঙ্কে গলা দিয়ে
কোনো কথা বের করতে পারছে না। মনে
প্রাণে চেষ্টা করছে কুহুকে থামতে বলতে
কিন্তু কিছুতেই শব্দরা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না।
কলরব হাজার চেষ্টায়ও যখন কিছু বলতে
পারলো না সে কুহুর হাত আকঁড়ে ধরলো।
এতোটাই জোরে আঁকড়ে ধরলো যে কুহুর হাতের
চুড়িগুলো বাঁকা হয়ে কুহুর হাতের সাথে সেঁটে
গেল আর ব্যাথায় কুঁকড়ে কুহু আস্তে করে বলল,
– উফ্! তোমার দেয়া ক্ষতকেও ভালোবাসি
কলরব। ভালো থেকো কলরব,মাঝে মাঝে
চাঁদের দিকে চেয়ে আমার জন্য দূর থেকে দু
ফোঁটা চোখের জল ফেলো। আমি বহুদূর থেকেও
আমার ভালোবাসার জানান দিব তোমায়।
কুহু এতটুকু বলেই কলরবের হাত থেকে নিজের
হাত ছাড়িয়ে নিল। কলরব কুহুর সাথে পেরে
উঠলো না। কুহুর মাঝে আজ অজানা এক
দিব্যশক্তি কাজ করছে। সেই শক্তির সাথে
কলরব হেরে গেছে। কলরবের সামনেই কুহু ছাদ
থেকে লাফিয়ে পড়লো। কাঁচা রাস্তায় সারি
সারি গাছের মাঝে কুহুর নিথর দেহ পরে
রইলো। কলরব চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু
তাও পারছে না। হাত পা অচল হয়ে আসছে ওর।
মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। পুরোপুরি অচল
হওয়ার আগেই কলরব কুহুদের সিঁড়িঘর দিয়ে
দৌড়ে নামলো। তারপর মেইন গেইট খুলে
বাড়ির পিছন দিকের গলির দিকে দৌড়
দিলো। কলরব শ্বাস ফেলতে পারছে না, দম
বন্ধ হয়ে আসছে ওর, চোখ উপচে বেদনা পড়ছে।
কলরব তারপরো পা চালিয়ে যাচ্ছে। এটুকু
রাস্তা আজ বহুদূর মনে হচ্ছে। দূর থেকেই কলরব
দেখলো কুহু রাস্তায় পরে আছে, সাদা শাড়ির
আঁচল রক্তে মাখামাখি। কলরব রক্ত দেখে
আৎকে উঠলো। কুহু বলে চিৎকার করে উঠলো।
কুহুর কাছে যেয়েই রাস্তায় বসে পড়লে সে।
পাশে তাকিয়ে দেখলো কূজন
ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন একটা
ডামি। কলরব কূজন থেকে চোখ সরিয়ে কুহুর
রক্তে মাখামাখি দেহের দিকে তাকালো।
কুহুর দিকে এগিয়ে এসে কুহুর গাল ছুঁয়ে
উদভ্রান্তের মতো বলতে লাগলো,
– কুহু! তোমার কিছু হয়নি। উঠো তো। এই বোকা
মেয়ে তাকাও না একবার। আমাকে এতো কষ্ট
দিচ্ছো কেনো? আমি কি করেছি কুহু? কি
এমন ভুল করেছি?
কলরব কুহুর মাথা তুলে বুকের সঙ্গে চেপে
ধরলো। আষ্টেপৃষ্ঠে কুহুকে জড়িয়ে ধরে
চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। আর
বিরতিহীনভাবে বলতে লাগলো,
– ফুলটুশী তুমি এমন কেনো করলে? তুমি
আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব বেশি মজা পাও তাই
না? আর কতো কষ্ট দিবে আমায়? তোমার
কিছু হবে না কুহু, কিছু হবে না। কিছু হবে না
শুনতে পাচ্ছো না বোকা? একবার চোখ মেলে
তাকাতে পারো না? কুহু! এই কুহু!
কলরব ঘামতে লাগলো, প্রচণ্ডরকমের ঘামা
ঘামলো সে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো তার।
শরীরের সবকটা পশম কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখ
খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলো বিছানায়।
চারপাশে তাকিয়ে চোখ বুলাতেই বুঝলো সে
এখন চাচার বাসায়। কলরব চট করে বিছানা
ছেড়ে দাঁড়ালো তারপর মোবাইল কোথায়
রেখেছে খুঁজতে লাগলো। পুরো ঘর তন্নতন্ন
করে খুঁজে শেষে মোবাইল পেল বালিশের
নিচে। মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো
বেটারি ডাউন। কলরবের রিতীমতো হাত পা
কাঁপতে শুরু করলো। সারা শরীর জুরে একটা
ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল। পাসওয়ার্ড দিয়ে
মোবাইল ওপেন করার সাথে সাথেই মোবাইল
বন্ধ হয়ে গেল। কলরব দৌড়ে ব্যাগ থেকে
চার্জার বের করে মোবাইল চার্জে দিয়ে কুহুর
নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার,দুবার,তিন
বারের মাথায় কুহু ওপাশ থেকে বলল,
– ঘুমোচ্ছি কলরব! পরে ফোন করুন প্লিজ।
প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা আমার।
কুহুর কণ্ঠ শোনেই কলরব হাপ ছেড়ে বাঁচলো।
শান্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে কুহুকে বলল,
– এখন ঘুমাও ফুলটুশী আমি রাখছি, পরে কথা
বলবো।
– আচ্ছা ফোন রাখলাম।
কুহুর সাথে কথা শেষ হতেই কলরব বিছানায়
বসলো। তারপর শরীর এলিয়ে দিলো
বিছানায়।
চলবে…..