একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী
পর্বঃ৫৮
স্কুলে আসার আগ পর্যন্ত কুহু কলরবের সাথে
একটানা কথা বলেই চলল। স্কুল গেইটের সামনে
রিকশা থামতেই কুহু ফোন রেখে ভাড়া
মিটিয়ে নেমে পড়ল। স্কুলের ভিতর যাওয়ার
আগে দারোয়ানকে একশো টাকার একটা নোট
দিয়ে বলল কিছু একটা দোকান থেকে কিনে
আনতে। আসার সময় কিছু খেয়ে আসেনি। প্রথম
পিরিয়ডেই ক্লাস ছিল তাই দারোয়ানকে বলে
এসেছে টিচার্স রুমে টিফিন রেখে দিতে।
দ্বিতীয় পিরিয়ডে ফ্রি তখন খেয়ে নিবে।
ক্লাসে এসে রুল কল করেই সবার হোম ওয়ার্ক
দেখতে চাইলো। কুহু কি মনে করে যেন
দীপাবলির খাতাটা সবার আগে দেখলো। কুহু
যখন দীপাবলির খাতা দেখছিল তখন খেয়াল
করলো দীপাবলি মুখ গুমঁড়া করে রেখেছে। কুহু
তাই জিজ্ঞাসা করল,
– মা বকা দিয়েছে বুঝি?
দীপাবলি ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,
– মা বকা দেয়নি মেডাম।
– তাহলে?
– আমি আপনার প্রিয় না তাইনা? শুধু আমার
নামটাই আপনার পছন্দের।
কুহু হেসে বলল,
– তুমিও আমার অনেক প্রিয় কিন্তু শুধু আমার
প্রিয় হলেই তো হবে না সব স্যার মেডামদের
প্রিয় হতে হবে।
– হুম।
– নাও তোমাকে স্টার দিয়ে দিলাম।
দীপাবলি খাতা নিতে নিতে বলল,
– আচ্ছা মেডাম ঐ ভাইয়াটা আমাকে পছন্দ
করে না তাইনা?
– কোন ভাইয়া?
– ঐ যে গতকাল যে সব্বাইকে বেলুন
দিয়েছিল…
কুহুর চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাই
বলল,
– দীপাবলি তুমি বেশি কথা বলো।
দীপাবলি গাল ফুলিয়ে বলল,
– মাও আমাকে গতকাল এটাই বলে বকা
দিয়েছিল। আমি যখন এশার কাছে বেলুন
চাইলাম সে আমাকে দিলো না। বাকি
সবাইকে দিয়েছে। আমি নাকি ঝগড়াটে তাই
আমাকে দিবে না। আর ঐ ভালো ভাইয়াটাও
তো আমার হাতে বেলুনগুলো না দিয়ে সবগুলো
এশার হাতে দিয়ে দিয়েছিল।
কুহু মনে মনে বলল,
– আমিও এই বাচ্চা মেয়েটার মতোই ঐ
পশুটাকে এরকম ভালো মানুষ ভাবতাম। আসলেই
মানুষ চিনতে বড্ড বেশি ভুল করি আমি।
কুহু দীপাবলির গালে হাত রেখে বলল,
– ঠিক আছে আমি তোমাকে কিনে দিব।
দীপাবলি খুশি হয়ে বলল,
– আমার বন্ধুদেরও কিনে দিতে হবে মেডাম।
এশা আমার বন্ধুদেরও দেয়নি।
কুহু বলল,
– ঠিক আছে দিব।
..
কুহু কোনোরকম ক্লাসে শুধু আজ বসে ছিল।
ভালোভাবে কিছুই পড়াতে পারেনি। বারবার
মনে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
কলরবকে কি সবটা বলে দেয়া উচিৎ? এই প্রশ্ন
নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আজ আর তেমন কিছু
পড়ানো হয়নি। টিচার্স রুমে বসেও এই এক
কথাই ভেবে যাচ্ছে। খাবারের প্যাকেট
খুলেওনি এখন পর্যন্ত। বেশ ক্ষুধা লেগেছে
কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। গতরাতেও না
খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। গতরাতের কথা মনে
পড়তেই
কুহু শিউরে উঠলো। কুহু যদি ইরিনদের বয়সী
হতো তাহলে ভয়ের চোটে ছাদেই হার্ট
অ্যাটাক করে মারা যেতো। এমনিতেও কম ভয়
পায়নি। কুহু মনে মনে তওবা করেছে আর
কোনোদিন ছাদে যাবে না সে। অন্তত কলরব
না আসা অব্দি তো নাই। জীবনের শিক্ষা
হয়েছে কুহুর। ভাবতেই হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে
যাচ্ছে। কূজন যে কতোটা ডেস্পারেট হয়ে
গেছে কুহু তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।
গতরাতে কূজনের মাথায় খারাপ কিছু আসেনি
দেখে যে সে ভবিষতেও এমন কিছু করবে না
তা তো নয়। বরং দিন দিন কূজন আরো পাগল
আর মরিয়া হয়ে উঠবে। এসব ভাবতে পর্যন্ত কুহুর
গা গুলিয়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি এসব চিন্তা
ফেলে কুহু নাস্তার প্যাকেট খুলতে শুরু করলো।
…
কূজন ঘড়িতে সময় দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরই
স্কুলের ছুটি হবে। এখন সে রিকশায় বসে আছে।
পায়ে আজ স্নিকারস পরেনি, সো পড়েছে
সাথে ফর্মাল প্যান্টশার্ট। কলরব অফিসে
যেমন করে যায় ঠিক তেমন। শুধু সানগ্লাসটা
পরেনি কারণ কূজনের পক্ষে সানগ্লাস পরে
হাঁটা অসম্ভব। চশমা ছাড়া খালি চোখে
হাঁটতে গেলেই পড়ে যাই পড়ে যাই অবস্হা আর
সেখানে যদি সানগ্লাস পরে তাহলে নির্ঘাত
গাড়ির নীচে চাপা পড়বে। কূজন ব্যস্ত
ভঙ্গিতে আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো
তারপর রিকশাচালককে দ্রুত চালানোর জন্য
তাড়া দিলো। কূজনের আজ মনেই ছিল না
বৃহস্পতিবারে স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়।
ভাগ্যিস ইরিনের বকবকানিতে মনে পড়ে।
তারপর তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে রওনা
দিল। অন্যদিন হলে রেডি হওয়া নিয়ে কোনো
ঝামেলা পোহাতে হতো না। কিন্তু কূজন
কলরবের মতন এক গাদা কাপড় শপিং করে
নিয়ে এসেছে তারপর খুব বেশ সময় নিয়ে শার্ট
চুজ করেছে সে। অবশ্য ইরিন সাহায্য না করলে
আরো বেশি দেরি হয়ে যেত। রিকশাচালকের
কথায় কূজনের ভাবনায় ছেদ পড়লো।
– আইয়া পড়ছি তো এহন নামেন না কেন?
রাস্তায় তো পাগল কইরা লাইছিলেন।
কূজন ওয়ালেট থেকে চকচকে পাঁচশো টাকার
নোট বের করে রিকশাচালকের হাতে ধরিয়ে
বলল,
– রেখে দিন ফেরত দেয়া লাগবে না।
রিকশাচালক এর মলিন আর বিরক্তভরা চাহনি
হঠাৎ খুশিতে চকচক করতে লাগলো। হাত
বাড়িয়ে টাকা নিয়ে বলল,
– ভাইজান আফনে বড় ভালা মানুষ।
কূজন রিকশা থেকে নামতে নামতে বলল,
– এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি বড্ড বেশি
খারাপ মানুষ, বড্ড বেশি!
রিকশাচালক কূজনের কথায় থ হয়ে রইল। কূজন
তা উপেক্ষা করে স্কুল গেইটের কাছে এগিয়ে
গেল।
..
কুহু গেইট থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য
দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ খেয়াল করলো কূজন কুহুর
দিকে হেঁটে আসছে। কূজনকে আজ পুরা
অন্যরকম লাগছে। কুহু কূজনের এই পরিবর্তনের
কারণ খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। কুহুর
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কুহু মনে মনে বলল,
– এখন যদি এই পাগল এসে উল্টাপাল্টা কিছু
বলে তাহলে আজ কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি করে ফেলব।
কূজন হেঁটে এসে কুহুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
– কেমন আছো কুহু? গানটা কেমন হয়েছে বললে
না যে?
আমি নিজে লিখেছি, সুরটাও…
কূজনের কথা শেষ হবার আগেই কুহুর কলিগ কলি
এসে বলল,
– আরিজা মেডাম ইনিই কি আপনার তিনি?
আমায় তো বলেছিলেন ট্রেনিং থেকে
ফিরেননি এখনো। কি ব্যাপার ভাইয়া
সারপ্রাইজ দিতে চলে এলেন নাকি?
কুহু কূজনের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কুহু
আসলে কূজনকে খুব কঠিন কিছু শুনানোর জন্য
কথা গুছিয়ে নিচ্ছিল এর মাঝেই কলি এসে
হাজির তাও আবার কিসব বলল। কুহুর ভয়ঙ্কর
ধরনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। তবে সেটা
চেপে গিয়ে বলল,
– না কলি উনি আমার হবু দেবর। কলরব উনাকে
পাঠিয়েছে আমাকে একটা জিনিস দেওয়ার
জন্য।
কলি আগ্রহ নিয়ে বলল,
– কি দেখি তো।
কুহু পড়লো মহাবিপদে। সে তো কূজনকে হিট
দিয়েই কথাটা বলেছিল। এখন কোথা থেকে
কি দেখাবে বুঝতে পারছে না। কলি তো উৎসুক
দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কিন্তু কুহু কি
দেখাবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কুহুর
কলরবের দেয়া আয়নাটার কথা মনে পড়লো। কুহু
আয়নাটা সাথেই রাখে সবসময়। ভ্যানিটি ব্যাগ
থেকে আয়নাটা খুলে কলিকে দেখিয়ে বলল,
– কলরব এটা পাঠিয়েছে আমার জন্য।
তারপর হাসিমুখে কূজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ধন্যবাদ ভাইয়া কষ্ট করে এখানে এসেছেন।
তবে ধন্যবাদটা না দিলেও পারতাম হাজার
হোক আমি আপনার ভাবি হই। দেবর হিসেবে
ছোটখাটো কাজ তো করতেই পারেন, তাইনা?
তবুও কলরবের ভাই আপনি তাই সৌজন্যতা
দেখানোও আমার কর্তব্য।
কুহু এতটুকু বলেই ব্যঙ্গের হাসি হাসলো।
কলি বলল,
– ভাইয়া এক্সট্রিমলি সরি আমি আসলে
বুঝিনি।
কলির কথা কূজনের কানে গেল না। কূজন এখনো
কুহুর বলা কথাগুলো হজম করে উঠতে পারছে না।
কুহু এমনভাবে বলল কীভাবে সেটা ভেবে
কূলকিনারা করতে পারছে না সে,
কোনোভাবেই না।
চলবে…