একটুখানি পর্ব : ৫৯

0
440

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ৫৯
কুহুর মনে এক পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। কূজনকে
উচিত শিক্ষা দিয়েছে সে। এমন ছ্যাঁচড়া
ছেলেদের এভাবেই সাইজ করতে হয়। গতকাল
রাতে কুহুকে ছাদে আটকে রেখে কূজন জঘন্য
অপরাধ করেছে। সেই অপরাধের তুলনায় এরকম দু
চারটে কথা শোনানো যেতেই পারে। তবে কুহু
বেশ ভদ্রভাবেই কথাগুলো বলেছে আর খারাপ
কিছুই বলেনি। যা সত্যি তাই বলেছে। কুহু তো
কূজনের ভাবিই। কুহুর মন বেশ ফুরফুরে হয়ে
এসেছে। গতরাতের শাস্তি সে কূজনকে
দিয়েছে। যদিও পিহু শুনলে বলবে এটা কোনো
শাস্তি হলো? কিন্তু কুহু জানে এর চেয়ে বড় শাস্তি
কূজনের জন্য আর হতেই পারে না। ভালোবাসার
মানুষের কাছে দেবর, ভাবি, শ্যালিকা,দুলাভাই এসকল শব্দ
শুনতে বেশ ভয়ংকর মনে হবে নিশ্চই। কুহু মনে
মনে একবার ভাবলো আচ্ছা কলরব যদি ওকে ভাবি
ডাকে তাহলে ওর কেমন লাগবে? ভাবতেই কুহুর মন
বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। কুহু এবার নিশ্চিত যে কূজনের
লজ্জা থাকলে আর কোনোদিন কুহুর পিছনে
পড়বে না। তবে মনের মধ্যে একটা খটকা রয়েই
গেল। কূজন যদি এতে করে ক্ষেপে যায়,তাহলে?
সে তো আরো বেশি ডেস্পারেট হয়ে যাবে।
কুহুর সত্যি সত্যি এবার খুব বেশি ভয় করতে লাগলো।
কুহু মনে মনে বলল,
– বিয়েটা করে গেলে কি হতো? উনি আছেন উনার
চাকুরী নিয়ে। বউ গেলে তখন চাকুরী দিয়ে কি
করবে তা আমি দেখে নিব।
কুহু নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল,
– ধুর কিসব বলছি। বউ আবার কোথায় যাবে। বরং বর
এসে হাজির হবে। কিন্তু কবে? দিন যায় না কেনো?
এই কূজনের জ্বালায় কুহু অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
পিহুর কথা মতন কলরবকে সব বলে দেয়া উচিত নয়কি?
অবশ্যই বলে দেয়া উচিত। কারণ পিহু যা বলে সবসময়
তাই ঠিক হয়। পিহু তো বলেছিলই কূজন আসলে
কুজন। কিন্তু কুহুই ওর ভালোমানুষী চেহারা দেখে
ভিতরে ভিতরে আরো পুড়ছিল। কিন্তু সব তো
খোলাসা হয়েই গেল। কলরবকে সবটা বলতেই
হবে নয়তো বড় ধরনের কোনো বিপদ দেখা
দিবে সামনে। কিন্তু কলরব যদি ভুল বুঝে কুহুকে
তাহলে কি হবে? নাহ্ কলরব কখনোই কুহুকে ভুল
বুঝবে না। ভালোবাসে সে কুহুকে, এতোটাই
বেশি ভালোবাসে যে কুহুর কথা চিন্তা করে সে
কাঁচের চুড়িই আনেনি। কতো তফাৎ দুইটা মানুষের
মাঝে। একজন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে
ঘুরে বেরিয়েছে এতোদিন আর এই আলো
ঝলমলে মুখশ্রীর আড়ালে থাকা ভয়ংকর মানুষটাকেই
কুহু পার্ফেক্ট একটা মানুষ ভাবতো। অথচ কলরবকে
প্রথম থেকেই কুহুর কাছে গায়ে পড়া স্বভাবের
মনে হয়েছে। কুহুর মাথায় হঠাৎ চিন্তা আসলো আচ্ছা
আমি যদি কূজনকে চুজ করে নিতাম তাহলে কলরব
কিরকম আচরণ করতো? কলরবও কি কূজনের মতন
এভাবে পিছে পড়ে থাকতো? কুহুর ধারণা অবশ্যই
থাকতো। পরক্ষণেই কুহুর মনে হলো নাহ্ কলরব
এমন করতেই পারতো না। কলরব সবসময়ই কুহুর
ভালো লাগাটাকে প্রায়োরিটি দিয়েছে। কুহু কোনটা
বললে রেগে যাবে, কোনটায় অস্বস্তি হবে,
কোনটা বললে কেঁদে দিবে সবটার দিকেই সে
খেয়াল রাখে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কুহু রাগ
করলে তা ভাঙানোর জন্য হাজারটা পায়তারা করে।
কলরবের কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট
হলে কুহুর ভালো থাকা। কুহু একয়দিনে খুব ভালো
বুঝে গেছে যে কলরব কুহুর জন্য সবদিক দিয়েই
পার্ফেক্ট। তাছাড়া মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর কারণে
হোক আর যেই কারণেই হোক না কেনো
রেস্টুরেন্টে কলরব কুহুর ইচ্ছের প্রাধান্য দিয়ে
বলে দিয়েছিল কুহুর সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে।
কুহু একটুও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং কূজনকে চুজ
করলে সে ভুল করতো। কলরব কেমন যেন
সবসময় কুহুকে বুঝে যায়। কুহুর কিছু বলতেই হয়না।
এমনকি অনেক সময় দেখা যায় কলরব একটা কথা
বললে কুহু বুঝতে পারে হ্যাঁ আমি তো আসলে
এমনটাই চাচ্ছিলাম। কুহুর মনে হচ্ছে যদি কূজন নামক
বালাইটা না থাকতো কুহু হতো পৃথিবীর সবচেয়ে
সুখী মানুষ। এতো কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে
রিকশা বাসার কাছে পৌঁছে গেছে খেয়ালই করেনি।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে গেইটে ঢুকতেই কূজনও এসে
আবার হাজির হলো। কূজনকে বাসার গেইটে ঢুকতে
দেখে কুহু কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। কড়া করে
অনেকগুলো কথা শুনাতে মন চাইছে কিন্তু এখানে
এতো কথা বললে আশেপাশের মানুষজন শুনে
ফেলবে। কুহু নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে
রেখে সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠতে লাগলো।
কূজনও কুহুর পিছন পিছন উঠতে লাগলো আর বলল,
– কুহু আমার কথা শুনো বলছি। কুহু দাঁড়াও। আমি তোমার
দেবর নই কুহু। আমি তোমার কি সেটা সময়ই বলে
দিবে।
কূজনের শেষের কথাটা কেমন যেন ছিল। কুহু
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিছন ফিরে তাকালো। তারপর আবার
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। কূজন কুহুকে থামতে
বলছে কিন্তু কুহু আরো দ্রুত চলছে। তিনতলা
বেয়ে উপরে উঠতে কুহুর মনে হচ্ছে শতজনম
লাগছে। পা যেন চলছেই না, পথও যেন শেষ হয়
না। কূজন পিছন থেকে কুহুর হাত ধরে টেনে দাঁড়
করাতেই কুহু চট করেই অপর হাত দিয়ে কূজনের
গালে কষিয়ে চড় দিল। কূজন তারপরো হাত ছাড়লো
না। কুহু যখন হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত কূজন তখন
একনাগাড়ে বলতে লাগলো,
– মিস কুহু আরিজা তোমাকে যে আমার বউ হতেই
হবে। তোমাকে অন্য কেউ বিয়ে করতে
পারবে না।
কুহু রেগে গিয়ে বলল,
– হাত ছাড়ুন বলছি। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া
ছেলেরা আপনার মতন কুলাঙ্গারই হয়।
– কেমন বীরপুরুষ তা বুঝতে চেয়ো না কুহু।
কুহু চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু এটা করা মোটেও
ঠিক হবে না। তাই কূজন যে হাতে কুহুর হাত ধরে
রেখেছে সে হাতে নিজের অন্য হাত দিয়ে
জোরে চিমটি কাটলো। এই কাজটা কুহু বেশ ভালো
পারে। কূজন প্রথমে ছাড়লো না কিন্তু কুহু এতো
জোরে চিমটি দিয়ে ধরে রেখেছে কূজনকে
বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছে। কূজন হাত ছাড়তেই কুহু
বলল,
– আপনার আর কলরবের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
কূজনের জবাবের অপেক্ষা না করেই কুহু চলে
গেল। এবার আর কূজন পিছু নিলো না, কুহুর
গমনপথের দিকে শুধু চেয়ে রইলো।
..
কুহু বাসায় ঢুকেই হন্তদন্ত হয়ে কলরবকে কল
করতে করতে বেডরুমে ঢুকলো। একবার রিং হতেই
কলরব ফোন রিসিভ করলো। কুহুর ফোন রিসিভ
করতে কলরব কখনোই দেরি করে না, পাছে
ফুলটুশি আবার না রেগে যায়।
কলরব ফোন ধরতেই কুহু বলল,
– কলরব আপনি কি কখনো অবিশ্বাস করে আমার হাত
ছেড়ে দিবেন?
কলরব মজা করে বলল,
– কিসব কথা বলছো বুঝতে পারছি না তো। কোনো
উপন্যাস বা মুভির ডায়ালগ নাকি?
কুহু কলরবের মজা করায় মন দিল না। সল এক মুহূর্তও
অপেক্ষা না করে হরহরিয়ে কলরবকে সব কথা
বলে দিল। কূজনের ডায়েরি দেওয়া থেকে শুরু
করে একটু আগের ঘটনা পর্যন্ত পুরোটাই বলল।
ছাদে আটকে রাখার কথাটা বলার সময় কুহু কেঁদে দিল।
কলরব তখন ধমকে বলল,
– তোমাকে না বলেছি একদম
কান্নাকাটি করবে না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
কুহুর কান্না কমার চেয়ে আরো বেশি বেড়ে
গেল। কান্না জড়ানো কণ্ঠেই বলল,
– কূজন আজকে আমার পথও আটকেছিল। জোর
করে হাত ধরে রেখেছিল। আমি কোনোভাবেই
আসতে পারছিলাম না পরে..
কলরব বাকিটুকু আর শুনলো না। কুহুকে ভরসা দিয়ে
বলল,
– আমি আগামীকালই চলে আসছি কুহু। তুমি একদম চিন্তা
করো না। আর এভাবে কাঁদছো কেনো? কূজন
জোর করে তোমার হাত ধরে আটকে
রেখেছিল তুমি তো আর নিজে সেধে যেয়ে
ওর হাতে হাত রেখে বসে থাকোনি তাই
তোমাকে ভুল বুঝার কোনো প্রশ্নই আসে না।
তোমার জন্য যা করার আমি তা করবো সো চিন্তা বাদ
দাও। রিল্যাক্স মুডে থাকো।
কুহু চোখের পানি মুছে বলল,
– শুনোন কূজনের সঙ্গে প্লিজ লাগতে যাবেন না।
কূজনের বাবা অনেক পাওয়ারফুল। তাছাড়া কূজন আজ
কেমন যেন হুমকির সুরে কথা বলল। আমার অনেক
ভয় করছে।
– ধুর বোকা মেয়ে বাদ দাও এসব। আমি আছি না?
তাহলে ফুলটুশীর কোনো চিন্তাই নেই।
ফুলটুশীর চোখের জল আমি থাকতে কখনো
ঝরতে দিব না।
কলরব একটু থেমে বলল,
– আচ্ছা কুহু তুমি কি কখনো ফুলটুশিকে হিংসে
করো? জেলাসি টাইপের কিছু?
কুহু হেসে বলল,
– মাঝে মাঝে।
কলরব ঠিক বুঝতে পারছে কুহুর চোখের কোণায়
জল আর ঠোঁটের কোণায় এখন হাসির রেখা। এই
হাসিটাকে আরো বিস্তীর্ণ করতে কলরব বলল,
– আচ্ছা আমি তো সবসময় কতোই বলি আমার
তোমার এটা ভালো লাগে, ওটা ভালো লাগে কিন্তু
তুমি তো কখনো বলোনি আমার কোন বিষয়টা
তোমার ভালো লাগে।
কুহু এক মিনিট ভাবলো তারপর বলল,
– তেমন কিছুই আমার ভালো লাগে না। তবে
ফুলটুশী গগনবিহারী হাসিটা শুনতে ব্যাকুল হয়ে
থাকে।
কুহুর কথা শুনে কলরব নিজের গগনবিহারী হাসি হাসতে
লাগলো আর কুহুর এতেই মন পুরোদমে ভালো
হয়ে গেল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here