একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
– অন্তিম পর্ব/ পর্বঃ৬৮
কলরব চেয়ে আছে। একদৃষ্টিতে কুুহুর চলে যাওয়া
দেখছে। চোখের পলকও ফেলছে না। যতক্ষণ
গাড়িটা দেখা গেল ঠিক ততোক্ষণ কলরব একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকলো। গাড়িটা গলির বাঁকে হারিয়ে যেতেই
কলরব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পিছন থেকে কাঁধে
কারো স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো। সুরভীর
দিকে তাকাতেই সুরভী বলল,
– কলরব কেনো করলি এমন? নিজের
ভালোবাসাকে অন্য কারোর হতে দিলি কি করে?
কলরব হাসিমুখে বলল,
– ভালোবাসার মানুষের ঠোঁটে চুমু খাওয়াটাই
ভালোবাসার স্বার্থকতা না। ভালোবাসার মানুষের
ঠোঁটের কোণের হাসিটাকে টিকিয়ে রাখাই
ভালোবাসা। যে হাসিটার প্রেমে পড়েছি সে
হাসিটাকে বিলীন হতে দিব নারে।
কলরবের কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জু
কলরবকে জড়িয়ে ধরলো, চোখ থেকে
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরাচ্ছে রঞ্জু। কলরব
রঞ্জুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আরে বলদ কাঁদচ্ছিস কেনো? কুহু ভালো থাকবে
এটাই আমার চাওয়া। ফুলটুশী যে কখনো আমার
সাথে বিয়ে হলে সুখী হতে পারতো না।
কলরবের কথা শুনে এবার সুরভীও কলরবকে
জড়িয়ে ধরলো কিন্তু কাঁদলো না অস্ফুট গলায় বলল,
– উই লাভ ইউ কলরব! জাস্ট লাভ ইউ।
…
হাসনাদ সাহেব জাহরাকে গাড়িতে বসে অপেক্ষা
করতে বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সাহরার
দিকে। সাহরা ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে
আছেন। হাসনাদ সাহেব সাহরার পাশে দাঁড়িয়ে
বললেন,
– আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি।
সাহরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
– জ্বি বলুন।
– এতোদিন জীবনে একটা আফসোস ছিল
আপনাকে না পাওয়ার আফসোস। সত্যি কথা বলতে
জাহরাকে নিয়ে সুখে আছি কিন্তু মাঝে মাঝে যখন
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় আজো ইচ্ছে
জাগে পাশ ফিরে আপনাকে দেখার।
হাসনাদ সাহেব এতটুকু বলেই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস
ফেললেন। একটু থেমেই আবার বললেন,
– কিন্তু এই মূহুর্তে জীবনে নতুন একটা আফসোস
যোগ হলো। ইশ্ কলরব যদি আমার ছেলে হতো
আর আমি যদি কলরবের মতন প্রেমিক হতে পারতাম।
সাহরা কিছু বললেন না চুপ করে রইলেন। হাসনাদ
সাহেব আবারো বললেন,
– আমি মনে করি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো
বাবা, স্বামী হিসেবেও ফেয়ার থাকার চেষ্টা করেছি
কিন্তু প্রেমিক হিসেবে খুবই স্বার্থপর একজন মানুষ।
বারবার চেয়েছি আপনি যেন আপনার সিদ্ধান্তে
জীবনে চলতে গিয়ে পঁচতান, আফসোস করেন
আমাকে রিজেক্ট করার জন্য কিন্তু আজ কলরব
শিখালো ভালোবেসে খাঁচায় বন্দি করে লাভ নেই
বরং ভালোবাসাকে আকাশে ডানা মেলার জন্য উড়িয়ে
দিতে হয়। ত্যাগেই সর্বসুখ কিনা জানি না কিন্তু ত্যাগ আর
ভালোবাসার মাঝে একটা গভীর সম্পর্ক আছে।
ইফতেখার সাহেবকে নিয়ে আমি অনেক
ভেবেছি। মাঝে মাঝে মনে হতো উনি কি
আসলেই আপনাকে না পেলে অন্য কাউকে বিয়ে
করতেন না? আজ উত্তরটা পেয়ে গেছি। আল্লাহ্
আপনাকে ভালো রাখুন আর আমার আজ থেকে
আপনার প্রতি কোনো রাগ বা অভিমান যাই বলুন সেটাও
নেই। আমার প্রতিও প্লিজ রাখবেন না।
হাসনাদ সাহেব সাহরার সাথে কথা বলে হাতের ইশারায়
কলরবকে ডাকলেন। কলরব তখন সঞ্জুর সাথে কথা
বলছিল। হাসনাদ সাহেবকে ডাকতে দেখে কলরব
এগিয়ে গেল। কলরব এগিয়ে যেতেই হাসনাদ
সাহেব কলরবকে বুকের সাথে চেপে শক্ত
করে ধরলেন। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
– আম প্রাউড অফ ইউ মাই সান! প্রাউড অফ ইউ!
আফসোস হচ্ছে আমি কেনো তোমার মতন
সন্তানের বাবা হতে পারলাম না।
কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলল,
– আঙ্কেল আমিও আপনার ছেলে আঙ্কেল।
দোয়া করবেন আমার জন্য।
হাসনাদ সাহেবের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা
পানি টপটপ করে কলরবের শেরওয়ানিতে পড়লো।
কলরব হাসি মুখে হাসনাদ সাহেবকে এগিয়ে গাড়ি
পর্যন্ত দিয়ে এলেন। জাহরা গাড়িতে বসেই
কলরবকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
কষ্টে উনার বুক ফেটে যাচ্ছে। জাহরা জীবনে
খুব কমই কেঁদেছেন আর আজ যেভাবে
কাঁদছেন কখনো এভাবে কেঁদেছেন বলে
মনে করতে পারছেন না। কলরব বারবার থামাতে
চেষ্টা করছে কিন্তু জাহরা থামছেনই না। কাঁদছেন
আর বলছেন,
– তোমাদের নানার বাড়িতে বেড়াতে যেয়ে একবার
তুমি দুষ্টামি করে শোকেজের কাঁচ ভেঙে
ফেলেছিলে। আপা তোমাকে মারতে তেড়ে
যেতেই আমার পিছনে এসে লুকিয়েছিলে। আজ
বাবা কি করে তুমি এই কষ্ট থেকে লুকিয়ে আমার
বুকে লুকাবে? কি করে বাবা?
– আরে খালামণি তুমিও মায়ের মতন কাঁদতে বসলে?
এভাবে কেঁদো না। মাগরিবের আজান পড়ছে
তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে হবে না? ছেলে আর ছেলের
বউকে বরণ করতে হবে তো।
জাহরা আরো বেশি কাঁদতে লাগলেন। কলরব
অনেক বুঝিয়ে জাহরাকে থামালেন তারপর ওদের
বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে এলো কলরব। নিজের রুমে
এসে আস্তে করে দরজা আটকালো। মাথা থেকে
পাগড়ীটা খুলে ওয়ারড্রবের উপর রাখলো।
ওয়ারড্রবের চেস্ট ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে
কুহুর ওড়নাটা হাতে নিলো। তারপর কলরবের কাঁপড়ের
ভাঁজে থাকা চুড়িগুলোয় হাত বুলিয়ে বলল,
– ফুলটুশী তোমাকে নিজ হাতে পড়ানো হলো না,
তোমার হাতে হাতও রাখা হলো না।
ওয়ারড্রব থেকে একটা টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট বের
করে চেঞ্জ করে নিলো। তারপর বিছানায় হাত পা
ছড়িয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে
হাতড়ে কুহুর ওড়নাটা খুঁজতে লাগলো,পেয়েও
গেল। ওড়নাটা হাতে নিয়ে চোখ মেলল সে। নাক
ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
– ফুলটুশী আই ডু লাভ ইউ। আমার নাইবা হলে
তারপরো আমি চাই তুমি জীবনে অনেক বেশি
সুখী হও। কলরব ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ধীরে
ধীরে একটার পর একটা চোখের জল বিসর্জন
দিতে লাগলো। কলরবের প্রতিটা অশ্রু কুহুর ওড়নায়
যেন তীব্র বর্ষণ করছে। যে মানুষগুলো মন
খুলে হাসতে পারে,নিজের হাসির শব্দ ধ্বনি প্রতিধ্বনি
করে অন্যের মুখে খুশির ঝিলিক বয়ে আনতে
পারে তাঁরা বোধহয় এভাবেই নিরবে কাঁদে। বালিশ
ভিজে যায় কিন্তু কান্নাদের আত্মচিৎকার কেউ শুনে
না। কলরবের বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না
কিন্তু নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। তাই নিজের
শরীর আর মনের সঙ্গে লড়াই করে উঠলো।
ওযূ করে ঘরেই নামাজ পড়ে নিলো। মসজিদে
যাওয়ার মতন শক্তি যোগাড় করতে পারেনি সে। নামাজ
শেষে শরীরে আর মনে একটু জোর পেল।
কুহুর ওড়নাটা সাথে করে নিয়ে ছাদে চলে এলো
কলরব। রেলিং এর উপর ওড়নাটা রেখে বলল,
– থেঙ্ক ইউ সো মাচ ফুলটুশী। থেঙ্ক ইউ। ভাগ্যিস
সেদিন নাকের ডগার রাগটা ঝারতে চুড়িসহ ওড়না গুলো
ফেলে দিয়েছিলে। নাহয় এই সৌভাগ্যটুকু আল্লাহ্
আমার কপালে রাখতো না।
কলরব অবাক হয়ে খেয়াল করলো আজও জোছনা।
বাহ্ জোছনা আছে,চাঁদও আছে নেই শুধু ফুলটুশী।
কলরব দুদিকে মাথা নাড়লো তারপর নিজের মনকে
শুধরে নিয়ে বলল,
– উঁহু ফুলটুশী তো ঠিকই আছে আমার হৃদয়ের
ঘোলাটে চাঁদ হয়ে, বুকের মাঝে আটকে থাকা
দীর্ঘশ্বাস হয়ে।
কলরব এসব ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে
মোবাইল বের করে সবচেয়ে প্রিয় গানটা প্লে
করলো,।
“এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনের।”
কলরব কুহু কূজনের শুনতে পেতেই মোবাইলটা
ছু্ঁড়ে ফেলে দিলো। ছাদের রেলিং টপকে
মোবাইলটা চুড়চুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলো।
কলরবের হঠাৎ করে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, হাত পা
কাঁপছে অনবরত, দম আটকে আছে আর
চোখের সামনে কুহুর হাসিমুখটা ভাসছে।
চোখজোড়ায় অস্বাভাবিক জ্বালা করছে। কলরবের
খুব খুব বেশি পছন্দের গান এটা। কলরবের ইচ্ছা ছিল
বিয়ের রাতে কুহুকে নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে এই গানটা
শুনবে। আমাবস্যার রাত হলেও কলরব কুহুকে নিয়ে
সারারাত ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকতো। পাশে কুহুর মতন চাঁদ
থাকলে আকাশের চাঁদের কোনো প্রয়োজন
হতো না কলরবের। কতো কতো প্ল্যান ছিল। কুহুর
জন্য নিজ হাতে কফি বানিয়ে নিয়ে আসবে তারপর
দুজন একই মগে চুমুক দিয়ে কফির স্বাদ নিবে।
কুহুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে কুহুর চুলে উত্তপ্ত
নিঃশ্বাস ফেলবে। কুহুর নাকের নাক ঘঁষে বলবে,
– নাকের ডগায় এতো রাগ কেনো ?
কুহুর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে
কুহুর মনকাড়া জোড়াভ্রুগুলোর দিকে চেয়ে
থাকবে। আরো কতো কি! কলরব কথাগুলো
ভাবতে ভাবতেই আর্তনাদ করে বলল,
– আল্লাহু্ তুমি যদি আমার জীবনে বসন্ত নাই আসতে
দিলে তাহলে কুহুকে কেনো আসতে দিলে
জীবনে? কেনো আল্লাহ্ কেনো?
কলরবকে পিছন থেকে হঠাৎ কেউ জড়িয়ে
ধরলো। কলরব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ইরিন। কলরব
ইরিনকে টেনে এনে বুকের মাঝে শক্ত করে
জড়িয়ে ধরলো। ইরিন গলা খুলে গান ধরলো,
” তুমি আছো আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এদুটি প্রাণের
কুহু কূজনের।”
এতোটুকু গেয়ে ইরিন আর গাইতে পারলো না,
অঝরে কাঁদতে লাগলো।ইরিনের কান্নায় কলরবের
টিশার্ট ভিজে একাকার হতে লাগলো।
ইরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– ভাইয়া ইউ আর দ্যা বেস্ট টিচার ইন দ্যা গ্যালাক্সি।
ভাবীকে যা বুঝিয়েছো ভাবী তাই বুঝেছে।
কলরব হালকা হেসে বলল,
– টিচার নারে চিটার। তোর ভাবীর সাথে চিট করেছি
আমি ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছি,ওকে ফাঁদে
ফেলে জালে আটকেছি।
– ভাইয়া এমনটা তুমি কেনো করলে? আমার ভাবীকে
কেনো দূরে ঠেলে দিলে? ভাবীর
ভালোবাসাকে অপমান করেছো তুমি। আর
কেনোই বা আমার হবু ভাবীকে ভাবী হতে
দিলে না?
কলরব ইরিনকে বুক থেকে সরিয়ে বলল,
– তোর হবু ভাবী তোর ভাবী হয়েছে ঠিকই শুধু
হবু ভাবীর বরটা চেঞ্জ হয়ে গেছে।
– ভাইয়া কেনো করলে এমন? ভাবীকে এতো
কষ্ট দিলে কেনো?
– হ্যাঁ অনেক অপমান করেছি ফুলটুশীকে,ওর চরিত্র
নিয়ে কথা বলেছি এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি
কিন্তু আমি নিরুপায়রে। যে আকাশে ফুলটুশী আমার
সাথে তারা গুণতো সে আকাশে যে মেঘ জমে
গেছে।
ইরিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
– ভাবীকে আর যাই করো না কেনো ভাবীর
ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তোলা তোমার মোটেও
ঠিক হয়নি। ভাবী কি তোমায় সত্যি ভালোবাসেনি?
– ইয়েস শি ডু লাভ মি ইরিন। শি ডু লাভ মি। কুহু শুধুই
আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ওর রাতগুলো কেঁড়ে
নিয়ে আমি কি করে শান্তির ঘুম দিব? কেনোই বা
কষ্টঘেরা ছাদের নীচে বেঁচে কুহু ধীরে
ধীরে কু্ঁড়ে কুঁড়ে মরবে? তারচেয়ে সুখের
বারান্দায় তাকে ঢেলে দিয়েছি।
– ভাবীর মনে তুমি কি কষ্ট দিয়েছো তুমি নিজেও
বুঝতে পারবে না। আমি একটা মেয়ে তাই বুঝি।
– এই মৃত্যুপথযাত্রীর যে আর কিছুই করার ছিল না।
কলরব নীচে পড়ে থাকা রিপোর্টগুলো ইরিনের
হাতে দিয়ে বলল,
– আমার মেয়াদ তো সর্বোচ্চ আর দেড়মাস ইরিন।
কুহুকে বিয়ে করে ওকে সারাজীবনের জন্য বিধবা
করতে চাইনা। আমার ফুলটুশী ভালো থাকুক এটাই চাই।
ইরিন রিপোর্টগুলো ছু্ঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
– তা তো জানি ভাইয়া তাই তো তোমার কথা মতো সব
কাজ করেছি, কূজন ভাইয়া মা,বাবা সবাই তো আমরা তুমি যা
বলেছো তাই করেছি। কিন্তু তুমি আর যাই করো
ভাবীকে এভাবে অপমান না করলে পারতে। ভাবীর
মা,বাবা, বোন সবাই এখন ভাবীকে দোষারূপ করছে।
– ওরা যখন সত্যিটা জানবে তখন আর ভুল বুঝবে না।
আর কুহু অনেক জেদী মেয়ে ইরিন আর
আমাকেও পাগলের মতন ভালোবাসে। আমার
ক্যান্সারের কথা শুনেও সে আমাকেই বিয়ে
করতো আর সারাজীবন একা একাই কাটাতো।
কখনো আমাকে ভুলে নতুন কাউকে নিয়ে বাঁচতে
পারতো না।
– এখন বাঁচতে পারবে? আমার তো মনে হয়না।
তারপরো শুধু তোমার শেষ ইচ্ছা বলে সবাই
মেনে নিয়েছি। আমরা তো চাইনি তোমার সাথে
বিয়ে হোক। ঢাকা যাওয়ার পর যেদিনই জেনেছো
তোমার লাং ক্যানসার সেদিনই তো মা বাবা ভাবীদের
বাসায় সবটা বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে চেয়েছিল
কিন্তু তুমি দাওনি বলেছো কুহুকে আমি স্বপ্ন
দেখিয়েছি এখন কুহুর স্বপ্ন সত্যি করতে না
পারলেও দুঃস্বপ্ন হতে চাই না।
– ওকে সুখী করার দায়িত্ব আমি কূজনকে দিয়েছি
ইরিন। তোর কূজন ভাইয়া যে আমার থেকেও বেশি
ভালো,অনেক বেশি ভালো মানুষ। দেখিস কুহুর সব
কষ্ট ভুলিয়ে দিবে,কুহু একদিন আমাকে সত্যি ভুলে
যাবে।
– উঁহু কখনো ভুলবে না। ভালোবাসার পাশাপাশি ঘৃণা
করবে তোমাকে। কূজন ভাইয়ার সঙ্গে লাশ হয়ে
বেঁচে থাকবে।
– তাও বেঁচে থাকবে তো। আমাকে যাতে ঘৃণা
করে এজন্যই এতো কিছু করলাম। আমার চেয়ে
বেশি আমার ফুলটুশীকে কেউ চিনে না। আমি ওর
প্রতিটা দুর্বলতা খুব ভালো করে চিনি। কোথায় আঘাত
করলে সে কি রিএক্ট করবে তাও জানি। আমি এরকমটা
না করলে কুহু কোনোদিনই কূজনকে বিয়ে
করতো না।
ইরিন ভাইকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল,
– এতো ভালোবাসো আমার ভাবিকে?
কলরব ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,
– উঁহুম একটুখানি।
– ভাইয়া তুমি চলে গেলে আমাদের কি হবে?
– কিছু হবে না। মা বাবার জন্য তুই আছিস। ওদের
সামলাতে হবে।
ইরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আর আমি ভাই পাবো কোথায়?
– বোকা মেয়ে তোর কূজন ভাইয়া আছে না? তুই
তো সোনার হরিণ ওর।
ইরিন কষ্টে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। কাঁদতে
কাঁদতে দৌড়ে চলে যায়। ইরিন বেশ কয়েকদিন যাবত
এমন কষ্ট পেতে পেতে এখন আর টিকতে
পারছে না। আজ বিকেলে এতো বেশি কষ্ট
হয়েছিল যে হাসনাদ সাহেবকেও ইরিন সব বলে
দিয়েছে। ইরিন রুমের দরজা বন্ধ করে আর্ট খাতা
খুলে যে পৃষ্ঠায় কুহু আর কলরবের বিয়ের ছবি
এঁকেছিল সেটায় মাথা গুঁজে কাঁদছে আর সাহরা আর
ইফতেখার সাহেব একজন আরেকজনকে আঁকড়ে
ধরে। পিহু কাঁদছে পিহুদের ছাদের কোণায় বসে।
কুহুর কথা মনে পড়তেই পিহু আর ঘরে থাকতে
পারছিল না। শতো ভয় ভুলে সে ছাদে এসেছিল।
কুহু বলতো ছাদে এলে মন ভালো হয়ে যায় হালকা
লাগে নিজেকে। তাই কুহুর ট্রিকস মেনে মন
ভালো করতে এসেছিল। কিন্তু এখন মন ভালো
হওয়ার বদলে ভীষণভাবে খারাপ হয়ে গেছে। পিহু
এতো কান্না কোনোদিন করেনি। অঝরে কাঁদছে
সে। পিহু কখনোই কোনোকিছুতে এতো
কাঁদে না। খারাপ পরিস্হিতিতেও সে নির্লিপ্ত থাকে।
কিন্তু আজ নিজেকে সামলাতে পারছে না। ইরিনের
ছুঁড়ে দেয়া রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে পিহু
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কলরবের লাং ক্যান্সার। স্মল
সেল কার্সিনোমা অব লাং। দুই মাসের মধ্যে নিশ্চিত
মৃত্যু। প্রথমে ইরিন আর কলরবের কথোপকথন
শুনে পিহু হতভম্ব হয়েছিল আর যখন রিপোর্ট
গুলো দেখলো চোখের জল সব বাধা ভেঙে
গাল বেয়ে পড়ছে। পিহু বারবার চোখ মুছেও
কিছুতেই পানি আটকে রাখতে পারছে না,কিছুক্ষণ পর
পর চোখ আর গাল দুটোই ভিজে উঠছে। কলরব
জানে না পিহু যে পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে সব
শুনেছে। ইরিন চলে যেতেই কলরব কুহুর ওড়নাটা
নিয়ে হাতের সাথে প্যাঁচিয়ে বাঁধলো তারপর পা
বাড়ালো সিঁড়িঘরের দিকে।
পিহু ভয় পাবে তাই সাথে টর্চ নিয়ে এসেছিল।
কলরবদের ছাদে পিহু টর্চ মেরে বলল,
– দুলাভাই দাঁড়ান।
কলরব অবাক হয়ে পিছনে ফিরতেই দেখলো পিহু
ভেজা চোখজোড়া নিয়ে কলরবের দিকে
তাকিয়ে আছে। কলরব হেসে বলল,
– মৌটুশী তুমি এখানে? তোমার তো ভূতে ভয়।
– ভালোবাসতে আরো ভয়।
– তুমি আন্টিকে সবটা খুলে বলো। আর ফুলটুশীর
কোনো দোষ নেই। আমি ইচ্ছে করে ওকে
রাগিয়ে দিয়েছিলাম।
পিহু ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,
– বাঁচার কি কোনোই চান্স নেই?
কলরব গগনবিহারী হাসি হাসলো তারপর বলল,
– বাঁচতে যে আমারো ইচ্ছে করে কিন্তু
উপরওয়ালার সে ইচ্ছে নেই।
– গাধীটা সত্যি একজন খুব বেশি ভালো মানুষকে
ভালোবেসেছিল।
– আহা মৌটুশী তুমি এভাবে কাঁদলে তো চলবে না।
তোমাকে আগের মতন স্ট্রং থাকতে হবে।
ফুলটুশীকে যে সামলাতে হবে।
– আসলেই ভাইয়া আমি ভালোবেসে এতো ছং
করতে পারবো না কখনো।
কলরব ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
– দোয়া করি তুমি যেন ডাক্তার হতে পারো। এই
রোগীটা হয়তো কোনোদিনও তোমার চিকিৎসা
পাবে না তার আগেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাবে।
পিহু দাঁড়িয়ে ছিল। কলরবের কথা শুনে ছাদে বসে
কাঁদতে লাগলো। কলরব পিহুকে আরো বলল,
– আমার বাস্কেটবলটা কিন্তু তোমাকেই দিয়ে
গেলাম।
পিহু মুখ তুলে বলল,
– আপনি যদি আমার আপন ভাই হতেন তাহলে আপনাকে
জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতাম।
কলরব বলল,
– ইশ্ আমি যদি সত্যি তোমার দুলাভাই হতে পারতাম!
কথাটা বলেই কলরব ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি বেয়ে
রাস্তায় নেমে এলো। পিহু সেখানে বসে কাঁদতে
কাঁদতে বলল,
– আপুণি আমারি এতো কষ্ট হচ্ছে তুই শুনলে তো
মরেই যাবি।
…
কলরব রাস্তায় নেমেই বসে বসে হাঁটুতে হাত ভাঁজ
করে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগলো। চিৎকার করে
কাঁদছে কলরব। পকেট থেকে কুহুর ছবিটা বের
করে বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,
– কেনো তোমাকে নিজের করে পেলাম না?
কেনো?
কলরব চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালো
তারপর হাতে বেঁধে রাখা কুহুর ওড়নাটা দিয়ে চোখ
মুছে গলির রাস্তায় এলোমেলো পা ফেলতে
ফেলতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন আর চিৎকার
করে না কাঁদলেও চোখ দিয়ে পানি অনবরত
পড়ছেই। কলরব থামাচ্ছে না। এ যে অনেক দিনের
জমানো কষ্ট,আজ আর চেপে রাখবে না। জলকে
ভয় পেতে নেই, জল থেকে মানুষের উৎপত্তি,
পৃথিবীর চারভাগের তিন ভাগই জল। ভালোবাসা কি
জানতে চাইলে কলরব নির্দ্বিধায় বলবে,
“ভালোবাসার অপর নাম উত্তপ্ত দুটি হৃদপিণ্ড আর
অশ্রুভেজা দুটি নয়ন”
তাই কলরব আর কান্না থামাচ্ছে না। অবিরত কাঁদছে আর
হাতে পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা ওড়নাটা দিয়ে বারংবার
চোখ মুছে যাচ্ছে। হঠাৎ করে কেউ ওড়নাটায় টান
দিয়ে ধরতেই কলরব থমকে গেল। পাশে তাকিয়ে
দেখলো মণ্টি দাঁড়িয়ে আছে।
কলরব তাকাতেই মণ্টি বলল,
– আমি সত্যি বড় হয়ে তোমার মতন হবো।
কলরব ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– তুই আজো কি টাঙ্কির চিপায় দাঁড়িয়ে ছিলি নাকি?
মণ্টি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
– হ্যাঁ।
– পেকে গিয়েছিস।
– তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো?
– এই তো আমার আর কি? কয়দিন আর বাঁচবো একটু
প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে যাচ্ছি।
– আমিও আসি তোমার সাথে?
– আচ্ছা চল।
মণ্টি আর কলরব পাশাপাশি হাঁটছে। গলির মোড়ের মুদি
দোকানদার তিতাস কলরবকে দেখে দোকান
ছেড়ে ছুটে এলো।
কলরব তিতাসকে বলল,
– কি ব্যাপার মামা কি অবস্হা?
– হিরো তুমি তৈয়ব সাহেবের মাইয়াটারে বিয়া করলা না
কেন?
কলরব হেসে বলল,
– “চুপচাপ গুম হওয়া রং,
এও যে ভালোবাসার ঢং!”
তিতাস কিছু বুঝলো না, কলরব এগিয়ে চলল নিজের
পথে। মণ্টিও সাথে আসছে। দুজন হাঁটতে হাঁটতে
রেলস্টেশন এসে পড়েছে। তারপর প্লাটফর্ম
ছেড়ে রেললাইনে হাঁটতে লাগলো। চারিদিকে
কতো মানুষ যারা শীতের রাতে গরম কাপড় ছাড়াই
গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। শীতে কাঁপছে
থরথর করে। কলরবের কাছে একসময় এই
মানুষগুলোকে খুব বেশি অসহায় মনে হতো কিন্তু
আজ ওদের সুখী মনে হচ্ছে আর নিজেকে
নিঃস্ব। ওদের থরথর করে কাঁপুনী দেখে কলরব
মণ্টিকে বলল,
– মণ্টি জানিস ওরা যে শীতে কষ্ট পেয়ে কাঁদছে
তা বুঝা যাচ্ছে কিন্তু আমি যে কষ্ট পাচ্ছি, বুকের ভিতর
যে ভূমিকম্পন হচ্ছে তা দৃশ্যমান না।
মণ্টি কি বলবে ভেবে পেল না।
কলরব রেললাইনের পাতের উপর হাঁটতে লাগলো।
মণ্টিও কলরবের অনুসরণ করে অপর পাতটায় উঠে
হাঁটতে লাগলো। লাল আলো জ্বলতে দেখে
কলরব বলল,
– মণ্টি আমার লাইফেরও রেড সিগনাল জ্বলে
উঠেছে।
কলরবের আজ কূজনের বলা কয়েকটা লাইন মনে
পড়ছে। কলরব দুদিকে দু হাত ছড়িয়ে চাঁদটার দিকে
মুখ তুলে তাকালো। কলরব বুঝতে পারছে না চাঁদটা
ঘোলাটে নাকি তার চোখ জোড়া ঝাপসা। রহস্য
উন্মোচনে মন না দিয়ে কুহুর মতন আবৃতি করে
কলরব বলার চেষ্টা করলো,
“জোছনা কুড়াইয়ো না বন্ধু!
চোক্ষে ধইরা রাখো।
স্বপন দেইখো মোরে লইয়া!
ছুঁইতে নাহি চাইয়ো।”
…
কুহু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো রুমটা একবার
দেখলো। চারিদিকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। গাড়িটা
যখন কূজন কুটিরে ঢুকেছিল কুহুর তখন মনে
হয়েছিল একটা ছোটখাটো স্বর্গ নিজের চোখে
দেখছে। এতো আলিশান বাড়ি সে বাস্তবে
কখনো দেখেনি,টিভিতে দেখেছিল। লনটা
দেখে কুহুর চোখ জোড়া বিস্ময়ে পলক
ফেলতে পারছিল না। আর এখন কূজনের রুম দেখে
বিশ্বাসই করতে পারছে না এই ঘরটা এখন তার। কুহু
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে টেনে বেডের
কয়েকটা ফুল ছিঁড়লো। তারপর বিড়বিড় করে বলতে
লাগলো,
– আমার এসব কিচ্ছু চাই না শুধু কলরবকে চাই। কিচ্ছু চাই
না।
বলতে বলতে বেড সাইড টেবিলে থাকা সব জিনিশ
হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলো। ল্যাম্পশ্যাডটা
ভেঙে মেঝেতে পড়ে রইলো। কূজনের ছবি
থাকা ফ্রেমটাও পড়ে গেল মেঝেতে। কুহু চিৎকার
করে কাঁদতে কাঁদতে নিজের সারা শরীরে
খামচাতে লাগলো,গালে এলোপাথাড়ি মারতে
লাগলো। নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে
অস্বাভাবিকভাবে কাঁদতে লাগলো। সারাদিন কাঁদতে
কাঁদতে কুহুর গলা ভেঙে গেছে। ভাঙা গলায় একলা
বসে বসে বলছে,
– আমি দেখে নিব কলরব। তুমি কোন ফুলটুশীকে
বিয়ে করো দেখে নিব। ওই মেয়ের কাছ
থেকে আমাকে ভালোবাসা শিখতে হবে। তারপর
কূজনকে ফাঁসিয়ে আমি মরে যাব। ও আমার লাইফটা
শেষ করে দিয়েছে ওকে আমি ছাড়বো না।
ওকে ফাঁসিতে ঝুলাবোই নয়তো আমার নাম কুহু
আরিজা না। নাহ্ নয়তো আমি মিসেস রবিন ইবনে হাসনাদ
না। কুহু বিছানার বালিশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের
মতন বলছে,
– নাহ্ আমাকে তো মরলে চলবে না। আমি যতোই
মরে কূজনকে মৃত্যুর জন্য দায়ী করে দিয়ে যাই না
কেনো কূজনের বাবা টাকার জোরে কূজনকে
বাঁচিয়ে ফেলবে। আমি মরবো না কিন্তু বেঁচে
থেকে ওকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মেরে
ফেলব। কূজনের বাবা তো টাকার জোরে সব
করতে পারবে এমনকি আমার কলরবকে মেরেও
ফেলতো। তাই মরলে চলবে না। কূজনকে
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করো দিব,ওকে আমি আমার
চাকর বানাবো। মুহূর্তেরও বিন্দু বিন্দু ভাগে তাকে
জানান দিব আমি শুধু কলরবকে ভালোবাসি। তখন বুঝবে
ভালোবাসায় কতো কষ্ট। আমি নাকি ভালোবাসতে
জানি না। ভালোবাসা শুধু ওরা দুইভাই জানে। একটা পাগল
মরে যাবে তাই ওকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম আর
কিছুই না কলরব। আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি
তুমি বুঝো না কেনো? কে বলেছে আমি
তোমার কথা চিন্তা করিনি? কূজন যদি মরে যেত তখন
কূজনের বাবা তোমাকে কখনো ছাড়তো না কলরব
কখনো না। তোমাকে জানাইনি কারণ তুমি আমার কথা
হেসেই উড়িয়ে দিতে। পরিস্হিতি ঠাণ্ডা হলে, আমি
ভেবেছিলাম আমরা লুকিয় বিয়ে করে ফেলবো
কলরব। কূজনের অগোচরে তাহলে কূজনেরও
কিছু হলো না আর আমরাও এক হলাম। কি থেকে
হয়ে গেল? তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না কলরব?
আমাকে নিজের ভাইয়ের হাতে তুলে দিলে। এখন
তোমার ভাই আমাকে খুবলে খুবলে খাবে, আমার
উপর জোর খাটাবে কিন্তু বলে রাখলাম আমার মন
কখনোই পাবে না। আমি এজীবনে শুধু
তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম, কোনো
টাইমপাস ছিল না। কুহুর কান্না আর চিৎকার এ বাড়ির প্রতিটা
মানুষ শুনতে পাচ্ছে। কথাগুলো অস্পষ্ট কিন্তু
চিৎকারগুলো হৃদয়বিদারক। কূজন লিভিংরুমে বসে
আছে। সোফার সাথে হেলান দিয়ে কলরবের বলা
কথাগুলো বারবার মনে মনে আওড়াচ্ছে।
কুহুর কান্না আর চিৎকারগুলো কলরবের বুকে
তীরের মতো বিঁধছে। কলরবের কথা গুলো তাই
আরো বেশি করে আওড়াতে লাগলো।
“আমার সাজিয়ে দেওয়া পুতুলটা তোকে দিয়ে
গেলাম ওর দায়িত্ব তোর। আমার ফুলটুশীর চোখ
থেকে কখনো যেন নোনা জলের ফোঁয়ারা না
নামে। ফুলটুশীকে তো আমি সুখী করতে
পারলাম না সে যেন তোর বুকে মাথা রেখে
প্রশান্তি খু্ঁজে পায়।
কূজন প্রতিত্তোরে বলেছিল,
– ভাই তোমার ফুলটুশীকে তোমার মতো করে
আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না।
– তুই তোর মতো করে ভালোবাসবি। তুই
ফুলটুশীর জগৎ জুড়ে আঁকড়ে ধরে থাকবি। ওকে
এখান থেকে বহুদূর নিয়ে যাবি, তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট,
ভিসা ব্যবস্হা করে ফেলবি। আমার লাশ যেন
ফুলটুশীকে দেখতে না হয়। মেয়েটা তাহলে
মরে যাবে।
কূজন কলরবের কথায় হাউমাউ করে কেঁদে
দিয়েছিল। কলরব কূজনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
– তুই ভেঙে পড়লে কুহুর কি হবে?
– ভাই তুমি কুহুকে বিয়ে করে নাও। যখন তুমি থাকবে না
তখন আমি ওর হাত ধরবো,পাশে থাকবো।
– ফুলটুশীকে এখনো চিনিসনি। সে কখনো
তোকে পাশে দাঁড়াতে দিবে না। আমি বেঁচে থাকা
অবস্হায় ওকে তোর করে দিয়ে যাব। এখনো
ফুলটুশীকে চিনলি না!
– ভাই প্রমিজ তোমার ফুলটুশীকে আমি ভালো রাখার
চেষ্ট করবো। কখনো ওর হাত ছাঁড়বো না।
– শোন এইবারের জন্য ক্ষমা করলাম কিন্তু আর
কোনোদিন কুহুকে ফুলটুশী ডাকবি না।
– ভাই আমি তোমার ফুলটুশী বলেছিলাম।
– বলিস নারে বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। ওকে
শুধু আমিই ফুলটুশী ডাকবো আর কেউ না।
– মনে থাকবে ভাই।
– আরেকটা কথা রাখবি?
– বলো।
– আমার হয়ে ফুলটুশীকে একটা গান গেয়ে শুনাবি?
– অবশ্যই শুনাবো।
হাসনাদ সাহেব কূজনকে ঝাঁকুনি দিতেই কূজন বাস্তবে
ফিরে এলো। হাসনাদ সাহেব বললেন,
– কূজন যাও কুহুকে সামলাও মেয়েটা কষ্টে শেষ
হয়ে যাচ্ছে।
কূজন শেরওয়ানীর হাতায় চোখ মুছে চশমা পরে
বেডরুমের দিকে এগুলো। দরজা খোলার শব্দ
পেয়েই কুহু কলরবের আয়নাটা ব্যাগে রাখলো।
কূজনকে দেখা মাত্রই কুহু চিৎকার বন্ধ করে
জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। কূজন
মেঝেতে পড়ে থাকা বালিশ ভাঙ্গা ল্যাম্পশ্যাড
দেখে এগিয়ে গিয়ে ফটোফ্রেমটা তুললো।
ফ্রেমটা ভাঙেনি তাই জায়গায় রেখে তারপর গ্লাসে
পানি ঢেলে কুহুর দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। কুহু
নিলো না কূজন পাশে বসে কুহুকে জোর করে
পানিটা খাওয়ালো। কুহুর রাগে সারা শরীর জ্বলতে
লাগলো। চোখ রাঙিয়ে কূজনের দিকে তাকাতেই
কূজন বলল,
– কুহু চলো বারান্দায় বসি। সামনেই ফুলের বাগান মাতাল
করা গন্ধ আসে। তোমার ভালো লাগবে।
কুহু জায়গা থেকে নড়লো না। কূজন বলল,
– তোমার নিশ্চয় এখন আমার সাথে বিছানায় থাকার
চেয়ে বারান্দার দোলনায় বসে থাকতে বেশি
ভালো লাগবে।
কুহু নিঃশব্দে উঠে কূজনের আগেই বারান্দায় চলে
এলো। খোলা বারান্দা খুব সুন্দর! কুহু রেলিং এ হাত
রেখে দূরে তাকিয়ে রইলো। কূজন কুহুর পাশে
দাঁড়িয়ে বলল,
– কুহু চাঁদের আলোয় তোমাকে অনেক
মোহনীয় লাগছে।
কুহু নির্লিপ্ত। কূজন বলল,
– আমি যদি তোমার হাত ধরি তুমি কি সেদিনের মতো
রাগ করবে?
কুহু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। কূজন কুহুর পিছনে
দাঁড়িয়ে কুহুর দুইহাতে হাত রেখে কুহুর মাথায় চিবুক
রাখলো। কুহুর ইচ্ছে হলো কূজনকে ধাক্কা দিয়ে
নিচে ফেলে দিতে কিন্তু চাপা নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর
কিছুই করলো না। কূজন রেলিং থেকে কুহুর হাত
সরিয়ে এনে কুহুর হাতসহ কোমর পিছন থেকে
জড়িয়ে ধরলো। কূজনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব
করতেই কুহু অস্ফুট স্বরে বলল,
– আমি ভালোবাসতে জানি না তাই আমার কাছে থেকে
ভালোবাসা পেতে চাইবেন না।
কূজন মুচকি হেসে বলল,
– তুমি সবাইকে খুব বেশি ভালোবাসো। আর আমি
আগেও বলেছি,এখনো বলছি আর ভবিষতেও
বলবো আমার একার ভালোবাসা আমাদের দুজনের
জন্য যথেষ্ট।
কুহু কূজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তারপর
ঘুরে বলল,
– আমি কলরবকে ভালোবাসি।
কূজন কুহুকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে
ধরে বলল,
– একটা গান শুনাবো তোমাকে।
– ছাড়ুন আমাকে আমি কোনো গান শুনতে চাইনা।
কূজন ছাড়ার বদলে কুহুকে আঁকড়ে ধরলো। কুহু
কূজনের সঙ্গে হাজার জাপটাজাপটি করেও নিজেকে
কূজনের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে না পেরে
ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়লো। অনেক্ষণ পর
বলল,
– কলরব আমাকে বিশ্বাস করলো না কেনো?
ওকে আমি সত্যি ভালোবেসেছি। এই জীবনে
আমি শুধু কলরবকেই মন দিয়েছি। আমি ওর মায়া ভরা মুখটা
ভুলবো কি করে?
যে ছেলেটার হাসির মাঝে কষ্ট লুকাতাম তাকে ছাড়া
কীভাবে বাঁচবো আমি?
কূজন কুহুর কথার পৃষ্ঠে বলল,
– একটা গান শুনাই।
কূজন গান ধরলো,
“তুমি আয়না দেখো না
তুমি আয়না দেখো না
তুমি আমায় খুঁজো না
আয়নায় আমায় খুঁজো না
তুমি সইতে পারবে না
তুমি রইতে পারবে না
কিছু বলার থাকবে না
কিছু করার থাকবে না
ঐ আয়নায় যদি খুঁজে ফেরো তুমি আমাকে
তবে পুড়তে পুড়তে পুড়েই ফেলবে তুমি
তোমাকে”
কুহু হঠাৎ করে কূজনকে আঁকড়ে ধরে অঝরে
কাঁদতে লাগলো। কুহুর চোখের সামনে বারবার
কলরবের হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠছে। কূজনের
গান ছাপিয়েও কলরবের গগণবিহারী হাসিটা কানে
আসছে। কুহুর নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। কূজন
কুহুকে জড়িয়ে ধরেই পিছন দিকে যেতে লাগলো
আর একাধারে কিন্নর কণ্ঠে গাইতে লাগলো,
“তুমি আয়না দেখো না
তুমি আয়না দেখে না
তুমি আমায় খুঁজো না
আমাকে খুঁজলে পাবে না।”
কূজন পিছোতে পিছোতে দোলনায় বসলো।
কুহুকে টেনে নিজের কোলে বসালে। কুহু
ধাক্কা দিয়ে উঠে গেল। কিন্তু কূজন নাছোড়বান্দা।
কুহুকে জোর করে কোলে বসালো আর
গেয়ে চলল,
“একটার পরে একটা পুড়ছে আমার প্রিয় সুখ।
ধোয়া এখন হচ্ছে আপন
পুড়ছে রে এই বুক
তুমি আর ভেবো না আর খোঁজনা এই আমাকে
আমি এখন নষ্ট বড় তোমার অভাবে
ঐ আয়না দেখে অবাক হবে
ভাঙবে বোকা ঘুম
আমি হঠাৎ করে ঘুমিয়ে যাব
ভাঙবে না সেই ঘুম
আমার হারিয়ে যাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া কাঁদাবে তোমায় খুব
তোমার ঘুম হারানোর অসুখ হবে পুড়ে যাবে সব
সুখ।
তুমি আয়না দেখো না
তুমি আয়না দেখো না
তুমি আমায় খুঁজো না
আয়নায় আমায় খুঁজো না
তুমি সইতে পারবে না
তুমি রইতে পারবে না
কিছু বলার থাকবে না
কিছু করার থাকবে না”
কূজন গান শেষ করতেই দেখলো কুহু ঘুমিয়ে
পড়েছে। সারাদিন এতো ধকল যাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছে। কূজন ধীরে ধীরে কুহুর
হিজাব খুলে একে একে সব গয়নাগুলো খুলে
রাখলো। চুলের খোপাটাও খুলে দিলো।কুহুর চুল
গুলো পিঠ জোরে ছড়িয়ে পড়তেই কূজন বলল,
– ওহ্ মাই গড!
কুহুর চুলে হাত দিতেই কূজনের মনে হলো যেন
কূজন আর নিজের মাঝেই নেই। কুহুকে ঘুম
থেকে না জাগিয়ে পাঁজাকোলা করে রুমে নিয়ে
এসে শুইয়ে দিল। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত
দিয়ে সরিয়ে কুহুর জোড়াভ্রুগুলোর সন্ধিস্হানে
আলতো করে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
– তোমাকে ভালেবাসার অধিকার পাইনি কিন্তু দায়িত্ব
পেয়েছি।
কূজন সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে মলম বের
করে কুহুর হাতে লাগিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
– কুহু তুমি এভাবে নিজের ক্ষতি কেনো করছো?
তোমার প্রতিটা কষ্টের জন্য আমাকে জবাবদিহি
করতে হবে। তোমার কান্না দেখে
ভালোবেসেছিলাম জানতাম না সত্যি সত্যি কখনো
যে বিধির খেলায় আমাকে এই কান্না মুছার দায়িত্ব নিতে
হবে।
মলম লাগানোর সময় কুহুর হাতের মেহেদীতে
ইংরেজী অক্ষরে’ ‘কে’ লিখা দেখে দীর্ঘশ্বাস
ফেলল।
মলম লাগিয়ে কূজন লাইট অফ করে কুহুর পাশে শুয়ে
পড়লো। ঘুমন্ত কুহুকে কূজনের কাছে ডিম
লাইটের আলোয় অপ্সরী মনে হচ্ছে। কূজন
কিছুক্ষণ একনাগাড়ে কুহুকে দেখার পর কুহুর দিকে
ঝুঁকে কুহুর বুকে মাথা রাখলো। কুহু ঘুমের মাঝে
কূজনকে সরাতে চাইলো। কূজন মাথা উঠালো না। কুহুর
প্রতিটা স্পন্দন কূজন গুনছে। কূজন জানে সে কুহুর
বুকে মাথা রেখে জীবন কাটাতে পারবে কিন্তু
কুহুর হৃদপিণ্ডের ধুঁকপুকানিটা যে বারংবার কুহুরব কুহুরব
বলে ধুঁকপুঁক করছে। কূজনের চোখ থেকে পানি
গড়িয়ে কুহুর বুক ভিজতে লাগলো। কুহুর হুঁশ নেই
কুহু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কূজন ফিসফিস করে বলল,
“তোমার প্রভাতফেরীর শুভ সকাল,
রাতের খোলা জানালা,
বিকেলের পড়ন্ত রোদ,
কালবৈশাখী ঝড়,
সবটাই কি আমি?
নাকি শুধু ঠিক দুপুরের নির্জনতা?
বালিশ ভিজানো ঢুঁকড়ে কাঁদা?”
কখনো এই প্রশ্নটা তোমাকে করবো না
কুহু,কখনো না! তোমাকে শুধু একটুখানি হাসাতে
পারলেই চলবে আমার। তোমায় একটুখানি সুখী
করতে পারলেই আমি হবো পৃথিবীর সবচেয়ে
সুখী মানুষ,সবচেয়ে সুখী।
সমাপ্ত