এক গুচ্ছো কদম পর্বঃ১

0
5173

বাসরঘরে সদ্য বিবাহিত বউয়ের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে বর যে আত্নহত্যা করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতেই পারতাম না।

আচ্ছা বউ মেরে তো আত্নহত্যাার নাম দিচ্ছেনা?

আরেনা,,আমাদের হিমাদ্রি এরকম মেয়েই না।সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে।আজ পর্যন্ত কোন দোষ বের করতে পারবেনা কেও আমাদের হিমাদ্রির।

কিন্তু এখন তো লাগলো। বিয়ের দিনেই বিধবা হয়ে গেলো।তাও বাঁচা যে দুর্জয়ের বড় ভাবি ছিল তখন তা নয় এই মেয়েকে সবাই জেলের ভাত খাওয়াতো।

আসলেই মেয়েটা বাড়িতে পা ফেলতেই একটা মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসলো।সত্যিই মেয়েটা কুফা।

বিয়ের পরেরদিন। একটা মেয়ের জন্য অবশ্যই জীবনের অনেকগুলো সুখের দিনের মধ্যে একটি দিন।এইদিনে প্রথম নিজের বাড়ি রেখে নিজের অন্য একটা বাড়িতে সকাল শুরু হয়।নতুন জীবনের সূচনা ঘটে।কতো স্বপ্ন, কতো আশা তৈরী হয় এইদিনে।হিমাদ্রির ও ছিল।কিন্তু ওইযে অনেক ভারী একটা শব্দ নিয়তি!!এই শব্দটার কাছে সকলেই পুতুল।হিমাদ্রি ও তাই।

পরনে একটা রাণি গোলাপি কালারের শাড়ী।যা রাতে সুন্দর করে ভাবী পরিয়ে দিয়েছিল।চুলে যখন হালকা বাতাস লাগছে তখন একটা মৃদু রজনীগন্ধার ঘ্রাণ আসছে।যা বিষাক্ত লাগছে এই মূহুর্তে হিমাদ্রির কাছে।শাড়ীর আঁচলটা আরেকটু গুটিয়ে শরীরে জরিয়ে নিলো।কেমন যেনো বমি বমি পাচ্ছে তার।দূরে রাখা নিজের সদ্য বিবাহিত স্বামির লাশের দিকে আরেকবার তাঁকালো।এখান থেকে ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছেনা।আচ্ছা মানুষটা যখন গানের ট্রিগারে চাপ দিলো তখন কী তার ব্যাথা লাগেনি!!হয়তো লাগেনি।কী এমন কষ্ট ছিল তার যে আত্নহত্যা করতে হলো।

দেখেন আপনি বাবা। আপনার হয়তো নিজের ছেলের জন্য বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু তাও বলছি যদি কেও জানাজায় উপস্থিত হতে না চায় তাকে জোর করবেন না।কারণ ইসলামে বলা আছে আত্নহননকারীদের জানাজায় অংশগ্রহণ না করাই উত্তম।কিন্তু আপনি আমাদের শরীক।অনেক বিপদের দিনে আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন। তাই সে কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে আমরা সবাই জানাজায় অংশগ্রহণ করবো।

ধন্যবাদ আপনাদের।আমার ছেলেটা এমন কেনো করলো?জানেন ভাই ঠিক গতকাল এই সময়ে আমি আমার ছেলেটাকে নিজের হাতে খিচুড়ি মেখে খাইয়েছি।আর আজকে আমার সামনে ছেলেটা লাশ হয়ে পরে আছে।আমি তো বাঁচতে পারবোনা।আমার আব্বাটা একা কীভাবে থাকবো কবরে।

কথাগুলো মিনমিনে গলায় বললো দুর্জয়ের বাবা।শরীর কাঁপছে তার।কাঁপবে না কোনো?নিজের প্রাণপ্রিয় ছেলেটা যে আজকে লাশ হয়ে বাবার সামনে পরে আছে।

কথাগুলো শুনে একবার দাড়িতে হাত বুলালো ইমাম।তার নিজের যে খারাপ লাগছেনা তা নয়।কালকে সন্ধ্যায় নিজে দাড়িয়ে থেকে দুর্জয়ের বিয়ে দিয়েছে সে।আর আজকে দাড়িয়ে তার জানাজা পরবে।

ধৈর্য্য ধরুন ভাই।আল্লাহের ওপর ভরসা রাখেন।তিনি যা করেন সবার ভালোর জন্য করেন।আর সবসময় কুরআনের সেই আয়াতের কথা মনে রাখবেন।

“ইন্না মা’আল উছরি ইউছরা”(সুরা আল ইনশিরাহ, আয়াত ৬)

“নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে”

তো ধৈর্যের সাথে আল্লাহের কাছে নিজের সন্তানের মাগফেরাত কামনা করেন।কারণ আত্নহনন যে মহাপাপ!!

কাল রাত থেকে এ পর্যন্ত মিনিমাম দশবার জ্ঞান হাড়িয়েছে খান বাড়ির বড় বউ মেহেলতা।কোনভাবেই ঠিক রাখা যাচ্ছেনা তাকে।যখনি জ্ঞান ফিরছে চিৎকার চেচামেচি করে কান্নাকাটি করছে।

বউ নিজেকে সামলাও।বাড়ির বড় বউ তুমি।সবাইকে তুমি সামলে না রাখলে কে রাখবে বলো!!

আমার দুর্জয়টা কীভাবে আমার চোখের সামনে মরে গেলো আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।ঠিক আমার সামনে দিয়ে নিজের মরণের পথে পা বাড়ালো। যাওয়ার আগে জানেন আমাকে কী বলে,, যে ভাবী তুমি কেনো আমার মা হলেনা!আমার যে সন্তান ছিল ও।

মাটিতে গড়িয়ে পরে কান্না করছে মেহেলতা।ঠিক যেমন নিজের সন্তান মারা গেলে কোন মা আহাজারি করে।

নিজের স্বামীকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে কোনমতে উঠে তার সামনে গিয়ে দাড়ালো।চোখগুলো লাল হয়ে আছে বিজয়ের।পুরুষ মানুষ তাই চিৎকার করে কাঁদতে পারছেনা।নিজের কলিজার টুকরো ভাইটাকে আজকে কবরে রেখে আসবে।

দেখলে আমি আবার সন্তানহারা হয়ে গেলাম।আমি তো বন্ধ্যা। তোমাকে বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারলাম না।দেখো তাই আল্লাহ আমার ছেলের মতো দুর্জয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো।

স্ত্রীকে বলার মতো কোন ভাষা নেই তার।চুপ করে শুধু বুকের মধ্যে চেপে ধরলো।

শান্ত হও লতা।

আমি পারবো না।আমার দুর্জয়!

সে মারা গিয়েছে।আর এটা আমাদের মানতে হবে।ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দিন।

বিজয়ের নির্দেশ পেয়ে পাশ থেকে নার্স একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিলো মেহেলতার শরীরে।এটা না করলে কাঁদতে কাঁদতেই মরেই যাবে হয়তো মেয়েটা।

মা,তুমি না বললে কালকে যে আমার বিয়ে হয়েছে তো আমাকে সবসময় নাকফুল পরে থাকতে হবে।আমি কতো না করলাম। তাও পরালে তাহলে এখন খুলে নিচ্ছো কেনো??

মেয়ের এই কথায় আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করে দিলো সাজেদা। নিজের হাতে মেয়েকে বিধবার বেশে সাজাচ্ছে সে।এটা হয়তো পৃথিবীর কোন মায়ের কাম্য হতে পারেনা।

জোর করে হিমাদ্রি গোসল দেওয়ালো সাজেদা।শাড়ী, গয়না সব খুলে একটা সাদা শাড়ী পরালো।হাত ভর্তি টকটকে লাল মেহেদী যা দেখেই বুঝা যায় এটা একটা সদ্য বিবাহিত মেয়ের হাত।কিন্তু পরনে তার সাদা শাড়ী যা বিধবা হওয়াকে নির্দেশ করে।এরকম হাত ভর্তি মেহেদী কিন্তু পরনে সাদা শাড়ী তা পৃথিবীর যে কোন মর্মান্তিক দৃশ্যকে হার মানাবে।

ধরে ধরে হিমাদ্রিকে দুর্জয়ের লাশের কাছে নিয়ে গেলো সবাই।শেষ দেখা দেখাতে।মেয়েটা কেনো জানি ঠিকমতো কাঁদছে না।হয়তো অধিক শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে।

স্বামীর লাশটা কিছুসময় অবলোকন করে গেলো হিমাদ্রি।পোস্ট মর্টেম করা হয়েছে।একটু একটু ফুলে ফুলে গিয়েছে।তার বিশ্বাসই হলোনা এটা সেই মানুষ যাকে কালকে কবুল বলেছে।আস্তে করে মাটিতে বসে পরলো।তাকে সেভাবেই কিছুটা দূরে টেনে নিলো তার ভাবী।হিমাদ্রির সামনে দিয়ে তার স্বামিকে চিরতরে নিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই।

এ পৃথিবীর সবথেকে কষ্ট হলো সেই ব্যাক্তির যার কাঁধে নিজের সন্তানের লাশ।নিজের আদরের ছোট ছেলের লাশ যে তাকে একদিন নিজ কাঁধে বহন করতে হবে তা হয়তো সে স্বপ্নেও ভেবেছিলো না।মানুষের জীবন এমনি যা সে চায়না সেটাই আগে হয় তার জীবনে।অনেক দূর্বল লাগছে।খাটিয়ারা সে ধরে রাখতে পারছেনা।মনে হচ্ছে হাজার কেজি ওজনের।হঠাৎ কিছুটা হাল্কা অনুভব হলো তার।ঘার ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাঁকিয়ে যে মানুষটিকে দেখলো তাকে দেখে নিজের কান্না আর ধরে রাখতে পারলো না।ছোট বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো।এটা যে তার আরেক কলিজার টুকরো।মৃদুল!আজকে প্রায় চার বছর পরে দেখলো।অন্যসময় হলে হয়তো কথাও বলতো না।কিন্তু এখন বুকে জরিয়ে ধরতে মন চাচ্ছে।কিন্ত নিরুপায় তার কাঁধে আরেক ছেলের লাশ।

বাবা কেঁদো না।আমি এসেছি।

আমার বাবাটা যে মরে গেলো মৃদুল।

নিজের বাবার মুখে এই কথাটা শুনে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় মানুষ লাগছে।তারপর বাবাকে সামলে কালেমা উচ্চারণ করতে করতে নিজের ভাইকে কবরে রাখতে চললো সে।

এতোকিছুর পরেও প্রশ্ন আসে সে মা কই যার সন্তানকে কবরে রেখে আসছে সবাই।সে আছে।কিন্তু অসার।সে মা টা জানতেও পারলো না তার অতি আদরের সন্তানকে সবাই শেষ বিদায় দিচ্ছে।

চলবে,,

#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ১
লিখাঃ সামিয়া খান

বিঃদ্রঃএক পর্ব পড়ে কেও বিবেচনা করবেন না যে এটা কষ্টের গল্প।এখানে ট্রাজেডি,কমেডি,লাভ,রোমান্স সব থাকবে।আর কেমন হলো বলবেন।

হ্যাপি রিডিং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here