এক গুচ্ছো কদম পর্বঃ২৬

0
1608

#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ২৬
লিখাঃসামিয়া খান

কাঁচ-ঘেরা রুমে বসে আছে মৃদুল।অফিসের মধ্যে এটা তার নিজস্ব কক্ষ।অফিস ডেক্সের থেকে উল্টো ঘুরিয়ে বসলেই কাঁচের ভিতর থেকে পুরো দৃশ্য দেখা যায়।সেটাই এতক্ষণ ধরে অবলোকন করেছে চলেছে মৃদুল।হিমাদ্রি কথা কয়দিন ধরে তার বড্ড মনে পড়ে।এরকম লাগতো তখন যখন হিমাদ্রি কেবল তাকে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল।

ল্যান্ড লাইনের বিকট আওয়াজে হুঁশ ফিরে মৃদুলের।বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলে অপরপাশ থেকে রিসিপশনের মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো।

“স্যার,আপনার সাথে কেও একজন দেখা করতে এসেছে।”

“এপোয়েন্টমেন্ট ছিল তার?”

“নো স্যার।”

“কোনো নাম বলেছে নিজের।”

“জ্বী।ভদ্রলোকের নাম আহনাফ হাসান।”

আহনাফের নাম শুনে তব্দা খেলো মৃদুল।নিজেকে সামলে বলল,

“যে এসেছে তাকে সস্মানের সহিত ভিতরে পাঠিয়ে দেও।”

“ওকে স্যার।”

ফোন রেখে রিসিপশনের মেয়েটি আহনাফের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। মুখে একটা অমায়িক হাসি এনে আহনাফকে বলল,

“স্যারের কেবিনটা থার্ড ফ্লোরে গিয়ে একদম কর্নারে।আপনার যদি যেতে সমস্যা হয় তো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

“নো মিস.।আই ক্যান ম্যানেজ।এন্ড থ্যাংকস ফর দ্যা ইনফরমেশন। ”

আহনাফ এসেছে এটা শোনার পর থেকেই বেশ প্যানিক হচ্ছে মৃদুলের।আজ প্রায় দুই বছর ওর এভাবে একা আহনাফের সাথে বসে কথা বলবে।যে মানুষের সাথে দেখা করার জন্য মৃদুল আজ এত নার্ভাস ফিল করছে, সে মানুষটার সাথেই ছোট থেকে চলাচল করেছে। কিন্তু একটা ঝড় এসে সব শেষ করে দিয়েছে।

দরজায় টোকা পড়ার শব্দে নড়েচড়ে বসলো মৃদুল।ঢোক গিলে নিজের কণ্ঠস্বর যতোটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রেখে আহনাফে ভিতরে আসতে বলল।

ভিতরে প্রবেশ করতেই আহনাফের শরীরে এসির ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগলো।কিন্তু তার কাছে এ হাওয়া প্রশান্তির নয় বরং বেশ বিরক্তির কারণ।অজানা কারণেই আহনাফ কখনো এসির বাতাস সহ্য করতে পারেনা। তা যতো গরম পরুক না কেনো।

মৃদুল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রিমোট নিয়ে এসিটা অফ করে দিলো।

“বসার জন্য কি পারমিশন লাগবে আমার?”

“তোর কি তা মনে হয় আহনাফ?”

“না আবার লাগতেও পারে।তুই তো এখন আর সে মৃদুল নয় যার সাথে আমি এক সিগারেট ভাগাভাগি করে খেয়েছি।”

কথাটা বলে আহনাফ মৃদুলের সামনের চেয়ারে বসলো।পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে।রুমটা একবার দেখেই মৃদু হাসলো।কারণ রুমের প্রত্যেকটা জিনিস হিমাদ্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে।

“আমি সেই আগের মৃদুলই রয়েছি।শুধু তোদের দেখার পার্থক্য চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে।”

আগের সেই মৃদুল থাকলে নিজের হিমকে নিজের কাছে নিয়ে আসছিস না কেনো?”

আহনাফের করা প্রশ্নে থমথমে গলায় উত্তর দেয় মৃদুল,

“আমি চাইলেই তো নিয়ে আসতে পারিনা?সে যদি না আসে?”

“মৃদ তুই হিমকে চিনিস না?ও কিন্তু নরম মনের মানুষ না।মেন্টালিটি প্রচুর স্ট্রং।সাথে আত্নসস্মান ও বেশী। এজন্য তুই যখন বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলি, আর থাকেনি একদম চলে গিয়েছে।”

“আমি কি ওকে একবারও বলেছিলাম যে হিম তুই চলে যা?শুধু বলেছিলাম হিম তুই এখান থেকে যা।এই একটা কথায় ও একবারে আমাকে ছেড়ে দেশান্তরে চলে গেলো।”

“আমার বোনের আরো একটা গুণ আছে।তা হলো মেয়েটা বডড অভিমানী।সেই ছোটবেলা থেকে তোর সঙ্গ কামনা করে এসেছে।একসময় সেই ইচ্ছেটা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।আবার যখন সেই বাসনাটা মনের সুপ্ত অবস্থা থেকে অঙ্কুরদগম হওয়া শুরু করলো!ঠিক তখুনি একটা দমকা হাওয়া এসে তাকে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো।”

“আমি নিরুপায় ছিলাম।মায়ের মনে এমন ধারণা তৈরী হয়েছিলো যে আমাদের পরিবারের যতো ঝামেলা তা হিমের জন্য শুরু হয়েছে।এজন্য হিমকে সহ্য করতে পারতো না।আমি ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসার পর যখন শুনলো আমি হিমকে বিয়ে করবো ঠিক তখুনি তার ভিতর জ্বলে উঠলো।”

“আর সেই আগুন দিয়ে আমার বোনকে পুড়ালো।”

“হয়তো।গরম দুধ ঢেলে দিয়েছিলো ওর উপর মা। কিছুটা নিজের উপরেও যাতে সে সবাইকে বিশ্বাস করাতেও পারে হিম তাকে পুড়াতে চেয়েছে।কিন্তু আফসোস কেও বিশ্বাস করেনি।এটা তাকে আরো এগ্রেসিভ করে তুলে।এমনিতেও কেবল প্যারালাইসিস থেকে ঠিক হয়েছিলো তার মধ্যে এরকম তার জন্য মারাত্নক ছিলো।হাজার হোক সে আমার মায়ের জায়গা নিয়েছে।এজন্য যাতে তার ক্ষতি নয় হয় আর হিমও যেনো ঠিক থাকে সেজন্যই বলেছিলাম ওকে সেখান থেকে যেতে।এর উল্টো মিনিং বের করবে হিম তা আমি একবারোও ভাবিনি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহনাফ প্রশ্ন করলো মৃদুলকে।

“অয়েত্রীর কি খবর?”

“ভালো।”

“ও আর বিয়ে করছে না কেনো?”

“মা করতে দিচ্ছেনা।মায়ের ধারানা আজ নয় কাল আমি ঠিকই অয়েত্রীকে বিয়ে করবো।”

“আমার বোনকে এখনো ভালোবাসিস?”

“ভালো তো আগে থেকেই বাসতাম।কিন্তু বুঝতে পারি এখন। আমার রোম রোমে হিম বসবাস করে।”

“তাহলে আমার বোনকে ফিরিয়ে নিয়ে আস।ওকে শুধু একবার কোমল সুরে ডাক দে ও মানা করতে পারবেনা।”

“আমিও আমার প্রেয়সীকে ফেরত নিয়ে আসার চিন্তা করেছি।ঠিক দুদিন পরে আমি আর মাদিহা আমেরিকা যাচ্ছি।মাদিহা তার মায়ের জন্য আর আমি আমার প্রেয়সীর জন্য।”

“আমি এটাই বলতে এসেছিলাম।”

উচ্ছাসে আহনাফ গিয়ে মৃদুলকে জরিয়ে ধরলো।মৃদুলও কতোকাল পড়ে নিজের প্রাণের বন্ধুকে কাছে পেলো।

“সৃষ্টি কেমন আছে আহনাফ?আর আমার দুই বাবা?”

“সবাই ভালো আছে।বিশ্বাস কর দুটোই ঠিক দুর্জয়ের কার্বন কপি।”

“আর সৃষ্টি?”

“সেও ভালো আছে।আসলে সৃষ্টি ছিলো ঠিক কাঁদামাটির মতো।আমি ওকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছি।এবং সেও আমার সংসারে চিনির মতো মিশে গিয়েছে।”
,
,
,

লেকের পাশে বসে আছে হিমাদ্রি। তার হাতে একটা ডায়েরী।এটা সেই ডায়েরী যেটা হিমাদ্রি দুর্জয়ের মৃত্যুর পর পেয়েছিলো।যখুনি সে শুন্যতায় বা দ্বীধায় ভুগে তখুনি সে দুর্জয় কথাগুলো পড়ে।এবং তা বারংবার।

“জানিস হিমাদ্রি?আমার ছোটবেলায় মৃদ ভাইয়ার উপর বড্ড ঘৃণা কাজ করতো।সাত বছর বয়সে শুনতে পাই মৃদ ভাইয়া আমার বায়োলজিক্যাল ভাই নয়।তখন থেকেই মা,বাবা যদি মৃদ ভাইয়াকে আদর বা ভালোবাসা দিতো তখন প্রচুর রাগ হতো।রুমে বসে বসে কাঁদতাম।এমনও দিন গিয়েছে যে আমি হুট করে মৃদ ভাইয়াকে মেরেছি।তখন আমার বয়স কম দেখে মৃদ ভাইয়া কিছু বলতো না।হয়তো ভাবতো ছোট্ট বাচ্চা।কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলে মৃদ ভাইয়া বুঝতে পারে তার প্রতি আমার একরাশ ঘৃণা।এই ঘৃণার বসেই আমি মা,বাবাকে মৃদ ভাইয়ার থেকে দূরে সরাতে থাকি।তা হয় রাগ করে,জিদ দেখিয়ে,নয়তো কান্নাকাটি করে।এমনকি নিজের ক্ষতিও করে।তখন থেকে মৃদ ভাই নিজেকে আমাদের থেকে গুটিয়ে নেওয়া শুরু করলো।একা একা থাকতো।শুধু তোর সাথে আর আহনাফ ভাইয়ের সাথে মিশতো।মাঝেমধ্যে দেখতাম ছাঁদে গিয়ে একা বসে বসে কাঁদতো।আর আমি তা দেখে মজা নিতাম।একদিন হুট করেই মজার ছলে আমি মৃদ ভাইয়ার শরীরে কাঁটা কম্পাস বিধিয়ে দেই।মনে আছে তো এই ঘটনাটা।আর তুই কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমার গালে ঠাশ ঠাশ কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলি।সেদিন থেকে আমার শত্রুর তালিকায় আরো একটা নাম যুক্ত হলো” হিমাদ্রী”।

মৃদ ভাইয়াকে যখন বাড়ী থেকে বের করে দেওয়া হলো তখন আমি প্রচুর খুশী হয়েছিলাম।কিন্তু পরক্ষণেই শুনতে পেলাম তোর সাথে আমার বিয়ে।আমি তোকে তখনো প্রচুর ঘৃণা করতাম এর জন্যই এমন করতাম।কিন্তু যখন তোর সান্নিধ্যে লাভ করলাম।তোর উপর আলাদা মুগ্ধতা কাজ করলো।

এটুকু পড়ে থামলো হিমাদ্রি। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রুকে একবার মুছে নিয়ে আবার পড়া শুরু করলো।

“ভার্সিটিতে থাকতে প্রচুর ঘুরতাম আমি।আর রোজ রোজ দামী রেস্তোরাতে যেতাম।এমনি একদিন রেস্তোরা থেকে দামী খাবার খেয়ে বের হচ্ছিলাম।হঠাৎ তখন রাস্তার পাশে টং দোকানের দিকে নজর গেলো।মৃদ ভাইয়া বসে আছে।পড়নে ময়লা শার্ট,প্যান্ট।চুল,দাড়ি অনেকদিন ধরে হয়তো কামায় না।আমি রাস্তা পার হয়ে গেলাম কিছু কথাতো তাকে একটু হেয় করতে।কিন্তু তার থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে দেখতে পেলাম মানুষটা পকেট থেকে টাকা বের করছে।এবং সব টাকা বের করার পর দেখলাম তার কাছে খুচরো কিছু টাকা ছাড়া কিছু ছিলনা।এবং তা দিয়েই দুটো পাউরুটি কীনে,টং দোকান থেকে এক কাপ চা কীনে তা গোগ্রাসে খেতে লাগলো।মনে হয় সারাদিন অভুক্ত ছিলো।হুট করেই আমার কেনো জানি বড্ড মায়া হলো তার উপর।দুনিয়াতে আপন বলতে আমরা ছাড়া কেও ছিলাম না।আমরাও লাত্থি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।সেদিন আর কথা হয়নি। চা খেয়ে যখন নিজের ক্ষয় যাওয়া জুতা পায়ে হেঁটে গেলো মৃদ ভাই আমার মনে হলো আমার কলিজা চলে যাচ্ছে।ঠিক সেদিনই আমি দেখতে পাই রোদসী তার চকচকে জামা,জুতো পড়ে আহাদের সাথে দিব্যি ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।”

এর থেকে বেশী কখনো পড়েনা হিমাদ্রি। কেনো যেনো এটুকু পড়ে তার বড্ড কাঁদতে মন চায়।মানুষটা তখন কতোটা কষ্টে ছিলো।অথচ ওদের কাওকে জানতে পর্যন্ত দেয়নি।

ডায়েরিটা অফ করে হিমাদ্রি ব্রেঞ্চের উপরে রাখলো।প্রচন্ড বুকটা ফাঁকা লাগছে।লেকের দিকে তাঁকিয়ে দেখে অনেকগুলো রাজহাঁস তাদের স্বমহীমায় লেকে সাঁতার কাঁটছে।সেদিকে তাঁকিয়ে হিমাদ্রি বিড়বিড় করে বলল,

“আর কতো অপেক্ষা মৃদ?”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here