এক গুচ্ছো কদম পর্বঃ২

0
2560

#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ২
লিখাঃসামিয়া খান

একজন সদ্য বিধবা হওয়া নারী যার স্বামী প্রয়াত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে তার স্বামির বড় ভাইয়ের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমানোটা আপাত দৃষ্টিতে সবার খারাপ লাগলেও তা এই দুই পরিবারে কেও তা আমলে নিচ্ছেনা।

হিমাদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মৃদুল।আর হিমাদ্রি পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু সে যে মৃদুলের কোলে মাথা দিয়ে আছে তা জানেনা।মৃদুলের বড় অদ্ভুৎ লাগছে ব্যাপারটা।আসলে সময় প্রবাহমান একটা নদীর মতো।কোনদিক দিয়ে যায় তা বুঝায় যায় না।এইতো মনে হয় সেদিনের কথা যেদিন ছোট হিমাদ্রিকে জোর করে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিল মৃদুল।

মৃদুলের দাদার আমল থেকে তারা এই এলাকায় থাকে।দুটো জেনারশন গিয়ে এটা তাদের থার্ড জেনারেশন। সে হিসেবে এলাকায় তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী। কারন তাদের অনেকগুলো ধানের মিল ও সারের কারখানা রয়েছে।মূলত এটা একটা মফস্বল শহর।

মৃদুলের যখন পাঁচ বছর একদিন সে বাড়ির বাহিরে তার বন্ধুদের সাথে খেলা করছিল। খেলা চলাকালীন সময় তার সমবয়সের একটা ছেলে সেখানে উপস্থিত হয়।কোলে তার খুব সুন্দর একটা এক বছরের শিশু।বাচ্চাটাকে দেখা মাত্রই মৃদুল দৌড়ে তার সামনে যায়।

এই পুতুলটা তোমার?এটাকে একটু কোলে দিবে আমাকে । আমি দেখবো।

না! এটা পুতুল না।ও আমার বোন।আমি দিবোনা।

দেওনা কীহবে?আমি তোমাকে অনেকগুলো রসগোল্লা খাওয়াবো।

আমি দিবোনা।এটা আমার বোন।।

মৃদুল ছোটবেলা থেকে অনেকটা একরোখা মনোভাবের ছিল।কোনকিছু যদি তার পছন্দ হয় তো তার সেটা নিতেই হবে পারলে কেড়ে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনা।এখনও হলো তাই।জোর করে আহনাফের কোল থেকে ছোট্ট হিমাদ্রিকে কেড়ে নিয়ে এক দৌড় দিয়ে নিজের বাড়িতে এসে পরলো।

বাগানে বসে তখন মৃদুলের মা বিজয়কে পড়াশোনা করাচ্ছিল।হুট করে মৃদুল একটা ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হলো।অনেকটা হকচকিয়ে গেলো সে।

এটা কার বাচ্চা নিয়ে এসেছিস মৃদ!

দেখো মা কী সুন্দর পরির মতো পুতুল। জানো মা এটা না নড়াচড়া করে।আর খুব নরম তুলতুলে।একবার ধরে দেখো।জানো তো ওই ছেলেটা দিতে চাচ্ছিল না এই পুতুলটা কেড়ে নিয়ে এসেছি।

নিজের পাঁচ বছরের ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বোকাবনে গেলো মৃদুলের মা।কিছু বলতে যাবে এমন সময় বাড়িতে বেশ হট্টগোল শোনা গেলো।একটা মহিলা একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে চেঁচামেচি করতে করতে ঢুকছে।তার সাথে আরোও অনেক মানুষ আছে।সাথে আসা বাচ্চাটা কেঁদে চলেছে।মৃদুলের মার বুঝতে বাকী রইলো না এরা কারা।

অনেক বোঝানোর পরে হিমাদ্রির মা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।বেশ একটা হুল্লোড় পরে গিয়েছিল।

আমার ছেলে তো ছোট তাই বুঝেনি।

বুঝতে পেরেছি ভাবি।দেখি বাবু আমার মেয়েকে দেও তো।

না আমি দিবোনা।এটা আমার ছোট্ট পরী পুতুল। এটা আমার।

না এটা আমার বোন।দেও বলেছি।

হিমাদ্রির ভাই আহনাফ জোর করে হিমাদ্রিকে নিতে গেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠে মৃদুল।কোনভাবেই সে হিমাদ্রিকে দিবেনা।

আচ্ছা বাবু দিতে হবেনা।কিন্তু একটু পরে দিয়ে দিও।হিমাদ্রি তো তোমার বোনের মতো।
বোন কথাটা শুনে আরোও কান্না করে দিলো মৃদুল।ছোট্ট হিমাদ্রি তার ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে অবাক হয়ে তা দেখতে লাগলো।
এটা আমার বোন না পরি পুতুল।

হেসে দিলো হিমাদ্রির মা।
আচ্ছা তোমার পুতুল।এখন রাখো কিন্তু একটু পরে দিয়ে দিও আর যখন মন চাবে তখন গিয়ে দেখে আসবে।নাক টানতে টানতে মৃদুল জবাব দিলো,,

সত্যি তো।

হুম,, সত্যি।

কথাটা শুনে অনেক খুশী হলো মৃদুল।হিমাদ্রিকে বুকে জরিয়ে নিলো।এক বছরের হিমাদ্রি কী বুঝলো কে জানে।তার ছোট ছোট হাত দিয়ে সেও মৃদুলকে জরিয়ে ধরলো।

ঘটনাগুলো অতীত।কিন্তু তা আজোও কতটা দৃশ্যমান এবং সতেজ।এগুলো মনে করলে মনটা যেনো প্রশান্তিতে ভরে যায়।হিমাদ্রি এখনোও ঘুমাচ্ছে।ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আঙুল চালিয়ে দিলো মৃদুল হিমাদ্রির চুলের গভীরে।

বাইরে থেকে বেশ জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না করার শব্দ ভেসে আসছে। প্রথম মৃদুল মনে করেছিল মেহেলতা কান্না করছে।কিন্তু পরে বুঝতে পারলো এটা একটা অপরিচিত গলার স্বর।

এই আঁখি কে কান্না করে রে?
বলতে পারলাম না মৃদ ভাইয়া।দাড়াও দেখে আসছি।

আঁখি মূলত মৃদের মামাতো বোন।তাদের এখানে থেকে পড়ালেখা করে।একটু পরে আঁখি হন্তদন্ত হয়ে মৃদুলের সামনে এসে দাড়ালো।

কী হয়েছে রে আঁখি?

মৃদ ভাইয়া দেখে যাও।বাইরে কী হচ্ছে।কথাটা শুনে চিন্তায় পরে গেলো মৃদুল।আস্তে করে হিমাদ্রির মাথাটা সোফায় বালিশের ওপর রেখে বাইরে গেলো ঘটনাটা কী বুঝতে।

একটা উনিশ-বিশ বছরের মেয়ে মাটিতে পরে কান্না করছে আর প্রলাপ বকছে।মেয়েটা বেশী সম্ভব পোয়াতী।পাশে একটা বৃদ্ধ মহিলা বসে মেয়েটাকে সামলাচ্ছে।দুজনের পরনেই জীর্ণ শীর্ণ কাপড়।তাদের দিকে একবার দেখে মৃদুল এগিয়ে গেলো তার বাবার কাছে।

বাবা কী হয়েছে?আর ইনি কে?

জানিনা তো মৃদ।
বাবার কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে এগিয়ে গেলো সেই মেয়ের কাছে।মেয়েটার সামনে বসে পরলো মৃদুল।

তুমি কে? আর কান্না করছো কেনো?

মৃদুলের প্রশ্ন শুনে মেয়েটা মৃদুলের মুখের দিকে তাকালো।

আপনি মৃদ ভাইয়া না?

হুম।তুমি কে?

আমি দুর্জয়ের বউ।

কথাটা শুনে সেখানে প্রত্যেকটা মানুষ হতবিহ্বল হয়ে গেলো।নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিলো মৃদুল।

তুমি যা বলছো তো ভেবে বলছো?

হুম। আমার কাছে প্রমাণ আছে।

বলে কতোগুলো ছবি সহ।কাবিনমা এগিয়ে দিলো পাশের মহিলাটি।সব পরিক্ষা করে বুঝতে পারলো যে মেয়েটা সত্যি কথা বলছে।

আচ্ছা সব কথা পরে হবে আগে তুমি উঠো।

না আমি কোথাও যাবোনা।আমার দুর্জয়কে এনে দেন।আমার সন্তানের বাবা ও।আমার মতো যে আমার বাচ্চাটাও এতিম হয়ে গেলো।

তুমি এতিম?

হ্যাঁ তার জন্যই তো সব সমস্যা।

মানে বুঝলাম না।

আমার আর দুর্জয়ের দুই বছরের ভালোবাসা ছিল।আমি মূলত একটা অনাথআলয়ে থাকি।গত পাঁচ মাস আগে আমরা বিয়ে করি।কিন্তু ও আপনাদের কাওকে বলতে পারছিলনা কারন আমার কোন পরিচয় নেই।কালকে ওর বিয়ে ছিল। ও তো কালকে অন্য কারো সাথে কবুল বলার সময়ই মরে গিয়েছে।আমার সাথে কালকে শেষ কথা বলেছে।শুধু এটুকুই বলেছে বাবুকে দেখে রেখো।আর আজকে ওর মরার খবর এসেছে।

বলে আবার কান্নায় ফেটে পরলো মেয়েটি। কারোও বুঝতে বাকী রইলো না দুর্জয় কেনো আত্নহত্যা করেছে।

তার মানে আমার জন্য মরেছে সে! আমি খুনী তার।

পিছন থেকে একথাগুলো শুনে মৃদুল ঘার ঘুরিয়ে দেখে হিমাদ্রি দাড়িয়ে আছে।প্রায় দৌড়ে হিমাদ্রির কাছে যায় মৃদুল।

না তুই খুন করবি কেনো রে হিম।দুর্জয় আত্নহত্যা করেছে।

না মৃদ আমার জন্য মরেছে।আমি মেরেছি তাকে।

বলে চিৎকার করে উঠলো হিমাদ্রি। এতোসময় পর মনে হয় ভিতরে দলা পাকিয়ে থাকা কষ্ট গুলো উপচে বের হয়ে আসছে।

না হিম তুই কিছু করিস নি।তুই তো আর কিছু জানতি না।

মৃদুলের বুকের দিকের শার্ট খামচে ধরলো হিমাদ্রি।

মৃদ আমি কেনো তার সাথে এ বিষয়ে কথা বললাম না।একবার কী জিজ্ঞেস করতে পারলাম না যে সে বিয়েতে রাজী কিনা!তাহলে তো আর এতোকিছু হতো না।

আর কিছু বলতে পারলো না হিমাদ্রি।ব্রেনে এতো চাপ সহ্য করতে পারলো না।মৃদুলের বুকে ঢলে পরলো।

হিমাদ্রির বাবা একটা ছোটখাটো ব্যবসায়ী।হয়তো অঢেল টাকা পয়সা নেই তার কিন্তু পরিবারে সুখ আছে।তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে সে। কিন্তু তার অতি আদরের মেয়েটা বিয়ের দিনেই বিধবা হয়ে গেলো।কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

দুইদিন ধরে কিছুই খাচ্ছেন না আপনি হিমের বাবা। একটু তো খেয়ে নেন।

আমার হিমের জীবনটা তো শেষ হয়ে গেলো হিমের মা।

স্বামির মুখে এমন কথা শুনে কান্না করে দিলো হিমাদ্রির মা।

জানিনা আমার মেয়েটার কীহবে!কিন্তু মৃদ এসে পরেছে আর কোন চিন্তা নেই।আমার হিমের কোন খারাপ হতে দিবেনা মৃদ।

জানি গো হিমের মা।আমার মেয়েটা খেয়েছে?

হ্যাঁ খেয়েছে। মৃদ খাইয়ে দিয়েছে।এখন আপনি একটু খেয়ে নেন।

বলে প্লেটে খাবার বেরে দিলো।মুখের সামনে ভাতের একটা গ্রাস তুলে নিলো হিমাদ্রির বাবা।কিন্তু খেতে পারলো না।ভাতটুকু প্লেটে রেখে। ফতুয়ার হাতাতে চোখগুলো মুছে নিলো।সব বাবার কাছে তার মেয়ে রাজকন্যা হয়না এটা যেমন ঠিক তেমনি কিছু কিছু বাবা আছে যাদের কাছে তার মেয়ে মুক্তার মতো দামী।

পানের খিলি মুখে দিয়ে হিমাদ্রির বড় ফুফু তার ভাইয়ের সামনে বসলো।

এতো ঢঙ কীসের আমি বুঝতে পারলাম না।মেয়ের জামাই মরেছে তো কী হয়েছে? মেয়ে তো বেঁচে আছে তাইনা।এখন ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দে।

বুবু তুমি যা বলছো ভেবে বলছো তো।

মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো মহিলা,,
তুই যা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলিস না।আমি বলি কী হিমাদ্রির সাথে আমার বড় ছেলের বিয়ে করিয়ে দে।যদিও ওর বয়স বেশী তাও কী আমার ছেলে লাখে একটা।

বুবু তুমি এগুলো কী বলো?

আমি ঠিক বলছি হিম এখনো একদম ঠিক আছে।একেবারে আনকোরা।আমার ছেলের সাথে জমবে ভালো।

বলে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো মহিলা।

হাসি শেষ হলে বাড়ির বাইরে যাওয়ার পথ ওটা যেতে পারেন।

ভদ্রতা বলতে কিছু শিখিস নেই তাইনা আহনাফ।

অনেক শিখেছি কিন্তু তোমার মতো মানুষদের সাথে ভদ্রতা আসেনা।

বেয়াদব কোধাকার।

আমি না আপনি?আমার বোন কোন পণ্য না যে আপনার ওই নেশাখোর ছেলের কাছে দিতে হবে।

দেখলি তোর ছেলে কতো বেয়াদব।

ও ঠিক বলেছে বুবু।

হ্যাঁ তাইতো বলবে।দেখলাম তো কতো ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছিলি।আর কে বলবে ওই ছেলে হয়তো বিয়ের আগে তোর বোনের সাথেও থেকেছে।

চুপ।আপনার মতো অভদ্র মহিলা যেনো আর না আসে এই বাড়িতে।লাগবে না এরকম বাজে মেন্টালিটির আত্নীয় আমাদের।ফিরে এসে যেনো আপনাকে বাড়িতে না দেখি।

কথাগুলো রাগে গজরাতে গজরাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো আহনাফ।

আহনাফের যখনি রাগ উঠে তখন সে হিমাদ্রির কাছে যায়।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকে বুকে একটা মোচর দিয়ে উঠলো আহনাফের।সৃষ্টি!হ্যাঁ দুর্জয়ের আরেক বউয়ের নাম সৃষ্টি।মেয়েটাকে চিনে আহনাফ। চিনবে না কেনো তার ভালোবাসা যে সে। আটমাস আগে এক মধুর বিকেলে দেখেই প্রেমে পরে গিয়েছিলো।পরে অনেকবার প্রেমের প্রস্তাব দিলেও আহনাফকে প্রত্যাখান করে দিয়েছে।বারবার প্রত্যাখান করার কারণে অনেকটা রাগ করে আহনাফ তিনমাস কোন খবর নেয়নি।তিনমাস পরে কালকে দেখেছে তাও আবার নিজের বোনের সতীনরুপে। সত্যি জীবনটা বড় নিষ্ঠুর।

মেহেলতা সৃষ্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে।খাবার মুখে দিয়ে আহনাফের দিকে নজর গেলো সৃষ্টির।একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো সৃষ্টি।দৃশ্যটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিমাদ্রির রুমের দিকে এগিয়ে চললো আহনাফ।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here