#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ২৪
লিখাঃসামিয়া খান
সূর্যাস্ত হতে আর মাত্র কিছু সময় বাকী।আকাশের রঙটা এখন ঠিক ডিমের কুসুম এর মতো হয়ে আছে।ঠিক খানিকটা কমলা এবং হলুদের মিশেল।মৃদুমন্দ হালকা বাতাস।হিমাদ্রি এবং ভৌমিক অন্য একটা শহরে এসেছে।সেদিন গাড়ীতে ভৌমিক নিজেকে বিবাহিত দাবি করার পর আর একটাও কথা বলেনি হিমাদ্রির সাথে।ঐদিনের পর থেকে অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।শীত চলে গিয়েছে।যদিও এখনো বেশ ঠান্ডা। কিন্তু তুষার পরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।ভৌমিক আজকে হিমাদ্রিকে বেশ দূরে লং ড্রাইভে নিয়ে এসেছে।
পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছে হিমাদ্রির।খুব বেশী নিরব না হলেও রোজ জীবনের একঘেয়েমিয়তা থেকে দূর হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
“মিস.হিমাদ্রি Las Vegas ঘুরতে যাবেন এই সামারে?”
“হঠাৎ Las Vegas? ”
“এমনি।জানেন Las Vegas কে পাপের শহর বলা হয়।”
“হুম জানি তো।এমন কোনো পাপ নেই যা Las Vegas এ হয়না।ক্যাসিনো,বার, ব্রোথেল দিয়ে জমজমাট শহর হলো Las Vegas.”
“আমি অনেকবার গিয়েছি Las Vegas সিটিতে।এমনকি আমি ওখানকার অনেক ব্রোথেলেও গিয়েছি।”
“সিরিয়াসলি!”
“ইয়েস।কিন্তু শরীরকে স্যাটিসফাইড করতেনা।আমার ভালো লাগতো।জানেন মিস. তাদের মধ্যে অনেকে নিজ ইচ্ছায় একাজে যুক্ত হয়নি।কেও হয়তো জন্ম থেকে হয়েছে,কেও অভাবে আবার কেও স্বভাবে।”
“তা অবশ্য ঠিক।”
“তাদের মধ্যে অনেক মিশুক ব্যাক্তিও আছে।এভা নামের একটা মেয়ে আছে যার সাথে আমার বেশ ভালো পরিচয়।আমি প্রত্যেক সামারে Las Vegas এ যাই।এবং এবারোও যাবো।আমার সাথে যাবেন?”
“কিন্তু সামার আসতে তো এখনো অনেকসময়!”
“যখন আসবে তখন যাবেন কীনা?”
“ওকে ট্রাই করবো।”
“এজ ইওর উইস মিস।”
তারপর বেশ কিছু সময় দুজনেই চুপ করে আশেপাশের পরিবেশ উপভোগ করতে থাকলো।হঠাৎ ভৌমিকের একটা কথায় চমকে যায় হিমাদ্রি।
“আমার জন্ম কলকাতার এক পঁচা গলিতে হয়েছে।”
“মানে?”
“আই ওয়াজ বর্ন ইন এ ব্রোথেল।মাই মম ওয়াজ এ প্রস্টিটিউট।”
হিমাদ্রি খেয়াল করলো প্রস্টিটিউট কথাটা বলার সময় ভৌমিকের স্বরটা বেশ কিছুটা কেঁপে উঠলো।সে বুঝতে পারছেনা ভৌমিকের এই কথার পরিপেক্ষিতে কি বলবে।হিমাদ্রি কিছু বলার আগেই ভৌমিক আবার বলা শুরু করলো।
“আমার মা জন্মগতভাবে পতিতা ছিলো না।অনেক ছোট বয়সে আমার ঠাকুরদা মারা যায়,এবং জন্ম দিতে গিয়ে আমার ঠাম্মি।আমার মা ছাড়া তাদের আরো দুটো বড় বড় ছেলে ছিলো।এবং তারা বিবাহিতও ছিলো।যখন তাদের বাবা মা মারা যায় তখন আমার মার বয়স ছিলো নয় বছর।আমার মায়ের দ্বায়িত্ব কেও নিতে চায়নি।একদিন আমার বড় মামার সাথে বড় মামী প্রচুর ঝগড়া করে কারণ তাদের অভাবের সংসার ছিলো।এতো অভাবে আরেকটা মুখের আহার জুটানো তাদের জন্য বোঝা বৈকি কিছু ছিলোনা।তাই তারা আমার মা কে বিক্রি করে দেয়।এতে দুটো লাভ হয়েছিলো।ভরণপোষণের ভারও চলে গেলো আবার কিছু টাকা পেলেও তারা।লাভের উপর লাভ বলতে গেলে।নয় বছরের ছোট মেয়ে পতিতালয় কী তা আর কতোটুকু জানতো।সেই থেকে শুরু।মা বলতো প্রথম প্রথম পতিতালয়ের সর্দারনী অনেক আদর করতো।কিন্তু যেদিন থেকে মান্থলি স্টার্ট হলো সেদিন থেকে বিহেভিয়ার চেঞ্জ হওয়া শুরু করলো।মাত্র তের বছর বয়সে অসহনীয় চিৎকার দ্বারা মায়ের নরক জীবনে প্রবেশ হয়।সেই থেকে শুরু।মায়ের যখন আঠার বছর বয়স তখন একদিন বিদেশী কিছু লোক আসে ব্রোথেলে।তাদের মধ্যে একটা যুবক এসেছিলো।নাম ছিলো টমাস।সবগুলো মেয়েদের বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল। কারণ পছন্দ হলে চড়া দাম দিয়ে কিনবে।আমার মা ও তাদের মধ্যে একজন ছিলো।আমি শুনেছি আমার মা দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো।তাই ওখানকার উপস্থিত সকলের বেশ পছন্দ হয়।তাদের মধ্যে টমাসও ছিলো।উচ্চ দামে মাকে সে কিনে নেয়।তারপর থেকেই টমাসের সেখানে যাতায়াত বেড়ে গেলো।সে মূলত মায়ের কাছেই যেতো।এক সময় তারা গভীর প্রেমে আবদ্ধ হয়ে পরে।বেশ সাবললিল ভাবেই তাদের প্রেম চলতে থাকে।টমাস মা কে অনেক স্বপ্ন দেখায়।বিয়ে করার, আমেরিকাতে নিয়ে যাওয়ার।
কেও হয়তো বন্দি জীবন চায়না।তেমনি আমার মায়েরও মুক্তির ইচ্ছা ছিলো।হুট করেই একদিন টমাস আসা বাদ দিয়ে দিলো।মা ভাবলো হয়তো কিছুদিনের জন্য আসছেনা কিন্তু আবার এসে পরবে।কিন্তু মা ভুল ছিলো।টমাস আর আসেনি।এদিকে মায়ের গর্ভে আমি চলে আসি।মা নিশ্চিত ছিলো যে আমি টমাসের সন্তান।ব্রোথেলে তখনকার সর্দারনী মা কে অনেক ভালোবাসতো।তাই গর্ভস্থায় আমার মাকে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো।ঠিক তার সাত মাস পরে আমি দুনিয়াতে আসলাম।আর আমার হতভাগী মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলো।ঠিক তার মায়ের মতো।”
ভৌমিক কিছু সময়ের জন্য কথা বলা থামালো।সন্ধ্যা নেমে আসছে।হাল্কা হাল্কা আলো এখনো বিদ্যমান।সেই আলোতে হিমাদ্রি দেখতে পেলে ভৌমিকের চোখে কার্নিশ বেয়ে অশ্রু চিক চিক করে পরছে।
“টমাসের কি হলো?টমাস আর আসেনি?”
“এসেছিলো।মায়ের মৃত্যুর ঠিক তিন মাস পরে।আসলে সে আমেরিকাতে ফিরে গিয়েছিলো।এবং তার বাগদত্তাকে বিয়েও করেছিলো।”
“তারপর কী হলো?”
“মায়ের মৃত্যুর সংবাদ তাকে একটুও বিচলিত করলো না।বরং এমন দেখালো সে এ বিষয় সম্পর্কে জানতো।এবং আমাকে দাবি করে বসলো।আমার যেহেতু কেও ছিলোনা তো সর্দারনী আমার ভালো ভবিষ্যতের জন্য দিয়েও দিলো।এবং টমাস আমাকে আমেরিকাতে নিয়ে আসে।”
“তার স্ত্রী তাকে কিছু বলেনা?”
“নাহ।কারণ মম লিন্ডা ছিলো ইনফার্টেল।এজন্যই মূলত টমাস আমাকে সাথে করে নিয়ে আসে।”
“ওহ।আপনি আপনার বাবাকে টমাস বলে ডাকেন?”
“আগে ড্যাড বলে ডাকতাম।কিন্তু পনের বছর বয়সে আমার নামে ইন্ডিয়া থেকে একটা লেটার আসে।লেটারটা ছিলো বাংলায়।ছোট থেকে আমেরিকাতে বড় হওয়া মানুষ অবশ্যই বাংলা পারবেনা।লেটারের মর্মদ্ধার করার জন্য আমি বাংলা ভাষা সম্পর্কে অবগত এমন একজনের শরনাপন্ন হলাম।লেটারটা ছিলো আমার মা যে ব্রোথালে ছিলো তার সর্দারনির।সে আমাকে একবার দেখতে চেয়েছে।মরণাপন্ন অবস্থা তার।আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ অপরিচিত ব্যাক্তি আমাকে কেনো দেখতে চাইবে।”
“আপনি গিয়েছিলেন তার সাথে দেখা করতে?”
“হুম।কিন্তু তা লুকিয়ে। মম লিন্ডার সিস্টারের সাথে।টমাসকে যখন লেটারের কথা বলি তখন সে আমাকে অনেক বকা দেয়।এবং যাওয়ার জন্য জেদ করলে তিনদিনের জন্য বাড়ীতে গ্রাউন্ডেড করে দেয়।আমিও তখন টমাসকে ভয় পেতাম তাই আর যাওয়ার জিদ করিনি।কিন্তু হঠাৎ এক রাতে মম লিন্ডা তার সিস্টার লিনাকে দিয়ে আমাকে ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেয়।মম লিন্ডা আসলেই একজন ভালো মানুষ।হয়তো সে চেয়েছে আমি আমার আসল মা কে চিনি।”
“এখানে আসার পর সেই ব্রোথালে গিয়েছিলেন?”
“ইয়েস লিনা আন্টি আমাকে নিয়ে যায়।ওখানে যাওয়ার পর আমি অবাক হয়ে যাই যে এরকম জায়গার একটা মানুষ হঠাৎ আমাকে কেনো দেখতে চাইলো।”
“সেই সর্দারনি তখনো জীবিত ছিলো?”
“হ্যাঁ।এবং তার কাছ থেকেই আমি আমার মা সম্পর্কে জানতে পারি।সবকিছু জানার পর এক তীব্র ঘৃণা আমার মনে জন্ম নেয়।সবার প্রতি।আমার বড় মামী একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে পতিতালয়ে বিক্রি করতে সাহায্য করে।আর ভাই হয়ে বড় মামা কীভাবে করলো এই কাজ নিজের বোনের সাথে।মায়ের তো আরেকটা ভাই ছিলো সেও এ বিষয়ে নির্বাক ছিলো।টমাসের প্রতি যে আমার মা কে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছিলো।শুধুমাত্র স্ত্রী কখনো মা হতে পারবেনা বলে আমাকে তার প্রয়োজন হলে।যদি তা না হতো তাহলে কোন নালার মধ্যে আমি পরে থাকতাম তার খবরও নিতো না।আর পুরো এই বেশ্যাবৃত্তির সিস্টেমটা।এটা কে প্রথম প্রচলন করেছিলো তা জানিনা।কিন্তু অবশ্যই যদি পৃথিবীতে একটামাত্র মানুষ যে ঠিক নর্দমার কীটের মতো হয়তো সে ব্যাক্তি হবে।”
“আপনি টমাসের কাছে কোনো জবাবদিহি চাননি?”
“আমি এগুলো জানার পরে আর আমেরিকাতে ফিরে যায়নি আমি।টমাসকে আমি মাফ করতে পারিনি।দীর্ঘ তিন বছর কলকাতাতে থাকি।এ সময়ে আমি বাংলা ভাষা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করি। আমি একা থাকবো দেখে মম লিন্ডা আমার সাথে থাকতে আসে।এই একটা মানুষ যে নির্দোষ ছিলো।কয়েকদিন পর আমার মায়ের ভাইদের আমি খুঁজে বের করি।জানেন মিস.তারা তখন যথেষ্ট প্রভাবশালী মানুষ।অথচ আমার মায়ের জীবনের সব থেকে বড় সর্বনাশকারী এরা।”
“তাদের নিজের পরিচয় দেননি?”
“নাহ।এবং প্রতিশোধও নেয়নি।কারণ আমি জানতাম প্রকৃতি ঠিক প্রতিশোধ নিবে।এবং নিয়েছেও।”
“তারপর কী হলো?”
“ইন্ডিয়াতে থাকতে একদিন খবর আসলো টমাস আত্নহত্যা করেছে।ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের গলায় নিজেই ক্ষুর চালিয়ে দিয়েছে।হয়তো আত্নগ্লানি বা অন্যকিছু।মম লিন্ডার সাথে তখন আমি আমেরিকাতে ফিরে আসি।হয়তো যার সাথে দ্বন্দ ছিলো সেই মানুষটা নেই। তার জন্য আমি বিনা সংকোচে ফিরে আসলাম।ছোট বেলায় বুঝতাম না কেনো আমার নাম অন্যসব আমেরিকানদের মতো না।কারণ ভৌমিক নামটা আমার মা আমার জন্য ঠিক করে রেখে গিয়েছিলো।”
“ওহ।আমার হয়তো আপনাকে সমবেদনা জানানোর জন্য কোনো ভাষা নেই।”
“এখানে শেষ না কাহিনি।এই অতীতটা আমার বর্তমান বিষিয়ে তুলেছে।আমেরিকার ফিরে আসার দুই বছর পর মানে আমার বাইশ বছর বয়সে প্রথম দেখা হয় আমার জীবনের ভালোবাসার দেবীর সাথে।আমার প্রথম ভালোবাসা,আমার মেয়ে কুঞ্জনের মা আরাধ্যার সাথে।”
চলবে,,