এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৮

0
1201

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

১৮.

আয়নায় তাকিয়ে আছি আমি। আর আমার কাঁধে থুঁতনি রেখে আয়নায় ভেসে ওঠা আমাদের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে আছে শোয়েব। আজ প্রথমবারের মতো তার দিকে তাকাতে আমার কোনো সংকোচ হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে। বুকের মাঝে অজানা এক ভালো লাগার সুর তুলেছে।

কালো রঙের পাঞ্জাবি ফর্সা গায়ের সঙ্গে মিশে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মিলি হুট করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখ বন্ধ রেখে মনে মনে বললো,

— আপনাকে আমি ভুলে যেতে চাই শরৎ। আমার আকাশে এতদিন আপনি থাকলেও আজ আমার আমার শোয়েব নামক রৌদ্র এসেছে। তাকে আমি ভালোবাসি না। কিন্তু, ভালোবেসে আমৃত্যু পর্যন্ত সংসার করতে চাই। আজ একটি জিনিস ভেবে দেখলাম আমার মনের কল্পনার শরৎের সৌন্দর্যের সাথে শোয়েবের সৌন্দর্য টক্কর দিতে পারে। বলা যায় আপনি আমার জীবনে হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে এলেও। আমার ভাঙা হৃদয়ে শোয়েব বসন্ত নিয়ে এসেছে। মাফ করে দিবেন আমায়। আজ থেকে আমার মনের ঠিকানা থেকে আপনার কাছে আর কখনো আমার মনের কথা পৌঁছেবে না।

— কি বিড়বিড় করছো, মন? চলো সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

শোয়েব মিলির গালে চুমু দিয়ে বললো। মিলি নিজের ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে শোয়েবের চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে হাসি দিয়ে বললো,

— চলুন।

শোয়েব ওঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মিলি ডান হাত বাড়িয়ে দিলে শোয়েব খুব শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে।

ফ্ল্যাটের বাইরে এসেই শোয়েব মিলিকে কোলে তুলে নেয়। তারপর,লিফটে ঢুকে পরে। মিলি চুপ করে শোয়েবের বুকে মাথা এলিয়ে রেখেছে।
নিচতলায় এসে লিফট খুলতেই শোয়েব মিলিকে নিয়ে এগিয়ে যায় ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ির দিকে। গাড়িতে আগে থেকেই বসে আছে ইরাবতী। মিলিকে শোয়েবের কোলে দেখে ইরাবতী দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো,

— ভাই, তোমার বৌকে একটু হাঁটতে দিও। নয়তো তোমার কোলে থাকতে থাকতে আমার একমাত্র আদরের ভাবি হাঁটতে না ভুলে যায়।

শোয়েব মিলিকে গাড়ির সামনের সীটে বসিয়ে দিয়ে ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমি এই জন্যই বলি আব্বাকে বলে তোমার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করার দরকার। বিয়ে হলে এমনিতেই তোমার পাকা পাকা কথা ফুরুৎ করে আকাশে উড়াল দিত।

শোয়েবের কথা শুনে ইরাবতী চুপ হয় যায়। সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— কাছে এসো তো ভাবি। তোমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলি।

ইরাবতীর মুখ থেকে এই কথা শুনে শোয়েব মুচকি হেসে গাড়িতে ওঠে রওনা হয় কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্য।

সেন্টারে পৌঁছানোর পর একে একে সবাই এগিয়ে আসে নব দম্পত্তির মাঝে । মিলি খেয়াল করে দেখলো ওর বাবা এবং দুইভাই এসেছে। মিলির দু’চোখে অশ্রু জমা কিন্তু ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। কালো লেহেঙ্গা দু-হাতে সামলে ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় নিজের বাবা-ভাইয়ের দিকে। মাহতাব সাহেব নিজের একমাত্র কন্যাকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। বাবার পেছনে পেছনে দুই ভাইও এগিয়ে যায়। মিলি ওর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কান্নারত কন্ঠে সালাম দিয়ে বললো,

— বাবা, আই মিস ইউ। আই মিস ইউ অল।

মাহতাব সাহেব মেয়েকে একপাশে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন,

— আই অলসো মিস ইউ, আম্মাজান।

এমনসময় পেছন থেকে দুইভাই এসে মিলিকে জড়িয়ে ধরলো। মিলি হেসে দুই ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন রকমের কথা বলতে লাগল।

দূরে দাঁড়িয়ে মিলিকে হাসিমুখে দেখে শোয়েবের ভালো লাগে। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ করে মিলি এবং ওর পরিবার যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এগিয়ে যায় শোয়েব। মিলির বাবাকে সালাম দিয়ে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে। মিলির দুইভাইকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মিলি পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে শোয়েবের দিকে। এই যে শোয়েব কত সহজে ওর পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের সঙ্গে কত সহজে কথা বলছে। কই মিলি যে পারে না শোয়েবের পরিবারের সাথে কথা বলতে!

এমনসময় ফটোসেশান শুরু হয়। তাই শোয়েব মিলির হাত ধরে এগিয়ে যায় হরেক রকম ফুল দিয়ে সাজানো স্টেজের দিকে। নানান ভঙ্গিতে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলতে হচ্ছে নবদম্পতির। একসময় ফটোগ্রাফার অনুরোধ করলো। মিলি যেন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে আর শোয়েব মিলির মুখের দিকে।

ঠিক সেভাবে ছবি তোলা হলো। এবং ফটোগ্রাফারদের ভাষ্যমতে শোয়েব এবং মিলির সবকটা ছবির থেকে এই ছবিটি চমৎকার হয়েছে।

ছবি তোলা শেষ হলে মিলি সোফায় বসে পড়ে। শোয়েব একপাশে যেয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেন অনবরত কল করতে থাকে । কিন্তু, ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি কল রিসিভ করছে না। তাই শোয়েব একপ্রকার মন খারাপ করে মিলির পাশে গিয়ে বসে। মিলি শোয়েবকে কিছু প্রশ্ন করবে তার আগে পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

—- আকাশ থেকে টুপ করে পরে যাওয়া এক টুকরো চাঁদকে নিয়ে তুই বসে আছিস, শোয়েব! আই কান্ট বিলিভ দিস! তোর মতো গাঁধার বৌ হবে একটা গাঁধি। বাট তুই দেখি আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছিস!

শোয়েব মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে ওর প্রাণপ্রিয় বন্ধু সাইফ এসেছে। শোয়েব একগাল হেসে ওঠে দাঁড়িয়ে সাইফকে জড়িয়ে ধরলো। সাইফ মুচকি হেসে শোয়েবকে জরিয়ে ধরে।

আশেপাশে থাকা উপস্থিত সকলেই দুই বন্ধুর মধুর মিলন দেখে আবেগে আপ্লূত হয়। মিলি বেশ খুশি হয় কারণ শোয়েব খুশি তাই।

দুইবন্ধু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছে আর মিলি পাশে বসে থাকায় সবটাই শুনছে। এমনসময় শোয়েবকে ওর বাবা শাফায়াত আহমেদ ডাক দেয় তাই শোয়েব সেখানেই ছুটে যায়। মিলি বসে বসে অপেক্ষা করছে শোয়েবের জন্য। সাইফ কিছু সময় পর মিলির থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে পড়ে। মিলি আরেকটু সরে বসে। সাইফ একমিনিট সময় নিয়ে মিলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—শোয়েবের সাথে আপনার লাভ ম্যারেজ নাকি এ্যারেন্জ ম্যারেজ?

মিলি লজ্জা পাচ্ছে খুব। অচেনা একটা মানুষকে কী করে বলবে এই কথা! কিন্তু, উত্তর দেয়া তো প্রয়োজন।

— এক হিসেবে এ্যারেন্জ ম্যারেজ। কিন্তু,আপনার ফ্রেন্ড গত একমাস আগে উনার বোনের বিয়েতে আমাকে দেখে এবং তখন থেকে আমাকে প……

মিলি পুরো কথা সম্পন্ন করে না চুপ হয়ে যায়।
সাইফ আর কিছু না বলে সেখানে ওঠে চলে যায়। কিছু সময় পর শোয়েব এসে মিলিকে জিজ্ঞেস করে সাইফ কোথায় আছে? মিলি জানায় যে সে জানে না। তাই শোয়েব সাইফের কাছে কল দেয় কিন্তু নাম্বারে কল যাচ্ছে না। শোয়েব হাল ছেড়ে দেয়। কারণ, সাইফ এমনই হুটহাট কোথায় যে চলে যায় কেউই জানে না।

খুব ভালোভাবে রিসিপশন সম্পন্ন হয়। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শোয়েব-মিলি দম্পতি রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্য।

রাত নয়টার দিকে শোয়েবের ঢাকার ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছায় ওরা দুজন। রাতের খাবার তৈরি করতে হয়নি কারণ শোয়েবের মা মরিয়ম ওদের সঙ্গে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন। শোয়েব বা মিলি এখন কেউই খাবার খাবে না। শোয়েব মিলিকে একটা রুম দেখিয়ে বললো সেখানে যেয়ে ভারি কাপড় ছেড়ে সুতি শাড়ি পরতে। মিলি সুবোধ বালিকার ন্যায় মাথা নাড়িয়ে শোয়েবের কথা মতো সেই রুমে চলে যায়। দরজা লক করে ব্যাগ থেকে একটি লাল রঙের সুতি শাড়ি বের করে হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। তারপর, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে নেয়। মুখে কোনোপ্রকার প্রসাধনী ইউজ করেনি। ভেজা চুল ফ্যানের বাতাসে কোনোভাবে হালকা শুকিয়ে একপাশে সিঁথি করে রুম থেকে বের আসে।

কিন্তু, পুরো ঘর যে অন্ধকার হয়ে আছে। মিলি শোয়েবকে ডাকবে তার আগে শোয়েবের কন্ঠ শুনতে পায় মিলি। মিলির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে,

— দুটো চোখ বন্ধ করো আজ তোমায় ফুলের রাজ্যে নিয়ে যাব।

মিলি শোয়েবের ফিসফিসিয়ে কথার মানে বুঝতে পারে। নিজের শাড়ির আঁচলের কোণা শক্ত করে চেপে ধরে। শোয়েব মিলিকে কোলে তুলে নেয় আর মিলি দুটোচোখ বন্ধ করে শোয়েবের গলা জরিয়ে ধরে। শোয়েব মিলিকে নিয়ে ডানপাশের রুমটায় নিয়ে যায়। মিলি ঠিক তখনও শোয়েবের কোলে। শোয়েব রুমের লাইট অন করে মিলিকে বললো,

— চোখ খুলে তাকিয়ে দেখো তো, মন। এই ফুলের রাজ্য তোমার পছন্দ হয়েছে তো?

শোয়েবের কথা শুনে চোখ খুলে তাকায় মিলি। সাদা ফুলের সমারোহ পুরো রুম জুড়ে। সাদা গোলাপ, গন্ধরাজ আর লাল গোলাপের সংমিশ্রণে সাজানো হয়েছে ওদের ঘরটা।

দুই কদম এগিয়ে মিলিকে ফুলের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মিলির পাশে শুয়ে পড়ে শোয়েব। শোয়েব মিলির দিকে না তাকিয়ে বললো,

— আজ থেকে এই ঘরটা এভাবে সবসময় ফুল দিয়ে সাজানো থাকবে। তোমার আমার সংসার, ভালোবাসা সবটাই যেন এই পবিত্র ফুলদের উপস্থিতিতে হয়। মিলি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

এই প্রথমবার শোয়েবের মুখ থেকে অনুরোধ শব্দটা শুনতে পেলো মিলি। শোয়েবের চোখের দিকে তাকায় মিলি। মিলির চোখের ভাষা বুঝতে পারে শোয়েব।

— আমার পিঠে যদি তোমার দেয়া চাবুকের ঘা পরে আমি একটু কষ্ট বা ব্যথা পাব না। কারণ, আমি জানব যে এই কষ্ট আর ব্যাথা আমি আমার মনের কাছ থেকে পেয়েছি। কিন্তু, তোমার এই বাদামী দু-চোখে আমি বাদে অন্যকারো প্রতি ভালোবাসা দেখতে পারব না। যেদিন দেখতে পাব হয়তো সেদিন আমি বেঁচে থেকেও মরে যাব।

শোয়েবের কথা শুনে মিলির দুচোখ ভারি হয়ে আসে। কারণ, মিলির দুচোখে কেন মিলির হৃদয়ের অন্তরালে শরৎ নামক অচেনা মানুষটির বসবাস। মিলি শরৎ নামক মানুষটাকে ভুলতে চায়। অন্তত আজকের পর থেকে শোয়েবের সামনে যেন কখনো শরৎ নামক মানুষটির নাম বা কথা মিলির মনে না আসে। নয়তো মিলি যে শোয়েবের কথার মান রাখতে পারবে না।

—আমার চোখে তাকালে আপনি শুধু নিজেকেই দেখতে পাবেন অন্য কাউকে কখনোই দেখবেন না। কারণ, আপনি আমার স্বামী। ভালোবেসে বিয়েটা না হোক আমাদের কিন্তু আল্লাহর তকদির ফয়সালায় আমি আর আপনি এখন একজোড়ায়, একই খাঁচায় বিয়ে নামক সম্পর্কে বন্দী।

কিন্তু, কে জানত মিলির শোয়েবকে দেয়া এই কথা কখনোই রাখতে পারবে না। বরং, শোয়েবকে কষ্ট দেয় মানুষটা মিলি নিজেই হবে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here