এক শহর ভালোবাসা’ পর্ব-৩

0
2270

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৩
#সুরাইয়া_নাজিফা

শান ভাইয়া রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে আছে আর আমি ওনার সামনে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আর শাড়ীর আঁচল নিয়ে মুছড়া মুছড়ি করছি। ইতিমধ্যে আমার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। কিছু বলছেও না করছেও না।যেমন ঝড় আসার আগে পরিবেশ গুমোট থাকে তেমনটা।কিছু বললে হয়তো আন্দাজ করতে পারতাম কতটুকু শুনেছে।বাট সে তো রেগেই বোম হয়ে আছে।

শান ভাইয়া গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
“আমাকে দেখলে তোমার পাগল মনে হয়?”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে তুতলিয়ে বললাম,
“না ম মানে ওই।”
“ফোনটা দেও।”
আচমকা কথাটা শুনে ভয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,
“হ্যাঁ।”
“কি হ্যাঁ হ্যাঁ করছো? ফোনটা দেও।”

কথাটা শুনেই আমার মুখ চুপসে গেল। ফোন দিলে যদি ধরা খেয়ে যাই।না দেওয়া যাবে না। তাই অনেকটা সাহস জুগিয়েই কাঁপা কন্ঠে বললাম,

“আমার ফোন আপনাকে কেন দিবো?”
“আমি বলেছি তাই।”
“আপনি বললেই তো আর আপনার সব কথা শুনতে পারব না। ”
“তুমি দিবে কি না ? ”
“না।”

কথাটা বলতে না বলতে শান ভাইয়া আমার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে এক আছাড়ে দুই টুকরা করে ফেললো। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি রিয়েকশন দেওয়াটাই ভুলে গেছি। শুধু মনে হলো চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এই ফোনটা আমার অনেক প্রিয় ছিল। আমার এইচ. এস.সি পরিক্ষার পর আপু আমাকে গিফট করেছিল। আমি রেগে বললাম,

“এটা কি করলেন আপনি?আমার ফোনটা ভেঙে ফেললেন? আপনি জানেন ফোনটা আমার জন্য কি ছিল?”

“সোজা কথা শুনলে এমনটা হতোই না। তোমার জিনিস নষ্ট হওয়ার জন্য তুমিই দায়ি।”

“আপনি আসলেই একটা হার্টলেস মানুষ। কারো প্রিয় জিনিস হারালে কেমন লাগে সেটা আপনি কি করে জানবেন। আপনার তো আর কোনো প্রিয় কিছু হারায়নি।”

“কারো চোখের সামনেই যদি তার প্রিয় জিনিসটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে তাহলে কতটা কষ্ট হয় সেটা আমার থেকে বেশী কেউ জানেই না। ”

শান ভাইয়ার কথাটা শুনে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল কি হয়েছে উনার?হঠাৎ এমন ব্যবহার কেন করছে?শান ভাইয়া আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এখন আর ওনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না।ফোনটার জন্য কষ্ট হচ্ছে।তাই আমি যাওয়ার জন্য শান ভাইয়ার পাশ কেঁটে যেই না এক পা বাড়িয়েছি অমনি শান ভাইয়া বলে উঠল,

“তাহলে কবে যাচ্ছো?”
আমি পিছনে এসে অবাক হয়ে বললাম,
“কোথায়?”
“কোথায় আবার তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে?এইমাত্রই তো বললে তুমি আমার সাথে থাকতে চাও না।”

শান ভাইয়ার কথা শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।যাক তাহলে কিছু শুনেনি।শুধু শেষের কথা শুনে ভেবেছে বফের সাথে কথা বলছি আর তাতেই এতো রাগ দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন?মাথা গরম থাকায় ত্যাড়া ভাবেই বললাম,

“হুম বলছিলাম তো?”
“তো এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বলার কি আছে। তুমি যখন যাবে তখন আমাকে বলে দিও। আমি নিজ দাঁয়িত্বে তোমাকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে দিয়ে আসব। যতোসব। ”

কথাটা বলেই উনি হনহনিয়ে চলে গেল। ওনার মতো অদ্ভুত মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। নিজের বউকে নাকি অন্যকারো হাতে তুলল দিবে। সাধে কি আর খচ্চর বলি। আমার ফোনটাও ভেঙে দিছে। হঠাৎ নিজের কথা নিজের মাথায় আসতেই থতমত খেয়ে গেলাম বউ? তাহলে কি এই বিয়েটা আমি মেনে নিলাম?উফ নো এবার আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো এই পাগলের সাথে থাকতে থাকতে।



সব নাস্তা প্রায় হয়ে গেছে কিছু বাকি আছে। শ্বাশুড়ী মায়ের সাথে ভূমিকা ভাবী আর কমলাও হাতে হতে সব কাজ করে ফেলছে। আমাকে কিছু ধরতেও দিচ্ছে না। তাই আমিও বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ বসে তাদের কাজ করা দেখছি। কিন্তু কতক্ষণ ভালো লাগে চুপচাপ বসতে। ফোনটাও নেই যে একটু গেমস খেলবো। তাই আমি শ্বাশুড়ী মায়ের কাছে গিয়ে বললাম,

“চা গুলো দিয়ে আসি আমি?”
“পারবি দিয়ে আসতে?”
“পারব।”
“ওকে সোনা দিয়ে আয় তাহলে একটু হেল্প হয়।সকাল থেকে কাউকে কিছু দেওয়া হয়নি এখনো।”

শ্বাশুড়ী মায়ের কথা অনুযায়ী আমিও ট্রেটা হাতে নিলাম। কিন্তু এতো গুলো চায়ের মাঝে দুটো কফি দেখে একটু অবাক হলাম।

“এই কফিটা কাকে দিবো?”
” সাম্য আর শানকে। ওরা চা খায় না। বাম সাইডের কফিটা শানকে দিস। ও চিনি বেশী খায় না। ”
“হুম।”

চিনি কেন খাবে? চিনি খেলে তো আর এই তিতা কফির মতো তিতা তিতা কথা গুলো আমাকে বলতে পারত না। কফিখোর একটা। নিজের মনে কথা গুলো বলেই নিজের কাজে চলে গেলাম।

একে একে সবাইকে চা গুলো দিয়ে দিলাম। তারপর শান ভাইয়ার বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্বশুর মশাই বিছানায় আধশোয়া হয়ে কপালে একহাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি গিয়ে দরজায় নক করতেই উনি উঠে চশমাটা পড়ে বললেন,

“আরে সোহা মা এতো ফর্মালিটির দরকার নেই। তুই তো এইবাড়ির মেয়েই। আয় না ভিতরে আয়। ”

আমি ধির পায়ে এগিয়ে গেলাম। তারপর বললাম,
“আঙ্কেল আপনার চা। ”
উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে চা টা নিয়ে নিলেন তারপর বললেন,
“এই বাড়িটাকে কেমন লাগছে?”
“ভালোই।”
“আর মানুষ গুলাকে। ”
আমি চোখে মুখে খুশি নিয়ে বললাম,
“অনেক ভালো।”
“আমার কিন্তু মনে হয় না।”
শ্বশুর মশাইয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
“না আঙ্কেল তেমন নয়। আপনারা সবাই সত্যিই অনেক ভালো।”
“তাই। যদি আমাদের সত্যি ভালো লাগতো তাহলে আঙ্কেল বলতি না বাবা বলতি। ”
আমি অস্ফুট সুরে বললাম,
“বাবা?”
“হ্যাঁ এখন থেকে বাবা বলবি।আর তোর যা লাগবে সব আমাকে বলবি। কখনো বাসার কথা মনে করে কষ্ট পাবিনা। আজ থেকে আমরাই তোর বাবা মা। কি মানতে পারবি তো? ”

বাবার কথা শুনে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। এমন মনে হচ্ছে যেন আমি এই বাড়ির বউ না মেয়ে।এমন একটা শ্বশুরবাড়ী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর ইশারায় বললেন না কাঁদতে।হঠাৎ উনি আবার বললেন,

“আমি জানি তুই আমাদের সবার উপর রেগে আছিস এভাবে বিয়েটা হওয়ায়।তুই ভাবছিস হয়তো আরশ পালিয়ে গেছে বলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে তোকে শানের বউ করে আনলাম। আসলে এটা সম্পূর্ন ভুল। তোকে আর স্মৃতি দুজনকেই আমার খুব পছন্দ ছিলো শান আর আরশের জন্য। তোকে যখন আমি প্রথমে দেখি তখনি এটা ভেবে নি যে তোকে এই বাড়ির বউ করে আনব।কিন্তু হঠাৎ স্মৃতি যে এমন কাজ করে বসবে ভাবতেই পারিনি। তবে আমি তোকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুই সত্যিকারের হীরাটাই পেয়েছিস। শান সবসময় তোকে আগলে রাখবে।দেখিস তুই অনেক সুখী হবি শানের সাথে। ”

ওনার কথা শুনে কি বলবো জানি না। তবে এখন রিয়েলাইজ হচ্ছে আরশ ভাই আর আপু ভুল করেছে। শুধু শুধু এতোগুলো ভালো মানুষ আমাদের কারণে ছোট হলো সবার সামনে। ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে বললাম,

“হুম।”
“তুই কি এখন ফ্রী আছিস। তাহলে বাবা মেয়েতে বসে কিছুক্ষন আড্ডা দেওয়া যেতো।”
“স্যরি বাবা। এখনো বড় ভাইয়াকে কফি দেওয়া বাকি তাই বসতে পারছি না তবে আমি কিছুক্ষন পর অবশ্যই আসবো তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবো। ”

আমি অনেক খুশি হয়ে বললাম। বাবাও হেসে বললো,
“ওকে বেটা আমি অপেক্ষা করব। ”

তারপর আমি বড় ভাইয়ার রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ভাইয়া পুষ্পের পাশে আধশোয়া হয়ে খবর পড়ছে। দরজায় নক করতেই ভাইয়া উঠে বসলেন,

“গুড মর্নিং ভাইয়া।”
“গুড মর্নিং। কিন্তু তুমি কেন? সকাল সকালই কাজে লাগিয়ে দিলো নাকি?
“না না। কেউ তো কিছু করতেই দেয় না। আমিই ভাবলাম চা গুলো সবাইকে দিয়ে একটু তাদের হেল্প করে দি।”
“হুম। ”
আমি ভাইয়াকে কফিটা দিয়ে দিলাম।
“পুষ্প ঘুমাচ্ছে এখনো?”
“হুম কালকে তো বিয়ে বাড়ির ঝামেলায় কারো ঘুমই হলো না।”

আমি গিয়ে পুষ্পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। একদমই ছোট্ট একটা মেয়ে। সবসময় আমাকে” মিষ্টি মিষ্টি “বলে অস্থির করে রাখে। এই বাড়ির মধ্যে যদি কারো সাথে আমার ভাব সবথেকে বেশী হয় তাহলে সেটা পুষ্প। ওর মিষ্টি মুখের মিষ্টি মিষ্টি কথা গুলো শুনলেই মন জুড়িয়ে যায়। কিছুক্ষন পুষ্পের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলাম জমরাজের ঘরে যাবো বলে।



দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি ভিতরে যাবো কি যাবো না সেটাই ভাবছি। তখন যে রাগ দেখালো। এখন না ঘর থেকেই বের করে দেয়। দিলে দিবে এত কেন ভাবছি। দূর কি ভবছিস সোহা কিছুই হবে না। তুই শুধু যাবি কফিটা দিবি আর বেরিয়ে আসবি শেষ। যেই বাবা সেই কাজ। আর আগে পিছে না ভেবে চলে গেলাম ভিতরে। ভিতরে গিয়েই মাথার মেজাজটা গরম হয়ে গেল।আমি দ্রুত পায়ে শান ভাইয়ার কাছে এসে বললাম,

“এটা কি করছেন আপনি? আমার জামা-কাপড় গুলো ফেলছেন কেন? ”
“আমার আলমারিতে কাকে বলে জামা-কাপড় রেখেছো?”
“এখানে বলতে হবে কেন?ঘরে আপনার আলমারি ছাড়া তো আর কোনো আলমারি নেই যে সেখানে রাখব।এখানে না রেখে আর কই রাখব। ”
“সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমার আলমারিতে তোমার কোনো কিছুর জায়গা হবে না। পারলে তোমাকে আমার ঘর আর লাইফ দুইজায়গা থেকেই বের করে দিতাম বাট আফসোস আমার হাত বাঁধা। ”

উনার কথাটা শুনে চোখ থেকে আপনাতেই পানি পড়তে লাগল। কতটা সহজে কথা গুলো বলে দিলো। একবারও ভাবল না আমার দিকটা।কি এমন ক্ষতি করেছি ওনার কেন এমন বিহেভ করছে?

“এই আমার সামনে একদম ন্যাকা কান্না করবে না।একদম চুপ।”

উনার ধমক শুনেই আমি পুরো সোজা হয়ে গেলাম। নিজের চোখের পানি মুছে অভিমানি কন্ঠে বললাম,

“ওকে আমার যেই ফোনটা ভেঙেছেন ফেরত দিন আমি চলে যাচ্ছি। ”

আমার কথা শুনে শানের মুখটা হা হয়ে গেল,
“এখানে তোমার বিবাহিত জীবন খাঁদে ঝুলছে আর তুমি আছো ফোন নিয়ে?আসলেই একটা স্টুপিড তুমি। ধ্যাত বোঁকা বললেও বোঁকার অপমান হবে।”

“ভালো হইছে আমি এমনই। ”

উনাকে মুখ ভেঙালাম। শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হয়তো উনি আমার এমন উত্তর আশা করেনি।
কিছুক্ষন চুপ থেকে উনি আবার বললেন,
“তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় গুলো সরিয়ে রুম খালি করো। কুইক। ”

এবার মাথাটা এতো গরম হচ্ছে বলার বাহিরে। ইচ্ছা হচ্ছে বলি,
“যে জামা-কাপড় গুলো সরিয়ে কি তোর মাথার উপরে রাখব। ”
কিন্তু মুখে বললাম,
“এগুলো সরিয়ে কই রাখব। ”
উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“কেন যার সাথে দুদিন পর যাবে তাকেই বলোনা তোমাকে একটা আলমারি বানিয়ে দেয় যেখানে তুমি তোমার জিনিসপত্র রাখতে পারো। ”

কথাটা বলেই উনি হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি উনার কথা শুনে হা হয়ে রইলাম।
“আরে এখন আমি বয়ফ্রেন্ড পাবো কোথায়? কেন যে কাল বলেছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। এইবার বুঝ মজা। এখন তো মনে হচ্ছে একটা আলমারির জন্য হলেও বয়ফ্রেন্ড বানাতে হবে।”



জামা-কাপড় গুলো গুছাতে গুছাতে প্রায় অনেকটাই লেইট হয়ে গেছে। এর মধ্যে দু’বার কমলা এসে ডেকে গেছে। উফ নির্ঘাত সবাই বকবে আমায়। সব হয়েছে শান ভাইয়ার জন্য। ফাজিল একটা তোর জীবনেও ভালো হবেনা। উল্লুকটা আমার গোছানো কাজ অগোছালো না করলে এমনটা হতোই না।

নিচে আসতে না আসতেই ফুফু শ্বাশুড়ী বলে উঠলেন,
“কি ব্যাপার প্রথম দিনই এতো লেইট তোমার। এতবার কেন ডাকতে যেতে হয়। তোমাকে কি বলা হয়নি সবাই এখন খাবে।”

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। শ্বশুর মশাই বললেন,
“আহ!রেশমা এভাবে বলছিস কেন?আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। ”
তখনি শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“শান কই সোহা।নিচে এলো না ঘরে আছে কি?”
“শান ভাইয়া আসেনি এখনও সেই কখন তো নিচে আসার জন্য বেরোলো। ”

আমার কথা শুনে সবাই বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে।কি রে বাবা এমনকি বলে দিলাম যে সবাই আমার দিকে এই লুক দিচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

“কি হয়েছে?”

তখনি সবাই হেসে দিলো। আমি কিছুই বুঝলাম না। সানিয়া হাসতে হাসতে বললো,
“তুমি এখনো শান ভাইয়াকে ভাইয়া বলে ডাকো।ওহ মাই গড।”
বলে আবারও হাসতে থাকল। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“ঐ আগের অভ্যাস তো তাই। ”

ফুফু শ্বাশুড়ী বাজ খাই গলায় বললো,
“কি দিনকাল আসলো বাবা জামাইরে নাকি কেউ ভাই ডাকে। এতো বড় মেয়ে কোনো কান্ড-জ্ঞান নাই। কালে কালে আর কত কি যে দেখব। ”

ওনার কথা শুনে বিরক্ত লাগল। এই মহিলাটার সমস্যাটা কি বুঝি না সেই সকাল থেকে একটার পর একটা ফোঁড়ন কেটেই যাচ্ছে।

শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে এরপর থেকে আর বলো না লোকে খারাপ বলবে কেমন? ”
আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালাম। আমি নিজের ব্যবহার দেখে নিজেই অবাক হচ্ছি আমি কখনোই এতো বাধ্য মেয়ে ছিলাম না। আর এখন সেই আমিই কিনা যে যা বলছে মুখ বুঝে শুনছি।

কিছুক্ষন পর শান ভাইয়া চলে এলো।
বাবা বললো,
“কিরে কই ছিলি তুই?”
“ওই তো পুল সাইডে। ”

তারপর সবাইকে নাস্তা সার্ভ করে দিলাম। বাবা বললো,
“সোহা তুইও বসে যা। ”
“না আপনারা খেয়ে নিন আমি পরে বসব।”
“আরে বস না। তোকে কিছুক্ষন আগে কি বললাম ভুলে গেছিস?”
শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“থাক ওকে জোড় করো না। ওর হাত কেঁটে গেছে তাই খেতে পারবে না। ”
“সে কি কিভাবে কাঁটলো?”
“ওয়াসরুমে পড়ে গেছিলাম। ”

কথাটা বলতেই শান ভাইয়া বিষম খেলো। ওনাকে আমি পানি এগিয়ে দিলাম। উনি খাওয়া ছেড়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। উনি হয়তো ভেবেই নিয়েছিলেন আমি সত্যিটা বলে দিবো। কারণ আমার জন্য এমন পরিস্থিতিতে উনি অনেকবারই পড়েছে।

বছর খানিক আগে শান ভাইয়ারা স্ব-পরিবার মিলে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আসলে আঙ্কেল আর আব্বু খুব ভালো বন্ধু ছিল এখনও আছে। তাই সুযোগ পেলেই চলে আসত। নাহয় আমরা যেতাম। কারণ সারা বছর কাজের চাপে তো সম্ভব হতো না । শান ভাইয়ার সাথে কখনো আমার ঝগড়া ছাড়া ভালো ভাবে কথাই হতো না। কারণ ওনার এই ত্যাড়া কথা গুলো পছন্দ ছিল না। তখন আমার এইচ.এস.সি সামনে ছিল। কিন্তু কিছুদিন অসুস্থতার কারণে আমি পড়া পিছিয়ে পড়েছিলাম।তাই নোট আনতে গিয়েছিলাম সোহেল নামের একটা ফ্রেন্ডের কাছে।নোটটা নিয়ে আসব তখনই সোহেল বললো ও যে মেয়েটাকে ভালোবাসত সে ওকে ছেড়ে চলে গেছে তাই ওকে শান্তনা দিচ্ছিলাম তখনই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল,

“ওহ আজকাল নোট আনার নাম করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রেম করা হচ্ছে জানতাম না তো।”

শান ভাইয়াকে দেখে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম,

“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?”
“কেন ডিস্টার্ব করলাম নাকি?ভাগ্যিস এসেছিলাম।”

“মাথার স্ক্রু তো আগেই ডিলা ছিল এখন কি বাকি গুলোও খুলে গেছে নাকি কি? কি বলছেন?আমি তো কিছুই বুঝতেছি না?”
“বুঝতে হবে না। নেক্সট টাইম তোমাকে যেন কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে না দেখি মনে থাকে যেন? ”

“আপনি বললেই হলো। আমার ফ্রেন্ডদের সাথে আমি একশত বার কথা বলব আপনার কি তাতে?”

“তোমাকে বলতে ইচ্ছুক নই। তবে কথার নড়চড় যেন না হয়।নিজের ভাই ছাড়া বাকি সব ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ।”

“আপনার কথা আমি শুনব কেন?”

“মুখে মুখে তর্ক করলে একটা থাপ্পড় মারব যে পরে আর কথাই বের হবে না মুখ থেকে।এখনি যাও বাসায়। ”

উনার কথা শুনে প্রচুর রাগ হলো।কত বড় সাহস আমাকে ধমক দেয়। বাসায় এসে আমি কান্না করে করে সবাইকে বললাম,

“শান ভাইয়া রাস্তায় সবার সামনে আমাকে থাপ্পড় মারছে।”

আমার কথা শুনে শান ভাইয়া নিজেও অবাক।কারণ উনি শুধু বলেছে।আমি এমনি ছিলাম। উনি আমাকে যা বলতো বা যা করত আমি তার থেকে এক দুই লাইন সবসময় বাড়িয়েই বলতাম। এরপর আর কি শান ভাইয়ার আব্বু ওনাকে অনেক বকা দিলো।উনাকে বকা খেতে দেখে আমি মজা নিচ্ছিলাম।

কথা গুলো মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।এতোটা বাঁদর ছিলাম। তাই হয়তো এখন এতোটা ভালো মানুষি আমার থেকে নিতে পারেনি। হঠাৎ বাবার কথা শুনে অতিত থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম,

“শান তাড়াতাড়ি নিজে খেয়ে সোহাকেও খাইয়ে দিস।”
“আমি পারব না। যার খাওয়া সে খাবে।”
শান ভাইয়ার কথা শুনে শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“এটা কেমন কথা শান দেখিস না মেয়েটার হাত কেঁটে গেছে কেমনে খাবে?”
“না পারলে না খেয়ে থাকবে আমার এতো ঠেকা পড়ে নাই কাউকে খাওয়ানোর। ”

কথাটা বলেই উনি উঠে চলে গেলেন। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবার সামনে মানুষ এমন ব্যবহার কেমনে করতে পারে একটুও খারাপ লাগলো না তার। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শ্বাশুড়ী মা বললেন,

“হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে তোর উপর রেগে আছে। মন খারাপ করিস না। শান কিন্তু মোটেও এমন না। রাগ পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে রাখবি যে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে সেই বেশী অভিমান করে। যা গিয়ে ওর অভিমান ভাঙ্গা। ”

“হুম।”

ভালোবাসা না ছাই।এখন হয়তো আর সহ্য হচ্ছে না আমাকে। আমার সাথে এই ব্যবহার এইজন্য করছে যেন আমাকে তাড়িয়ে ঐ শাকচুন্নিকে তাড়াতাড়ি ঘরে তুলতে পারে। আমিও এতো সহজে ছাড়ব না। একবার সুযোগ পাই সব সুদে আসলে উসুল না করেছি তো আমার নামও সোহা না ।জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here