এক শহর ভালোবাসা পর্ব_৪৩

0
1312

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪৩
#সুরাইয়া_নাজিফা

শান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আর আমি শানের কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। শান আমার মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যার ফলে আমার ঘুম চলে আসছিলো।

আমি উঠে বসলাম,
“ধ্যাত ভালো লাগছে না। ”
“কি হলো?”
“কেউ আমার মাথা হাত বুলিয়ে দিলে আমার ঘুম চলে আসে। ”
শান হাসল,
“নিজেই বললে হাত বুলিয়ে দিতে এখন নিজেই বলো ঘুম আসছে পড়া চোর একটা। ”
আমি কপাল কুচকে বললাম,
“মোটেও না। ”
“ওকে আজকের মতো ঘুমিয়ে পড়ো এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গেছে। ”

শানের কথা শুনে আমি খুশি হয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। তারপর টেবিলের উপর বই রেখে আবার বিছানায় এসে বসলাম। পাশে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে তারপর শানকে বললাম,

“পানি খাবেন? ”
“দেও। ”

শানকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম। শানের খাওয়া হলে গ্লাসটা পাশে রেখে তারপর
সুয়ে পড়লাম। শান আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমি শানের বুকে মাথা দিলাম। শান সবসময়ের মতো আমার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। হঠাৎ আমার ছোট্ট মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করতে লাগল।তাই আমি শানের বুক থেকে একটু মাথা তুলে শানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

“আচ্ছা আপনি যদি বিয়ের আগেই আমাকে ভালোবাসতেন তাহলে প্রথমবার প্রথম রাতে ঐরকম ব্যবহার করলেন কেন?”

আমার প্রশ্ন শুনে শান মাথায় হাত বুলানো বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“অনেকদিন থেকেই জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম কিন্তু এতো কিছুর মধ্যে কখনো জিজ্ঞেস করাই হয়নি তাই। ”
“ওহ। ”

শান চুপ হয়ে গেল
“কি ব্যাপার শুধু ওহ বলে চুপ হয়ে গেলেন যেটা জিজ্ঞেস করলাম বলুন? ”
“হলুদের রাত থেকেই আমি তোমার উপর প্রচন্ড রেগে ছিলাম তাই ফুলসজ্জার রাতে ঐ রকম ব্যবহার করেছিলাম। ”

শানের কথা শুনে আমি উঠে বসে বললাম,
“রেগে ছিলেন কেন?”

শানও উঠে বসে মুখ ফুলিয়ে বললো,
“কেন আবার তুমি কাজকর্মই এমন করো যে সেসব চোখের সামনে দেখলে মানুষ রাগতে বাধ্য হবে।”

আমি গালে হাত রেখে ভাবার অভিনয় করে বললাম,
“আমি আবার কি করেছিলাম? ”

“কেন মনে নেই হলুদের রাতে কোন ছেলের হাতে হাত রেখে বসে বসে গল্প করছিলে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে। এখন কোনো মানুষ যদি তার ভালোবাসার মানুষকে এভাবে অন্য কারো হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে নিশ্চয়ই তার খুশি হওয়ার কথা নয়? ”

উনার কথা শুনে আমি আবার তিন -চার মাস পিছনে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম যে উনি কি বলছেন। কার সাথে ছিলাম তাও হলুদের রাতে?কিছুক্ষন ভাবনার পর হঠাৎ মনে পড়তেই আমার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল আমি কিছুতেই নিজের হাসি আটকাতে না পেরে খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে শান ভ্রু কুচকে বললো,

“রাত বারোটা বাজে পাগল হয়ে গেছ নাকি?”

আমি হাসতে হাসতে বললাম,
“না তবে আপনার কথা শুনে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। ”

“কেন আমি পাগল হওয়ার মতো কি বললাম?”

“আচ্ছা আপনি কি সেই ছেলেটার মুখ দেখেছিলেন?”

“না। মুখ দেখলে ঐ ছেলের কপালে অনেক দুঃখ ছিল ভাগ্যিস দেখিনি পিছন ফিরে ছিল। ”

“বাই এনি চান্স তাহলে ঐ ছেলেটাকেই কি আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড ভেবেছিলেন?”

“এখন ওতো রাতে বিয়ের কনে অনুষ্ঠানের মাঝে না থেকে যদি বাড়ির বাহিরে কোনো ছেলের সাথে থাকে তাহলে তো মানুষ নিশ্চয় তাদের ভাইবোন ভাববে না। ”

“এই আমাদের সমাজের সবার না একই সমস্যা কোনো একটা ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলো কি দেখলো না এরমধ্যে মনগড়া একটা সম্পর্ক জুড়ে দিয়ে পুরো বাড়ি রটিয়ে বেড়ায়। আর বলে মেয়েটা খারাপ। অথচ একবারও এটা ভাবে না যে ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভাইবোন হতে পারে অথবা তাদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্বপৃূর্ণ সম্পর্কও থাকতে পারে?যেগুলো আমাদের যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। সবাই পারে না।”

শান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“মানে?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
“মানে আপনি যাকে দেখেছিলেন সেটা সৃজন ছিল।”

শান অবাক হয়ে বললো,
“হোয়াট?”

“জ্বী। সৃজনকে আমি একটা মোটা দড়ি আনতে বলেছিলাম যেটা দিয়ে আমার রুম থেকে ফেললে নিচ পর্যন্ত নাগাল পাওয়া যায়। আমি জানতাম আপু বাবাকে বলতে পারবে না আর আরশ ভাইয়াকেও আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয় তাই পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় তাই প্লান’ বি ‘ছিল এটা আমার।আর সৃজন সেদিন হলুূদের অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে দড়িটা যোগার করে সেটা দেওয়ার জন্যই বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছিলো ওত রাতে। কারণ সবার সামনে তো সেটা দেওয়া সম্ভব নয়। ”

আমার কথা শুনে এবার শানও ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। শান হেসে নিজের একহাত কপালে ঠেঁকিয়ে বললো,

“সিরিয়াসলি আর আমি সেদিন তোমাদের দুজনকে দেখে এসে এত পরিমাণ রেগে ছিলাম যে সেদিন রাতে বাবা একটা কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন সেটা পর্যন্ত কমপ্লিট করিনি। বাসায় এসে সবার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছিলাম সাথে নিজের রুমে সব ভেঙে চুরে চুরমার অবস্থা করেছি।এতটাই রেগে ছিলাম তোমার উপর। কেন তুমি আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারলেনা? আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি সেদিন যদি আরশ না পালাতো তাহলে হয়তো আমি বিয়ের আসরেই সবার সামনে বলে বসতাম আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই। বিয়ের পর ভেবেছিলাম তোমাকে অন্যকারো সাথে জড়ানোর শাস্তি দেবো বাট আফসোস তোমার ঐ মুখটা যতবার দেখেছি ততবারই দূর্বল হয়ে পড়েছি। আমার মনে হয়নি কখনো যে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারো আমাকে ছাড়া।কারণ তোমার জন্ম শুধু আমার জন্য। যার কারণে ঐ প্রথম দিনের পর আর সম্ভব হয়নি খারাপ ব্যবহার করার। ”

আমি “দ” স্টাইলে বসে দুইহাত হাটুতে রেখে চোখ ছোট ছোট করে শানকে প্রশ্ন করলাম,
“বাই দ্যা ওয়ে মনে করেন সেদিন আপনার ভুল ছিল বাট যদি এমন কখনো হয় আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না বা অন্যকারো প্রেমে পড়ি তখন? ”

কথাটা বলতেই এতক্ষনে শানের হাসিখুশি মুখটা এক মুহূর্তে আধারে ঢেকে গেল। উনি রেগে আমার হাত ধরে টেনে আমাকে বিছানায় শুয়ে হাত দুটো বিছানায় চেপে ধরলেন। নিমিষেই আমার হাসিটা মিলিয়ে গেল।

“এত শখ কেনো এখনো অন্য ছেলের। তোমাকে বলেছিলাম না একদিন এমন কথা না বলতে। তুমি চাইলেও আমার সাথে থাকবে আর না চাইলেও। তারপরেও অন্য ছেলের কথা মাথায় আসে কি করে। আজ তোমার এমন হাল করব যে দ্বিতীয়বার আমি ছাড়া অন্যকোনো ছেলের কথা মাথায়ও আসবে না। ”

হঠাৎ উনাকে এতো রাগতে দেখে আমি ভিত কন্ঠে বললাম,
“স্যরি আমি তো মজা করছিলা…..।”

উনি আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন আর আমার গলায় নিজের মুখ ডুবিয়ে দিলেন।


৪ বছর পর,

“আরিশ বাবা দাঁড়া উফ এভাবে দৌঁড়াতে পারবো না আমি। ”
“ধলো পারলে আমালে ধলো। ”

এভাবে আধো আধো কন্ঠে বলে চলেছে আর দৌঁড়ে চলেছে আরিশ। আর আমিও আরিশের পিছনে ছুটে চলেছি ওকে ধরার উদ্দেশ্যে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হঠাৎ পা পিছলে পড়তে নেবে তখনই আমি গিয়ে ওকে ধরে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আরিশও ভয় পেয়ে গেছে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষন পর আমি ওকে আমার চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে রেগে বললাম,

“এখনি কি হতো পড়ে দাঁত মুখ ভেঙে যেত তারপর নিজেও বকা শুনতি আমাকেও শুনাতি বললাম দাঁড়া এভাবে কেউ দৌঁড়ায়? ”

আরিশ ঠোঁট ফুলিয়ে মন খারাপ করে বললো,
“থলি(স্যরি)। ”

ওর এই আধো আধো বুলিতে স্যরি শুনে আর মুখ দেখে চোখের পলকেই আমার রাগ গলে জল হয়ে গেল আর আমি হেসে দিলাম।

আরিশ মাথা তু্লে বললো,
“তুমি লাত (রাগ) তরোনিতো(করোনিতো?”
আমি ওকে কোলে তুলে বললাম,
“এমন একটা গোলুমোলু মিষ্টির দোকানের সাথে কেউ রাগ করে থাকতে পারে তবে যদি সে আমাকে একটা ভালোবাসার পরশ দেয় তাহলে আমার রাগটা পুরোপুরি ভেঙে যাবে। ”

কথাটা বলতেই আরিশ আমার গালে নিজের ঠোঁট ছুয়ে দিলো তারপর নিজেও আমাকে তার গালের দিকে ইশারা করতেই আমিও ওর গালে একটা আদর দিলাম।

তখনই স্মৃতি আপু পিছনে এসে বললো,
“কি এতো ফিসফিস হচ্ছে দুই চাঁচি আর ভাতিজা মিলে হুম। ”

আপুর কথা শুনে আমি পিছনে ফিরে তাকালাম আর দুজনের মুখেই একটা হাসি ফুটে উঠল। হ্যাঁ আরিশ স্মৃতি আপু আর আরশ ভাইয়ার ছেলে। ভাইয়ার নামের সাথে মিল রেখে আরিশের নামকরণ করা হয়েছে । আরিশের বয়স এখন আড়াই বছর । দেখতে একদম নিজের বাবা মায়ের কার্বন কপি মাশাআল্লাহ । এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যেন সারাদিন হা করে তাকিয়েই থাকতে মন চায়।

দেখতে দেখতে চারবছর কেঁটে গেছে। সময় কতো দ্রুত চলে যায়। এই চার বছরে সবার জীবনেই নতুনত্বের ছোঁয়া এসেছে।আপুর কোল জুড়ে আরিশ এলো। একমাস হলো আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স কম্প্লিট করেছি। অনার্স কম্প্লিট হওয়ার পর কথা মতো আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা শিফট করি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে এডমিশন নেই। এখন সবাই আমরা একই সাথে একই বাড়িতে থাকি। সারাদিন আমরা তিন ঝাঁ মিলে হাসি মজা মাস্তিতেই দিনটা কেঁটে যায়। ইদানীং মায়ের শরীরটা ভালো নেই তাই তিনি আমাদের আড্ডায় অংশ নিতে পারে না তবে মা থাকলে তিনিই পুরো আড্ডা জমিয়ে দেয়। তারউপর এখন তো আরিশের সাথেই খুনশুটিতে সময় চলে যায়।

ঐশী আর তিমির ভাইয়া তিনবছর আগেই অষ্ট্রেলিয়ায় শিফট হয়ে গেছে। ওদের বিজন্যাসও ওখানেই শিফট করে নিয়েছে। ঐশীর এখানে থাকলে পুরনো স্মৃতি গুলো মনে পড়ে কষ্ট হয় তাই চলে গেছে শানের চোখের আড়ালে। ওদেরও একটা মেয়ে হয়েছে তৃমিশা। মেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই আছে।

শান, আরশ ভাইয়া, সাম্য ভাইয়া সবাই আগের থেকে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবা বিজন্যাস থেকে পুরোপুরি ছুটি নিয়ে নিয়েছে যার কারণে সব দায়িত্ব এসে পড়েছে ওদের উপর। হয়তো আগের মতো এতো সময় দিতে পারে না তবে আমাদের ভালোবাসা একবিন্দুও কমেনি।সাথে শানের কেয়ার তো যেন বেড়েই চলেছে। অফিসে থাকলেও যখনই সময় পায় ফোন দিয়ে আমার খবর নেয় পারলে তো প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় কল দেয়।এজন্য ফোন সবসময়ই নিজের কাছেই রাখতে হয়। শান আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে একটুকুও চেন্জ হয়নি। শুনেছি সময়ের সাথে নাকি ভালোবাসাও কমতে থাকে কিন্তু আমার মনে হয় এখন আগের থেকে আরো বেশীই ভালোবাসে শান আমায় এতটা চোখে হারায়।

আমাদের পুষ্পও অনেক বড় হয়ে গেছে এখন নয় বছরের হয়ে গেছে সে আর আগের থেকে অনেক পাঁকা বুড়িও। রোজ রোজ নতুন কাহিনী করে স্কুল থেকে ফিরে আর খুব উৎসাহ নিয়ে এসে সেসব আমাকে শুনায় আর না শুনতে চাইলেও জোর করে শুনাবেই সে। এভাবেই সবার জীবন একদম খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে বিন্দাস চলছে।

আমি আপুর কাছে গিয়ে বললাম,
“রান্না শেষ? ”
“হুম অলমোস্ট শেষ বাকিটা রহিমা আন্টি দেখে নিবে। তা কি ফিসফিস চলছিল দুজনে মিলে বললি না কিন্তু।”
আমি আর আরিশ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বললাম,
“কি হবে কিছু না। তাই তো আরিশ সোনা। ”

আরিশ আমার কথায় সায় দিয়ে দুই তিনবার জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো। আপু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“মিথ্যে বলে লাভ নেই আমি কিন্তু সব দেখেছি? ”

আমি আর আরিশ একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে মাথানিচু করে নিলাম। আপু আরিশকে আমার কাছে থেকে নিয়ে বললো,
“কতবার বারণ করেছি না এসব দুষ্টমি না করতে কথা শোনো না কেন তুমি?এখন যদি পরে হাত পা ভাঙে তারপর আর কেউ মেয়ে দেবে?”

আরিশ মুখ উঁচু করে আধো আধো কন্ঠে বললো,
“দিবে। মেত(মেঝ) মণির মেয়েতে(মেয়েকে)দিবে আমি ওতেই(ওকেই)বিয়ে তলব(করব)। ”

আপু দুই গালে হাত দিয়ে মুখটা ইংরেজি “ও” বর্ণের মতো করে বললো,
“সর্বনাশ যার আসার এখনও খবর নাই তাকে বিয়ে করার জন্য আগে থেকেই লাইন দিয়ে ফেলেছিস তুই। ”

আরিশ কি বুঝল জানি না ও শুধু হাসল ওর হাসি দেখে আমরা দুজনেই হেসে দিলাম। তারপর আমরা দুজনেই আরিশকে নিয়ে কিছুক্ষন মজা করলাম।

তখনই আপু বললো,
“ভূমিকা আপু এখনও আসেনি পুষ্পকে নিয়ে?”
“না। ”
“এতো লেইট যে আজ?”

কথাটা বলতে না বলতেই পুষ্প দৌঁড়ে এসে আরিশকে জড়িয়ে ধরল পুষ্পকে দেখে আরিশও অনেক খুশি হয়ে গেল। হয়তো দুজনেই কাজিন তবে পুষ্প আরিশকে এতটা ভালোবাসে যে মনেই হয় না এরা কাজিন। পুষ্প বাসায় থাকলে আরিশের আর কাউকে প্রয়োজন হয়না সারাদিন পুষ্পর সাথে খেলাধুলা, খুনসুটিতেই কেঁটে যায়। ভূমিকা আপু এসে সোফায় বসল।

“বাবা এই মেয়ে ছোট বেলা থেকই আমাকে একের পর এক পেইন দিচ্ছে কখনো শান্তিতে থাকতেই পারেনা এতটা বড় হয়েছে তারপরও ওর জন্য কমপ্লেইন শুনতে শুনতে শেষ আমি। ”

আমি বললাম,
“কেন কি করল আবার পুষ্প?”

“কি করেনি তাই বলো ওদের স্কুলের একটা ফুলের বাগান আছে সেখানে লেখা ছিল ফুল ছিড়লে পাঁচশত টাকা জরিমানা। এরপরেও সেই মেয়ে ওখান থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়েছে। আর ওকে যখন ডাকা হলো কি বললো শুনবে ‘ওখানে কোথাও তো লিখা ছিল না ফুল ছিঁড়া মানা শুধু বলেছে জরিমানা। তো আমার বাবার অনেক টাকা আছে সেখানে পাঁচশত কেন একহাজার দিতেও আপত্তি নেই তাই আমার যেই ফুল ভালো লাগবে আমি সেটাই ছিঁড়ব’ এজন্যই স্কুলে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে ছিল। ”

ভূমিকা আপু কথা শুনে আমি আর স্মৃতি আপু হেসে দিলাম।স্মৃতি আপু বললো,
” ঠিকই তো আছে ওখানে লিখতে হতো তো ফুল ছিঁড়া মানা ওরই বা কি দোষ। ”

“না স্মৃতি তুমি আর ওকে তাল দিও না এমনিতেই পুরো বিগড়ে গেছে মেয়ে আরও লাই দিলে মাথা উঠে যাবে। ”

ওদের কথা শুনে আমি পুষ্পকে কাছে ডেকে বললাম,
“সোনা তোমাকে বলেছিলাম না স্কুলে গিয়ে দুষ্টমি না করতে তারপরেও করেছো কেন?”

“দুষ্টমি করিনি শুধু ফুল নিয়েছি। ”

“উহুম সেটাও অন্যায়। দেখো তোমার যেই প্রিয় টেডিটা আছে ওটাকে তো তুমি অনেক ভালোবাসো কাউকে ধরতে দেও না এখন কেউ যদি সেটা ক্ষমতার জোরে তোমার অনুমতি ছাড়া ধরে তাহলে তোমার কেমন লাগবে?”

পুষ্প মন খারাপ করে বললো,
“অনেক খারাপ লাগবে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
“তেমনি ওদেরও খারাপ লেগেছে যখন তারা বারণ করার পরেও তাদের অনুমতি ছাড়া ফুলটা ছিঁড়েছো। দেখো সোনা টাকাটা বড় না বড় হচ্ছে মানুষের সেই জিনিসটার প্রতি ভালোবাসা, টান, অনুভুতি সেখানে আঘাত করা কি অন্যায় নয়? ”

পুষ্প হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। আমি আবারও বললাম,
“এইবার দেখো তোমার ওই টেডিটার যদি একটা চোখ, বা নাক তুলে নেওয়া হয় তাহলে কি ওই টেডিটার আর সৌন্দর্য থাকে? ”

“না। ”

“তেমনি ফুল গাছে থাকলেই দেখতে সবথেকে বেশী সুন্দর লাগে ছিঁড়ে ফেললে তারসহ পুরো গাছটারই সৌন্দর্য নষ্ট হয়।তাকে আর কোথাও মানায় না। বুঝলে তাই এরপর থেকে আর এমনটা করবে না কেমন?”

“ওকে মিষ্টি। ”

“গুড গার্ল এবার গিয়ে ফ্রেস হয়ে নেও যাও। ”

পুষ্প চলে গেল সাথে করে আরিশকেও নিয়ে গেল। স্মৃতি আপু বললো,
“তোর মতো পুষ্পকে আর কেউ বুঝাতে পারে না।এতো সুন্দর করে বুঝাস যে বুঝতে বাধ্য ”

ভূমিকা আপু মন খারাপ করে বসে আছে আমি উনাকে শান্তনা দিয়ে বললাম,
“ব্যাপার না আস্তে আস্তে বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না। ”

ভূমিকা আপু গম্ভীর কন্ঠেই বললো,
“আর ঠিক হবে এই মেয়ে বড় হলে একদম স্বৈরাচারী হবে দেখো সবাই। ”

আপু ভূমিকা আপুর মন ভালো করতে হঠাৎ বলে উঠলো জানো তো আরিশ কি বলেছে একটু আগে। তারপর আপু সব কিছু খুলে বললো। ভূমিকা আপু কথাটা শুনে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে হাসার উপক্রম।

তারপর আমাকে বললো,
“দেখেছো তোমার মেয়ে এখনও পৃথিবীতে আসেইনি তার আগেই বর রেডি এবার তো মেয়েকে পৃথিবীতে আনা প্রয়োজন কোনো প্লান করেছো? ”

আমি একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বললাম,
“এখনো আমার স্ট্যাডি কমপ্লিট হয়নি তাই কোনো প্লান করিনি। ”

ভূমিকা আপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আর কবে প্লান করবে কে জানে বিয়ের চারবছর হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিকে দেখে কিছু শেখো তোমাদের কত পরে বিয়ে করেও ওর বাচ্চার বয়স আড়াই বছর আর তোমরা কি করছো লজ্জা থাকা উচিত। ”

ভূমিকা আপুর কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম।আপু তো এমন ভাবে আমাকে বলছে যেন সব দোষ আমার একার এখন নিজের মুখে বাচ্চার কথা শানকেই বা কিভবে বলব যদি সে কিছু না বলে? তখনই পুষ্প উপর থেকে চিল্লিয়ে বললো,

“মিষ্টি তোমার ফোন বাজছে হয়তো শান ফোন করেছে।”

আমি কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম উপরে যাওয়ার জন্য । হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেই আমার মাথাটা কেমন ঘুড়ে উঠলো। আমি মাথায় হাত দিয়ে পরে যেতে নিতেই আপুরা ধরে ফেললো।

স্মৃতি আপু বললো,
“কি রে কি হয়েছে তোর? ”
ভূমিকা আপু বললো,
“ঠিক আছো? ”
আমি একটু বসে দুইমিনিট চোখ বন্ধ করে রইলাম তারপর দুজনকে শান্ত করার জন্য বললাম,
“ঠিক আছি সম্ভবত এতক্ষন বসে ছিলাম তাই এমন হয়েছে তোমরা বসো আমি আসছি। ”

কথাটা বলেই আমি আস্তে আস্তে উপরের দিকে পা বাড়ালাম। এখন এদের কি করে বলবো ইদানীং এমন মাঝে মাঝেই হচ্ছে বললে শুধু শুধু টেনশন করবে।


রাত আটটা বাজে শান ফিরে আসে।কয়েকদিন ধরে উনার আসতে এমনই লেইট হয়।হয়তো কাজের চাপ বেশী। প্রতিদিনের মতো শান আসার পরই আমি উনার কোট, টাই সব খুলে দিলাম।

শান আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন কাঁটলো আজ সারাদিন? ”

“এইতো প্রতিদনের মতো কেঁটে যাচ্ছে। আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে? ”

“ভালোই একটা প্রজেক্ট নিয়ে কিছুদিন এতো বিজি আছি যে তোমাকে ঠিক মতো সময়ই দিতে পারছি না। তুমি রাগ করছো না তো?”

আমি হেসে বললাম,
“একদমই না। কেন রাগ করব এতো কাজের মাঝেও আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন। আমার এতো যত্ন করছেন তারপরও কেন রাগ করব? ”

শান আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো,
“আমাকে বুঝার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা আমার মিষ্টি বউটা। ”
“আচ্ছা আপনি গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসুন আমি কফি নিয়ে আসছি। ”

তারপর আমি গিয়ে উনার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসলাম। শান ফ্রেস হয়ে সোফায় এসে বসল আমি উনার দিকে কফি বাড়িয়ে দিতেই শান কফিটা হাতে নিয়ে আমাকে টেনে উনার সামনে বসিয়ে দিলো।

আমার একগালে হাত দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে তোমার কিছুদিন ধরে তোমাকে একটু উইক দেখাচ্ছে? শরীর খারাপ নাকি?”

কি বলবো বুঝতেছি না। কিছুদিন ধরেই এমন দূর্বল দূর্বল লাগছে। মাথা ঘুরানো, ঘাড় ব্যাথা, মাঝে মাঝে তো খেতেও পারিনা তেমন একটা। কিন্তু এখন এটা বললেই শুরু হয়ে যাবে শানের বকা ঝকা তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।

আমি একটু হেসে বললাম,
“কিছু হয়নি ঠিক আছি। ”

“শিউর?কিছু লুকাচ্ছো না তো? ”

আমি একটু ভিত কন্ঠে বললাম,
“না।”
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here