‘ একটা ছোট্ট অভিনয় করতে হবে আপনাকে মিস তায়্যিরাত আহি! দ্যা গ্রেট ভোকাল আর্টিস্ট এআরকে ওরফে আনভীর রেজওয়ান খান এর অনাগত সন্তানের মা হওয়ার অভিনয়। আপনি রাজি হলেই আমরা এখান থেকে চলে যাবো।’
গটগটিয়ে কথাগুলো বলে ফেললো এআরকে’র বিশিষ্ট সেক্রেটারি নাহিদ রেজওয়ান। একথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এআরকে বসে আছে আমার সামনে, এতে আমি যতটা না অবাক হয়েছি তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছি উনার কন্ডিশন শুনে।এমন নয় যে মানুষটাকে এই প্রথম দেখেছি আমি। এর আগেও একবার দেখেছিলাম, অনেক কাছ থেকে দেখেছিলাম। তবে ভাবতে পারিনি যে উনি আমায় খুঁজতে খুঁজতে এখান পর্যন্ত এসে পড়বেন। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম। কেননা জানতাম একদিন না একদিন ঠিকই আমায় পেয়ে যাবেন উনি, যতই আমি পালানোর চেষ্টা করি না কেন।
কিছুক্ষণ আগের কথা। রাত গভীর হওয়ার দরুন ঘুমে মগ্ন ছিলাম আমি , আজ মেডিক্যাল ট্রেনিং শেষে সুপারশপে ওভারটাইম কাজ করতে হয়েছিলো। তাই বাসায় এসে গোসল সেরে বিছানায় শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়ি। এই ফ্ল্যাটে আগে আমি আর রাহি আপু থাকলেও আপাতত আমার একারই বাসস্থল। তাই মাঝরাতে মৃদু শব্দ পাওয়াতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল । সেই সাথে তেষ্টাও পেয়েছিলো বড্ড। তাই পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে ড্রইংরুমে যেতেই টের পেলাম আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ আছে এখানে। ক্রমেই সেটা গভীরভাবে টের পেতে থাকলাম। কেনো যেনো মনে হচ্ছিল যে মানুষটাই হয়তো চাচ্ছিলো যে আমি বুঝি তার উপস্থিতির কথা। গায়ে হিম ধরে গেলো আমার। কিন্ত বিচলিত হলাম না। রান্নাঘর থেকে নাইফটা নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম লাইট জ্বালানোর উদ্দেশ্যে। কিন্ত আমি স্পষ্ট টের পেলাম যে আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে কেউ। আমি নাইফটা নিয়ে যেই না পেছনে ঘুরে আক্রমণ করবো অমনেই ছায়া মূর্তিটি নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো আমার হাতের কব্জি। আমি চিৎকার করতে গেলেই মানুষটা সোফায় পড়ে থাকা একটা কাপড় নিয়ে মুখ বেঁধে সজোরে সোফায় ফেলে দিলো৷ এমন কাজে কপালে কড়া ব্যাথা পাওয়াতে আহ্ করে শব্দ বেড়িয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। টের পেলাম ক্ষতস্থান থেকে মৃদু রক্ত পড়ছে।
একমুহূর্তের জন্য মানুষেটাকে একটা হিংস্র বাঘ থেকে কম কিছু মনে হচ্ছিল না আমার৷ নাহলে এভাবে একটা মেয়েকে কেউ আঘাত দেয়? পরক্ষণেই ভাবলাম যে যে এখানে আছে হয়তো হিংস্র বাঘ থেকেও অধম। নাহলে এত রাতে একটা মেয়ের ফ্ল্যাটে কেনই বা আসবে কেউ। গোঙাতে লাগলাম আমি। হঠাৎ শীতল কন্ঠে শুনতে পেলাম,
‘ লাইট ছাড় নাহিদ।’
মুহূর্তেই ড্রইংরুমের লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। এতক্ষণ যেই আমি ভয়ে আর ব্যাথায় কাকিয়ে উঠেছিলাম সামনের দৃশ্য দেখে সে ব্যাথা ভুলে তাকিয়ে রইলাম বিস্ময়ে। চোখের পলক ফেললাম কয়েকবার। কিন্ত না, ভুল কিছু দেখিনি আমি। আমার সামনে সত্যি সত্যি সেই মানুষটি বসে আছে যার সাথে দেখা করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে সবাই। এআরকে ওরফে আনভীর রেজওয়ান খান। দেশের সবচেয়ে বড় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ‘স্টার হিট’ এর ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ভোকাল আর্টিস্ট। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাথময়াটিক্সে গ্রাজুয়েট এই মানুষটার সিঙ্গিং ক্যারিয়ারের কোনো কল্পনাই ছিলো না, কিন্ত উনার বাবার চাপেই উনি এই ক্যারিয়ারে ঢুকেছিলেন কয়েক বছর আগে। একেতো উনার বাবা ইমতিয়াজ সাহেব ‘স্টার হিট’ এর সি.ই.ও। আর নিজের আসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে অনকেটা স্বার্থের বশেই ছোট ছেলেকে এখানে নিয়ে আসেন। এই নিয়ে শুরুতে সাংবাদিকদের মাঝে ছিলো মুখরোচক কথাবার্তা, বলা হতো যে ছোটবেলায় ছায়ানটে গান শিখলেও বহু বছর উনি গান থেকে দূরে ছিলেন। তার ওপর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য ক্রমেই তিনি আরও দূরে সরে যান। আর ম্যাথম্যাটিক্সে গ্রাজুয়েট একজন মানুষ কোনো বাঁধা ছাড়া যদি এই ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকে তবে বুঝতে হবে যে এখানে বাপ-চাচার হাত আছে। এমন নানা কথা শোনানো হয়েছিলো উনাকে। তবে নানারকম সমালোচনাকে উনি ছিটকে সরিয়ে দেন যখন সত্যি সত্যিই উনি গান গাওয়া স্টার্ট করলেন। উনার ভয়েস আর মিউজিক নিয়ে এত দক্ষতা অনায়াসেই যে কাউকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। বাবার পরিচয় ডিঙ্গিয়ে নিজের একটি পরিচয় গঠন করলেন উনি। এটা সত্য যে এই ইন্ডাস্ট্রিতে এত সহজভাবে ঢোকার জন্য উনার বাবার হাত থাকলেও বাকিটুকু যা অর্জন করেছিলেন, সব করেছেন নিজ যোগ্যতায়। বর্তমানে দেশের যদি সবচেয়ে বড় ফ্যানডম কোনো মানুষের থাকে সেটা ইনি ছাড়া আর কেউ নন। আমি শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠলাম,
‘ আপনি?’
উনি হাসলেন। আমার মুখ বাঁধা থাকলেও উনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন কি বলতে চেয়েছি আমি। তাই বলে ওঠলেন,
‘ যাহ! আমি তো ভেবেছিলাম এ যাত্রায় ভুলেই যাবে আমায়। দুনিয়াটা বড়ই অদ্ভুত না? যেদিকে অন্যরা এআরকে কে একবার দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সেদিকে সে একটা সামান্য এক মেডিক্যাল স্টুডেন্টকে পাগলের মতো খু্ঁজে বেড়িয়েছিলো, ভাবা যায়?’
আমি সোফায় পাথর হয়ে বসে আছি। চোখ যেন মানতে পারছে না যার জন্য এতদিন দূরে দূরে ছিলাম অবশেষে সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উনি বসে আছেন সোফার ঠিক অপর প্রান্তে, পায়ের ওপর পা তুলে। ব্ল্যাক টিশার্টের ওপর ব্ল্যাক ডেনিম, সাথে ব্ল্যাক জিন্স সবমিলিয়ে উনার কিলার লুক অনায়াসেই কারও চোখ ধাধিয়ে দিতে পারবে। তবে এখানে শুধু উনি নেই, কালো পোশাকধারী তিনচারজন গার্ড আর একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। যাকে আমি চিনি। আমি হাত বাঁধা না থাকলেও আঘাতের দরুন হাত নাড়াতে পারছি না মুখ খোলার জন্য। উনি এবার ছেলেটিকে ইশারা করে বললেন,
‘ মহারাণীর মুখের কাপড় খুলে দে।’
কথামতো সেটাই হলো। আমি তবুও বসে রইলাম সোফায়। কেননা উনি ছেলেটিকে বলেছেন আমার মুখ খুলে হাত বেঁধে দিতে। জামাকাপড় এর একেবারেই নাজেহাল অবস্থা আমার৷ একটা ঢোলা টিশার্ট আর ট্রাউজার ছাড়া কিছুই পড়িনি আমি। এতগুলো মানুষের মাঝে আমার বিব্রত বোধ স্বাভাবিক থাকলেও উনাদের এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যাথ্যা নেই। আমি কটাক্ষ করে বললাম,
‘ কিভাবে এসেছেন আপনি? কেনই বা এসেছেন? এভাবে যে আপনি নিজের গার্ডদের নিয়ে মাঝরাতে একটা মেয়ের ফ্ল্যাটে এসে তাকে আঘাত করলেন এটা কি আমার ম্যানারলেস মানুষের কাতারে ফেলা উচিত?’
আমার কথা শুনে হেসে দিলেন আনভীর। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একপ্রকার ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো এবার এ হাসি দেখে। আমি নিশ্চিত কোনো বিশেষ একটা কারণেই এসেছেন এখানে। নাহলে আমি এতটাও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই যে ভোকালস্টার এআরকে আমার সাথে এভাবেই দেখা করতে চলে আসবে। আমি ঠোঁট নাড়ালাম পুনরায়। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কেন এসেছেন আপনারা?’
‘ একটা ছোট্ট অভিনয় করতে হবে আপনাকে মিস তায়্যিরাত আহি! দ্যা গ্রেট ভোকাল আর্টিস্ট এআরকে ওরফে আনভীর রেজওয়ান খান এর অনাগত সন্তানের মা হওয়ার অভিনয়। আপনি রাজি হলেই আমরা এখান থেকে চলে যাবো।’
এআরকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কথা শুনে আমার শরীরের কম্পন ধরে গেলো। নিউরনের কাজ করাও ইতিমধ্যে যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ পাগল টাগল হয়ে গিয়েছে নাকি এরা? আমার মুখ ফুটে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলো,
‘ অসম্ভব! আপনাদের মাথা কি ঠিকাছে? আমি কেনো এমন অভিনয় করতে যাবো?’
এতক্ষণে মুখ খুললেন আনভীর। আমার ওপর তীব্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গহীন কন্ঠে বললেন,
‘ কারন আমি বলেছি তাই।’
‘ আর আপনি কেনো বলেছেন এ কথা?’
আনভীর কথা বললেন না৷ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি ভড়কে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ ক কি….’
আমায় বলতে দিলেন না উনি। হঠাৎ সোফা থেকে উঠে আমার দিকে এগোতে থাকলেই আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পেছাতে থাকলাম।
‘ কি করছেন আপনি?’
আমি আশপাশে গার্ডগুলোর দিকে তাকালাম। সবাই দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। একপর্যায়ে দেয়ালে মিশে দাঁড়াই আমি। আনভীর এবার দাঁড়ালেন আমার কাছাকাছি এসে। বলে ওঠলেন,
‘ তোমার কাছে আর কোনো ওয়ে নেই মিস আহি। তুমি যাকে এতদিন ধরে খুঁজছ তার অনেককিছুই আমি জানি৷ তুমি যদি চাও যে আমি তার ঠিকানা তোমায় দিয়ে দেই তবে তোমায় তো আমার শর্ত মানতেই হবে। জানি তুমি মানবে, আফটার অল সিবিআর এর সিক্রেট এজেন্ট উম্মে রাহিয়্যাত এর ছোট বোন বলে কথা।’
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো একথা শুনে। কেননা আমি ভাবতেও পারিনি আনভীর এত বড় সত্য জেনে যাবেন যে আমিই রাহি আপুর বোন। আর আমি এতদিন যাকে খুঁজে চলছি সেটা রাহি আপুই। আমি তৎক্ষনাৎ বলে ফেললাম,
‘ কোথায় আছে আপু?’
‘ কুল ডাউন ম্যাডাম। বললাম তো আমি জানি তোমার বোনের ঠিকানা। আফটার অল, সে আমার এত বড় সত্যের কথা জেনে গিয়েছিল, তাকে নিজের আন্ডারে রাখাটাই তো বেটার ছিলো, তাই না?’
‘ মানে আপু আপনার কাছে?’
‘ সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি শুধু বলে আমার শর্তে রাজি আছো কি-না৷ যদি রাজি থাকো তবেই কিন্তু তোমার বোনকে ফিরে পেতে পারো ভেবে নাও। তোমার কাছে আমি ছাড়া আর কোনো ওয়ে নেই আহি!’
শেষ কথাটি উনি বললেন একেবারে আমার কানের কাছে এসে, ফিসফিসিয়ে। আমি পাথর হয়ে গেলাম। উনার শর্তে রাজি হওয়া একজন মেয়ের পক্ষে কখনোই সম্ভব না যে বিয়ের আগে অনাগত সন্তানের মা হওয়ার জঘন্যতম অভিনয় করতে চাইবে। আমি দেয়াল ঘেষে নিয়ে নিচে বসে পড়লাম মানুষটার কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। কিন্ত পারলাম না, আনভীরও বসে পড়লেন আমার মুখ বরাবর হাটু গেঁড়ে। আমি বলে ওঠলাম,
‘ রাহি আপু আপনার বড় একটি সত্য জেনেছে সেটি জানলেও কি সেই সত্য সেটা জানতাম না। তবে এখন আচঁ করতে পারছি সেটা আপনার খুবই জঘন্য সত্য। যার জন্য প্রথমে রাহি আপুর তারপর আমার মুখোমুখি হলেন। না হলে একটা মানুষ কতটা জঘন্য না হলে এভাবে একটা মেয়েকে এমন অভিনয় করতে বলতে পারে ভাবা যায়? ‘
আনভীর মিহি হাসলেন। বললেন,
‘ আমি কেমন তা আমাকেই না হয় বুঝতে দাও। আর তুমি যে রাহির কথা শুনে আমায় ভুল বুঝছো, পারলে একটু ভুল ধারনা ভেঙে ফেলো যে নিজের আপন মানুষই কতটা স্বার্থপর হতে পারে। আর আমার সম্পর্কে এক্সপ্লেইনেশন দিতে আমি বাধ্য নই। তোমার কাছে আমি খারাপ হলে হ্যাঁ, আমি খারাপ। নিজের জন্য যেমন খারাপ, তোমার জন্য সেই সীমা ছাড়াতে পারি।’
‘ আমি যদি আপনার শর্তে রাজি না হই কি করবেন আপনি?’
আনভীর গহীন চোখে তাকালেন। বললেন,
‘ বোনকে ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ পেলেও না?’
‘ না, আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারবো আপুকে। কিন্তু আপনার শর্তে রাজি হওয়া অসম্ভব। আপনি চলে যান এখান থেকে।’
আনভীর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না আমার কথা৷ উনি ভেবেছিলেন অন্যদের মতো আমি হয়তো অসহায় হয়ে মাথা নত করবো উনার কাছে। উনি বলে ওঠলেন,
‘ রাহির মতোই সাহস আছে দেখছি। কিন্ত তোমার মতো আমার কাছেও আর কোনো ওয়ে নেই সুইটহার্ট, অভিনয় তো তোমায় করতে হবেই। তোমার আপু, বাবা সবাইকে বলতে হবে যে তুৃমি প্রেগন্যান্ট এন্ড তোমার গর্ভে আমার সন্তান বেড়ে ওঠছে। সিম্পল একটা অভিনয়।’
ঘৃণা জেগে ওঠলো মানুষটার প্রতি। বলে উঠলাম,
‘ কিন্ত কেন এআরকে? আমি এমন কি দোষ করেছি?’
আনভীর হাসলেন। আমার মুখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলে সরিয়ে বললেন,
‘ তোমার সবচেয়ে বড় দোষ হলো তুমি রাহির ছোট বোন৷ আমার লাইফ ডেস্ট্রয় করে দিয়েছে ওই ব্লাডি বিচ টা। আমায় এতবছর কষ্ট দিয়েছে, আমায় আমার ফ্যামিলি থেকে আলাদা করেছে, এভাবেই ওকে ছেড়ে দিবো নাকি। আমার ফ্যামিলি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাইতো? আমিও ওর কাছ থেকে ওর ফ্যামিলি আলাদা করে নেবো। আর ওর ফ্যামিলি তুমি ছাড়া আর কেউই না সুইটহার্ট। ‘
নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে এবার আমার৷ মনে জেগেছে তুমুল অবিশ্বাস। আমি শক্ত গলায় বললাম,
‘ অসম্ভব! আপু এমন মানুষই না যে কাউকে ডেস্ট্রয় করতে পারে। হতে পারে আপনি মানুষটাই অমন। তাছাড়া আপনার একরোখা ব্যবহার এর আগেও একবার দেখেছি এআরকে। যতই আপনি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির আইডল হন না কেন, এটা মানতে বাধ্য যে আপনি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই না। তাই ফ্যামিলি থেকে দূর তো থাকবেনই।’
কথাগুলো আমি বলেছিলাম বিক্ষোভের সাথে। উনি আমার লাইফকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন যেখানে আমার সবকিছু অনিশ্চিত। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এমনই করতো। কিন্ত আমায় কথায় প্রচন্ড রেগে গেলেন আনভীর। পাশের টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে সজোরে আমার পায়ের কাছাকাছি ছুড়ে মারলেন। আমার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেলো উনাকে রেগে যেতে দেখে। নাহিদ রেজওয়ান পাশ থেকে বলে ওঠলো,
‘ শান্ত হও এআরকে।’
উনি শান্ত করলেন নিজেকে। আমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পুনরায় বলে ওঠলেন,
‘ ভেবেছিলাম এর আগে আমার জীবন বাঁচিয়েছো বলে ভালো বিহেভ করবো তোমার সাথে। বাট আই ক্যান্ট ডু দ্যাট। তুমি আমার শর্ত মানবে মানে মানবেই। এর এক পাও এদিক সেদিক নড়তে আমি তোমাকে দেবো না। আর আমিও দেখবো কতদিন তুমি তোমার রাহি আপুর অন্ধপট্টি চোখে দিয়ে রাখো। ‘
উনি একথাটি বলে স্মিত হাসি দিলেন এবার। এই হাসি দেখে ভয় ঢুকলো আমার মনে। কেননা এই হাসির সাথে একেবারেই অপরিচিত আমি৷ একদিকে উনার ভয় আবার অন্যদিকে অপূর্ব ভাইয়ার ভয়৷ সে যদি জানতে পারে যে আমি এখানে নেই বা এআরকের সাথে আমার জড়ানো শর্তের কথা, মেরে ফেলবে আমায়। আনভীর উঠে দাঁড়ালেন এবার। ইশারায় নাহিদ রেজওয়ানকে কিছু একটা বলতেই সে এসে আমার মুখে রুমাল চেপে ধরলো। আমি টের পেতে থাকলাম জ্ঞান হারাতে চলছি আমি। তারপর ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলাম অতীতের রাজত্বে।
___________
অতীত
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে বাহিরে। আমি পড়ার টেবিলে বসে পড়াশোনা করতে মগ্ন। শ্রাবণ মাসের রাত। হাওয়ার উপদ্রবটা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেকটাই বেশি। মেডিক্যাল ইন্টার্নশিপের স্টুডেন্ট হওয়ার দরুন পড়ালেখা আর ট্রেইনিং এর মাত্রাটা আগের তুলনায় অনেক বেশি। তার ওপর আজ বাড়িতে ছিলাম একা। রাহি আপু গতকাল থেকেই নিরুদ্দেশ। এ আর নতুন কিছু না, সিবিআর এর সিক্রেট এজেন্ট হওয়ার দরুন প্রায়ই আপুকে নিরুদ্দেশ হতে হয়। পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে গেলো টেরই পাইনি। চোখ খুললাম জানালার কাচ ভাঙার একটা বিকট শব্দ শোনাতে। তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ালাম আমি। কেননা শব্দটা এসেছিলো ড্রইং রুম থেকে। আমার ফ্ল্যাটে বেডরুম, লিভিংরুমের সাথে এডজাস্ট কিচেন রুম ছাড়া আর কোনো রুম নেই। ভয়টা হুহু করে বেড়ে ওঠলো এবার। ড্রইংরুমে জানালার কাছাটাতে যেতেই থমকে গেলাম আমি। আমারই বাসায় জানালার সামনে একটা অবয়ব দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃসন্দেহে সে একজন পুরুষ। আমি চিৎকার দিতে গেলেই লোকটা কাছে এসে মুখ চেপে ধরলো আমার। তবে হাতের জোর ছিলো অনেক কম। আহতকন্ঠে বলে ওঠলো,
‘ হ্ হ্ হেল্প মি!’
উনার শরীরের ভারে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়ালাম আমি। উনার স্পর্শে থাকাতে ভেজা অনুভব করছি। খানিকবাদেই বুঝলাম যে উনি রক্তাক্ত। একে তো অন্ধকার। বাইরে শো শো হাওয়া বইছে, জানান দিচ্ছে শ্রাবণের, অবয়বটার আহত শরীরের স্পর্শ শিহরণ জাগিয়ে দিলো হৃদয়ে। আমি কোনোমতে হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে টর্চ নিলাম। লাইটটা উনার মুখের কাছাকাছি আনতেই অবাকের চূড়ান্তে পৌঁছে গেলাম আমি৷ আমার মনে হয়না এতটা অবাক এর আগে কখনও হয়েছিলাম কি-না। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? বায়োকেমিস্ট্রি’র বইয়ের পাতায় মুখ গুজে ঘুমানোতে আবোল তাবোল দেখছি নাকি আমি? কেননা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দ্য গ্রেট ভোকালস্টার এআরকে ওরফে আনভীর রেজওয়ান খান। দাঁড়ানো বললে ভুল হবে, কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছেন, পেটের বুকের কাছে এতটা রক্তাক্ত দেখে আটকে ওঠলাম আমি। বুঝলাম ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে উনার সাথে। আমি বললাম,
‘ আপ্….আপনাকে তো শুট করা হয়েছে। জলদি হসপিটালে চলুন, নাহলে তো….’
‘ না, হসপিটালে না৷ সেখানে রিক্স আছে আমার। প্লিজ ডাক্তারকে নিয়ে আসো, আই…… আই উইল….’
আর বলতে পারলেন না আনভীর, ফ্লোরে লুটিয়ে পড়তেই আমি ভয় পেয়েে গেলাম। উনার তখন ইশারা করাতে সব জানালা, দরজা লাগিয়ে দিলাম আমি। কোনোমতে উনাকে টেনে বেড পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। উনার কন্ডিশন ভালো না। নিঃশ্বাস ঘনঘন ফেলছেন। উনাকে বাঁচানোর জন্য এখন একমাত্র উপায় হলো আমি নিজে। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট লাইফে বেশ কয়েকবার এসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও এখন আমি একেবারে একা। আমি ভাবার সময় নিলাম না আর। ড্রয়ার থেকে সব সরঞ্জাম বের করে উনার কাছে বসলাম। একে একে খুলতে লাগলাম উনার শার্টের বাটন। দম নিয়ে বলে ওঠলাম,
‘ ইউ হ্যাভ টু ডু দ্যাট আহি, ইউ হ্যাভ টু ডু দ্যাট!’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব: ১
আগের সিজনের সাথে এই সিজনের কোনো মিল নেই। যারা পড়তে চান তারা পড়তে পারেন৷ বাই দ্য ওয়ে সারপ্রাইজ টা কেমন ছিলো? অনেকেই বলেছেন আহি-আনভীরকে আবার আনতে হবে মানে আনতেই হবে৷ তাই আবদারটি না রেখে পারলাম না আর। কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্ত।